মজিদ মাহমুদের উপন্যাস ও কিছু মুক্তচিন্তন

জ্যোর্তিময় দাশ

সংস্কৃতি মনস্ক মজিদ মাহমুদ (জন্ম: এপ্রিল ১৯৬৬) নামক মানুষটির প্রারম্ভিক পরিচয় দিতে হলে বলা যায় তিনি সম্প্রতি তাঁর যাপন-যাত্রায় একান্নটি বসন্ত অতিক্রান্ত করেছেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে আর একটু বিশদ পরিচয় দেবার ক্ষেত্রে বলা যায় যে, এই একান্ন বসন্ত ঋতুর পরিক্রমার পর্বকালের মধ্যে প্রায় তিন দশককাল তিনি সাহিত্য সৃজনে মগ্ন তাপস জীবন কাটিয়েছেন। এই সৃজনকালখণ্ডে তাঁর ঔরসজাত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ত্রিশ অতিক্রান্ত। যার মধ্যে রয়েছে প্রায় একডজনের মতো কাব্যগ্রন্থ এবং গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ও অন্য সম্পাদিত সংকলন আঠারোটি। যথেষ্ট ঊর্বর তাঁর সৃজনশীলতা।

অতএব অক্ষরপ্রেমিক মজিদ মাহমুদ সম্পর্কে তৃতীয় পর্যায়ে বলা যায় তিনি মূলত একজন ধীমান কবি এবং সেই সঙ্গে গবেষক, সম্পাদক ও বিদগ্ধ প্রাবন্ধিক। বিদগ্ধ বিশেষণটি আচমকা কলমচ্যুত কোনও শব্দ ব্যবহার নয়, কারণ তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর।বিদগ্ধ আরও এই কারণে, কারণ তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থের তালিকায় রয়েছে  ভাষার আধিপত্য ও বিবিধ প্রবন্ধ (২০০৩), উত্তর-উপনিবেশ সাহিত্য ও অন্যান্য (২০০৯), এবং সাহিত্যচিন্তা ও বিকল্পভাবনা’র (২০১০) মতো চিন্তন-মননের বই। বইয়ের শিরোনাম থেকেই বিষয়বস্তুও জটিলতা ও সারমর্ম বোঝা যায়।

কবি প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদ সম্পর্কে চতুর্থ পর্যায়ে বলা যায় যে, উনিশ বিশ বয়সে (১৯৮৫) তিনি কিশোর কবিতা লিখে আত্মপ্রকাশ করলেও কথা সাহিত্যিক হিসেবে সৃজনশীল সাহিত্যে পদক্ষেপ রেখেছিলেন মাকড়সা ও রজনীগন্ধা’ (১৯৮৬) গল্পগ্রন্থের মাধ্যমে। তখন তাঁর বয়স মাত্র কুড়ি বছর। পরবর্তী বাকী তিরিশ বছর নিরবিচ্ছিন্ন ধারায়  এসেছে পরিণতমনস্ক পাঠকদের জন্য একের পর এক কাব্যগ্রন্থ এবং গবেষণামূলক প্রবন্ধ গ্রন্থ। অথচ আমাদের এই নিবন্ধের আলোচনার বিষয় ঔপন্যাসিক মজিদ মাহমুদ প্রসঙ্গে। যেটি তাঁর প্রায় যৌবনোত্তর অর্ধশতাব্দী বয়সের ভালোবাসার সন্তান। এই শেষ মন্তব্যটি অবশ্যই অনুমান ভিত্তিক প্রক্ষেপণ।

সুবিদপাঠক, এই নাতিদীর্ঘ গৌর চন্দ্রিকার প্রয়োজন এই কারণে যে আমরা কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদকে যতটা চিনি এবং নানাবিধ স্মারকগ্রন্থের বিবিধ লেখাপত্র থেকে তাঁর কাব্যমনন এবং প্রবন্ধ চেতনার সম্বন্ধে যতটা ওয়াকিবহাল, তাঁর উপন্যাস সম্পর্কে সে হিসেবে প্রায় কিছু জানি না। আমাদের সময়’ পত্রিকার ঈদ সংখ্যা: ২০১৫-তে মজিদ মাহমুদের প্রথম উপন্যাস “ বেথেলহেমের পথে পথে’ প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে জানা যাবে উপন্যাসটির রচনাকাল অথাৎ উপন্যাসটি লেখকের প্রাথমিক পর্বের রচনা নাকি তাঁর বর্তমান পরিণত বয়সের চিরন্তন ফসল। এই তথ্য উপন্যাস আলোচনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অথচ এই প্রয়োজনীয় তথ্যটি পত্রিকার প্রকাশ থেকে জানা যায় না। সে ক্ষেত্রে এই আলোচনার প্রেক্ষিতটি পারম্পার্যহীন হলেও সম্ভবত অযৌক্তিক হবে না। আমরা আলোচ্য উপন্যাসের ব্যাপ্তির দিগন্ত থেকে ধরেই নিয়েছি এটি তাঁর পরিণত বয়সের রচনা।

বেথেলহেমের পথে পথে’ উপন্যাসের আপাতদৃষ্টিতে কোন নিদিষ্ট কাহিনি নির্ভর বিষয়বস্তু, যাকে ইংরেজিতে আমরা থিম বলি, কিছু নেই। রোম্যান্টিক উপন্যাস হলে আমরা পেতাম বা পেতে পারতাম বিবাহ পূর্ব প্রেমের উন্মাদনা যা প্লেটনিক অথবা লক্ষণরেখার অতিক্রমকারী অনৈতিক, অতঃপর বিবাহোত্তর সমাজ স্বীকৃত উন্মাদ দৈহিক  এবং মনস্তত্ত্বের কোনও সংজ্ঞা। রহস্য কাহিনি হলে রহস্যেও ক্রমিক বিন্যাস, চুরি খুন অ্যাডভেঞ্চার ও রোমাঞ্চকর নানান পরিস্থিতি ছড়ানো সুতো একসময় গুটিয়ে এসে রহস্যের সমাধান বা খুনি-অপরাধীকে সনাক্তকরণ, যা কিনা পাঠকরা সবিস্ময়ে উপলব্ধি করেন যে আপাত নিরীহদমন চরিত্রটিই প্রকৃত অপরাধী। ইতিহাসভিত্তিক কাহিনিতে ইতিহাসের সঙ্গে লেখকের কল্পনার মিশেলে এক পরাবাস্তব জগতের দেশে পাঠককে হাতছানি দিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টার ক্লান্তিকর ভূমিকা থাকে।

মজিদ মাহমুদ এই চেনা ছকের বাইরে পদক্ষেপ রেখেছেন বলেই তাঁর উপন্যাসে একটি কাহিনির বদলে অনেক উপ-কাহিনি এসে ভিড় করেছে, অনেক সংস্কার কুসংস্কারের দ্বন্দ্ব, সেই সঙ্গে পুরাণ ও মিথের সমাবেশÑ ফলে বেথেলহেমের পথে পথে’ উপন্যাসে উপস্থাপিত কাহিনিটি বহুকৌণিক এবং বহুমাত্রিক স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। উপন্যাসের শুরু এইভাবে :

আজ বিলু ওরফে বিলকিসের দুনিয়া কাঁপানো ভয়ঙ্কর সেইদিন। ভয়ে ভয়ে ছিল, বেইজিংয়েই বুঝি হয়ে যাবে। এখন যদিও কষ্ট হয় না তবু বড্ড বিরক্ত লাগে। এই অদ্ভুত নিয়মটি কেবল মানুষের মেয়েদের জন্য। বিলু ভাবে সৃষ্টির কী অসীম খামখেয়ালি। মানুষের জন্য সবকিছুতেই প্রকৃতি একটু কঠিন করে দিয়েছে। আর কোন প্রাণিকে প্রকৃতি এমন দুর্বল করে সৃষ্টি করেনি। চার পায়ের পরিবর্তে তাকে কিভাবে সতর্কতার সঙ্গে দুপায়ের ওপর ভর দিয়ে চলতে হয়।’

মাসের একটি নিদিষ্ট সময়ে যৌবনবতী নারীদের কয়েকটি দিন কিছুটা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করতে হয়। স্ত্রীলোকের সেই ঋতুবতী হওয়ার শাশ^ত রীতিটিই এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয়ভাবনা। ঋতুবতী বাহ্যিক রক্তক্ষরণের অস্বস্তির পেছনে প্রকৃতির সৃষ্টিতত্ত্বের এক অলৌকিক সংজ্ঞা লুকিয়ে থাকেÑ এই ঋতুই এক কিশোরীর যৌবনময়ী হয়ে ওঠার স্বীকৃতি বহন করে, সে তখন নারী জীবনের চরম সার্থকতার সোপানে পা রাখে, সে সন্তানধারণের উপযুক্ত বলে প্রমাণিত হয়Ñ সেই ঋতুময়ী নারী রক্ষা করে প্রকৃতির সৃষ্টিচক্র, জীবন থেকে জীবনের হাত ধরে মানুষ প্রগতির এগিয়ে যায়। নারী রজঃস্বলা না হলে সৃষ্টির পথ রুদ্ধ হয়ে যেত। নবাগত শিশুর কলকাকলির বদলে পৃথিবী ভরে উঠত জ¦রগ্রস্ত বৃদ্ধদের আর্তনাদেÑ আর কালচক্রের বিবর্তনে সেই আর্তনাদে একসময় মুছে গিয়ে পৃথিবী মানবশূন্য হয়ে কেবল কীটপতঙ্গ ও পশুর আবাসস্থল হয়ে যেত।

এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে মজিদ আমাদের অসংখ্য বিকল্প পরিস্থিতির সম্মুখে এনে দাঁড় করিয়েছেন। সঠিক সময়ে গুরুজন স্থানীয়রা কোনো মহিলা কিশোরীকে সমুচিতভাবে সচেতন না করলে বয়ঃসন্ধিক্ষণের এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি তার শরীরে ও মনে কী আলোড়ন ও ভীতির সৃষ্টি করে, এবং সেই বীতি অশিক্ষিত নিরক্ষর মননে কী ভয়াবহ কুসংস্কারের জন্ম দেয় আর সেই পরিস্থিতির সুযোগে ততোধিক অজ্ঞানী গুণিন ওঝারা শরীরে অসৎ ভূত প্রেতের অবস্থানের কথা বলে উপার্জন করে অনৈতিক উপায়ে, যার ফলে কিশোরীর চরম ক্ষতি হতে পারে, সে দিকেও পাঠককে সচেতন করেছেন লেখক।

বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। ভাষা ব্যবহারে একটুকু সংযমের বিচ্যুতি ঘটলে লেখাটির প্রকৃত উদ্দেশ্য নষ্ট হয়ে উপন্যাসটি বটতলার তৃতীয় শ্রেণির উত্তেজনার উদ্দীপক অপাঠ্য রচনা হয়ে যেতে পারত। কিন্তু লেখককে ধন্যবাদ দিতে হয়, কারণ তিনি বিদগ্ধ সচেতনতায় বিষয়টির বহুমাত্রিক দিকটি ফুটিয়ে তুলেছেন। লেখকের নিজস্ব বর্ণনার ফিরে আসি :

বিলুর জীবনে এই ঘটনাটির শুরু একটু অন্যভাবে। প্রথম শুরুটা ছিল খুবই আকস্মিক। কিছু বুঝে ওঠার আগেই, মা খালা কিংবা মুরুব্বি গোছের কোন বয়স্ক মহিলা সতর্ক করে দেয়ার আগেই, বয়ঃসন্ধিক্ষণের ভেদরেখা অতিক্রম করে তার শৈশব যৌবনে প্রবেশ করেছিল। একটি লিঙ্গরেখার বাইরেও যে নারী শরীর আলাদা তখন থেকে বিলু তা বুঝতে শিখেছিল। সে এও বুঝেছিল যে-সব ছেলে বন্ধুর সঙ্গে সে এতদিন বেড়ে উঠেছিল, তারা একই সঙ্গে তার আনন্দের ও বেদনার কারণ’।

সুন্দর সংযত একটি বর্ণনার মধ্যে দিয়ে এক কিশোরীর নারী হয়ে ওঠার চমৎকার বিবরণ পেশ করলেন লেখক। মজিদ প্রাথমিকভাবে একজন কবি বলে তাঁর উপন্যাসের ভাষার বারবার পাঠক এক কাব্যময়তার সুর খুঁজে পান। নারীর এই পরিবর্তনের কথা প্রসঙ্গে এসেছে প্রায় সঙ্গতভাবেই, কুমারী মাতার প্রসঙ্গও। আর কুমারী মাতার কথায় যে অপরাধবোধের চিত্র সচরাচর সমাজের মানসপটে ভেসে ওঠে তাকে লেখক যিশু-মাতা মেরীর প্রসঙ্গ তুলে চমৎকার পবিত্রতার পরিবেশে উন্নীত করেছেন। বিলুর জবানীতে আমরা সে কথা জানতে পারি :

তার বড় ফুপুর বাড়িতে এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছিল। আকলিমা নামে তাদের একটি কাজের মেয়ে ছিল। বয়স তের/চৌদ্দ বছরের বেশি হবে না। দেখলে আরও কম মনে হয়। আকলিমা কেবলই বড়দের পরিত্যক্ত সালোয়ার কামিজ পড়তে শুরু করেছে। তার আগেই আকলিমার পেটে মধ্যে একটি মানব শিশু বড় হচ্ছিল। আর বাচ্চাটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারেনি আকলিমা একজন চোরাই গর্ভবতী। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য এবং এখনো সে বিষ্ময় এতটুকু ম্লান হয়নি। কারণ এখনো আকলিমা তার আগের কথাতে অটল যে, সে জানে না এ সন্তান তার পেটের মধ্যে কি করে এলো। অকথ্য যন্ত্রণা ও নির্যাতন সইতে হয়েছিল আকলিমাকে।… যদিও বিলু কুমারী মাতা মেরির গল্প জানত; আকলিমা জানতো না; জানলে বলতে পারতো, এ শিশু তাকে দান করেছে ঈশ^র, তিনি ছাড়া কার ক্ষমতা আছে গর্ভধারণের। ইশা আলাইহের সাল্লামের মা মরিয়ম ঈশ্বরের পবিত্র আত্মা দ্বারা গর্ভবতী হয়েছিলেন’।

নারী শরীরের এই রক্তক্ষরণকে কেন্দ্র করে এসেছে বঙ্গ প্রসঙ্গ, এসেছে বাল্যবিবাহ কথা, গৌরীদান প্রথা, উল্লিখিত হয়েছে কুলীন ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহ আচার, বৃদ্ধের তরুণী বিবাহ এবং অন্তর্জলি যাত্রার মতো অযৌক্তিক প্রক্রিয়া । যেহেতু লেখক নিজে রবীন্দ্র গবেষক তাই বাল্যবিবাহ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথের নিজের বিবাহ প্রসঙ্গ। কবি যথাথভাবে উল্লেখ করেছেন কবিগুরু যখন ২৩ বছর বয়সে বিবাহ করেছিলেন তখন তাঁর স্ত্রী ভবতারিণী দেবী ছিলেন ৯ বছরের এক কিশোরী কন্যা। ভবতারিণী মা হয়েছিলন চৌদ্দ বছর বয়সে, উপন্যাসে সে কথারও নথি পেশ করেছেন। আসলে নারী জীবনে এই একটি বিশেষ শারীরিক প্রকৃতিগত প্রেক্ষিত নিয়ে মজিদ মাহমুদ এমন এক বিস্তৃত আলেখ্য উপস্থাপন করেছেন যে সেখানে রবীন্দ্রনাথের পিরালি ব্রাহ্মণ সমাজ যে ব্রাহ্মণকুলে ব্রাত্য এবং কোনো এক পুরুষে তাঁরা মুসলমানদের সঙ্গে এক আসনে অনুগ্রহণের পঙক্তিভোজনে বসেছিলেন বলে তাঁরা পতিত হয়েছিলেন যে কথাও পাঠক জানতে পারে। মজিদ চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন কবির শেষের কবিতা’র প্রসঙ্গও। ঋতুমতী নারীর এই বাধ্যবাধকতার মাসিক ব্যাপারটির বারবার নানান পরিপ্রেক্ষিতে মজিদ অসাধারণ দার্শনিক ব্যাখ্যা করেছেন প্রতীকী উপমান ও উপমিতির মাধ্যমে। তার একটি উদাহরণ এই ধরনের :

বিলু মেয়েদের এই পিরিয়ডকে চাঁদের কলার সঙ্গে তুলনা করে থাকে। চাঁদকে যেমন নতুন করে পূর্ণ হবার জন্য ক্ষয়ে যেতে হয়; মেয়েদের শরীরও ঠিক তেমনি। …এই অপ্রয়োজনীয় রক্ত কণিকাগুলো, মরা কোষগুলোর নিজের জন্য প্রয়োজন নেই। আবার না হলে জীবন শুকিয়ে যায়। মরা নদীর মতো কেউ আর তাতে অবগাহন করে না। মৃতসমুদ্রের মতো জোছনার স্পর্শে সেখানে আর জোয়ার আসে না। শরীরে এ এক বাঞ্ছিত অত্যাচার। যতদিন শরীরে জোয়ার-ভাটা আছে, শরীর ততদিন জীবিত। শরীর ততদিন অন্য শরীরকে ধারণ করতে সক্ষম।’

ঔপন্যাসিক মহাকবি কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ এপিক কাব্যগ্রন্থের প্রসঙ্গে আলোচনা করতে করতে সুচতুরভাবে বতমান সময়ের রাজনৈতিক একনায়কতন্ত্রবাদকে পরোক্ষে একহাত নিয়েছেন; স্বৈরতন্ত্রের কাছে নাগরিকের অসহায়তার সুন্দর আলেখ্য দেখতে পাই আমরা :

‘রাজা দুষ্মন্ত মৃগয়ায় এসে একটি উদ্ভিন্না মায়াবী হরিণের পিছে দৌঁড়াতে গিয়ে বনের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেন। কাণ¦মুণির আশ্রমের কাছে এক অনন্য সুন্দর আশ্রম বালিকা দর্শনে তার হৃদয়ে কৈবল্য উপস্থিত হয়। রাজার বৈকল্য উপশমে রাজ্যের সর্বত্র রয়েছে অনুকুল আইন। আইন না থাকলেও কিছু নয়। রাজা যা করেন তা-ই আইনের অধীন; রাজা যা বলেন তা-ই আইন। এটি পাঁচ হাজার বছর আগে যেমন সত্য ছিল, আজও তা ব্যতিক্রম নয়। রাজার নয়ন পথে কোনো অবিবাহিত তরুণী উদিত হলে, রাজার মাসন-উদ্গত হলে সেই তরুণীকে তৎক্ষণাৎ রাজা অধিকারের মধ্যে আনতে পারতেনÑ এ ধরনের বিয়েকে রাজা দুষ্মন্তের আমলে বলা হতো গান্ধর্ব বিবাহ।’

সাহিত্যিকমাত্রেই সমাজ সচেতন। তাঁর আশপাশের পরিচিত জগতে কী ঘটে চলেছে সে সম্পর্কে তিনি যে সম্যক অধিগত তার প্রমাণ পাই এই উপন্যাসে বারবার। ইদানীং নারী ধর্ষণের ঘটনা সংবাদপত্রের পাতায় ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিন উল্লিখিত হয়। লেখক ধর্ষণের একটি বাস্তব ব্যাখ্যা দিয়েছেন অশিক্ষিত দিদিমার জীবন দর্শন থেকে :

বিলুও তার দাদির কাছে জানতে চেয়েছিল, দাদি ধর্ষণ কি? দাদি বলেছিল, সাপের বিষথলির মতো পুরুষের মাথায় বিষথলি থাকে; বিষথলি পূর্ণ হয়ে গেলে সেটি খালি না করা পর্যন্ত সাপ পাগলের মতো ঘুরতে থাকে, কোনো মানুষ দেখলে সাপের রক্ত গরম হয়ে ওঠে, মানুষের শরীরে বিষদাঁতের ফাঁক দিয়ে তা ফেলে দিতে চেষ্টা করে। পুরুষ মানুষও ঠিক একই রকমÑ একা অপরিচিত মেয়ে মানুষকে ঘোরাঘুরি করতে দেখলে, অসতর্ক মুহূর্তে তার শরীরে বিষ দাঁত ঢুকিয়ে বিষ ফেলে দিতে চেষ্টা করে।’

ধর্ষণ প্রসঙ্গে অবধারিতভাবে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মেয়েদের প্রতি পাক সৈনিকদের অমানবিক অত্যাচারের কাহিনি। সে এক কলঙ্ক ইতিহাসÑ বারবার তা ধিক্কৃত হওয়া প্রয়োজন। সেই পাশবিক অত্যাচারের কথা মজিদ তাঁর মানবিক লেখনিতে বড়ো ব্যথার সাথে উচ্চারণ করেছেন। মলিনা নামে একটি অল্পবয়সী তরুণী নিখোঁজ হয়ে যায়। পরে জানা যায় যে, গ্রামে একটি হত্যার ঘটনায় বিশেষ বাহিনি যে ক্যাম্প বসেছিল, সন্ধ্যার পর তারা নিরীহ কিশোরীকে তুলে নিয়ে দিনের পর দিন গণধর্ষণ করে। হঠাৎ একদিন ক্যাম্পে বড় অফিসারের আগমনের সূত্রে মলিনাকে তারা ছেড়ে দেয় :

…‘মলিনা ফিরে এসে নানির কাছে সব বলেছিল। নানি জানতে চেয়েছিল, ওরা মলিনার বিশেষ জায়গা ছাড়া অন্য কোথাও মারেনি তো। যুদ্ধের বছরে পাক মিলিটারিরা মেয়েদের পেলে কি অত্যাচারই না করতো। কেবল তাদের ক্যাম্পে ধরে রেখে দিনের পর দিন পাশবিক নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হতো না; অনেক বিকৃতকামীরা মেয়েদের গোপনাঙ্গে বেয়োনেট ঢুকিয়ে দিতো, স্তন কেটে নিতো। মানবিকতার এই সব অপমান মেয়েদের আদিকাল থেকেই সইতে হয়েছে। পুরুষ যুদ্ধ ক্ষেত্রে মারা গেছে সত্য; কিন্তু সেই মৃত্যুর মধ্যে অপমান ছিল না। মেয়েদের বেঁচে থাকতে হয়েছে কেবল পুরুষের ময়লা সাফ করার জন্য।’

ধর্ষিতা অবিবাহিত (মলিনার মত) কিশোরীরা তাদের কুমারী জীবনের সন্তানদের নিয়ে সমাজে বসবাস করার অধিকার পায়নি। সামাজিক বিচার ব্যবস্থার চাপে তাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে অথবা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার পথে অপমানের জ্বালা শেষ করতে হয়েছে। কারণ পিতৃপরিচয়হীন সন্তানের দায়িত্ব কোন গ্রাম গ্রহণ করতে রাজি হয় না। তাই তারা তাদের সন্তানকে বেথেলহেমের পথে মুক্তি দিতে চেয়েছিল। অসংখ্য ঈশ^রের পুত্র প্রতিদিন ঈশ^রের নামে যিশুর মতো নিজেকে বলি দিয়ে আসছে।

মজিদ মাহমুদ তাঁর প্রথম উপন্যাসে নারীর শারীরিক অক্ষমতাকে এক বিশাল ক্যানভাসে বহু বিচিত্র রঙের বর্ণলী  চিত্রপটে অসাধারণ নৈপুণ্যে ভাস্বর করে তুলেছেন। এই কাহিনির এখানেই শেষ হবার কথা নয়, আমরা হয়তো পরবর্তীতে আরও বৃহৎ প্রেক্ষাপটে এই প্রসঙ্গের অন্যতম রূপরেখার পরিচয় পাবোÑ সেই আশায় পাঠক অপেক্ষারত থাকবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *