তুমি শুনিতে চেয়ো না : ৫

পর্ব-৫

লুম্বিনী হাসপাতালে আমায় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। তারা ধরেই নিয়েছিল আমি এখন বদ্ধ-উন্মাদ। যে কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারি। আগেই বলেছি, নজরুল নামের কবির উপস্থিতি যদি সত্যি সত্যি আমার শরীরে থাকত, তাহলে সামান্য একটি হাসপাতাল আমায় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে পারত! আমি কি এখানে এদের খাতায় ব্রিটিশ রাজের চেয়েও ভয়ংকর অপরাধী? তারাও তো আমায় প্রকাশ্যে এভাবে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার দুঃসাহস দেখায় নি! আমার গান-কবিতা-রাজনৈতিক তৎপরতায় ব্রিটিশ রাজ পতনের আশঙ্কা করেছিল। অথচ এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার মানসিক অসুস্থতার দ্বারা কী পতনের আশঙ্কা করছে? নিরস্ত্র রোগী আমি, যার নাম কাজী নজরুল ইসলাম—ব্রিটিশের খাতায় রিবেল পোয়েট।

সেই রাতে আমি ঘুমাতে পারলাম না। ঘুমাতে গেলেই স্বপ্ন দেখি—দুঃস্বপ্ন। আমার সব স্বপ্ন মূলত আটকে ছিল ‘নবযুগ’ অফিসে, থানায় পুলিশের খাতায়। সার্কাস রোডে নতুন করে নবযুগের অফিস নেয়া হয়েছে সেখানে। প্রথমবারের মতো হক সাহেব নবযুগের সাথে থাকলেও এবার মূলত কুষ্টিয়ার শামসুদ্দীন সাহেব এর প্রকাশের দায় নেন। তিনি ছিলেন বৃহত্তর নদীয়া জেলার লোক। কুষ্টিয়ার সুলতানপুর গ্রামে জন্ম। বঙ্গীয় কৃষক প্রজা দল গঠিত হলে তিনি হন সাধারণ সম্পাদক। অনেকবার কারাবরণ করেছেন। ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দির কেবিনেটে মন্ত্রী ছিলেন। মৌলবী হলেও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে এম.এ পাস।

আমার অতীত কৃতির কথা স্মরণ করে এবারও আমায় নবযুগের প্রধান সম্পাদক করে আনা হয়। কিন্তু ততদিনে আমি সুন্দরের সাধনায় মত্ত হয়ে পড়েছি। কিছুদিন আমার সুন্দর আমার কাছে এসেছিল—যোগের পথ ধরে। তখন আমার মা ছিলেন পরম সুন্দর। তার রুদ্রমূর্তির মধ্যে দেখেছিলাম দেশমাতার কল্যাণ-মূর্তি। আজ ‘তিনি আমার কাছে নিত্য প্রিয়ঘন সুন্দর, প্রেমঘন সুন্দর, আনন্দঘন সুন্দর।’ এখন আর দুনিয়ার কোনো কাজে আমি আনন্দ পাই না। যখন আমি বস্তুগত কাজের সঙ্গে, অর্থগত কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করি, তখন আমার সুন্দর আমায় ছেড়ে যেতে চায়। যে সুন্দরের জন্য আমার এতদিনের সাধনা, তা তিরোহিত হয়েছে—আমার পরম সুন্দরের আহ্বানে। প্রথমে সেই সুন্দর এসেছিল তার বাণীর মাধ্যমে, তারপর এল প্রেমের মাধ্যমে, তারপর সন্তানের ভালোবাসার মাধ্যমে। সর্বাধিক যে সুন্দর আমার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছিল—ভারতমাতার মধ্যে, আমার দুঃখিনী বাংলা মায়ের জন্য। কিন্তু একে একে সেই সকল সুন্দর আমাকে ত্যাগ করে পরম সুন্দরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। আমার বুলবুল আগেই চলে গেছে। আমার দুলী শয্যাশায়ী। যে ভারতমাতার জন্য আমি সুন্দরের সাধনা করছিলাম, সেখান থেকেও সৌন্দর্য তিরোহিত হয়েছে। হিন্দু এখন অধিক হিন্দু, মুসলমান আরো মুসলমান হওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের থেকে সুন্দর বিদায় নিয়েছে। তারা বৈচিত্র্যময় সুন্দরের সঙ্গে এখন আর থাকতে চায় না। তারা পুষ্প থেকে পাপড়িকে আলাদা করে নিয়েছে। বৃন্ত ও গর্ভকেশর ভাগ করে নিয়েছে। এখন আর এখানে আমার সৌন্দর্যচর্চার কাজ নেই। তাই আমি আজ ‘হিন্দু-মুসলমানের সকল জাতির ঊর্ধ্বে, যিনি একমেবাদ্বিতীয়ম, তার দাস।’ যেখানে খণ্ডের জন্য লড়াই করতে হয় না। সবাই অখণ্ডের অংশ।


মুসলিম লীগের সম্মেলনে একবার হক সাহেব বলেছিলেন, ‘হিন্দু প্রকৃতিগতভাবে মুসলমানের শত্রু—হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বিষয়ে এমন ধারণা নিন্দনীয় ভুল।’


নবপর্যায়ে নবযুগের সূচনা হওয়ার পরে আমি পত্রিকার সম্পাদক বা সাংবাদিক হিসাবে কোনো দায়িত্বই পালন করতে পারি নি। পারার চেষ্টাও করি নি। কার জন্য করব? হক সাহেবের জন্য, শামসুদ্দীন সাহেবের জন্য, সোহরাওয়ার্দি সাহেবের জন্য? তাদের তো কিছু একটা হলেই চলে—জিন্নাহ বা গান্ধী—যে কেউ একজনের সঙ্গে থাকলে তাদের মন্ত্রিত্ব নিশ্চিত। যদিও হক সাহেবের ব্যাপারে আমার সর্বদা উচ্চ ধারণা ছিল। নেতা হিসাবে তিনি জিন্নাহ বা গান্ধীর মাপের, সুভাষ-হক ঠিক আছে। এখন রাজনীতির খেলায় সে নেহেরুও নিচে নেমে এসেছেন। মুসলিম লীগের সম্মেলনে একবার হক সাহেব বলেছিলেন, ‘হিন্দু প্রকৃতিগতভাবে মুসলমানের শত্রু—হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বিষয়ে এমন ধারণা নিন্দনীয় ভুল।’ সেই হক সাহেবকেও আজ নিজের রাজা বাঁচানোর জন্য জিন্নাহ’র কাছে ধর্না দিতে হচ্ছে।

