তুমি শুনিতে চেয়ো না : ৪

পর্ব-৪

আমি এখন নিজের বর্জ্যের মধ্যে বসে আছি। নিজের মল ও মূত্রের মধ্যে মাখামাখি করছি। শরীর থেকে পরিত্যক্ত পদার্থ দুই হাতে চটকাচ্ছি। এ নিয়ে আমার কোনো ঘৃণা নেই, অনুশোচনা নেই। কেন থাকবে? মানুষের শরীর এখনো বহন করলেও আমি মানুষের বুদ্ধির জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। আমি সচ্চিদানন্দ স্তর পার হয়ে বিশ্ব-প্রকৃতির সঙ্গে লীন হয়েছি। আমি চাইলেই মানুষের সমাজ থেকে বাইরে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু যাব না। দেখব, এরা কতটা নিচে নামতে পারে। আমার চিন্তা ফানাফিল্লাহ পর্যায়ে পৌঁছে গেলেও শরীর রয়েছে মানুষের। মানুষের শরীর—প্রকৃতির জগৎ নিঃসংকোচে নিতে পারে না। সহস্র বছর ধরে মানুষের প্রধান চিন্তা ছিল সে কিভাবে প্রকৃতির প্রভু হয়ে উঠবে। বিশ্ব-জগৎ নিয়ন্ত্রণে নেবে। হয়তো নিয়েছে, অথবা নেয় নি। কিন্তু হারিয়ে ফেলেছে আনন্দ, জগতের বৃহত্তর যোগাযোগের উপায়।

সকালে কালীকৃষ্ণ গুহ এসেছিল, হায়দার এসেছিল, তারা আমায় এ অবস্থায় দেখে গেছে। আমার শাশুড়ি তাদের বলেছিল, ‘যাও দেখে এসো নুরুর কাণ্ড।’ আমার এই অবস্থা—আমার শাশুড়ির জগৎ থেকে সব আলো কেড়ে নিয়েছে। আমার শ্বশুর মারা যাবার পরেও, বালিকা বয়সে বিধবা হলেও এমন নিরাশ হয় নি। তার এই হতাশাকে আমি দুনিয়ার কোনো হতাশার সঙ্গে তুলনা করতে পারব না। এমনকি বুলবুল মারা গেলে, দুলি নিস্তরঙ্গ হয়ে গেলে—সে অনেক ব্যথা পেয়েছিল, ভেবেছিল এই ব্যথা বয়ে তাদের সারাজীবন বেঁচে থাকতে হবে। কিন্তু এখন আর এ কথা ভাবতে পারছে না। বাঁচা-মরার বিষয়টি এখন আর তার মাথায় কাজ করছে না। কেবল তার মনে হচ্ছে, সহমরণে না গিয়ে মহাপাপ হয়েছে। জীবনের প্রতি মোহমুক্তির কারণ হয় না। তবু মনে মনে একটি গান গুনগুনিয়ে উঠছে। ‘শূন্যে মহা-আকাশে/ তুমি মগ্ন লীলাবিলাসে/ প্রলয়সৃষ্টি তব পুতুলখেলা/ নিরজনে প্রভু নিরজনে।’ গিরিবালা দেবীর গান গাওয়া, কবিতা লেখার অভ্যাস ছিল।

তখন আমি ১৫/৪ শ্যামবাজার স্ট্রিটের বাসায় থাকি। আমাকে সেখানে একটি ছোট্ট ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। অবশ্য বাড়িতে এর চেয়ে বেশি বড় কোনো কক্ষ নেই। যেহেতু এখন আমি উন্মাদ। ‘আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!/ আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।’ যাদের সঙ্গে এতদিন আমি কাজ করেছি, যাদের হয়ে কাজ করেছি, তাদের সঙ্গে আমার চিরদিনের জন্য সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটেছে। কিংবা আমি মানুষের জগৎ থেকে নির্বাসিত হয়েছি। কই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আবুল কাশেম ফজলুল হক—সে তো আমার এই অবস্থার কথা শুনে একদিনও দেখতে এল না। আমার আর্থিক কষ্টের কথা জেনেও কোনো পদক্ষেপ নিল না। হিন্দু-মুসলিম ইকুইটি ফান্ড থেকেও তো আমার জন্য কিছু করতে পারত। আসলে সে তো এখন মানুষ নেই, এখন সে মানুষের সমাজ থেকে পশুদের সমাজের অধিপতি হয়েছে। গত বছর লাহোরে গিয়ে ভাগাভাগির ফর্মুলা দিয়ে ‘শেরে বাংলা’ খেতাব নিয়ে এসেছে। অথচ একদিন বাংলার মেহনতি মানুষের, কৃষক-মজুরের সে-ই ছিল ভরসা। তার নেতৃত্বেই তো আমার ‘যুগবাণী’র নবযুগের উত্থান।

অর্থের অভাবে এখন আমার চিকিৎসা চলছে হোমিপ্যাথি, আয়ুর্বেদ। আমার ডাক্তার কবিরাজ বিমলানন্দ তর্কতীর্থ, আর হোমিওপ্যাথ ডি. এল সরকার। তারা আমার উত্তেজনা কমানোর ওষুধ দিচ্ছে। যাতে আমি নিজের মল নিজে চটকাতে না পারি। মূত্র ও মলের উপর শুয়ে না থাকি। আর এইসব জাতীয় নেতাদের, বনের বাঘ নেতাদের—কষে গালি দিতে না পারি। আমার রাগ সপ্তমে উঠে যাচ্ছে—কোথায় তোর ফজলুল হক, নাজিমদ্দি, সোহরাওয়ার্দি, তজিমদ্দি। তোরা হবি এই বাংলার ভাগ্য-বিধাতা, আধ-মরা মুসলিম কৃষকের নেতা! তোদের কবিই তো না খেয়ে, বিনা চিকিৎসায় মরে যাচ্ছে। তোরা আছিস পিঠা ভাগাভাগিতে। তোদের কবির চিকিৎসা করছে কবিরাজ, পানিপড়া। পানিপড়ার পাকিস্তান গড়া ছাড়া তোদের আর কী যোগ্যতা আছে?

আমার অসুখের খবর পেয়ে চুরুলিয়া থেকে এসেছে ছোট ভাই আলী হোসেন। আর জুলফিকার হায়দার নিজের মায়ের পেটের ভাইয়ের মতো লেগে আছে। কালীকৃষ্ণ গুহ মাঝে মাঝে আসছে। আর আছে সাহু, কাঠিয়া—কথা বলতে পারে না—কথা বলা এমন কোনো ভালো কাজ নয়। তারা আমার দেখভাল করছে। জোর করে কুয়োতলায় নিয়ে যাচ্ছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। কিন্তু আমার তাতে কিছু এসে যায় না। আমি সুযোগ পেলেই ওদের মুখে কয়েক ঘা মেরে দিচ্ছি। পাগলের গায়ে কোথা থেকে যে শক্তি ভর করে কেউ জানে না। প্রকৃতির শক্তি। পাগলকে দেখে তাই তথাকথিত সুস্থ মানুষ ভয় পায়।

আমি আজ মানুষের পরিচ্ছন্নতা বোধের বাইরে চলে গেছি। যারা এসব পরিষ্কার করছে, এটা তাদের প্রয়োজনে। যেহেতু তারা এ অবস্থায় আমায় বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারছে না। আমার যেহেতু পরিচয় আছে, লোকজন চিনে ফেলবে। কিন্তু কিসের লোকজন, আমি নাকি সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি! আমার গানের রেকর্ড বিক্রি হয় কাড়িকাড়ি। বাইরে প্রকাশক, শিল্পীর ভিড় লেগে থাকে। এখন প্রকাশক, গ্রামোফোন কোম্পানি, কলেরগান কোম্পানির মালিকেরা কোথায়! তারা সব ভেগেছে—যাতে রয়ালিটি দিতে না হয়। আমার লেখায় নাকি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যায়-যায়। আমার পেছনে লেগে থাকা ব্রিটিশ স্পাই, দেশি টিকটিকি আজ কোথায় গেল! আমার পতনে কি তারা তাদের পতন থামিয়ে দিতে পেরেছে! আমি আর তাদের জন্য ভীতিকর নই। তাই কেউ আর আমাকে ধরে নিতে আসছে না, অনশনে থাকলে কেউ জোর করে খাওয়াচ্ছে না। কেবল রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করলে, পুলিশের সিপাইরা বলবে, এই লোক একদিন ইংরেজ ট্রিগার্ড সাহেবের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। যদিও সময় হলে আমার ঘরের মধ্যে খাবার থালা দিয়ে যাচ্ছে আলী হোসেন, কখনো হায়দার। কখনো দু-এক নলা খাচ্ছি, বাকিটা মেঝেতে ঢেলে চটকে লেপে দিচ্ছি। সবকিছু খাবারের বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর এসব ওরাই সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কখনো আমার শাশুড়ি গিরিবালা দেবীকেও করতে হচ্ছে। প্রমীলা তো নিজে নিজে উঠতে পারে না। পারছে না বলে কষ্ট পাচ্ছে। তবু ভালো, সবটা ওর চোখের আড়ালে হচ্ছে। সানি ও নিনির চোখে মুখে কী অসহায় অনিশ্চয়তার ভয় ফুটে উঠেছে‍! ওদের স্নেহময় বাবা—আজ এতটাই অপরিচিত।


জিন্নাহ বলেছিল, ‘এদেশের হিন্দু ও মুসলমানকে একমাত্র গরু পার্থক্য করেছে।’


আমার এই কাজটি কেউ পছন্দ করছে না। অনেকে ভাবছে, আমরা তো আগেই জানতাম একদিন আমার এ অবস্থা হবে! আমার জন্য কোনো এক পাপ নির্ধারিত হয়ে আছে জীবনে। ঘৃণায় তাদের গা ঘিন ঘিন করছে। আমাকে ত্যাগ করে চলে যেতে চাচ্ছে। প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করতেও তাদের দ্বিধা নেই। যাদের সঙ্গে আমি এতকাল বাস করেছি, তারা কেউ মনে মনে পছন্দ করছে না। নিকটাত্মীয়রা ভাবছে, সুস্থ হওয়ার যদি কোনো পথ খোলা না থাকে—মরে যাওয়া ভালো। কিন্তু আমি কেন মরতে যাব। আমি তো পৃথিবীর জগতের সাথে আমার এই অবস্থার কোনো বিরোধ দেখছি না। বরং এতদিনে আমি এই ভারতবর্ষের মানুষের মধ্যে, ধর্ম-রাজনীতি-ছোঁয়াছুঁয়ির যে-তীব্র সংকট দেখে আসছি, তাতে আমার কাছে মনে হয়েছে, তাদের এক দল যদি মানুষ হয়—তাহলে অন্যদল পশু। একে অন্যকে কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই হত্যা করতে পারে। তারা মানুষের শরীর স্পর্শ করলে অচ্ছুত হয়ে যায়। তারা গরু নিয়ে বিবাদ করে। কেউ গরু কাটে, কেউ গরু পূজা করে। গরুর এতে কী এসে যায়! আর এসে যায় না বলেই, গরু নিজের গোবরের মধ্যে, চোনার মধ্যে শুয়ে থাকে। নিজের বিষ্ঠা শরীরের সঙ্গে লেপ্টে রাখে। তাতে কারো কোনো অসুবিধা হয় না। যারা কাটছে তাদেরও না, যারা পূজা করছে তাদেরও না। বরং গোবরটুকু চেটেপুটে পরিষ্কার করে নিয়ে যাচ্ছে। গরুর গু দিয়ে ঘর লেপে পবিত্র করছে, মানুষ-ছোঁয়ার পাপমুক্ত হতে গরুর মল ভক্ষণ করছে। কোনো ধর্মের লোকই গরুর বিষ্ঠাকে অপবিত্র মনে করে না। তারাও ঘর লেপে উঠান লেপে। ভাত রাঁধে। এই গরুর জন্য তারা নিজের দেশ ভাগ করে নিচ্ছে। জিন্নাহকে ব্রিটিশ সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছিল—হিন্দু ও মুসলামানের মধ্যে পার্থক্য কী? জিন্নাহ বলেছিল, ‘এদেশের হিন্দু ও মুসলমানকে একমাত্র গরু পার্থক্য করেছে।

সাংবাদিক আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলেন, কিভাবে?

জিন্নাহ বললেন, মুসলমানরা গোরু জবাই করে খায়। আর হিন্দুরা গরুর পূজা করে।

আমি যে আমার মলের মধ্যে শুইয়ে আছি, এই ভারতবর্ষে, এই কোলকাতা শহরে প্রায় প্রতিটি মানুষই তো এর চেয়ে ভয়াবহ দুর্গন্ধপূর্ণ মলের মধ্যে প্রতিদিন শুয়ে থাকে। তাদের মাথার মধ্যে অনেক অনেক বছরের মল জমা হয়ে আছে। যারা একজন আরেকজনের গন্ধ সইতে পারে না। স্পর্শ সইতে পারে না। তারা শরীর পশুর গোবর দিয়ে লেপে পরিশুদ্ধ করতে পারলেও এক মানুষ আরেক মানুষকে পবিত্র ভাবতে পারে না। মানুষ ছুঁলেও তাদের পশুর বিষ্ঠা খেতে হয়। তাদের মনের ময়লাকে পরিষ্কার করতে হয় পশুর বিষ্ঠা দিয়ে।

তাহলে আমি নতুন করে কী সমস্যা করলাম! মল আমি বাইরে নিয়ে এসেছি, আমার ভেতরে এখন কোনো ক্লেদ নেই, ময়লা নেই। কিন্তু যারা পেটভর্তি মল, মাথার ঘিলুভর্তি বিষ্ঠা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা আজ ভারতবর্ষকে টুকরো টুকরো করার জন্য, নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়ার জন্য নানা ফন্দি আঁটছে—হিন্দু আঁটছে, মুসলমান আঁটছে। তারা মুখে দুর্গন্ধযুক্ত বাক্য বলার আগে যদিও একটু কথার সুগন্ধি মেখে নিচ্ছে; যাতে প্রতিপক্ষের কাছাকাছি থেকে নিজেদের মাথার মলভর্তি চিন্তাগুলো প্রকাশ করতে পারে।

আজ এদেশে অনেক বড় বড় নেতা। ব্রিটিশের কোম্পানি থেকে পড়ে এসেছে, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, ম্যানচেস্টার। যদিও আমি সেই সব দেশে যাই নি। কিন্তু মহাত্মা তো গেছে, জিন্নাহ গেছে, সুভাষ গেছে, নেহেরু গেছে, শ্যামাপ্রসাদ গেছে, আম্বেদকার গেছে, কবিগুরু গেছে, অনেক পাতি কবি, পাতি নেতা গেছে। কিন্তু তাতে কার কী হয়েছে—তারা শুধু পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে কূটচিন্তাপূর্ণ দুর্গন্ধময় বিষ্ঠাই উপহার দিচ্ছে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম যেমন, অক্সফোর্ড—মানে ষাঁড়ের নাদি। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম যেমন ক্যাম্প নদীর ছোট সেতু; সেহেতু তাদের শিক্ষা এমন কী উন্নত, দুর্গন্ধ ছড়ানো ছাড়া, অন্যের প্রতি অসম্মান, এবং পরাস্ত করার চেতনা ছাড়া—তারা কীইবা শিখে এসেছে—সেখান থেকে? এইসব মেট্রিক-পাস ব্যারিস্টার আজ ইংরেজ প্রভুদের সুরে কথা বলছে।

ইংরেজের দেশে গিয়ে কী শিখে এসেছে তারা? তাদের ভাষা, তাদের কেতা, তাদের পোশাক, হাতের বদলে কাঁটা চামচে খাওয়া, মদের টেবিলে চিয়ার্স বলা, ম্যাম বিয়ে করা! ইংরেজ কি এদেশে প্রসপেরো নয়? তারা কি জলে ভেসে এসে এদেশের মালিক বনে যায় নি?

কোথা থেকে একটা ঝড় বয়ে এল। শেক্সপিয়রের টেম্পেস্টের ঝড়। ‘সহসা এল ঊর্ধ্ব-গগনে বৈশাখী ঝড়, প্রগাঢ় নীলকৃষ্ণ মেঘলোকে জড়িয়ে। ঘন ঘন গভীর ডমরুধ্বনিতে, বহ্নিবর্ণা দামিনী-নাগিনীর ত্বরিত সঞ্চারণে আমার বাহিরে-অন্তরে যেন অপরূপ আনন্দ তরঙ্গায়িত হয়ে উঠল। সহসা আমার কণ্ঠে গান হয়ে, সুর হয়ে আবির্ভূত হলো—এল রে প্রলয়ঙ্কর সুন্দর বৈশাখী ঝড় মেঘমালা জড়ায়ে। আমি সজল ব্যাকুল কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলাম, তুমি কে? মধুর সহজ কণ্ঠে উত্তর এল, তোমার প্রলয়-সুন্দর বন্ধু।’

তারও আগে ঝড়ে নৌকাডুবিতে বেঁচে আসা দেশদখলকারী প্রসপেরো আমায় শাসনের স্বরে বলল, ‘তোর এই অভিশাপের জন্য আজ রাতেই তোর ভয়ংকর পেটের ব্যথা হবে। আর সারারাত তোর শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হবে, এক ধরনের পোকা মৌমাছির থেকেও তীক্ষ্ণ হুল দিয়ে বিদ্ধ করবে তোকে। তোর মাথার মধ্যে বনবন করে ঘুরতে থাকবে, তোর সকল স্মৃতি দেব ভুলিয়ে।’

আমি ক্যালিবানের মতো বললাম, ‘এই দেশ আমার। আমার মা ভারতমাতার তৈরি। আমরা হিন্দু-মুসলিম-শিখ-বৌদ্ধ-শৈব-পার্শি—সবাই মিলে আমরা মাকে সৃষ্টি করেছি। আমরা কেউ বাইরে থেকে আসি নি। আমাদের জন্ম এখানে। যারা বাইরে থেকে এসেছিল তারা মরে গেছে। আমাদের নিজেদের মধ্যে ছোট-খাটো বিবাদ থাকলেও মা আমাদের সমান ভালোবাসতেন। আমাদের তার পক্ষতলে আগলে রেখেছিলেন, কোথাও দস্যুবৃত্তির জন্য পাহাড় পেরুতে দেয় নি। সমুদ্র পেরুতে দেয় নি। চোখে চোখে রেখেছে। আর তুমি আমার কাছ থেকে আমার মাকে কেড়ে নিয়েছ। যখন তুমি প্রথম এখানে এসেছিলে তখন তুমি আমাকে আদর করতে, আমাকে দিন-রাতের আলোর গতি-প্রকৃতি শেখাতে এবং আমিও তোমায় ভালোবাসতাম। ভালোবেসে তোমায় এই ভারতবর্ষের কোথায় কোন ঝরনা, ঊর্বর জায়গা-জমি আছে তা দেখাতাম। আমার ভারতমাতা সাপ-ব্যাঙ যেসব উড়ন্ত রথরহস্যের মন্ত্র একদিন আমার ছিল আজ সেগুলো তুমি আয়ত্ত করে নিয়েছ। আমার মায়ের বোন প্রয়াত রানির কবরের কোহিনুর তোমার রানির মুকুটে আজ শোভা পাচ্ছে। আজ তুমি আমায় এই শক্ত পাথরটায় সঙ্গে বেঁধে রেখে বাকি গোটা দেশটা কেড়ে নিয়েছ আমার কাছ থেকে।’

ইংলিশ প্রসপেরো বলল, ‘তুই হলি শয়তান, মিথ্যাবাদী, দয়া-মায়া নয়, তোকে সোজা করতে চাই বেত্রাঘাতে। আমি একদিন যত্ন করে তোদের আমার সভ্যতা শেখাতে চেয়েছিলাম, ভাষা শেখাতে চেয়েছিলাম, কেতা শেখাতে চেয়েছিলাম, তাই তোদের নিয়ে গেছি আমাদের দেশে, শিখিয়েছি আমাদের ভাষা, চামুচ ধরানো, মিথ্যা তর্ক-বিতর্ক করে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেয়া, মনের কথা মুখে না বলা। আর তোরা কিনা ফিরে এসে আমার উপরে, আমার মেয়ে মিরান্দার উপরে চড়াও হচ্ছিস। আমার মেয়ের সঙ্গে শোয়ার স্বপ্ন দেখিস। তোরা তো অর্ধ-মানুষ। দেখ আমার মেয়ে কী সুন্দর! তোরা কেউ পাবি না তার সোনালি কেশের স্পর্শ। এ দেশের খেয়ে-দেয়ে বড় হলেও, দেখিস সাগর পারে কেউ এসে আমার মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে, বাচ্চা-কাচ্চাসহ নিয়ে যাবে। তোরা আম-আঁটির মতো পড়ে থাকবি।’


তোর ঠিক শাস্তিই হয়েছে রে শয়তান। তোর মুখ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।


বিদেশি সুন্দরী রাজকুমারী মিরান্দাও আমায় গালি দিয়ে বলে, ‘তুই একটা ঘৃণ্য নেটিভ। তোর সবটাই মন্দে ভরা, তুই কারো কোনো ভালো গ্রহণ করতে পারিস না। আমি একদিন তোকে কত দয়া করতাম। তোরা নেটিভ—তাও তোদের প্রিন্স বলে ডেকেছিলাম। আমি কত আদর করে তোদের আমাদের মধুর ভাষা শিখিয়েছি। আগে বন্য শুয়োরের মতো ঘোঁত-ঘোঁত করতিস, মনের ভাব প্রকাশ করতে পারতিস না। কিন্তু তোরা এতই দুষ্ট, এত সব ভালো ভালো কথা শেখালেও তোরা মানুষ হতে পারিস নি। সবই তুই খারাপ অর্থে নিয়েছিস। তোদের অরবিন্দ, তোদের লালবিহারী, তোদের সুভাষ-হেমন্ত। তুই যদিও আমাদের ভাষা শেখার জন্য ইংল্যান্ডে যাস নি, তবুও তুই মন্দই রয়ে গেছিস। তুই অহংকারী, সারাদিন কেবল বলিস, তোর মা সেকোরাক্স, তুই ভারতমাতার সন্তান, এই ভূমি তোর, তুই সারাক্ষণ লালসার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাস। তুই কী ভাবিস, তোর মতো কুৎসিতকে আমি বিয়ে করব! তুই আমার শরীর কখনো পাবি না। তোর সাথে করি আমি ছলনা। তোর ঠিক শাস্তিই হয়েছে রে শয়তান। তোর মুখ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।’

ক্যালিবানের মতো আমিও সুন্দরী মিরান্দাওকে বললাম, ‘আমায় তুমি যে ভাষা শিখিয়েছ তাতে আমার একমাত্র লাভ হয়েছে যে তা দিয়ে আমি মানুষকে কেবল অভিশাপ দিতে পারি। তোমাদের ভাষায় মানুষের জন্য কোনো আশীর্বাদের শব্দ নেই। অথচ তোমরা এখানে আসার আগে সারাক্ষণ আমরা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের গান গাইতাম। সুর করে পড়তাম পদ্মাবতীর প্রেমে মুসলিম সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজির করুণ আকুতি, লাইলি-মজনু গুলে-বকাওলী।’

এই ভারতবর্ষ তো একটি দেশই ছিল, মোগলদের আগে খণ্ডিত হলেও ছিল, মোগলরা এই দেশকে একসঙ্গে যুক্ত করেছিল, প্রায় দুইশ বছরের ইংরেজ-শাসন দেশকে একটি নামেই শাসন করেছে, এখন কেন দুটি রাষ্ট্র লাগবে? মুসলমানদের কেন আলাদা রাষ্ট্র হতে হবে, তারা তো এই অখণ্ড ভারতের বাসিন্দা; তাদের মুসলিম পূর্বপুরুষরা সংখ্যালঘু হয়ে দাপটের সঙ্গে এদেশে বাস করেছে, শাসন করেছে। এমন কী ঘটল, ব্রিটিশ চলে গেলে আলাদা হয়ে যেতে হবে? এই হলো নিজের দেশে হাজার হাজার বছর ধরে এক সঙ্গে বাস করার ফল। এই হলো তোমার ইংরেজ প্রভুদের শিক্ষা। যে ইংরেজ তোমাদের কাছে থেকে রাজ্য কেড়ে নিল, ছলে-বলে-কৌশলে, যারা এতদিনে তোমাদের নিঃস্ব করেছে, আর সেই তোমরাই কিনা তাদের কাছে পিঠাভাগের আবেদন করছ। তোমরা যদি ইংল্যান্ডে পড়তে না যেতে তাহলে ক্ষুদিরামের মতো, শের আলীর মতো, বাঘা যতীনের মতো, সূর্যসেনের মতো নিজের মায়ের অপমানকারীদের মেরে তাড়িয়ে দিতে।

সংস্কৃতির নামে, জাতীয়তাবাদের নামে, ধর্মের নামে, জাতপাতের নামে নির্দিষ্ট স্বার্থ বজায় রাখতে উদ্ভূত ময়লা, বর্জ্যের মধ্যে শুয়ে থাকছ। অথচ আমি তো তোমাদের কিছু বলছি না। এক সময় বলেছি, কবিতা লিখে, গান লিখে, গলায় হারমোনিয়াম বেঁধে সারা দেশ চারণের বেশে ঘুরে ফিরেছি। সবাই বলত—‘বোঝে না ক’ যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে।’

আমার আর এখন কিছু করার নেই। হক সাহেবও এখন আমাকে বিশ্বাস করে না, সোহরাওয়ার্দি সাহেব তো সন্দেহের চোখে দেখে—যেহেতু মুসলিম লীগ নিয়ে আমার উৎসাহ নেই। শ্যামাপ্রসাদ আমার প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল মনে হলেও, হিন্দু-জাতীয়তাবাদের উত্থান চায়। হেমন্তকুমার, ড. বিধান চন্দ্র রায়ও—রাজনৈতিক খায়েশের বাইরে নয়। কাল যার মন্দ চাইবে, আজ তার নিরাময়ে চিকিৎসা করবে।

আমার এই পাগলামির জন্য, মূক-বধির হওয়ার জন্য—সবাই দেখল—আমার পারিবারিক বিপর্যয়, আমার পুত্র হারানোর শোক, আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাওয়া, আমার আর্থিক সংকট; কিন্তু কেউ একবারও বলল না, এ সবই তো একান্ত আমার ব্যক্তিগত, শারীরিক ও মানসিক ব্যাপার। কিন্তু নজরুল নামে যে আমি, সে কি কেবল রক্ত-মাংসের এই ব্যথা-বেদনাপূর্ণ একজন মানুষ? সংসারজীবনে এই ব্যথা কি আমি প্রথমবার সয়েছি? আমার পিতা-মাতা আমার নাম রেখেছিলেন দুখু। দুঃখই আমার সুখ, দুঃখই আমার যিশুখ্রিস্ট, কণ্টকের মুকুটে আমায় যত মানায়, রাজমুকুটে ততটাই আমি বিরক্ত হই। কবেইবা আমার অর্থ ছিল। আমি কি বাড়ি কিনেছি, ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স করেছি? চাইলেই তো পারতাম। একটা গাড়ি কিনেছি বলে অনেকেই আমায় বেহিসেবি, বেসংসারী বলে। তারা জানে না, আমি তো সারা জীবন রাস্তায় থেকেছি, রাস্তায় পয়সা ঢেলেছি; গাড়ি তো আমার রাস্তার বান্ধব, এটি যদি এসময়ে না হয়ে আরো কিছুদিন আগে হতো, যখন মোটরগাড়ি আসে নি, তাহলে তো আমি ঘোড়া কিনতাম। আমার চাই গতি, পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানো আমার কাজ। আমি তো কেবল রাজধানীর কবি নই, আমি লেটো দলের, চারণকবি। আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস।

আমার বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ ছিল আমার স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া। হিন্দু-মুসলিমের যে মিলনের স্বপ্ন আমি সারা জীবন দেখেছি, যে গালাগালিকে গলাগলিতে রূপ দেয়ার জন্য সারা জীবন সাধনা করেছি। তাই আমি ছিলাম ‘গালির বাগিচার বাদশা।’ মুজাফ্‌ফর,  সুভাষ, হক, গান্ধী—সবাই মিলে তো আমরা ওই রাস্তাতেই হাঁটছিলাম। কই এতদিন তো এই বিষাক্ত বাষ্প দূর করা অকল্পনীয় মনে হয় নি! ভারতবর্ষে বিরোধ ছিল, সংঘাত ছিল, কিন্তু এই দুটি বৃহত্তর ধর্মগোষ্ঠী এক সঙ্গে বসবাস করতে পারবে না—তা তো কখনো কেউ ভাবে নি। তাহলে ব্রিটিশ আসার আগে তারা এতকাল কিভাবে এক সঙ্গে বসবাস করল। আজ যখন আমাদের চূড়ান্ত স্বাধীনতা সময় এসেছে, তখন নিজেদের সঙ্কীর্ণতাগুলো অনেক বড় হয়ে সামনে আসছে।

এটাকে কিভাবে স্বদেশের স্বাধীনতা বলা যায়! এটা তো স্বাধীনতা নয়, এটা তো ভাগাভাগি, এটা তো মায়ের অঙ্গচ্ছেদ। যদিও এই কথাগুলো কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সময়ে এসেছিল। মায়ের সন্তানেরা তা রুখে দিয়েছিল। অথচ আজ তারাই এই ভাগের মচ্ছবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। যখন সবাই মিলে আনন্দ করার কথা তখন হিন্দু-মুসলমানের হাজার বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব বড় হয়ে দেখা দিল। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না, এমনকি আমাকেও না—যে সারাজীবন ধরে নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছে এই ভারতে, এই বাংলায় আমার কোনো ধর্ম নেই, আমার ধর্ম এদেশের মুসলমানের ধর্ম, আমার ধর্ম এদেশের হিন্দুর ধর্ম, আমার ধর্ম মানবতার ধর্ম। আমি হিন্দুর দেবতাকে নিয়ে যত গান-কবিতা লিখেছি, মুসলমানের আল্লাহ-পয়গম্বরকে নিয়ে ততটাই লিখেছি। নিজে ধর্মপ্রাণ মুসলামানের ঘরে জন্মগ্রহণ করেও জীবনসঙ্গী করেছি এক হিন্দুকন্যাকে। নিজের পুত্রদের নাম হিন্দু-মুসলমানের মিলিত ধারার সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছি। মুসলিম মেয়েরা আমায় যতটা ভালোবেসেছে, হিন্দু মেয়েরাও ততটা বেসেছে। বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ ছিল না। অথচ আজ কেন আমার মনে সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে! আজ সবাই আমার এই রীতিকে সন্দেহের চোখে দেখছে। বলছে, অনেক হয়েছে তোমার মিথ্যা আস্ফালন, এবার থামো। এবার আমাদের শান্তিমতো পাঁঠা বলি দিতে দাও, এবার আমাদের গরু জবাই করতে দাও। অনেকদিন ‘ম্যায় ভুখা হুঁ মায়ি।’

হক সাহেব মুসলিম লীগে নাম লেখানোর পরে প্রথমে আমি তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম এই ভারতকে স্বাধীন করতে হলে হিন্দুশক্তির যেমন উত্থানের দরকার আছে, মুসলিমশক্তিরও উত্থানের দরকার আছে। দুই শক্তি একত্রিত হয়ে মহাশক্তিতে রূপান্তরিত হবে। পরদেশি বেনিয়াদের সাত সমুদ্দুর পার করে নিজের দেশে পাঠিয়ে দেবে। অথচ আজ তারা নিজের দেশ ভাগাভাগির জন্য তাদের কাছে ধর্না দিচ্ছে। এ যেন পিঠাভাগের গল্পকে হার মানায়। কথা ছিল, ইংরেজ চলে যাবে, যেতে বাধ্য হবে, যা যেভাবে আছে সেভাবে থাকবে। হিন্দু নেতারা মিলে মুসলিম নেতারা মিলে এই দেশকে গড়ে তুলবে। সুভাষ, লালবিহারীর লাল ফৌজ, জয়হিন্দ একদিন সব ঠিক করে দেবে। দুশো বছরের ক্ষত সারিয়ে তুলবে। অথচ তারাই আবার আমাদের ভাগাভাগির মালিকের আসনে বসে পড়েছে। যাদের আমরা খেদানোর জন্য লড়াই করেছি, তারাই আজ আমাদের বিচার করছে।

সেই থেকে হক সাহেব আমায় পছন্দ করছে না, সোহরাওয়ার্দি তো আগে থেকেই হক সাহেবের লোক মনে করে আমায় ততটা গুরুত্ব দিতে চায় না; তখন সেখানে শ্যামাপ্রসাদ, বিধানচন্দ্র রায় কিভাবে আমায় আলাদা ভাবতে পারে! রাজ্যশাসনের একটা খায়েশ থেকে সবাই একটা মুখোশ পড়ে আছে বটে, মুখোশ খুলে ফেললেই যার যার চেহারা ভেসে উঠবে। নেহেরু শাসন করবে না জিন্নাহ শাসন করবে—এটিই সবচেয়ে বড় ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিন্দু-মুসলমানের হাজারো সমস্যা আছে, সেই সমস্যা নিয়েই তো তারা এক দেশে হাজার হাজার বছর ধরে বাস করে আসছে। জিন্নাহ যদি নেহেরুর নেতৃত্ব মেনে নেয়, নেহেরু যদি জিন্নাহর নেতৃত্ব মেনে নেয়, তাহলে কি এই সংঘাতের অস্তিত্ব থাকবে? জনগণ হলো ভেড়ার পাল, তাদের যেদিকে পরিচালনা করা যায়, তারা সেদিকে জলের স্রোতের মতো ছুটতে থাকে। কেন কী তা বুদ্ধি দিয়ে ভাবার দরকার হয় না।


গোলাম মোস্তফা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, জসীমেরও খায়েশ কম নয়; ইতোমধ্যে তরুণ কবিরা ‘সাত সাগরের মাঝি’ লিখতে উঠে-পড়ে লেগেছে।


আমার এই জাতীয় ব্যর্থতার কথা কেউ জানতে চাইল না। ধ্বংসের মধ্যে যে আনন্দ আছে, সম্প্রদায়ের মধ্যে যে আদিম উন্মাদনা, তাই এখন প্রকাশ হতে যাচ্ছে। আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম না, এখন আমার কী করা উচিত। আমার কি এখন নব্য পাকিস্তানের অগ্রদূত কবি হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়া উচিত? ইতোমধ্যেই গোলাম মোস্তফা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, জসীমেরও খায়েশ কম নয়; ইতোমধ্যে তরুণ কবিরা ‘সাত সাগরের মাঝি’ লিখতে উঠে-পড়ে লেগেছে। এখন আমার কী করা উচিত? নাকি হিন্দু বন্ধুদের মন রক্ষা করে আমার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের গলা টিপে ধরা উচিত? আমি অনেক ভেবেছি। রাতের পর রাত ঘুমাতে পারি নি। পথে-প্রান্তরে একাকী ঘুরে বেরিয়েছি। আগের মতো কবিতায় গানে হাসিতে স্বতঃস্ফূর্ততা পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার মাথার মধ্যে হাতুড়ি-পেরেক ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে চাচ্ছে। আমি পাকিস্তানের, না আমি হিন্দুস্থানের? কোনটি আমার দেশ? কোন দেশের স্বাধীনতার জন্য আমি এতদিন কবিতা লিখলাম, জেল খাটলাম, সংগ্রাম করলাম? সেটি কেবল হিন্দুর জন্য, সে কি কেবল মুসলমানের জন্য? এমনকি আমার সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি কোনো আশা-ভরসা দেখতে পেলাম না। কেবলই মনে হতে লাগল একটি দেশের মতো আমার সাহিত্যও হিন্দু-মুসলিমের ভিত্তিতে ভাগ করে নেবে ওরা। ইসলামি গানগুলো, ইসলামি জজবার কবিতাগুলো পাকিস্তান তাদের নিজেদের সম্পদ দাবি করবে। হিন্দুরা আমার শাক্ত ও বৈষ্ণব পদাবলী রেখে দিতে চেষ্টা করবে। বলবে, দ্যাখো, এদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঘটনা ছিল। আমার রচনাগুলোকে বলা হবে মুসলমান কবি-রচিত বৈষ্ণব পদাবলী, কালীর গান, দেবদেবীর প্রশংসা; আমি মধ্যযুগের শুকুর মুহম্মদ, আলাওল, জায়সীর মতো হবো স্মরণীয়—তারাও কিছু বৈষ্ণব পদ লিখেছিলেন। তবে এটা ঠিক, মুসলমান কবিরা তার প্রতিবেশী সহোদরদের সম্মানে কালির গান, বিষ্ণুর গান লিখে যত এগিয়ে আছে, তারা তা পারে নি। তবু এটা কোনো তুলনার বিষয় না, ভালোবাসা প্রতিযোগিতার বিষয়।

এই অবস্থার মধ্যে না ছিল আমার ঘরে শান্তি, না ছিল মনে। যেসব নেতাদের সাথে এতদিন কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করেছি, মুক্তির দূত মনে করেছি, তারা আজ আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠছে। হক সাহেবকেও আমি আজ সহ্য করতে পারি না, বন্ধু হেমন্তকুমার সরকার, দীলিপ, শ্যামাপ্রসাদ কাউকেই নয়। এমনকি আমার বন্ধু মুজাফ্‌ফরকেও নয়। যে মুজাফ্‌ফরের কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। যে মুজাফ্‌ফরের সঙ্গে আমার দেখা না হলে, আমি ঠিক বলতে পারব না আমার চিন্তাধারার কী পরিবর্তন হতো—আমি কি হামদ-নাত লিখে, ‘মোয়াজ্জেম’, ‘মোসলেম ভারত’, ‘সওগাত’-এ লিখে জীবন পার করে দিতাম। আমার মধ্যে সাহস ও সততা, ন্যায় ও বণ্টনের ধারণা হয়তো শৈশব থেকেই ছিল। কিন্তু মাজাফ্‌ফরের সান্নিধ্যে তা আরো শাণিত হয়েছে, পদ্ধতিগত হয়েছে। সেই মুজাফ্‌ফরের কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থানও পরিষ্কার নয়। দেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে তারা কী চাচ্ছে, আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় নি। কই, দেশভাগের ব্যাপারে তারা প্রবল প্রতিরোধ না করে বরং পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ছে। তারা মনে করছে, মুসলিম সম্প্রদায় নিম্নবর্গের হিন্দুদের মতো অবহেলিত সম্প্রদায়, তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে হয়তো যার যার জায়গা থেকে সাম্য অবস্থা গড়ে উঠতে পারে।

এই বহুমুখী চাপের মধ্যে আমার কী করা উচিত বুঝতে পারছিলাম না। যোগসাধনায় নিজেকে আরো শক্ত করে বেঁধে ফেলতে চেষ্টা করলাম। দুনিয়ার সকল চিন্তা থেকে, এর ভালো-মন্দ থেকে, জন্ম-মৃত্যু ব্যথা-বেদনা থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে চাইলাম। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মতো নিজেকে বলতে থাকলাম, এই খাণ্ডবদাহে, এই পুরু-পাণ্ডব যুদ্ধে, এই কুরুক্ষেত্রে যে মরে সে মরুক, আমার কী! আমি কি আমার ভাইয়ের মৃত্যু, জ্ঞাতির মৃত্যু, জায়া ও জননীর মৃত্যু রোধ করতে পারব? জগতের সকল কিছু নিজস্ব নিয়মে চলতে থাকবে। সময় একদিন সবকিছু হত্যা করবে। আমি তো নিমিত্ত ছাড়া কিছু নই। আমি নিমিত্তও নই, আমি নিমিত্ত হতে চাই না। আমি তো তির হাতে অর্জুন নই, আমি তো শান্ত-ধী পার্থ নই, আমার তো রথ নেই, নিজের চলার জন্য যে একটি গাড়ি কিনেছিলাম, কিস্তি দিতে না পারায় কোম্পানি কেড়ে নিয়ে গেছে। আমার কোনো সারথি নেই। আমার জন্য ভগবান কৃষ্ণের আলাদা কোনো আশীর্বাদ নেই। আমাকেই কেউ কেউ শ্রীকৃষ্ণ ভগবান বলে ভুল করেছে। আমি পৃথিবীর ও স্বর্গের সকল দেবতার অভিশপ্ত বিদ্রোহী ভৃগু।

ভগবানের চেয়ে এ পৃথিবীতে ভয়ঙ্কর একা আর কে আছে! রূপধারী ভগবান জানেন কিভাবে তার মৃত্যু, নিজের মৃত্যু তার নিজেকেই রচনা করতে হয়। তার কোনো আনন্দ নেই, রোমাঞ্চ নেই, বেদনা থাকলেও কাঁদার উপায় নেই। তাই আমি চেয়েছি, সংসার ছেড়ে বাড়িঘর ছেড়ে, এমনকি এই কোলকাতা, ভারতবর্ষ ছেড়ে অন্তত পণ্ডিচেরীতে চলে গিয়ে নিশ্চিত বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করি। শুনেছি শ্রী অরবিন্দ সেখানে হাজার হাজার বিঘা জমির উপরে আশ্রম গড়ে তুলেছেন আমাদের মতো ভক্তদের জন্য। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত হেঁটে যাওয়া কষ্ট। ওখানে থাকার জন্য আলাদা কোনো অর্থ উপার্জনের প্রয়োজন নেই। সব কিছু চলছে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। সংসারেও তো আমার কেউ নেই। স্ত্রী অসুস্থ হলেও সে তার মায়ের কাছে নিরাপদে থাকবে। আমার দুটি সন্তান আছে সানি ও নিনি—আমি না থাকলে জানি ওদের কোনো অসুবিধা হবে না। কারণ তারা কাজী নজরুল ইসলামের সন্তান, অনেকেই তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। তা না দিলেও সমস্যা নেই। আমার বইয়ের পাবলিশাররা নিজেদের স্বার্থে সামান্য কিছুটা দিলেও তাদের চলে যাবে।

আমি তো জীবনের প্রথমে অরবিন্দের পথে যাত্রা শুরু করেছিলাম, বারীন্দ্রকে নেতা মেনে ছিলাম। তারাই তো আমার গুরু, তারা যে পথে গমন করবেন, আমারও তো সে পথে গমন করা উচিত। সেখানে গিয়ে গুরুর পদে বসে আধ্যাত্মিক চেতনায় মশগুল হলে এই ভাগাভাগির রাজনীতি আমায় স্পর্শ করতে পারবে না। আমি তো কপর্দকশূন্য মানুষ, আমার জন্য তো পথে বেরিয়ে যাওয়া এমন কোনো কষ্টের নয়। যাদের আছে, যাদের বাবার আছে—কবি দ্বিজেন্দ্রনাথ রায়ের পুত্র যদি সব ফেলে ঘর ছাড়তে পারে, জমিদার-নন্দন হেমন্ত সরকার যদি ঘর ছাড়তে পারে, নলিনী যদি পারে তাহলে আমার জন্য কিসের বন্ধন!

কিন্তু আমার জন্য পণ্ডিচেরী যাওয়ার রাস্তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যেদিন আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বারশো মাইল রাস্তা আমি পায়ে হেঁটে যাব। একইসঙ্গে আমার পাপস্খলন হবে। আমি যেদেশের জন্য লড়াই করেছিলাম, সেই দেশমাতৃকাকে আমি দেখতে দেখতে বিদায় জানাতে জানাতে অগ্রসর হব। কোথায় বসে দুদণ্ড মেঘদূতের মতো জিরিয়ে নেব, কোনো জলাশয়ে এক আজলা পানি তুলে পান করব। ইচ্ছে হলে প্রাণভরে কাঁদব। আমার দুখিনী ভারতমাতার জন্য, আমার পঙ্গু স্ত্রীর জন্য, আর অসংখ্য প্রেমিকার জন্য, নিজের মায়ের প্রতি অবহেলার জন্য। কিন্তু হলো না, শ্যামবাজার থানার কাছে এক পরিচিত জন দেখে ফেলল। জানতে চাইল, কাজী সাহেব কোথায় যাচ্ছেন? আমি বললাম, পণ্ডিচেরী। সে ভাবল আমার মাথা খারাপ হয়েছে, না হলে কেউ বারশো মাইল পায়ে হেঁটে পণ্ডিচেরী যায়!

কী অসম্ভব অবিশ্বাস, এই নাকি হিন্দু ধর্ম! যে হিন্দু ধর্মের সাধক-সন্ন্যাসীরা যুগ যুগ ধরে হাজার হাজার মাইল পায়ে হেঁটে তীর্থকেন্দ্রে পৌঁছেছে। কই, সেদিন তো কেউ তাদের অবিশ্বাস করে নি! এই ভারতবর্ষ তো সেইসব সাধু-সন্ন্যাসীর দান। যারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পায়ে হেঁটে গমন করেছে। তৈরি করেছে শত শত তীর্থস্থান, ধর্মপীঠ। মুসলমান সাধুরাও একই প্রক্রিয়ায় তীর্থ গমন করেছে, পীর-আউলিয়াদের সমাধিকে কেন্দ্র করে, সরাইখানাকে কেন্দ্র করে ঘুরে বেরিয়েছে। তারা কি কোনো যানবাহন ব্যবহার করেছে? তারা কি সঙ্গে খাদ্য বহন করেছে, নাকি তারা টাকা-কড়ি বহন করেছে? আজকের মতো যান্ত্রিক বাহন, হোটেল, পয়সার বিনিময়ে খাদ্য—সে তো প্রাচীন ভারতে ছিল না। এখনো তো সাধুরা একই পদ্ধতিতে তীর্থভ্রমণ করে। সঙ্গে বহন করে বড়জোর জল-খাবারের একটা ঘটি। সঙ্গে নিয়ে যায় পথের নানা অভিজ্ঞতা, ইতিহাস ও মানচিত্র।

কিন্তু আমার বেলায় তা হলো না। হয়তো আমি প্রকৃত সাধু নই বলে সে আমায় বিশ্বাস করে নি। পুলিশে খবর দিয়েছে। তারা আমায় উদ্ধার করে আমার সেই পুরোনো বৃত্তে রেখে গেছে। আমি মনে মুক্তি পেলেও দেহে বন্দিই রয়ে গেলাম।

‘সত্যকে হায় হত্যা করে অত্যাচারীর খাঁড়ায়,
নেই কি রে কেউ সত্য-সাধক বুক খুলে আজ দাঁড়ায়?’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *