নিদানের কালে পূর্বসূরীদের পদাঙ্ক তালাশ করতে হয়, তাতে কখনো কখনো সঠিক পথের দিশা পাওয়া যায়। প্রিয় সোমেন চন্দ, নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আপনি যে পদচ্ছাপ রেখে গেছেন কালের ধুলোয়, সে পদরেখা আমাদের পথ দেখাচ্ছে নির্ভুল মানচিত্রের মতো; কিন্তু কী দুর্দৈব! আমাদের ঠুলিআঁটা চোখ কখনো খুঁজে পায় না আপনার সে প্রিয় পদচিহ্ন।
মাত্র বাইশ বছরের এক অপরিসর জীবন পেয়েছিলেন আপনি কিন্তু শ্রমে ও সাধনায় সে জীবনের ব্যাপ্তি ছড়িয়েছেন অনন্ত অব্দি। বোধকরি এ ভূবাংলায় যত দিন শোষণ ও তোষণ থাকবে, বিভেদ ও বিভাজন থাকবে, মূঢ়তা ও শঠতা থাকবে, রাজনীতি ও জোচ্চুরি থাকবে তত দিন আপনার প্রয়োজনীয়তা ফুরানোর নয়।
উনিশ শ কুড়ি সালের চব্বিশ মে জন্ম নিয়েই আপনি দেখেছিলেন ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি। চারদিকে অন্যায় অসাম্য। রাজনীতির নামে চলছে জোচ্চুরি আর হরিলুট। যে দেশ হওয়ার কথা ছিল গরিবের, নিঃস্বের, ফকিরের-নির্বিশেষে সবার, সেই দেশ ক্রমেই দখল হয়ে যাচ্ছে বড়লাটদের হাতে। একটুখানি বোঝার মতো বয়স যখন হল আপনার, তখনই বেছে নিলেন প্রতিরোধের পথ। হাতে তুলে নিলেন কলম আর জীবনকে সঁপে দিলেন বিপ্লবের বেদিমূলে।
উনিশ শ পঁয়ত্রিশ সাল। আপনার বয়স মাত্র পনেরো। চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্বজুড়ে চলছে হিটলারের তাণ্ডবলীলা। আপনি ঢাকার প্রগতিশীল সব লেখককে একত্র করে গঠন করলেন ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’। কে না জানে, এই সংগঠন সেকালে ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে কী অসামান্য ভূমিকাই না রেখেছিল। তখন ঢাকার কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা ‘প্রগতি পাঠাগার’ নামে পাঠচক্র পরিচালনা করতেন। সেই পাঠাগার পরিচালনার দায়িত্বও অবধারিতভাবে উঠে এল আপনার কাঁধে। এর বছর কয়েক বাদে ঢাকা রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের পদ দেওয়া হয় আপনাকে। আপনি হাসিমুখে সেই দায়িত্বও পালন করেছেন, অর্জন করেছেন আশাতীত জনপ্রিয়তা। ভাবলে বিস্ময় জাগে, তখন আপনার বয়স মাত্র কুড়ি!
প্রিয় সোমেন চন্দ, আপনি পড়ালেখাতেও ছিলেন ঈর্ষণীয় মেধাবী। ডাক্তারিবিদ্যা পড়তে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন বটে কিন্তু আর্থিক অনটন আর ব্রংকাইটিস রোগের কারণে পড়াটা শেষ করতে পারেননি। তাতে অবশ্য খুব একটা ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি আপনার। টিএস এলিয়ট, অডেন, স্টিফেন, স্পেন্ডার, ভার্জিনিয়া উলফ, হাক্সলি, ইএম ফস্টার, হেমিংওয়ে, ম্যাক্সিম গোর্কি, আঁদ্রে জিদ, র্যালফ ফকস, ক্রিস্টোফার কডওয়েল, আপটন সিনক্লোয়ার প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য লেখকদের বই পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন আপনি। আপনার পড়ালেখার পরিধি হয়ে পড়েছিল বিস্তৃত ও ব্যাপক। আপনি কার্ল মার্ক্সের ‘ডাস ক্যাপিট্যাল’ যেমন আয়ত্ত করেছেন, তেমনি গভীর অভিনিবেশে পড়েছেন যোসেফ ম্যাজিনির ‘ডিউটিজ অব ম্যান’, রোঁমা রোঁলার ‘আই উইল নট রেস্ট’, র্যালফ ফকসের ‘দ্য নভেল অ্যান্ড দ্য পিপল’ কিংবা ক্রিস্টোফার কডওয়েলের ‘ইলিউশন অ্যান্ড রিয়েলিটি’।
আবারও বলি, মাত্র বাইশ বছরের আয়ুষ্কাল পেয়েছিলেন আপনি। এর মধ্যেই লিখেছেন ছাব্বিশটি গল্প, একটি উপন্যাস, দুটি নাটক ও তিনটি কবিতা। এই অঙ্গুলিমেয় সৃজনকর্মের মধ্যেই ধরা আছে আপনার জীবন ও দর্শন। তিরিশের দশকে প্রতিশীল সাহিত্যান্দোলনে স্বতন্ত্র ও ব্যতিক্রমী সত্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন আপনি। আপনার সব কর্মের পেছনেই একমাত্র স্বপ্ন ছিল কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষের বিজয় সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করা।
কিন্তু আপনার সংগ্রাম গাত্রদাহের কারণ হয় তৎকালীন ফ্যাসিস্টদের। তাই উনিশ শ বিয়াল্লিশ সালের ৮ মার্চ ঢাকার সূত্রাপুরে আয়োজিত ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে আপনি যখন একটি মিছিল নিয়ে লক্ষ্মীবাজারের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন উগ্র ফ্যাসিবাদী দুর্বৃত্তরা অতর্কিতে ছুরিকাঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করে আপনাকে!
আপনার মৃত্যু আমাদের সত্যিই অপরাধী করে দেয়, প্রিয় সোমেন চন্দ! যে আদর্শ আর স্বপ্নকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলেছেন আপনি, সেই আদর্শ আজও অধরা রয়ে গেছে এ ভূবাংলায়। যে বৈষম্যহীন সমাজ দেখবেন বলে রাতের পর রাত নির্ঘুম লিখে গেছেন আদর্শলালিত শিল্প-সাহিত্য, সেই সোনালি ভোর আজও দেখেনি বাংলার আকাশ। যে শোষণহীন মানবসমাজের বাসিন্দা হবেন বলে দিনের পর দিন কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ জনতাকে সংগঠিত করেছেন, সেই আরাধ্য মানবসমাজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
প্রিয় সোমনে চন্দ, যে নিকশ কালো আঁধারের মাঝে চৈতন্যের মশাল জ্বেলেছিলেন আপনি, তার চেয়েও অধিক তমশায় ঢেকে গেছে আজকের বাংলার চারপাশ; কিন্তু মশাল জ্বালানোর মতো কেউ নেই। বাংলার পথেপ্রান্তরে আজ কত শত কবি-সাহিত্যিক-গল্পকার-ঔপন্যাসিক, কিন্তু প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ গঠনের আহ্বান জানানোর মতো কেউ নেই। একটি দাঙ্গা কিংবা ইঁদুর লেখার মতো কলম কারও হাতে নেই!
তাই এই দুর্দিনে আপনাকে বড্ড বেশি দারকার, প্রিয় সোমেন চন্দ।

মারুফ ইসলামের জন্ম বগুড়ার নশরৎপুরে। এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশের শীর্ষ গণমাধ্যমগুলোতে গল্প, প্রবন্ধ, ফিচার, মতামত, বিশ্লেষণসহ বহুমাত্রিক লেখা লিখে চলেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, পাঠকের মন জয় করার জাদুকাঠিটি তাঁর হাতে আছে। গল্প বলেন চমৎকার ভঙ্গিতে। আর জীবনের যাবতীয় জটিল কথা বলেন খুব সহজে। তাঁর দেখার চোখটিও বেশ পরিপক্ক। তিনি গল্পের ভেতর দিয়ে দর্শনের কথা বলেন। জীবনের দর্শন, সমাজের দর্শন। আর বলেন মানবজীবনের গভীর উপলব্ধির কথা। তাঁর টানটান গদ্যে উঠে আসে অস্বস্তিকর সব জীবনসত্য।
এ পর্যন্ত লিখেছেন তিনটি গল্পের বই, একটি উপন্যাস, একটি অনুবাদ বই ও দুটি ই-বুক। এ ছাড়া পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন সহস্রাধিক গল্প, প্রবন্ধ, ফিচার, মতামত ও বিশ্লেষণ। তিনি পড়াশোনা করেছেন ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।