গুজরাটি জিন্নাহ নিঃসন্দেহে বাংলার ফজলুল হককে কখনো বিশ্বাসে নেবেন না। ইংরেজের কেতা অনুকরণ ছাড়া হক সাহেবের চেয়ে তিনি কিসে সেরা ছিলেন? ব্রিটিশই ছিল জিন্নাহ’র প্রথম পছন্দ, পোশাকে কথাবার্তায় তাদেরকে অনুসরণ করতেন। আর ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল—সেই বরিশালের ছেলে এ.কে ফজলুল হক। হক সাহেবের ছাত্রজীবনের তুখোড় ইতিহাসের বিপরীতে জিন্নাহকে বসানোর চেষ্টা ইংরেজের সব সময় ছিল। ম্যানচেস্টার সিটি হাউসে এখনও জিন্নাহ’র মূর্তি আছে। এত তরুণ বয়সে আর কেউ নাকি এই ডিগ্রি অর্জন করতে পারে নি। কিন্তু ডিগ্রিটা কী! সেটা কি আই.এ বি.এ এম.এ, নাকি তথাকথিত সভ্য হওয়ার প্রশিক্ষণ। সব ধরনের ডিগ্রি নিয়েও বাংলার কৃষক-শ্রমিকের রাজনীতি হক সাহেব ভোলেন নি। পূর্ববঙ্গে মুসলমান আর পূর্ববঙ্গে হিন্দুর শ্রেণিগত তেমন পার্থক্য নেই। উভয় ধর্মের লোকই অর্থনৈতিকভাবে নিম্নবর্গের কামার-কুমোর-জেলে কিংবা ভূমিচাষি। কিন্তু সর্ব-ভারতীয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চেতনা ধর্মীয় চেতনার উপরে সওয়ার হওয়ায় মধ্যবিত্ত বাঙালির ঘটে পানি পায় নি। হক সাহেব এখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হলেও তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। সবই বিগড়ে গেছে—কেবল জিন্নাহ নয়, হিন্দু নেতারাও দেশ ভাগ চায়। বাংলার লাট সাহেব, ফুরফুরার পীর—মুসলীম লীগের উর্দুভাষী নাজিমদ্দীনের পক্ষ নিয়েছেন। নাজিমদ্দীন নির্বাচনে আপাতত হকের বিরুদ্ধে জয়ী না হলেও তার কবর রচনা করে ফেলেছেন। জনগণ হক সাহেবকে চেনে, জনগণ আমাকে চেনে; কিন্তু জনগণের সম্পদ তো রাজার দখলে।

তাই এই অফিসে এসে অধিকাংশ সময়ে আমি ধ্যানে মগ্ন থেকেছি। অবশ্য আবুল মনসুর আহমদ একটু বাড়িয়ে বলেছে যে, আমি নতুন নবযুগ অফিসে এসে সারাদিনই অজু ও নামাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। আমার নাকি অজু করতে লাগত আধা ঘণ্টা, আর নামাজ পড়তে দুই-তিন ঘণ্টা। আর সারাদিনই নাকি আমি মোনাজাতের মতো হাত তুলে রাখতাম। হাত-পা ছড়িয়ে সেজদা করতাম। আবুল মনসুর যাই বলুক, এ কথা ঠিক, আমি তখন সুন্দরের সাধনায় লিপ্ত। আমার নিয়ম তাদের নিয়ম থেকে আলাদা হয়ে গেছিল। তাই আমার পদ্ধতি মনসুরের ধরা সম্ভব হয় নি। আর মনসুর যেহেতু রম্য লিখত, তাই সবকিছুর মধ্যে মজা খোঁজা ওর স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

একবার খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন নবযুগ অফিসে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এল। তার সঙ্গে কথা-বার্তার মধ্যেই আমার কাছে পরম সুন্দরের বার্ত চলে এল—আমি ধ্যনস্থ হয়ে পড়লাম। ওকে বললাম, মঈনুদ্দী চোখ বন্ধ কর। মঈনুদ্দীন চোখ বন্ধ করল। আমি বললাম, ‘কিছু দেখতে পাচ্ছিস?’ ও বলল, ‘কিছু না।’ অথচ আমার চোখের সামনে লাল-নীল স্বর্ণবর্ণ কতরূপ গাভী ভেসে বেড়াচ্ছিল। আমি আদম ও ঈভের মতো বেহেশতের উদ্যানে উড়ে বেড়াচ্ছিলাম। কোরানের অক্ষরগুলো নানা রূপ ধরে আমার সঙ্গে কথা বলছিল। আমার এসব দেখে, মঈনুদ্দীনও ভেবেছিল, আমি আসলে এখন দুনিয়ার পথের পথিক নই। ওর ধারণা তো আর মিথ্যা নয়। ফেরার পথে ও আমায় সঙ্গে করে বাড়ি রেখে যেতে চাইল। তখন আমার ঠিকই অহং জেগেছিল। বুঝতে পারলাম, মঈনুদ্দীনও আমায় শেষমেশ পাগল ঠাওরালো।

আমি তখন স্বপ্ন দেখতাম—আমি যেন প্রথম প্রকাশিত নবযুগ অফিসে কাজ করছি, ‘ধূমকেতু’ এমনকি ‘লাঙ্গল’ পত্রিকা বের করছি—সব কিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল তখন। আমি তখন দৃশ্য থেকে দ্রষ্টব্য আলাদা করতে পারতাম না। আমার কাছে জড় ও জীবের পার্থক্য ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। স্বপ্নের মধ্যে ধারাবাহিকতা থাকত না। মনে হতো কেউ আমার মাথায় প্রবল বেগে আঘাত হানছে। এমনকি যেদিন রেডিও আফিসে আমার কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেদিও মনে হয়েছিল, কেউ যেন মোটা রড দিয়ে আমার মাথার নিচে ঘাড়ের উপরে সজোরে আঘাত করেছে। আমি তীব্র যন্ত্রণায় কেঁপে উঠিছিলাম। সত্যিই কি আমাকে সেখানে সেদিন কেউ মেরেছিল? অনেকে এ কথা বলেছে, আমি বুঝতে পারি নি। আকাশবাণীতে আমার অনেক শত্রু ছিল। তারা চাইত না আমি আর এখানে এত বড় ভাণ্ডারীর পদ দখল করে থাকি। তাছাড়া আমার কাজ-কর্মের তো কিছুটা গা-ছাড়া ভাব এসেছিল।

তারিখটা যদিও জুলাই মাসের দশ তারিখ ছিল, আমি লিখেছিলাম, অক্টোবর মাসের সাত তারিখ। অর্থাৎ মাসের স্থলে তারিখ বসে গিয়েছিল। এটা তো সুস্থ মানুষদেরও হতো পারে। আমি হায়দরকে চিঠি লিখেছিলাম। সকাল সকাল চলে আসতে। হায়দারের অনেক দোষ ছিল, আবার হায়দার ছাড়া কেউ এতটা খেদমত আমায় করে নি দুঃসময়ে। সে ছিল আমার মায়ের পেটের ভাইয়ের মতো। চিঠিতে লিখেছিলাম, ‘প্রিয় হায়দার, তুমি এখনই চলে এসো, অমলেন্দুকে আজ পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। আমি কাল থেকে অসুস্থ। ইতি নজরুল।’

অমলেন্দু মানে অমলেন্দু দাশগুপ্ত। সে-ই মূলত নিষ্ঠার সঙ্গে নবযুগ পত্রিকার দায়িত্ব পালন করত তখন। আমি লিখেছিলাম, অমলেন্দুকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। এতেই সবাই ধরে নিয়েছিল, আমার স্মৃতিভ্রম হয়েছে, আমি হ্যালুসিনেশনে ভুগছি। কিন্তু কেউ বলছে না, পুলিশ অমলেন্দুকে কখন ঘরে থাকতে দিয়েছে। বেচারা কেবল বিএ পরীক্ষা দিয়েছে, আর অমনি পুলিশ ধরে নিয়ে তারে জেলে পুরে দিল। একটানা আট বছর জেলের ঘানি টেনে মাত্র কয়দিন আগে বেরিয়ে এসেছে। এখনো তো তার পেছনে পুলিশ সর্বক্ষণিক লেগে আছে। যে কোনো সময় আবারো অ্যারেস্ট হয়ে যেতে পারে। এখানে আমার হ্যালুসিনেশনের কী আছে! আমার অসুস্থ হওয়ার মাত্র কয়দিন পরেই তো সে আবারও গ্রেফতার হলো, সুভাষ বসুর হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণে যোগ দিয়ে। এবার তো তাকে আরো ছয় বছর জেলের ঘানি টানতে হলো। জীবনের অর্ধেকটা সময় তাকে জেলে কাটাতে হয়েছে। জেলের স্মৃতি আমার মতো তাকেও ভীতিগ্রস্ত করে তুলেছিল। জীবনে কয়েকটা বই লিখেছে, সব জেল-জীবনের স্মৃতি। যেমন : বকশা ক্যাম্প, ডেটিনিউ, বন্দীর বন্দনা। পুরো দেশকেই ইংরেজ সরকার তখন একটা জেলখানায় পরিণত করেছিল।


একবার দীনেশ সেনের অসুখ হয়েছিল। ডাক্তার বিধানকে ডাকা হলে দুই হাজার টাকা ফি দাবি করেন।


অনেকেই মনে করে, আমার একদিনেই কথা বন্ধ হয়ে গেছে। আমি আসলে ধীরে ধীরে বাকরুদ্ধতার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। আর সেটি কতটা আমার যোগভ্রষ্টতা আর কতটা ডাক্তারি বিদ্যার ভ্রষ্টতার ফল—আজ আর তা সমাধানের প্রয়োজন দেখি না। ডাক্তার যখন জেনে-শুনে আমার শরীরে দশ লাখ পাওয়ারের পেনিসিলিন পুশ করে, তখন আর আমার কথা বলার দরকার থাকে না। পরিণাম কী হবে তা নিশ্চয় ড. বিধানচন্দ্র রায় জানতেন। ভাঙা বাংলার ভবিষ্যৎ মুখ্যমন্ত্রী। কবিগুরুর চিকিৎসাতেও তিনি সফল হতে পারেন নি। তারও কিছু করার ছিল না, সেও ভাগ্য-বিড়ম্বিত শিকারি জারা, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দেহের মায়াভঞ্জনে সে নিমিত্ত বই তো নয়। ডাক্তার বিধান রায়কে নিয়ে একটা নিদারুণ গল্প আছে—একবার দীনেশ সেনের অসুখ হয়েছিল। ডাক্তার বিধানকে ডাকা হলে দুই হাজার টাকা ফি দাবি করেন। না পেরে তার পরিবার স্যার নীলরতনকে ডেকে নিয়ে যান। ডাক্তার নীলরতন তার চিকিৎসা করলেন। তাঁর কাছে ফিস জানতে চাইলে স্যার নীলরতন বললেন, ‘বাঙালি জাতির দীনেশ সেনের কাছে কিছু ঋণ আছে, ফিসের কথা উঠবে কেন?’

আমি যেদিন অসুস্থ হই, বাংলার জাতীয় কবির বাড়িতে কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। তাই তার শাশুড়ি গিরিবালা দেবীর পক্ষে কোনো ডাক্তার ডাকা সম্ভব হয় নি। হায়দার এসে দোতলায় বাড়িওয়ালা ডি.এল. সরকারের বাসায় নিয়ে গেল। অগত্যা তার হোমিওপ্যাথি দিয়ে চিকিৎসা শুরু হয়েছিল। আমি নিজেও তখন বুঝতে পারি নি এই অসুস্থতা আমায় চিরদিনের জন্য পঙ্গু করে দেবে। অসুস্থ হওয়ার পরেও যতদূর পেরেছি, খোঁজ-খবর নিয়েছি সহকর্মীদের। রেডিওর ঘটনার প্রায় দশ দিন পরে আমি নবযুগের ব্রজেন্দ্রকুমার রায়চৌধুরী ও হায়দারকে চিঠি লিখেছি। সেইসব চিঠিতে অন্যদের দৃষ্টিতে কিছুটা অসঙ্গতি থাকলেও গভীর বিচারে ঠিক ছিল। আমি ব্রজেন্দ্রকিশোরকে নবযুগের জন্য এডিটোরিয়াল লিখতে বলেছিলাম। অক্টোবরের মধ্যে সুস্থ হয়ে যাব বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলাম। বলেছিলাম, ফাল্গুন মাস থেকে আমাদের মাইনা বেড়ে যাবে। মনসুর মায়নার টাকা নিয়ে আসবে। বলেছিলাম, মনসুর চিফ মিনিস্টার হক সাহেবের পা ধরে কেঁদেছে। এরপর আমার পা ধরে কাঁদবে। মনসুর আমায় খুব ভালোবাসলেও নবযুগের সম্পাদক হিসাবে বেতন-ভাতায় অনিয়ম করে ফেলে। যদিও সেটি ওর দায়িত্বের মধ্যে ষোলআনা পড়ে না। মনসুরের বয়সের দিক দিয়ে আমার সমবয়সী, তাছাড়া ওর বাড়ি ময়মনসিংহ ত্রিশালে। রাজনীতিতে সুভাষ বসুর কংগ্রেসে হাতেখড়ি হলেও এখন মুসলিম লীগে সক্রিয়। এর মধ্যে চলছে বিশ্বব্যাপী মহামারী, আর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ধেয়ে আসছে পঞ্চাশের ভয়াবহ মন্বন্তর। এই সময়ে হায়দারকে এক চিঠিতে জানিয়েছিলাম। ‘নবযুগে তিন চার মাস বেতন হয় না। বাড়িতে টাকা পয়সা নেই। অসুখ-বিসুখ ঋণ, পাওনাদারের তাগাদা। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত একটানা খাটুনিতে আমার নার্ভাস সিস্টেম কাজ করছে না।’

ওই চিঠিতে আরো বলেছিলাম, ‘হিন্দু মুসলিম ইকুইটির টাকা কারো বাবার সম্পত্তি নয়। বাংলার বাঙালির টাকা। আমি মরে গেলে একদিন ওই টাকা ফেরদৌসির মতো আমার জানাজার নামাজের দিন পাব।’ এটা সত্য, আমি এসব কথা হক সাহেবকে উদ্দেশ্য করেই বলেছিলাম। আমার আর্থিক সংকটের কথা তারা ভালোভাবেই জানেন। আমি অসুস্থ শুনেছেন, কই নিজে একবার আসতে পারেন নি। হায়দার তার ভাগ্নে ইউসুফ আলীকে নিয়ে হক সাহেবের সঙ্গে দেখে করে আমার দুর্গতির কথা জানায়। তিনি তার কেবিনেটের অর্থমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদকে টেলিফোনের মাধ্যমে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থার কথা বলেন। এতে আমি সন্তুষ্ট হতে পারি নি, বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর যতই কাজ থাক, কবি নজরুল ইসলাম না খেয়ে, অর্থকষ্টে রোগে ভুগে মারা যাবে আর তিনি অফিসিয়াল দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিত থাকবেন! এমনকি পরের দিন রাইটার্স ক্লাবে তার সঙ্গে হায়দরের সাক্ষাতের কথা থাকলেও কাজের অজুহাতে হক সাহেব বাইরে চলে যান। অবশ্য শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী হক সাহেবের পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া শ্যামাপ্রসাদও আমায় পছন্দ করতেন। তার বাবা আশুতোষ মুখার্জী মারা গেলে আমি ‘আশু-প্রয়াণ গীতি’ লিখেছিলাম—

বাংলার ‘শের’ বাংলার শির, বাংলার বাণী, বাংলার বীর সহসা ও-পারে অস্তমান। এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ।

আশুতোষের সাহস মেধা স্বাধীনচেতা মানসিকতা ও ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের জন্য তাকে ‘বাংলার বাঘ’ উপাধি দেয়া হয়েছিল। স্বাধীনতাসংগ্রামী কুষ্টিয়ার যতীন্দ্রনাথ মুখার্জীকে ‘বাঘা যতীন’ বলা হতো। কিন্তু বছর দুই আগে লাহোরে হক সাহেব ‘শেরে বাংলা’ নাম নেয়ার আগে আমিই বাঘের স্থলে ‘শের’ ব্যবহার করেছিলাম। যদিও শের বললে আশুতোষ মুখার্জীকে না বুঝিয়ে ফজলুল হক সাহেবকেই বোঝায়। এসব কারণে শ্যামাপ্রসাদ আমার প্রতি আত্মীয়তা পোষণ করতেন।


আমার বন্ধু হক, আমার গুরু হক, বনের বাঘের মতো সাহসী তুমি—তাহলে আমরা শেষমেশ কেন বিড়াল হয়ে গেলাম!


অবশ্য হক সাহেব আমার জন্য কিছু করেন নি বলা ভুল হবে। আমি তো জীবনের শুরুতে তার সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছি। কোলকাতা-জীবনে আমাকে, মুজাফ্‌ফরকে কেন্দ্র করে তার ‘যুগবাণী’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশ। তার সাহস, সরলতা সর্বদা আমায় মুগ্ধ করেছে। অত বড় মানুষ—দেখে বোঝার উপায় নেই। নিচের তলার মানুষ থেকে উপরতলার সবখানেই ঠিকঠাক মতো মানিয়ে নিতে পারতেন। তবে তিনি নিজেও জানতেন, ‘তিনি সুন্দর সুন্দর বিশ্বাসযোগ্য মিছা কথা কইতে পারেন।’ প্রতারণা তার ধাতে ছিল না, জটিল রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে চাইতেন। শুধু বাংলামুলুক হলে তার জন্য কোনো সমস্যা ছিল না। সর্বভারতীয় খেলার কাছে, গুজরাটি কাশ্মিরি বুদ্ধির কাছে হেরে গেছেন।

আমার আর্থিক কষ্ট দূর করার জন্য ফজলুল হক নিতে চেয়েছিলেন এক সম্মানজনক পদক্ষেপ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নামে একটি চেয়ার প্রতিষ্ঠার কথা ছিল। আজ সবগুলো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে আমার নামে সম্মানসূচক চেয়ার। সরকারের পক্ষ থেকে ‘সঙ পাবলিসিটি অর্গানাইজেশন’ নামে একটি নতুন বিভাগ খোলার কথা ছিল। বিজ্ঞাপনও দেয়া হয়েছিল—সব আমাকে মাথায় রেখে। অনেক বেতন। আবেদনকারীর এমন যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল—যা আমি ছাড়া কেউ পূরণ করতে পারবে না। এই হলো ফজলুল হক—আত্মীয় বন্ধুদের জন্য করতে তার কোনো যুক্তি লাগে না। কিন্তু সে পদ আমার গ্রহণ করা হয় নি। আমি তার আগেই বুদ্ধির জগৎ থেকে বের হয়ে এসেছি। তবু হক সাহেবকে আমি ক্ষমা করি নি। আমার বন্ধু হক, আমার গুরু হক, বনের বাঘের মতো সাহসী তুমি—তাহলে আমরা শেষমেশ কেন বিড়াল হয়ে গেলাম!

সেদিন আমি রেডিও অফিসে ছিলাম। পঙ্কজ মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রসহ অনেকেই উপস্থিত ছিল। বীরেন্দ্র আকাশবাণীতে মহালয়ার দিনে মহিষমর্দিনী চণ্ডীপাঠ করে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। হক সাহেব আমায় ডেকে পাঠালেন। প্রায় ঘণ্টাতিনেক রাইটার্স বিল্ডিংয়ে থেকে আমি খুব মন খারাপ করে ফিরে এলাম। বীরেন্দ্র জিজ্ঞাসা করল, ‘কাজীদা কী হয়েছে? হক সাহেব কী বললেন?’

আমি বললাম, ‘হক সাহেব বললেন, মুসলিম লীগ বাংলাকে ভাগ করে নিতে চায়। তিনি আমার মত জিজ্ঞাসা করলেন।’

—তুমি কী মত দিলে? —বললাম, বাংলা ভাগ মানে বাঙালি জাতিকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করা। —হক সাহেব কী বললেন? আমি বললাম, তিনিও তাই মনে করেন। —তোমার কী মত? —আমি বলে দিয়েছি, জীবন দিয়ে এর বিরোধিতা করব।

বাংলা ভাগ রুখতে পারি নি। তাই নিজেকেই ছিন্নভিন্ন করেছি।

বাংলা ভাগের দ্বারা ভারতবর্ষে বাঙালিকে যেমন দুর্বল করা হবে তেমনি পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে মুসলিম সংখ্যালঘুকে ভারতবর্ষে অধিক সংখ্যালঘুত্বে পরিণত করা হবে। যেসব অংশ নিয়ে পাকিস্তান হবে, সেখানে তো মুসলমানরা আগে থেকেই সংখ্যাগুরু, তাহলে পাকিস্তান কিভাবে সংখ্যালঘু মুসলমানকে রক্ষা করবে!


বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের কুচকাওয়াজে তিনি ছাত্রদের ব্রিটিশ পতাকা অভিবাদন করতে বলেন। ছাত্ররা এর প্রতিবাদ জানালে তিনি চাবুক মারার আদেশ দেন।


লুম্বিনীতে যাওয়ার আগে দু’একটি কথা বলা দরকার। আমার রোগের শুরুর দিকে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী আমার বাড়িতে এসেছিলেন। আগেই বলেছি, বাড়িটি ছিল অপ্রশস্ত। সরু সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। তখন যদিও তার আহামরি বয়স নয়। আমার চেয়ে বছর দুয়েকের কমই হবে। তবু অল্প বয়সে বড় বড় দায়িত্ব পালন করায় শরীরের মধ্যে স্থূলতা এসেছিল। তেত্রিশ বছর বয়সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি থাকার সময়ে তার অনুরোধে কবিগুরু থিম সং লিখে দিয়েছিলেন—‘চলো যাই চলো যাই।’ তবে তার সম্বন্ধে একটি প্রচার অপপ্রচার যাই বলি না কেন সেটি ওই সময়ের একটি কলঙ্ক হিসাবে আছে—বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের কুচকাওয়াজে তিনি ছাত্রদের ব্রিটিশ পতাকা অভিবাদন করতে বলেন। ছাত্ররা এর প্রতিবাদ জানালে তিনি চাবুক মারার আদেশ দেন। তিনি ছাত্রনেতা ধরিত্রী গাঙ্গুলি ও উমাপদ মজুমদারকে বহিষ্কারের আদেশ দেন। পরে যদিও সেটা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন, তবু তার চরিত্রে ভালো-মন্দের মিশ্র তিলক যুক্ত হয়ে আছে।

এত বড় একজন লোক এই দুঃসময়ে আমার বাড়িতে আসায় সত্যিই আমি অভিভূত হয়েছিলাম। তার অনেক প্রশংসা করেছিলাম। তিনি চিকিৎসার খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। আমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল, তাই তার সঙ্গে লিখে মনের ভাব প্রকাশ করছিলাম। তখনো আমার মনের জোর যথেষ্ট ছিল। ভাবছিলাম কিছুদিন বিশ্রাম নিলেই আমি পুনরায় সুস্থ হয়ে উঠব। তাকে বলেছিলাম, ‘হাজার খানেক টাকা হলেই এ যাত্রা আমি সামলে নিতে পারব।’ আমার বাড়িওয়ালা ডাক্তার মি. সরকার কোলকাতার এমবি গ্লাসগোর এফআরসিআর। তিনি সপরিবারে মধুপুর যাচ্ছেন হাওয়া বদলাতে। সেখানেও তার বাড়ি আছে—আমায় থাকতে দেবেন। মুখার্জী বাবুকে বলেছিলাম, ‘আমার ইনভেলিড স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।’ মুখার্জী বাবু থাকা অবস্থায় আমায় দেখতে আসেন সওগাতের নাসিরউদ্দীন, কোলকাতার মেয়র বদরুদ্দোজা আর হক সাহেবের ভাগ্নে ইউসুফ আলী। তিনি তাদের নিয়ে টাকার খোঁজে বেরিয়ে যান। সেদিনের মতো ব্যাঙ্ক বন্ধ হওয়ায়, অলংকার ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে পাঁচশ টাকা ধার নিয়ে নাসিরউদ্দীনের হাতে আমার জন্য পাঠিয়ে দেন।

ওই দিন রাতে আমি হাওয়া-বদলে কোলকাতা থেকে মধুপুর রওয়ানা হই। নবযুগ পত্রিকার আমার সহকর্মী অমলেন্দু দাশগুপ্ত এবং কালীপদ গাঙ্গুলি মিলে ধরাধরি করে অসুস্থ প্রমীলা ও বাকশো-পেটরা নিচে আনতে সহায়তা করে। রাত নটার ট্রেন ধরে কোলকাতা থেকে ৩১০ কিলোমিটার দূরে মধুপুর চলে আসি। মধুপুর বিহার ঝাড়খণ্ডের মধ্যে এক মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর স্বাস্থ্যকর স্থান। দেওঘর থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরে। রেল-স্টেশন থেকে বেরুতে বাঁ হাতে ডালমিয়া কূপ, ডানে কালিপুর। স্টেশনকে ডানে রেখে কবরখানা ছাড়িয়ে সর্বধর্ম সমন্বয় ও মানবসেবায় ব্রতী প্রভুধাম। আরও এগিয়ে প্রাচীনতম পাথরচাপটি ছাড়িয়ে বৃহত্তম বাহান্ন বিঘার কপিল মঠ। অসংখ্য ধর্মমন্দির, চতুর্ভুজ নারায়ণ মন্দিরটিও মনোরম। আশু ঘোষের সোনার বাংলা, আর আহমেদের রিভারভিউ। সামনে শেখপুরা বায়ু-বিলাসীদের জন্য তীর্থস্থান।

মধুপুর এসে আমি কিছুটা ভালো বোধ করছিলাম। দুশ্চিন্তা কিছুটা কমে আসছিল। ভাবছিলাম আর চাপ নিব না। তবু টাকার সংকটের কথা ভেবে তখনও অস্থির ছিলাম। বিশেষ করে পাওনাদারদের মামলায় কোর্টের ওয়ারেন্ট আমাকে অস্থির করে তুলছিল। এখানে এসে গোটা দুই-তিন চিঠিও লিখেছিলাম। যারা এই চিঠিগুলো দেখেছেন, তারা আন্দাজ করতে পারবেন, একজন অসুস্থ লোকের পক্ষে এতটা ভারসাম্য রেখে লেখা সম্ভব হয় না। দুজন লোকের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়। অসুখের শুরুতে যারা আমার পাশে ছিলেন। প্রথম চিঠিটি লিখি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে, দ্বিতীয় চিঠি হায়দারকে। এই চিঠিতে তারিখের গোলমাল ধরা পড়েছে—২৭ জুলাইয়ের পরিবর্তে ১৭ জুলাই লিখে ফেলেছিলাম। চিঠির বিষয়বস্তু ছিল শ্যামাবাবু এত সত্বর ব্যবস্থা করে না দিলে মধুসূদনের মতো আমার নির্ঘাৎ মৃত্যু হতো। যথারীতি হক সাহেবের উপর আমার রাগ-ক্ষোভও এ চিঠিতে বেশি প্রকাশ পেয়েছিল। তাছাড়া শ্যামাপ্রসাদ হক সাহেবের কেবিনেটের মন্ত্রী হলেও দু’জনের পার্টি ভিন্ন, ফলে তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বও ছিল, সেজন্য আরো গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলাম, যাতে শ্যামাপ্রসাদ আমার উপরে সন্তুষ্ট থাকে। চিঠিতে মারাত্মক যে কথাটি ছিল—‘হক সাহেব যখন আমার কাছে এসে কাঁদতে থাকেন যে, ‘আমায় রক্ষা করো, মুসলমান ছেলেরা রাস্তায় বেরুতে দিচ্ছে না।’ আমি তখন মুসলিম লীগের ছাত্র এবং তরুণ দলের লিডারদের ডেকে শান্ত করি। ওই চিঠিতে আমি শ্যামাপ্রসাদের কাছে আমার যাচিত আরো পাঁচশ টাকা প্রদান একং হিন্দু মুসলিম ইকুইটি ফান্ড থেকে আমার ঋণ মুক্তির কথা বলি। তিন-চার মাস কোর্টের মাধ্যমে টাকা দিতে না পারায় পাওনাদাররা বডি ওয়ারেন্ট বের করতে পারে। এছাড়া হায়দার ও দুলির পক্ষের আত্মীয়া বুড়ুকে দুটি পৃথক চিঠি লিখেছিলাম। সংসারীদের চোখে এই চিঠিতে কিছু সন্দেহ ছিল, যেহেতু আমি আসছে শরতে সম্পূর্ণ ভালো হওয়ার কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম, আমার এই শরীর যার সেই বন্ধুই আমায় সারিয়ে তুলবেন। এতে ভুল কোথায় ছিল, আমি ঠিক বুঝতে পারি নি।

মধুপুরে হাওয়া-বদলে এসে আমার শরীরের উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয় নি। হাতের কাঁপুনিটা কিছুদিনের জন্য সামান্য কমেছিল। কিন্তু আমার শাশুড়ি গিরিবালা দেবী চাচ্ছিলেন না এখানে আর সময় নষ্ট করা হোক, বরং কোলকাতায় গিয়ে আধুনিক এলোপ্যাথি চিকিৎসার শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে। ২১ আগস্ট সকালবেলা আমরা কোলকাতা ফিরে এলাম। আমরা পৌঁছানোর পর পর হায়দার এল। হায়দারের ধারণা আমার অসুখের কোনো উন্নতি হয় নি। কথা-বার্তা আরো জড়িয়ে যাচ্ছিল। শরীরের জোরও কমতির দিকে। সে আমার কাছে জানতে চাইল, এলোপ্যাথিক চিকিৎসা করাব কি না। আমি তাতে সায় দিলাম।

চিকিৎসার জন্য আমার বাড়িতে কোনো টাকা ছিল না। শ্যামাপ্রসাদও প্রথমবারে পাঁচশ টাকা পাঠানোর পরে আর কোনো টাকায় পাঠান নি। শাশুড়ি গিরিবালা দেবী ও স্ত্রীর সম্মতিক্রমে হায়দার আমার অসুস্থতার খবর জানিয়ে বাংলা ও ইংরেজি পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়। এখানেও কোনো সাড়া মিলল না। হায়দার নিজে গিয়ে চিফ মিনিস্টার শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, সাবেক মন্ত্রী ও ভবিষ্যৎ অবিভক্ত বাংলার চিফ মিনিস্টার নাজিমউদ্দীন ও সোহরাওয়ার্দির সাথে সাক্ষাৎ করেন, কিন্তু কেউ তাৎক্ষণাৎ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন নি।


গুরু-শিষ্য বলা চলে একই ছুরির নিচে বলি হয়েছি।


পরিণামে আবারও আমার কবিরাজি চিকিৎসা শুরু হলো। হায়দার বিখ্যাত কবিরাজ বিমলানন্দ তর্কতীর্থের চিকিৎসালয়ে আমার অসুস্থতার কথা জানালে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে আমার চিকিৎসা করাতে রাজি হন। তার কাছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও চিকিৎসা নিয়ে উপকৃত হয়েছিলেন। কবিরাজ বিমলানন্দ তর্কতীর্থের চিকিৎসায় কবিগুরু ফলও পাচ্ছিলেন। কিন্তু বার বার দোনামনা করে শেষমেশ ঠেলে দেয়া হয় ছুরিকাঁচি, কাটাকাটির টেবিলে। সেকালের সবচেয়ে বড় ডাক্তার নীলরতন সরকার চান নাই অপারেশন হোক। তবু ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের জবরদস্তিতে নীলরতন সরকারকে সরে যেতে হয়। গুরু-শিষ্য বলা চলে একই ছুরির নিচে বলি হয়েছি।

কবিরাজ তর্কতীর্থের আন্তরিকতার অভাব ছিল না। কিন্তু আমার পক্ষে মেজাজ ঠিক রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। গালাগালি, পেশাব-পায়খানা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। যার বর্ণনা আগেই দিয়েছি। এ অবস্থার মধ্যে হায়দার আবার হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন। হক সাহেব এবার কোলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ইউ.পি. বসুকে ফোন করেন এবং আমাকে রাঁচি পাঠাতে অনুরোধ করেন। কিন্তু আমার শাশুড়ি ও স্ত্রী রাঁচি পাঠাতে রাজি হন নি। শেষমেশ সিদ্ধান্ত হলো কোলকাতার কাছে লুম্বিনীপার্ক লুনাটিক অ্যাসাইলামে নেয়া হবে।

মাসিক ১৭০ টাকার বিনিময়ে আমায় লুম্বিনী পার্ক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এই হাসপাতালে আসতে আমার মন সায় দেয় নি। যেহেতু আমার স্ত্রী ও শাশুড়ি আমায় রাঁচি পাঠানোর ব্যাপারে রাজি ছিলেন না, সেহেতু ডাক্তার নগেন্দ্র দে ও ডাক্তার মোহাম্মদ আলী অন্তত লুম্বিনী পার্কের লুনাটিক হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেয়। হায়দার, আলী হোসেন আর হিজ মাস্টার্স ভয়েসের হেমচন্দ্র সোম আমায় ট্যাক্সিতে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের করে আনে। আমার মন বলছিল, খারাপ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আমার হয়তো সুস্থ হয়ে কোনোদিন ফেরা হবে না। আমি না যাওয়ার জন্য যথেষ্ট বল প্রয়োগ করেছিলাম। আলী হোসেনের মুখে সজোরে ঘুষি বসিয়ে দিয়েছিলাম। তবু তিন জনের সম্মিলিত বলের কাছে পরাস্ত হতে হলো।

এখানেও ডাক্তারদের সেই চিরাচরিত দৈব বাণী—মুখ গম্ভীর করে বলতে হবে—‘সত্যি অনেক দেরি করে ফেলেছেন।’ কবে থেকে কোথা থেকে দেরি হয়েছে সব যেন তারা জানেন। অতএব এখনি ভর্তি হয়ে যান। ভর্তি কাউন্টারে ১৯৯ টাকা ১৩ আনা ৯ পাই জমা দিয়ে হায়দার ফিরে এসে দেখল—

ইতোমধ্যে আমার পায়ে শিকল পরানো হয়ে গেছে। আমি তখন বন্দি সিংহ। হুঙ্কার দিতে লাগলাম, নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুললাম, গালাগালি দিতে থাকলাম। হায়দারকে দেখতে পেয়ে হুঙ্কার দিয়ে বললাম, আমায় এখান থেকে নিয়ে চল। মুহূর্তে আমার এতদিনের যোগ ও আধ্যাত্ম্য সাধনা টুটে গেল। জীবন জগৎ তুচ্ছ হয়ে গেল। আমার এমন কী হয়েছে যে লোহার শিকল দিয়ে আমার দু’পা দু’হাত বেঁধে ফেলা হলো! শিকল ছেঁড়ার সাধ্যমতো চেষ্টা চালাতে লাগলাম। প্রকৃত সিংহের পক্ষে, এমনকি বন্য ঐরাবতের পক্ষে মানুষের তৈরি শিকল ছেঁড়া সম্ভব হয় না।

মানুষের তৈরি শিকলের কাছে মানুষ কত অসহায়। আজ থেকে দুই দশক আগে ইংরেজের জেলখানায় বসে গান বেঁধেছি, সুর দিয়ে থালা-বাসন বাজিয়ে গেয়েছি—‘এই শিকল পরা ছল, মোদের এ শিকল-পরা ছল/ এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল।’ আজকের এই পরিস্থিতির কাছে সেদিনের সেই বীরত্ব-সংগীত কত তুচ্ছ আর রোমান্টিকই না মনে হচ্ছে। সেদিন জেলখানার প্রাচীর ডিঙিয়ে অনেকের পক্ষে আমার কাছে পৌঁছানো সহজ ছিল। সেদিন পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় নলিনীকান্ত সরকারের কাঁধের উপর ভর দিয়ে জেলখানার প্রাচীরের উপরে উঠে আমার সান্নিধ্য পেয়েছিল। আজ কেউ আসবে না—কল্যাণের নামে, মানুষের তৈরি শিকল ভেঙে এখানে আমায় উদ্ধার করতে। আমি আজ না খেয়ে থাকলেও গুরু টেলিগ্রাম পাঠাবে না, ‘গিভ আপ ইয়ুর হাঙ্গার স্ট্রাইক, আওয়ার লিটারেচার ক্লেইমস ইউ।’ গুরু বেঁচে থাকলেও আজ টেলিগ্রাম পাঠাতেন না—কারণ বাংলা সাহিত্যে আর আমার কিছু দেয়ার নেই।

শেষমেশ আমি আমার নিয়তি মেনে নিলাম। একটি সিংহশাবক ফাঁদে পড়ার পরে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ফাঁদ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু সেসব আর কখনো হয় না, এক সময় নিয়তির কাছে সেও বন্দি হয়ে পড়ে। আমিও এখন নিয়তি-তাড়িত এক বন্য সিংহশাবক ছাড়া কেউ নই। বিগত দুই দশকে ব্রিটিশ পুলিশ যা পারে নি, আজ এখানে জনদরদি ডাক্তারগণ তা পেরেছে। ডাক্তার বসু একদিন হায়দারকে ডেকে মৃদু হেসে বলল, ‘কবিকে প্রথম যেদিন আপনি নিয়ে এলেন, সেদিনই ওর চেহারা দেখে রোগের কারণ ধরে ফেলেছিলাম। সব কিছু পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছি—রোগটি সিফিলিস।’

হায়দার ভাবল, ‘সিফিলিসরূপী কাল সাপ আমার দেহে ধীরে ধীরে ফণা তুলে দাঁড়িয়েছে। তারপর সেই কাল সাপ দেহের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কঠিন প্যাঁচে জড়িয়ে ধরে আজ তার মস্তিষ্কে ছোবল মেরেছে।’


সিফিলিস ধরেই ডাক্তাররা আমার চিকিৎসা শুরু করল। যদিও রোগটি সিফিলিস ছিল না বলে পরবর্তীকালে লন্ডন ও ভিয়েনার ডাক্তাররা নিশ্চিত হন।


সিফিলিস ধরেই ডাক্তাররা আমার চিকিৎসা শুরু করল। যদিও রোগটি সিফিলিস ছিল না বলে পরবর্তীকালে লন্ডন ও ভিয়েনার ডাক্তাররা নিশ্চিত হন। আমার পারিবারিক ডাক্তার অশোক বাগচী এবং ডি কে রায়, যারা বিদেশ থেকে উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে এসেছিল, তারাও নিশ্চিত করে বলেছে রোগটি মোটেও সিফিলিস নয়। সিফিলিস রোগীর চুল ও চোখের রং বদলে যায়। তাহলে সিফিলিসের মতো ভয়ংকর চিকিৎসা আমার উপরে প্রয়োগ করা হয়েছিল মূলত অনুমান করে। কারণ পৃথিবীতে এমন কোনো ডাক্তারের জন্ম হয় নি—যারা সর্বরোগ নির্ণয় ও সর্বরোগের চিকিৎসা না জানে। আমার ক্ষেত্রে যখন রোগটি ধরতে তারা অক্ষম ছিল, তারা ধরেই নিয়েছিল, আমি যেহেতু যৌবনে ইংরেজ রেজিমেন্টে কাজ করেছি, সেহেতু সেনা-প্রস্টিটিউশনে গমন করে থাকব—এটিই স্বাভাবিক। তাছাড়া কলের গানের আমলে আমার কাছে যত বালা ও বাইজি গান শিখতে এসেছিল—তাদের সাথেও আমার সম্পর্ক থেকে থাকতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে মানসিক অ্যাসাইলামের জন্ম অবদমিত যৌন-আকাঙ্ক্ষা থেকে। এমনকি লুম্বিনীপার্ক অ্যাসাইলামের প্রতিষ্ঠাতা মনোবিজ্ঞানী গিরীন্দ্রশেখর বসুও ফ্রয়েডের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তার চিঠি নিয়ে ভিয়েনায় ফ্রয়েডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ফলে এইসব ফ্রয়েডীয় ডাক্তারদের মাথায় আগেই সেক্সের চিন্তা হাজির থাকে।

আমার সিফিলিস হয়েছে এ কথা জানাজানি হওয়ার পর সবাই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। যদিও এতদিনও তারা কোনো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় নি। তবু এবার একটা নৈতিক কারণ খুঁজে পেল—আমি যত বড় কবিই হই না কেন, যে অবৈধ নারী-গমন করে, আর যাই হোক তাকে সমর্থন করা যায় না। সময়ের পরে জন্মগ্রহণ না করলে আমায় হয়তো তারা পাথর মেরেই হত্যা করত। প্রতিদিন বাবুরা তাদের চোখের সামনে ছোকড়া নিয়ে ঘুরছে। রাতে বাইজি নাচাচ্ছে। তাদের যারা শাসন করছে সেই ইংরেজের অধিকাংশ তাদের নিজেদের মেয়ে মানুষ সাথে আনে নি। সাথে নিয়ে এসেছে সিফিলিস ও গনোরিয়া। ইংরেজ আসার আগে এদেশে এই ভয়ংকর যৌনরোগের প্রাদুর্ভাব হয় নি। যদি হয়েও থাকে, আমার জেল-জীবনে ইংরেজ পুলিশ প্রতিহিংসাবশত আমার অনশনকালে ইনজেকশন পুশ করে আমার রক্তশিরায় এই রোগের বীজ ঢুকিয়ে দিতে পারে। ভারতবর্ষের কোনো হিন্দু রাজা বা মুসলিম বাদশার হেরেম বা জেনানা-মহলে হাজার হাজার মেয়েমানুষ গমনের অপেক্ষায় ছিল না। ছোঁয়াছুঁয়ির দোষে একজন আরেকজনকে হত্যা করছে। ঈশ্বরের নামে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে হত্যা করছে। হিন্দুর ঈশ্বর মুসলমানের ঈশ্বরকে হত্যা করছে, শিখ ঈশ্বর জৈন ঈশ্বরকে হত্যা করছে। বৌদ্ধ নিরীশ্বর শান্তির নামে হত্যা করছে। গরিবের অর্থ লুণ্ঠন করছে, নারী পাচার করছে, শিশু পাচার করছে, খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে, ময়লার ভাগাড় থেকে একটি মুদ্রা তুলে চেটে পরিষ্কার করছে—তাতে কোনো অন্যায় নেই। অন্যায় শুধু নারী-অঙ্গের সঙ্গে পুরুষ-অঙ্গের স্পর্শে। সে স্পর্শ রাতের অন্ধকারে ব্রাহ্মণের সঙ্গে শূদ্র বারবণিতার হলে সমস্যা নেই, মৌলবী সাহেবের সঙ্গে শূদ্রাণীর হলেও সমস্যা নেই। সবাই তার মস্তিষ্কে সিফিলিস বহন ক’রে অন্যের সিফিলিস খোঁজ করছে।

পাপ করিয়াছ বলিয়া কি নাই পুণ্যেরও অধিকার? শত পাপ করি হয় নি ক্ষুণ্ন দেবত্ব দেবতার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *