মজিদ মাহমুদ
হয়েছিল; রাষ্ট্র নাগরিকদের ভালোমন্দের ক্ষেত্রে ধর্মীয় কোনো ব্যবস্থাপত্র সামনে আনবে না। অবশ্য এর আগে এমন সব বিষয়ের তারা ফয়সালা করতে পেরেছিল, তাহলো এমন-বাইবেলের বাইরেও অভ্যন্তরীণ এবং দেশের বাইরে রফতানিযোগ্য বুদ্ধি ও যুক্তিভিত্তিক চিন্তাশীল উপাদান; যেমন পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে, কিংবা মানুষ বিবর্তনের ফল;-সাধারণ মানুষের কাছে যদিও এই সত্য প্রায় ধর্মের মেটাফোরের মতো, কারণ কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদি ছাড়াই সেগুলো তাদের মেনে নিতে হয়; এবং এমন সব বিষয় যা এখনো মীমাংসিত হয়নি, সত্যিই মানুষ বানরজাতীয় প্রাণী থেকে উদ্ভূত; নাকি স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক পুরুষ ও নারীর গর্ভ থেকে তারা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীময়; এর সঙ্গে যদিও দুনিয়ায় বেঁচে থাকা জীবনের কিছু এসে যায় না, তবু যখন পৃথিবীর জীবনের কর্মের ওপর মৃত্যু-উত্তর অনন্ত জীবনের ভালো থাকা নির্ভর করে, তখন তো আর অনেকেই অল্প-দামে মরজীবনকে বিক্রি করতে চাইবে না; যেহেতু ধর্মে নির্দেশ আছে, কি ধরনের কর্ম-সম্পাদন করলে তারা কি ধরনের একটি অনন্ত আনন্দময় জীবন যাপন করতে পারবেন। যদিও ধর্মের অনেকগুলো অনুশীলন ব্যক্তিগতভাবে সম্পাদন করা যায়, আবার অনেকগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে; বিশেষ করে বর্তমান সময়ে এসে কেবল মুসলিম দুনিয়ায় নয়, খ্রিষ্টান দুনিয়াতেও গর্ভপাত, সমলিঙ্গের বিয়েসহ নানা ব্যক্তিগত অধিকার নিয়ে রাষ্ট্রকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে; এর বাইরে মুসলিম দুনিয়ায় আছে ব্যাংকিং ও সুদব্যবস্থা, মেয়েদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও মেয়েদের ড্রেসকোড নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক-এসবও রাষ্ট্রকে মোকাবেলা করতে হয়। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষকতা ও রাষ্ট্র একটি জটিল সম্পর্কের দ্বারা আবদ্ধ।
ভারত মহাদেশ যদিও ধর্মের দ্বারা বিভাজিত হয়েছিল; কিন্তু অচিরেই ধর্মনিরপেক্ষ একটি চরিত্র ধারনের চেষ্টা করে আসছিল; ভারতের ক্ষেত্রে তো ছিলই, নেহেরুর অব্যাহত প্রচেষ্টার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সারবস্তু অন্তত চিন্তা ও প্রচারে ছিল; পাকিস্তানের ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে না হলেও পাকিস্তানের প্রথম আইন বিষয়কমন্ত্রী যোগেন ম-লসহ দলিত নেতাদের পাকিস্তান সমর্থনের মধ্যে এই সত্য প্রমাণ করে, বাইরে ধর্মনিরপেক্ষ মোড়ক না থাকলেও রাষ্ট্রের মূলচরিত্র ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু পরিণামে এই যুক্তি দেয়া খুব কঠিন যে, পাকিস্তান ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ছিল; আর এ প্রমাণ করতে চাওয়া উদ্ভটও বটে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার বাইরে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এই দাবি জোরেসোরে ছিল যে, এতে নিম্নশ্রেণি হিন্দুরাও সুবিধা পাবে; কিন্তু পরিণামে কেবল হিন্দু নয়, বাঙালি মুসলমানরাও বঞ্চনার শিকার হন। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক চেতনার সীমাবদ্ধতাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে একটি উদারনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। নবগঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান যে চারটি মূলনীতির ওপর নির্মিত হয়েছিল তার অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষ নীতি আর প্রকৃতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এক নয়, কিংবা সম্ভব নয়, তা কিছু দিনের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে; প্রথমত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মমতের প্রতি প্রশ্রয় প্রদর্শন ছাড়া ভোটকেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়; ফলে অপর একটি আদর্শ দ্বারা নিগৃহীত না হওয়া পর্যন্ত চলমাল মূল্যবোধের সবটার সঙ্গেই কৌশলগত সম্পর্ক শাসককুলকে রেখে চলতে হয়। সুতরাং সংবিধান ধর্ম নিরপেক্ষ হওয়া সত্ত্বেও, এই মতের দাবিদার দলটিকেও এই ভেবে জনগণের সমীহ আদায় করতে হয় যে, তারা ইসলামের জন্য কতখানি করেছেন, কিংবা ইসলামি দেশগুলোর সঙ্গে কতখানি সম্পর্ক রক্ষা করে চলছেন, এসবই জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অকুণ্ঠ সম্মানবোধ, যদিও এসবই বহিঃসম্পর্কের ব্যাপার। রোমান সম্রাট কনস্ট্যানটাইন ধর্ম না মেনেও রাষ্ট্রীয়ভাবে খ্রিষ্টান ধর্মের স্বীকৃতিদানের মাধ্যমে মূলত জনগণের ইচ্ছের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের দ্বারা জনগণের ইচ্ছের দ্বারা রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার সম্মতি আদায় করে থাকেন।
ফলে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি জোর দেয়া হলেও পাকিস্তান আমলের অধর্মনিরপেক্ষতার চেয়ে আলাদাভাবে ক্রিয়া করেনি; বরং ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মীয় গোষ্ঠীর কাছে প্রতিপক্ষ হিসাবে হাজির হয়েছে, কেবল আলাদাভাবে স্বীকৃতি থাকার কারণে। এতদিন হিন্দু-মুসলমান দুটি আলাদা জাতি হিসাবে স্বীকৃত থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় পক্ষ বলে আলাদা কোনো গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল না; অথচ সেই অস্তিত্বই বড় হয়ে বিশাল ধর্মীয় পক্ষ হিসাবে রূপ লাভ করে; এবং স্বাধীনতার স্থপতি সপরিবারে নিহত হওয়ার পরে পঞ্চম সংশোধনির মাধ্যমে অকার্যকর তবু শোভন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটিরও অবসান ঘটানো হয়; এবং এটি করে জাতীয় সিম্বলের মতো ইসলামকে জাতীয় ধর্মের স্বীকৃত দেয়া হয়; এটি যদিও এমন কিছু নয়, একটি দোয়েল পাখিকে জাতীয় পাখি করার অর্থ এই নয় যে আর কোনো পাখির অস্তিত্ব দেশে নাই, কিংবা তাদের গুরুত্ব কম রয়েছে। তারপর শুক্রবারে সাপ্তাহিক ছুটি, যা ইসলামি পাকিস্তানে দরকার হয়নি; ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর অবাধ রাজনীতি করবার সুযোগ, এসবই সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু একটি প্রশ্ন তলিয়ে দেখা হয়নি যে, আধুনিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার সঙ্গে ধর্মীয় রাজনীতির কোনো সুযোগ আছে কিনা? এ দেশে সেক্যুলার হওয়ার পেছনে প্রধানত হিন্দু ও মুসলিম দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি অবৈরিপূর্ণ বসবাসের রাষ্ট্রীয় মনোবৃত্তি বোঝানো হলেও সংবিধানের আওতায় কোনো হিন্দু ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় না, যেমনটি জামায়াতে ইসলামী কিংবা অপরাপর মুসলিম দলের অস্তিত্ব রয়েছে; তাহলে এই প্রণোদনার পেছনে যে একটি ভোটের রাজনীতি রয়েছে এ কথা অস্বীকার করা যায় না। কারণ, এদেশে হিন্দুধর্মের কোনো রাজনৈতিক দল রাস্তায় নামলে যে ভোটের রাজনীতিতে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে, সেই বুদ্ধিটুকু তাদের ঘটে আছে; কিন্তু মুসলিম নামে দল গঠন করলে প্রাথমিকভাবে যেমন সকল মুসলমানকে দলভুক্ত ভেবে আনন্দ পাওয়া যায়, তেমনি আখেরে সম্ভবনাকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। অথচ ভারতে ঠিকই হিন্দু মৌলবাদি দলগুলো ক্ষমতার স্বাদ নিতে শুরু করেছে। এমনকি ভারতে কোনো হিন্দু ধর্মীয় গোষ্ঠী ক্ষমতায় থাকলে এ দেশের ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো সন্তোষ প্রকাশ করে থাকেন; এবং ইদানীং প্রায়ই লক্ষ করা যায়, দুটি ধর্মের বিশ্বাসগত চরম বৈরিতা সত্ত্বেও তারা ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা ধর্মহীন রাজনীতির চেয়ে শ্রেয় মনে করেন। এমনকি কেউ কারো অখ-তাকে আঘাত করতে চায় না; অথচ নিয়ম অনুসারে ইসলামি দলগুলোর প্রধানত কাজ করার কথা ছিল অমুসলিমদের মাঝে, তাদের হেদায়েত করার মাধ্যমে খোদার সন্তুষ্টি অর্জনের পথ প্রশস্ত হওয়ার কথা; কিন্তু মুসলিম দলগুলো কেবল মুসলমানদের মধ্যে কিংবা দলগুলোর মধ্যে নিজেদের সঙ্গে ফারাক তৈরির মাধ্যমে একটি আদর্শগত বৈরিতা তৈরি করছে। তাহলে দুটি দেশেই ধর্মীয় রাজনীতির সমান্তরালে যে বস্তুটি আসছে তাহলো, গণতন্ত্র ও সংখ্যাগুরুর সমর্থন লাভ। ধর্মীয় দল কিংবা ধর্ম আখেরে কোনো কাজে আসছে না, হয়তো তা বাইরে বা চেতনায় থেকে যাচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে ভারত একটি ভিন্ন ধর্ম-সহিষ্ণু রাষ্ট্র হলেও আধুনিক সেক্যুলার রাষ্ট্র-ধারণার আমলে তা রীতিমত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে; এমনকি ধর্মীয় উগ্রপন্থার জন্ম হচ্ছে, এটি যে ভালো তার পক্ষে মতামত গঠন হচ্ছে, এবং জনগণের সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার হচ্ছে। অথচ এই ভারতের রয়েছে হিন্দু ও মুসলিম দুটি বিপরীত মেরুর বাসিন্দাদের অন্তত এক হাজার বছরের বসবাসের অভিজ্ঞতা। দুটি ধর্মের মৌলিক শিক্ষার মধ্যে তীব্র বিরোধ থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তারা এতদিন ভালোভাবে বসবাস করে আসলেও, সাম্প্রতিক ধর্মনিরপেক্ষতার যুগে এমন সব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে; যা আগে কখনো হতে হয়নি। যদিও তাদের জানা থাকা উচিত-এই দুটি সম্প্রদায় চূড়ান্তভাবে কেউ কাউকে ধ্বংস করতে পারবে না; এমনকি তাদের বৈশিষ্ট্যেরও মৌলিক কোনো পরিবর্তন হবে না; বরং তারা এই সত্যটি উপলব্ধির মাধ্যমে ভারতীয় সমাজকে আরো এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে।
মুসলিম ও হিন্দু ধর্মের ঘাত-প্রতিঘাতের ফলে একদা ভারতীয় সমাজ লাভবান হয়েছে, তার চিন্তা, জ্ঞান ও সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে; এবং দুটি ধর্মই তার কৌলীন্য হারিয়ে একটি নতুন ধরনের চিন্তামতের জন্ম দিয়েছে। ভারতীয় বহুশ্বরবাদ মোকাবেলায় মুসলমানরা যেমন তাদের নির্ভেজাল একেশ্বরবাদ ছেড়ে পীর-সুফি-সাধু-সন্তসহ নানা মধ্যস্বত্বভোগীর প্রতি নির্ভরশীল হয়েছে, তেমনি হিন্দুদের মধ্যে মুসলমানদের বিশ্বাসের অনুরূপ শিখ-বৈষ্ণব-ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তন হয়েছে। সুফি-বাউল চিন্তার পাশাপাশি কবীর, নানক, দাদু, রামানন্দ বহু সমন্বয়বাদি সাধকের জন্ম হয়েছে; যাদের চিন্তা মূলত মধ্যযুগে ভারতীয় সমাজের সেক্যুলার ধর্মমত হিসাবে কাজ করেছিল। শুরুতে শিখ ধর্মের গুরুগৃহ সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল, এখনো আছে, কিন্তু শিখ আলাদা একটি পরিশুদ্ধ ধর্মে পরিণত হয়েছে; ঈশ্বরসেবক হওয়ার জন্য কোনো ধর্মীয় পরিচয়ের দরকার হয় না। অবশ্য সকল ধর্মের শুরুতে একটি উদার সর্বধর্মীয় বিষয় কাজ করে; ইসলামের আদিযুগে তা লক্ষ করা যায়, ইসলাম শুরুতে তার পূর্ববর্তী সকল ধর্মের স্বীকৃতি যেমন রয়েছে, তেমন মসজিদেও খ্রিষ্টান পাদ্রিদের উপাসনায়ও আপত্তি ছিল না। সকল নবীন ধর্ম হয়তো তার অস্তিত্বের সংকটে কিংবা অস্তিত্বশীল ধর্মগুলোর গোঁড়ামির বিরুদ্ধে একটি উদার চেতনা থেকে কাজ করেছিল; কিন্তু কালক্রমে সেই সব ধর্মের অনুসারিরা সেই চেতনা থেকে নিজেদের সরিয়ে এনে ধর্মীয় পরিশুদ্ধতা রক্ষার চেষ্টা করেন; যদিও নিত্য-নতুন চিন্তা ও গোষ্ঠী তাদের নিজেদের ধর্মমতের মধ্যেই ঘটতে থাকে; এবং তারা তাদের নিজেদের উপদলের সঙ্গে একটি আপসরফা করলেও অন্য ধর্মের মানুষদের সঙ্গে সেটা করতে আগ্রহী থাকে না। যদিও মুসলমানরা আজ অনেক দেশে আন্তঃধর্মীয় সংঘাতেও লিপ্ত রয়েছে। মুসলমানদের এই সংঘাতের পেছনে যদিও পশ্চিমা সেক্যুলার কান্ট্রিগুলোর অনেককে দায়ী করা হয়; তবু এটি তো সত্য মুসলমানদের দ্বারাই তাদের দুষ্কর্ম সাধিত হচ্ছে; কিছু পরিবার বা সামরিকপক্ষ নিজেদের ক্ষমতা টিকে থাকার জন্য অন্যদের ক্রীড়নক হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে; এর অনেকটাই ধর্মীয় মোড়কে সাধিত হচ্ছে।
ধর্মনিরপেক্ষতার চ্যালেঞ্জগুলো আজ প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ দেশগুলোকেও মোকাবেলা করতে হচ্ছে; খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবারের রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আমেরিকায় কোনো মুসলমান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে পারবে না; এটি তাদের সংবিধানের জন্যও সাংঘর্ষিক; তাদের আক্রমণের তীর ওবামার দিকে; যদিও ওবামা মুসলমান নন; তবে তার বাবা আফ্রিকান-মুসলমান ছিলেন, ওবামা তার মায়ের ধর্ম ক্রিশ্চিয়ানিটিকেই গ্রহণ করেছেন; এবং অদূর ভবিষ্যতেও আমেরিকায় কোনো মুসলমানের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না; তবু কেন রিপাবলিকানরা এই স্লোগান নিয়ে আসছেন? হয়তো আমেরিকান জনগণের মধ্যে একটি সাম্প্রদায়িক মানসিকতা রয়ে গেছে, বিশেষ করে মুসলিমবিদ্বেষী মানসিকতা; আর এটিই হয়তো রিপাবলিকানরা ক্যাশ করতে চাচ্ছেন, সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটের চেয়ে সংখ্যাগুরু খ্রিষ্টান ভোট তাদের জন্য বেশি জরুরি; এখন আর রাজনৈতিক উপাদান হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতা কাজে আসছে না। ইউরোপের দেশগুলোও এটি কমবেশি মোকাবেলা করছে। যদিও আমরা অনেকদিন ধরে ইউরোপীয় বস্তুচিন্তা ব্যবহার করে আসছি; তবু সঠিকভাবে তা ব্যবহার করার সুযোগ ঘটেনি। স্বাধীনতা-উত্তর একবারই সেই সুযোগ এসেছিল, কিন্তু এর বাস্তবতা রাজনৈতিক ক্ষমতার অনুকূলে নয় বলে প্রবর্তকগণই এর একটি জগাখিচুড়ি ব্যবহার করেছেন। একুশ শতকের সূচনাপর্বে বিশ্বব্যাপী তথাকথিত মুসলিম জঙ্গিবাদের প্রচারসর্বস্বতায় আরেকটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল; কিন্তু ক্ষমতা হারানোর ভয় থেকে তা গ্রহণ করা হয়নি; সংবিধান সংশোধন হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরে আসছে, সঙ্গে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হিসাবেও থাকছে; উলামাদের নিয়ে অঙ্গসংগঠনও করা হচ্ছে; ব্লগারদের উৎসাহ দেয়া হচ্ছে, আবার হত্যাকারীদের যুক্তি আছে বলেও মনে করা হচ্ছে; আজ পক্ষ-বিপক্ষ নির্ণয় করা বড্ড কঠিন হয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মের সম্পৃক্ততার এমন একটা গ্যাঁড়াকল রচিত হয়েছে, যা থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার জন্য রাষ্ট্রের যে সংস্কারগুলোর প্রয়োজন ছিল, তার একটি হতে পারতো মুসলিম পারিবারিক আইন; মেয়েদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও কার্যত কিছু করার ঝুঁকি সরকার নিতে রাজি নয়; অথচ আইয়ুবের ইসলামি পাকিস্তানি রাষ্ট্রেও এ আইনের যুগান্তকারি সংশোধন হয়েছিল, যা এখনো এ দেশের আইনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে, তার একটি মেয়েদের বিয়ের বয়স নির্ধারণ ও দাদার আগে পিতার মৃত্যু হলে নাতিদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার হওয়া। ইসলামের আইনের যদিও সারবস্তু ছিল, পিতার সম্পত্তিরই কেবল উত্তরাধিকার হওয়া যাবে, দাদার সম্পত্তির নয়; কিন্তু কোরানের উত্তরাধিকার আইন মোটেও কট্টর ব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, মানবিক চেতনাই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে; এবং এই আইনের মধ্যে এর সংস্কারের সূত্র নিহিত আছে; মেয়েদের সম্পত্তির ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা কোরানে রয়ে গেছে; কিন্তু ইসলামি আইন যে ইনসাফের ওপর ওপর প্রতিষ্ঠিত সেটি সঠিকভাবে দেখার জন্য কোনো যুগোপযোগী ব্যাখাকারি উলামা বা নেতা ঝুঁকি নিচ্ছে না; অথচ দেড় হাজার বছর আগে যে আইনটি হয়েছিল মেয়েদের সম্পত্তি পাইয়ে দেয়ার জন্য, সেই ধর্ম আজ মেয়েদের বঞ্চিত করার দোষারোপ নিয়েও কানে পানি দিচ্ছে না; এতে রাষ্ট্রেরও কিছু এসে যায় না, ‘যেমন আছ তেমন নাচ’ নীতিতে সবাই বিশ্বাসী। তবু সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ বস্তু এখনো দামি হিসাবে প্রতিপন্ন; বিশেষ করে সংখ্যালঘু ভোট টানার জন্য এর রয়েছে ধন্বন্তরিগুণ, যেমন বড় দুটি দলের নেতাকর্মীরা সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে একই রকম আচরণ ও মনোভাব পোষণ করেন, অন্তত সম্পত্তি বা স্বার্থের ব্যাপারে, তবু বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ হিন্দু ভোট আকর্ষণে এগিয়ে থাকে, কারণ অন্তত আইন ও চেতনাগতভাবে সংখ্যালঘুরা নিজেদের হীন ভাবেন না; অপরদিকে বিএনপি এটি বোঝাতে সক্ষম হয়নি যে নাগরিক হিসাবে এদেশে তাদের গুরুত্ব কম নয়। আপাতভাবে জামায়াতে ইসলামী দুর্নামের ভয়ে সংখ্যালঘু নিপীড়ন না করলেও তাদের অনেককেই বলতে শুনছি, তারা চলে গেলেই ভালো, কারণ তারা তো তাদের ভোটার হবে না। আবার তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া যায়, কোন ইসলামি দল ক্ষতায় আসলো তাহলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিক মর্যাদা কি হবে। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাটি এখানে কেবল সংখ্যালঘু ভোটের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে; সংখ্যাগুরুদের নিয়ে যেন কিছুই ভাবার নেই।
আসলে ধর্মনিরপেক্ষতা একটি গোলমেলে বস্তু হিসাবে রয়ে গেছে; আদতে যাকে ধর্মনিরপেক্ষ বলা হয়েছে, তার আসলে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র কখনো ছিল না; ধর্মনিরপেক্ষতার উপাদান মূলত নিজেই একটি ধর্মবস্তুতে রূপ নিয়েছে; বিশেষ করে মধ্যযুগে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের যুগে কবীর, লালন, অশোক, আকবর, দারাশিকো, গান্ধি-তাদের জীবন দর্শনের মূল্যবোধ ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ থেকে গ্রহণ করা হয়নি; বরং ধর্ম তাদের জীবনের অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল; নিজের ধর্মীয় লেবাসকে তারা সমালোচনা না করলেও অন্যের ধর্মাচরণে তারা উপহাস করেছেন। বর্তমানেও ধর্মনিরপেক্ষতা সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত না হয়ে ভোটের রাজনীতির ক্ষেত্রে পরিচালিত হচ্ছে। সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মীয়-সম্প্রীতি রক্ষা করে কিনা, তা নিয়েও আজ প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে; সবাই প্রত্যক্ষ করেছে যে, অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার যে উন্মাদনা তার জন্ম সর্বোচ্চ ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সংবিধানের আওতায় হয়েছে; সাম্প্রদায়িক গুজরাট হত্যা আর তারই ওপরে ভর করে ক্ষমতায় আসীন-সংবিধান সে সব রক্ষা করতে পারেনি; কারণ একটি মাত্র দল যখন এই ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার ও সুবিধাভোগী হয়ে পড়ে, তখন ক্ষমতার অন্যান্য অংশীদাররা অন্য পথে ক্ষমতায় আসতে চেষ্টা করে। সুতরাং একটি মুক্ত গণতান্ত্রিক চর্চা এবং ভালোত্বের সংস্কৃতি যখন একটি দেশে বিনিময়ের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় তখন বক্রপথই পথ হয়ে ওঠে। ফলে চরিত্রের দিক দিয়ে ভারতের কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে বস্তুত কোনো তফাত নাই; বলা হয়ে থাকে বিজেপির প্রতিষ্ঠাদের কেউ বিশ্বাসী হিন্দু নন এবং তাদের দলেও মুসলমান নেতার সংখ্যা কম নন। পাশাপাশি নেপাল সাংবিধানিকভাবে এতকাল হিন্দুরাষ্ট্র বলে স্বীকৃত হলেও ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুরাষ্ট্রের মতো সেখানে ধর্মীয় সংঘাত বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতে দেখা যায়নি; বরং তাদের জনগণের মধ্যে ভারতীয়দের প্রতি এক ধরনের ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে, কারণ সে দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যের শীর্ষভাগ তাদের দখলে। আবার অতিসম্প্রতি তাদের হিন্দুরাষ্ট্রের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা যে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের জন্ম দেবে না তা বলা মুশকিল; ইতোমধ্যেই তাদের তরাই এলাকার জনগণের মধ্যে একটি উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। যদিও আপাতভাবে ধর্মীয় উগ্রপন্থা মানুষের জন্য ক্ষতিকর মনে হয়েছে, তবু ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গি কর্মকা- দ্বারা গত শতকে যত লোক নিহত হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ও রাষ্ট্রের দ্বারা সেই হত্যাকা- কয়েকগুণ বেশি হয়েছে। সুতরাং, রাষ্ট্রের ধর্মীয় পরিচয় বা ধর্মনিরপেক্ষতার সাংবিধানিক সংযোজনের আসলেই কোনো প্রয়োজন আছে কিনা; সেটি ভেবে দেখার দরকার হয়ে পড়েছে। কারণ বর্তমান রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় এগুলো রাজনৈতিক জিকির ব্যতীত আর কোনো কাজে আসছে বলে মনে হয় না। আসলে এই মীমাংসাটাই জরুরি, রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্কের ধরন কেমন হবে। সংবিধানে এমন সব প্রতীকী মেটাফোর যার বহুবিধ ব্যাখ্যা হতে পারে, তা আসলে নাগরিকের প্রয়োজনে আসে না। নাগরিকের মৌলিক অধিকারসহ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, ব্যবসায়-বাণিজ্যের নিরাপত্তা, গমনাগমের স্বাধীনতা, গোপনীয়তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সরকার নির্বাচনের স্বাধীনতা এবং ফৌজদারি ও দেওয়ানি অপরাধসমূহের নিষ্পত্তির সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থাকাই যথেষ্ট; আর সব অবশিষ্ট হতে পারে রাষ্ট্রের এখতিয়ার মুক্ত। যদিও আমার এই মত রাষ্ট্রের কাঠামোর সুচিন্তিত প্রকাশ নয়, তবু বলা যায়, এমন কিছু পরিবর্তন কেবল সংখাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নেয়া কোনো ন্যায়সংগত নয়, তার অন্যতম হলো, যা দেশের একজন ব্যক্তিরও চিন্তা বা বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে ক্ষুণœ করে। রাষ্ট্রের এমন সব বিষয়ে হাত দেয়ার প্রয়োজন হয় না, যেখানে রাষ্ট্র বা ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়; তবে আমাদের এখানে সরকার ও রাষ্ট্রকে অধিকাংশ সময়ে সমান্তরাল হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
আমাদের গ্রামের উন্মূল নাপিত পরিবারকে দিয়ে এ আলোচনা শুরু করেছিলাম; কারণ আমার কাছে এ আলোচনা সম্পাদনের জন্য কোনো গবেষণা-প্রণালি ছিল না; অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে এগুতে চেয়েছি। যেমন নাপিত পরিবারটির আজ যে উন্মূলিত হওয়ার ঘটনা, তা কেবল একটি গ্রাম-সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; ইউরোপের শরণার্থী ব্যবস্থার সঙ্গেও তার যোগ রয়েছে; কারণ বিশ্বায়নের ধাক্কায় আমাদের পরিচিত সকল কিছু আজ অপরিচিত হয়ে যাচ্ছে, আর যা অপরিচিত তা-ই আমাদের অচেনা ও অপর মনে হচ্ছে। যেমন মধ্যযুগে ধর্মের বিভেদ থাকলেও তার রূপ ছিল দেশজ, যেমন শত শত বছর মুসলমানরা ভারতীয় সমাজে বাস করলেও ধর্মের প্যাটেন্ট পরিশুদ্ধতার দরকার হয়নি; বা কেউ তার প্যাটেন্ট দাবি করেনি; যেমন এই শতাব্দীতে এসে আমাদের বলতে হচ্ছে, এই নিমগাছ, এই পাটগাছ আমাদের, আমরা যদি সময় মতো বাণিজ্যের খাতায় তালিকাভুক্ত না করতে পারি তাহলে অন্যরা এটি নিয়ে নেবে এবং এর ব্যবহারের জন্য আমাদের অতিরিক্ত টাকা গুণতে হবে। তেমনি আজ নানা রকম যোগাযোগ, তথ্য-প্রযুক্তি, অনুবাদ ও বর্ণশিক্ষার ফলে ধর্মের মূল গ্রন্থের বাণী ও উপগ্রন্থের সঙ্গে যেমন যে কারো সহজে পরিচয় ঘটছে, সেহেতু তার ব্যাখ্যাও নানা রকম হয়ে যাচ্ছে; এবং এতকাল যা দেশজ ও প্রায়োগিক ছিল তা-ই আজ হয়ে যাচ্ছে কেতাবি ও বাণিজ্যিক; হিন্দু ধর্মের জন্যও এটা সত্য, কারণ হিন্দুরা প্রকৃতগতভাবে ধর্মের কোনো পরিশুদ্ধতা ছাড়াই পুরোপুরি স্থানিক নিয়মে ধর্মপালন করে এসেছেন এতকাল; কে রাম আর কে লক্ষণ তার বাস্তব রূপ নিয়ে তার মাথাব্যথা ছিল না; অথচ আজ দশমু-ের রাবণ আর দশভূজা দুর্গা হিন্দুর মানসলোকে ক্ষমতালক্ষ্মী হিসাবে দেখা দিয়েছে; ফলে এই নাপিত পরিবারকে পুরনো মালের নতুন মোড়কের যুগে টিকতে হলে বেশি মূল্য গুণতে হবে; ধর্মনিরপেক্ষতা হুদাই একটি বোল।