মজিদ মাহমুদ
মেয়েটিকে আব্দুল কুদ্দুসই প্রথম দেখেছিল। টংঘর থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির ডাকে নদীর ধারে গিয়েছিল। তখন ঠিক শীত পড়ে নাই। তবু কার্তিক মাসের শুরুতে নদীতে টান ধরেছিল। সকালে এক-আধটু কুয়াশা। ম্যার-মেরে শীতের আগমনও টের পাওয়া যায়। পায়খানার চাপ ছিল প্রবল। তাই হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়েছিল। কোনোদিকে তাকানোর ফুরসৎ ছিল না। শাকপাতা খাওয়া পেট। কামড় দিলে রেহাই নেই। ভ্যার-ভ্যার করে বেরিয়ে আাসতে চায়। তাছাড়া তখনো পুরোপুরী ফরসা হয়নি। কোনো দিকে ঠাহর করার জো ছিল না।
আরাম করে কাজ সেরে আব্দুল কুদ্দুস নদীর ধারে যায়। নদীর দিকে পাছা দিয়ে পানি খরচ করে। তবে পারতোপক্ষে নদীতে এ কাজটি করতে চায় না সে। নদীতে খোয়াজ খিজির থাকে। পানির ফেরেশতা। তাকে অপবিত্র করা হয়। তাছাড়া আজকাল এনজিও কর্মীরা দেখা হলেই বলে- নদীতে মলমূত্র ত্যাগ করা ঠিক না। রোগ-বালাই ছড়ায়। কলেরা-আমাশা হয়। কিন্তু না করে তো উপায় থাকে না। নদীর ধারে কাশবনে বাস। বছরের এ সময়টায় আসতেই হয়। নদীর ধারের খাস জমিতে কাশবন মাথা তোলে। শত শত বিঘা খাস জমি। বেওয়ারিশ এসব জমির মা-বাপ নেই। লাঠির জোর যার- জমির মালিকানা তার। আব্দুল কুদ্দুস এ জমির মালিক না। এ জমির মালিক রফি পরামানিক। কুদ্দুস তার বান্ধা চাকর। মাস-মায়না নয়। বছরের হিসাবে ১২ মন ধান আর ৬ হাজার টাকা। এছাড়া দুইটা লুঙ্গি দুইটা গামছা, একটা জামা এবং শীতের একটা চাদরও দেয়। টাকার হিসাবে বেতন বেশি নয়। প্রতিদিন শ্রম দিলে এর চেয়ে বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতিদিন শ্রম বেচা যায় না। সব সময় শ্রমের বাজার ঠিক থাকে না। বছরবান্ধায় সে অনিশ্চয়তা থাকে না। নিজের খাওয়া পরার চিন্তা করতে হয় না।
কুদ্দুসের বড় ভাই আব্দুর রহিমও রফি পরামানিকের বছরবান্ধা চাকর। তার বাপও তাই ছিল। দাদার হিস্টরি জানে না।
বাপ মারা যায় অল্প বয়সে। সে সব হিসেব কুদ্দুস রাখে না। কুদ্দুস এককুড়ি পর্যন্ত গুনতে জানে। কুড়ির পরে সব সংখ্যা তার কাছে বাহুল্য মনে হয়। আগামীকালের পরে তার দিনক্ষণের দরকার হয় না। আর দরকার হলে তো তার ভাই আব্দুর রহিম আর পরামানিক রয়েছে। তারা তো আর তাকে ঠকাবে না। অবশ্য ঠকানো শব্দটির সঙ্গে তার পরিচয় নেই। দুনিয়ারি সব কিছুই তার ভালো। খারাপ বলে কিছু নেই। আল্লার দুনিয়ার এত ভাবার কিছু নেই। আল্লা যা কিছু করে ভালোর জন্য করে।
যাক, কুদ্দুসকে নিয়ে এতকিছু বলার দরকার পড়ে না। কুদ্দুস এমন কোনো মানুষ নয় যার জীবনের সবটা পরিচয়ের দরকার আছে। কিন্তু মেয়েটির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে কিঞ্চিৎ ঘটনা তার জীবনে ঘটেছিল। এ গল্পটি আমি তাদের কাছ থেকেই শুনেছিলাম। কুদ্দুস কিংবা রহিমের কাছ থেকেও হতে পারে; কিংবা তাদের কোনো ঘনিষ্টজনের কাছ থেকে শুনতে পারি।
কুয়াশার মধ্যে কুদ্দুসের প্রথমে মনে হলো তার মতো কেউ এখানে প্রকৃতির ডাকে এসেছে। তাই মুখ ফিরে নিয়ে চলতে থাকলো। কিন্তু এ চরে তো কারো আসার কথা নয়। তাহলে ভূত-পেত্মী নয় তো! কুদ্দুস কোনো দিকে তাকায় না। বড়কুল পড়ে বুকে ফুঁ দেয়। কোনো দিকে তাকায় না। কিন্তু কিছুদূর এসে কৌতূহল ঠেকাতে পারে না। চোখ মুছে ভালো করে তাকায়। দেখে, না সত্যিই মেয়ে মানুষ। তার পাছাটা মাটির সঙ্গে লাগানো আছে। ভূতটুত হলে তো কিছুটা শূন্যে থাকতো। ভূত মাটিতে পা দিতে পারে না।
কুদ্দুস কিছুক্ষণ ইতস্তত করে। তার ভাবনায় মেলে না। এখানে মেয়ে মানুষ আসবে কোথা থেকে। পাঁচ ক্রোশের মধ্যে কোনো বাড়িঘর নেই। কাশবনের গা লাগোয়া পদ্মা। পানিতে ভেসে ভেসে তো এতদূর কেউ আসতে পারে না। এসব ভাবতে ভাবতে আকাশ কিছুটা ফরশা হয়ে আসে। পুবকোণে হলুদরেখা ফুটে উঠে। তাছাড়া অল্পতে কুদ্দুস ভয় না। গায়ে অসুরের মতো শক্তি। কুমির টেনে ডাঙায় তুলেছিল- তার এ গল্প এলাকায় সবাই জানে। তাই সহজে কেউ ঘাটায় না। তবে ভূত-পেত্মী হলে তো কিছু করার নেই। ওরা তো মানুষ না- ছায়া। ছায়ার সঙ্গে তো লড়াই করা চলে না।
তবে কাছে গিয়ে আব্দুল কুদ্দুসের মনে হলো- না, ছায়া নয়। এমনকি প্রকৃতির ডাকেও কেউ আসেনি। মাটি কাদায় লেপ্টে আড়মোড়া ভাঙা একটি মেয়ে। বয়স অনুমান করার ক্ষমতা কুদ্দুসের ছিল না। এক কুড়ি না হলে দুই কুড়ির কম। ছোটবেলায় মা মারা গেছে। গ্রামে দুএকটা মেয়ে মানুষ দেখেছে। তাদের আলাদা কোনো স্মৃতি নেই। কিন্তু নদীর ধারে পড়ে থাকা এই বিস্রস্ত মেয়ে মানুষটি দেখে তার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠে। তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা সঞ্চিত পুরুষ মানুষ জেগে উঠে। আর এ ধরনের জাগরণ মেয়েটির প্রতি তার মমত্ব জাগিয়ে দেয়। এতদিন ভাই ছাড়া তার নিজের কেউ ছিল না। অচেনা একজন মেয়ে মানুষকে তার নিজের বলে ভাবতে ইচ্ছে হয়। আর সে ইচ্ছে থেকেই মনে হলো মেয়েটির উপর দিয়ে রাতে একটা কষ্ট গিয়েছে। হয়তো খাওয়া হয়নি। কিন্তু কিভাবে সে এখানে এলো। এরকম একটি প্রশ্ন তার মনের মধ্যে ছিল। পরে সে জেনেছিল, গোয়ালন্দ থেকে কিছু লোক তাকে নৌকায় তুলে এনেছিল। সারারাত তাদের নৌকায় ছিল। লোকগুলো তাকে সারারাত কোথাও মেরেছে। তারপর কি যেনো খাইয়ে ঘুম পারিয়ে দিয়েছিল। ঘুম ভাঙতেই সে নিজেকে এখানে আবিষ্কার করে।
কুদ্দুস এত সব বোঝে না। গোয়ালন্দ কোথায় তাও সে জানে না। গোয়ালন্দ যেখানেই হোক; মেয়েটিকে তার মনে হয় পরী। মনে একটু ভয়ও লাগে। জলপরী নয় তো। তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে পানির নিচে পাতাল পুরীতে নিয়ে যাবে না তো। কিন্তু মেয়েটির যাদু থেকে সে রক্ষা পায় না। হাত-পা অবশ হয়ে আসে। আবার তাকে ছেড়ে কোথাও যেতেও পারে না।
মেয়েটি পানি চাইলে হাতের বদনাতে নদী থেকে পানি আনে। মেয়েটিকে দেয়। মেয়েটি ঢকঢক করে পানি খায়। কিছুটা পানি চোখে মুখে ছিটা দেয়। বলে, এটি কোন গ্রাম। কুদ্দুস উত্তর দেয়, ডিক্রির চর।
গল্পের এই সূচনাটুকু না বললে পাঠক ঠিক বুঝে উঠতে পারতেন না। মেয়েটি কোথা থেকে এলো। গোয়ালন্দ থেকে একটি মেয়ে রাতের বেলা কিছু লোকের সঙ্গে নৌকা যাত্রা করতে পারে এ কথা তো ঠিক। রাতের অত্যাচার শেষে নদীর চরে তাকে ফেলে দিয়ে চলে যেতে পারে এটাও তো ঠিক। তবে কুদ্দুসের জগতে গোয়ালন্দ নেই। গোয়ালন্দও চর শানিরদিয়ারের মতো একটি গ্রাম। চোখের সীমানা কালো হয়ে এলে যাকে দেখা যায়। সেও তো রূপকথারই একটি জগৎ।
কুদ্দুসের কাছে কোনো খাবার আছে কিনা জানতে চায় মেয়েটি। কুদ্দুস দ্রুত টঙয়ে ফিরে যায়। যবের ছাতু মুড়ি আর গুড় নিয়ে ফিরে আসে। নদী থেকে পানি এনে দেয়। গোলাকার টিনের থালে ছাতুগুলো পানিতে মেখে গোগ্রাসে গিলে ফেলে। সারারাতের ক্লান্তি ভোলো। ক্ষুধা ভোলে। জানতে চায়- কুদ্দুস কোথায় থাকে। জানতে চায়- তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে কিনা। ততক্ষণে মেয়েটির মোহ কুদ্দুসকে পেয়ে বসেছে। মেয়েটির সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তাকে ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না। মুহূর্তের মধ্যে তার এ পরিবর্তন তার চোখে পড়ল। যে কুদ্দুস নিজে কিছু ভাবতে পারে না। তার সমগ্র জগৎ তার ভাই আব্দুর রহিম কেন্দ্রিক। আব্দুর রহিম ছাড়া তার দুনিয়া নেই। আব্দুর রহিম বিয়ে করবে। ভাবী তাকে আদর করবে। তাদের ছেলে মেয়ে হবে। সেই ছেলে মেয়েকে নিয়ে তার কেটে যাবে সময়। এই মেয়েটিকে তার ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার কথাও ভেবেছিল সে। এখন ভাবনাটা ভাগ হয়ে গেছে। কিন্তু দুভাইয়ের পক্ষে তো এক মেয়েকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ভাই যদি বলে এ মেয়ে তুই কোথাই পেলি। মেয়েটিকে একা ফেলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলো তাদের টংঘরে।
আব্দুর রহিম আরো সকালে উঠে চলে গেছে মহিষের বাথানে। এই কাশবনের পাহারা ছাড়াও তার মালিকের রয়েছে গোটা বিশেক মহিষ। তার মধ্যে বেশ কয়েকটা দুধ দেয়। দুইভাই পালা করে এই মহিষ দেখাশোনা করে। দুধ দুইয়ে জ্বাল দিয়ে রাখে। সর থেকে ঘি তৈরি করে। নিজেরা খায়। সপ্তাহে শুক্রবার সকালে আব্দুর রহিম দুধ নিয়ে, ননি নিয়ে রফি পরমানিকের বাড়িতে যায়। সন্ধ্যায় আবার ফিরে আসে। সঙ্গে আনে চালডাল নুন ও কুপি জ্বালানোর তেল। নদীতে গোসল করতে গিয়ে মাঝে মাঝে মাছ ধরে আনে। একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনের প্রায় সবটাই তাদের রয়েছে। জীবনে কোনো কষ্টের বোধ তাই তাদের মধ্যে জাগ্রত হয়নি। সংসারের রীতি অনুসারে একদিন তাদের বিয়ে করতে হবে সে কথা ভাবলেও মেয়ে মানুষের জন্য আলাদা কোনো কষ্ট তারা টের পায়নি। এমনকি মায়ের জন্যও নয়।
মেয়েটিকে টংঘরে রেখে আব্দুল কুদ্দুস বড় ভাই আব্দুর রহিমের কাছে গিয়ে ঘটনাটি জানায়।
এ রকম একটি অদ্ভূত ঘটনায় আব্দুর রহিম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। রহিমের বোধশোধ কুদ্দুসের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি। বলে, এডা তুই কি করচিস কুদ্দুস? অচিনা মেয়ে মানুষ ঘরে তুইলা আনচিস? এতে গুণা হইব না? মানষ্যে জানলে একঘরে করবে না?
তবু রহিম কৌতূহল থামাতে পারল না। হাতের কাজ দ্রুত সেরে বাথানে ফিরে এল। এবং মেয়েটিকে দেখে তারও কুদ্দুসের দশা প্রাপ্ত হলো। সত্যিই সেও তো এর আগে মেয়ে মানুষ দেখেনি। যুবতী মেয়ে একান্ত কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা এই তাদের প্রথম। মেয়ে মানুষের জন্য বুকের কোণে যে একটি ব্যথা থাকে তারা এর আগে টের পায়নি। মেয়ে মানুষকে বুকের কাছে টেনে নেয়ার ইচ্ছা এই তারা প্রথম টের পেল। এরপর দুইভাই আর কোনো কথা বলল না। এমন একটা নির্জন বনের ধারে তাদের বাস। লোকজন তেমন একটা কেউ আসে না। মহিষের দুধ, কোলের মাছ- খাওয়ার খুব একটা কষ্ট নেই। কিন্তু বেশিদিন তো আর এমন বেগানা মেয়েমানুষকে নিজেদের কাছে রাখা যাবে না।
এসব ভাবনার মাঝে সন্ধ্যা হয়ে আসে। কুপিতে তেল ঢালে কুদ্দুস। সলতে ঠিক করে। মাটিতে গর্ত করে কাটা চুলায় রহিম ভাত চড়ানোর আয়োজন করে। এতক্ষণে মেয়েটি অনেক স্বাভাবিক হয়ে আসে। বলে, ভাইজান আমি রাধতে জানি। তারপর সব আয়োজন সেই করে। তারপর তিনজন একত্রে খেতে বসে। খাবার স্বাদ আজ রহিম ও কুদ্দুসের কাছে অন্য রকম মনে হয়। মানুষ জীবনের অর্থ খুঁজে পায় তারা। সংসার জীবনের আনন্দ বুঝতে পারে তারা। দুই ভাই মেয়েটিকে নিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ সংসারের স্বপ্ন দেখতে থাকে। কিন্তু তাদের গোপন কথা কেউ জানতে পারে না। কুদ্দুস মেয়েটিকে পেয়েছে; তাই মেয়েটির প্রতি তার হক ষোল আনা। ভাই যে মেয়েটির কথা ভাবতে পারে একথা তার কল্পনাতে আসেনি। অন্যদিকে রহিম ভাবে কুদ্দুসের সব চিন্তা তাকে নিয়ে। তাছাড়া সে বিয়ে করলেই না কুদ্দুসের কথা।
রাতে শুতে যাওয়ার আগে তারা বেশ সমস্যায় পড়ে। একটি মাত্র টংঘর। তার পুরোটা জুড়ে একটি মাত্র মাঁচা। একটি কাঁথা ও দুটি বালিশ দুই ভাই ভাগাভাগি করে নেয়। কিন্তু তৃতীয় জনকে শোয়ানোর জায়গা তাদের নেই। তাছাড়া মেয়ে মানুষ। একসঙ্গে জড়িয়ে কুড়িয়ে তিনজনের থাকা চলবে না। শেষ পর্যন্ত মেয়েটিকে তারা ঘরের মাঁচানে শোয়ায়। দুই ভাই কাশবন বিছিয়ে ঘরের বাইরে মাচার নিচে শুয়ে থাকে। কারো ঘুম আসে না। মেয়েটিকে নিয়ে তাদের স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে। তাদের বাপ ছিল না। মা মারা গেছে বহুকাল আগে। তাদের ঘর সংসার বলতে রফি পরামানিকের বাড়ি। আর তাদের হালি-কৃষাণকে কেন্দ্র করে তার জগৎ। সে জগতে মেয়ে মানুষ নেই। সুখ-দুঃখে কারো আংশিদারিত্ব নেই। দুই ভাই আদি পিতার সন্তান হাবিল কাবিলের মতো বেড়ে উঠেছে। একটি মেয়ে মানুষকে নিয়েই কি শুরু হবে তাদের মধ্যে হাবিল কাবিলের দ্বন্দ্ব। এ সব ভাবতে ভাবতে দুজনই বুঝি শেষের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মেয়েটি এসে প্রথম তাদের জাগিয়ে দেয়। এই একদিনের মধ্যে তারা একটি পরিবারভুক্ত হয়ে পড়ে।
রহিম কুদ্দুসকে বলে, চল আমরা আরেকটি টং বানাই। ওকে থাকতি দিতে হবি তো। দুইভাই ফুটন্ত কাশ কেটে আনে। কচি কাশের পাতা দিয়ে বাঁধন দেয়। মুলিবাঁশ দিয়ে চাঙ তৈরি করে। তাদের একটি টংয়ের পাশে আরেকটি টং ওঠে। একটি বাড়ির স্বপ্ন জেগে ওঠে তাদের মনে।
শুক্রবার রহিম যথারীতি গ্রামে যায়। পরামনিকের বাড়ি থেকে সপ্তাহের চাল-ডাল-নুন-তেল আনতে হবে। কিন্তু বন থেকে বেরুতে গিয়ে প্রথম টের পেলÑ এই বনের মধ্যে কোথায় যেন টান ধরেছে। কি যেন ফেলে রেখে যাচ্ছে।
ফেরার পথে রহিম নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে অপরিচিত দোকান থেকে একটি শাড়ি, কিছু স্নো পাউডার, একটি চিরনি আয়না কিনল। কেউ দেখে ফেলার ভয়ে কাজটি সাবধানতার সঙ্গে করল। মনে মনে অনেক কথা ভাবল। এখনো মেয়েটির দেশের বাড়ির কথা জানা হয়নি। গোয়ালন্দ না কোথায় যেন বলেছিল। গোয়ালন্দ কোথায় রহিম জানে না। রহিম পরিচিত দু’একজনের কাছে গোয়ালন্দ কোথায় জানতে চায়। সবাই তাকে সন্দেহ করে। তার দিকে সন্দেহের চোখে চেয়ে থাকে। বলে, গোলালন্দ দিয়ে তুই কি করবি? রহিম বলেছে এমনিতেই। দোস্ত হাবিল নিকারি তাকে কথা দিয়েছে, একদিন তাকে নিয়ে গোয়ালন্দ যাবে। ওখানে অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়ে মানুষ থাকে। এখান থেকে নৌকায় করে যেতে হয়ে। এখান থেকে দশ ক্রোশ মতো পথ। ঘন্টা চারেক সময় লাগে। পান্তা খেয়ে নাও ছাড়লে দুপুরের মধ্যে পৌঁছান যায়।
রহিম অন্যদিনের তুলনায় একটু আগেই ফিরে আসে। টঙের আঙিনায় পা রাখতেই কুদ্দুসের উপস্থিতি টের পায়। মেয়েটি আর কুদ্দুসের হাসির শব্দ শুনতে পায়। দুজনেই টঙের ভেতর বসে আছে। মেয়েটি বলছে তুমি কি আমাকে বিয়ে করবা? আমি কৈল খারাপ মেয়ে মানুষ। তই তুমি বিয়ে করলে আর খারাপ কাজ করুম না।
এসব কথা রহিমের কানে যেতে তার সব চিন্তা ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবু জোরে হাঁক ছেড়ে, কাঁশবনের আবরণ ছিন্ন করে টঙে প্রবেশ করে। শাড়ি ও স্নো পাউডার দেখে মেয়েটি খুশি হয়। মেয়েটির খুশি দেখে রহিমের এতক্ষণের হতাশা কিছুটা কেটে যায়। তারা আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এক সঙ্গে রাতের খাবার খায়।
রাতে ঘুম ভাঙার পর কুদ্দুস বড়ভাই রহিমকে দেখতে পায় না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে। পাশের টঙে শব্দ শোনে। এরপর থেকে দু ভাই আর কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। অল্পতেই রেগে যায়। হাতাহাতি হৈচৈ করে। মেয়েটির সামনে এলে দুজনাই চুপ করে থাকে। কারো সঙ্গে কথা বলে না। গপাগপ ভাত গেলে। পিঠের সঙ্গে পিঠ দিয়ে শুয়ে থাকে। সহজে কারো ঘুম আসে না।
এভাবে দুভাইয়ের মনের মধ্যে ভ্রাতৃহত্যার প্রবণতা জেগে ওঠে। কেউ একজন কাউকে হত্যা করলে এখানে কেউ টের পাবে না। মহিষ ধোয়ানের সময় পানিতে ঠেশে ধরলেই তো সব বালাই শেষ। কিন্তু এ কথা ভাবতে গিয়ে দুভাই বুঝলো তাদের পরস্পরের ভালোবাসা খুব গভীরে। কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচার অর্থ খুঁজতে পারে না। আর এ কথা উপলব্ধি করতেই তাদের যাবতীয় রাগ গিয়ে পরল মেয়েটির উপর।
এই মেয়েটিই তাদের ভ্রাতৃহত্যার মতো পাপে লিপ্ত করেছে। অবশ্য তারা এও ভাবলো, তাদের দুভাইকে পরীক্ষা করার জন্য আল্লা এই মেয়ে মানুষটি তাদের জন্য পাঠিয়েছিল। যেভাবে বাবেল শহরে হারুত মারুত ফেরেশতাদের পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সে পরীক্ষায় তারা ফেল করেছিল। তবু ফেরেশতাদের পাপের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রভু তাদের আসমানে তুলে নিয়েছিলেন। এ গল্প পরামানিক বাড়ির বান্ধা হুজুরের কাছে তারা বহুবার শুনেছে। কিন্তু রহিম ও কুদ্দুসের এ পাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার আর কোনো পথ নাই। দুই ভাই-ই এক পাপের ছুরিতে বিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু ভ্রাতৃহত্যা থেকে রক্ষার উপায় হিসাবে তারা সিদ্ধান্ত নিলো মেয়েটিকে গোয়ালন্দ রেখে আসবে।
একটি ছই করা নৌকায় ভোর হওয়ার আগেই মেয়েটিকে নিয়ে তারা গোয়ালন্দের উদ্দেশে রওনা হলো। নদী পথ সরল ও সোজা। নদী পথ চিনতে হয় না। নদী নিজেই মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। গোয়ালন্দ ঘাটে আসতেই মেয়েটি বলে এখানে তাকে নামিয়ে দিলেই হবে। সে তার গন্তব্যে যেতে পারবে।
মেয়েটিকে নামিয়ে দিয়ে বেলাবেলি ফিরে আসে তারা। দুজনই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। অন্তত ভ্রাতৃহত্যার হাত থেকে এ যাত্রায় তারা রক্ষা পেল। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল; কাঁদল। কিন্তু কেউ স্বাভাবিক হতে পারল না। মেয়েটি তাদের বুকের মধ্যে জগদ্দল পাথরের মতো বসে রইল। কাজে মন বসাতে চেষ্টা করলো।
শুক্রবার রহিম গ্রামে গিয়ে ঐদিন আর ফিরল না। ফিরল একদিন পরে সন্ধ্যায়। কয়েকদিন পরে কুদ্দুস তিনদিন থাকল না। এভাবে তারা নিয়মিত পালা করে অনুপস্থিত হতে থাকলো। তারা বুঝতে পারল গোয়ালন্দ না গেলে তারা বাঁচবে না।
তাই দুভাই সিদ্ধান্ত নিলো মেয়েটিকে তারা ফিরে নিয়ে আসবে। অসহায় মেয়েটিও তাদের বিশ্বাস করলো। ঘাটের ধকল সেও তো সহ্য করতে পারে না। সেও তো একটু ভালোবাসা চায়। শুধু একজন পুরুষের ভালোবাসা তারও মনের মধ্যে স্বপ্ন হয়ে আছে। একটি রাতের লুণ্ঠনের পর যদিও সে সত্য বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছিল। তবু প্রভু তার কপালে রেখেছেন বহুগামীতা। দুইজন পুরুষকে নিয়ে এক মহিলার ঘর করার বিধান যেহেতু প্রভু দেননি। তবু অন্তত ঘাটের অত্যাচার থেকে দুভাইয়ের ভালোবাসা অনেক সুখের। ঘাটে মাসির কাছে শুনেছিল আগের দিনে এক ভাইয়ের পাঁচ বৌ ছিল। দুই ভাই সে তুলনায় কম।
আশ্বিন মাস নদীতে টান ধরেছে। সারাদিন টিপটিপ বৃষ্টি। রহিম ও কুদ্দুস দুজনই নৌকা বাওয়ায় পটু। নদীর পাড়ে বাস। পানি দেখে ভয় করলে তো আর চলে না। সকালে গোয়ালন্দ যাওয়ার সময় দুভাই কেউ কারো সঙ্গে কথা বলেনি। ফেরার পথেও না। নৌকার ছইয়ের মধ্যে মেয়েটিও চুপচাপ বসে থাকে। আগের চেয়ে তার এ আসা অনেক নিশ্চিত। অনেক দোচলায়মান। সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, এবার কি সম্পর্কের ভিত্তিতে সে তাদের সংসারে যাচ্ছে। আগেরবার দুভাইয়ের সঙ্গেই তার সম্পর্ক হয়েছিল বটে; কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ জানতো না। সে সম্পর্কের গ্লানি তাকে সহ্য করতে হয়নি। কিন্তু এবার? অনেক মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়েছে। কিন্তু এত জটিল অবস্থায় সে পড়েনি। দুভাইয়ের প্রতি এতদিনে তার এক অন্ধ ভালোবাসা ছিল কিংবা নির্ভরতা। যা সে ব্যাখ্যা করতে পারে না।
সে ভাবে, এভাবে চলে আসা তার ঠিক হয়নি। ভালোবাসা-টালোবাসা তাদের জন্য নয়। মা ছিল না; বাপ দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল। এসব গল্প এখন আর মনে নেই। মনে করার ইচ্ছেও নেই। তার জীবন নির্ধারিত হয়ে গেছে গোয়ালন্দ বস্তিতে। তবু তার জীবনে ঘটনার কোনো রঙ ছিল না। দু’ভাইয়ের সঙ্গে দৈবক্রমে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা পূর্বের জীবনের চেয়ে জটিল এবং পঙ্কিল। এ পাপ থেকে বেরুনোর তার রাস্তা জানা নেই। তবু তার এ জীবনের সকল স্মৃতি; দুর্দমনীয় অভিলাষ গড়ে উঠেছে লুণ্ঠিত হবার ঘটনার পর থেকে। এই দুই সহোদরের সঙ্গে।
এতক্ষণ কেউ কোনো কথা বলেনি। রহিম হাল ধরে নিচ্চুপ বসে আছে পাছা নায়ে। কুদ্দুস একমনে দাঁড় টানছে। আর মেয়েটির মনে ভেসে উঠছে নায়রের স্মৃতি।
আশ্বিন মাসের এ সময়টিতে নদীতে স্রোত ছিল না। নদীতে বরং উল্টো স্রোত বইতে শুরু করেছে। কিন্তু আজ সকাল থেকে টিপটিপ বৃষ্টি। বৃষ্টির প্রকোপ এখন বেড়েছে। নিম্ন চাপটাপ হতে পারে। এ সময়টাতে দু’একবার এমন হয়ে থাকে। দিক অন্ধকার করে বৃষ্টি আসছে। প্রবল বাতাসে সবকিছু উল্টে নিয়ে যেতে চায়। আকাশের অবস্থা ভালো ঠেকছে না। রহিম ও কুদ্দুসের মনে জেগে ওঠে উৎকণ্ঠা। রহিম নৌকার গুলুয়ের উপর দাঁড়িয়ে হাল ধরে। গায়ের সব শক্তি দিয়ে ঘুল্লি মারে। তাদের ভরসা নৌকা প্রায় পাড়ে চলে এসেছে। আর বিশ গজের মতো যেতে হবে। তারা ভালো সাঁতার জানে। এটুকু পানি পথ কিছু না। কুদ্দুস রহিমের দিকে চায়। রহিম চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর প্রবল বেগে হাল স্রোতের বিপরীতে ঠেলা মারে। প্রবল বাতাস আর হালের উল্টো আঘাতে কাঠের নৌকাখানি ভারসাম্য রাখতে পারে না। পানির নিচে তলিয়ে যেতে থাকে। মেয়েটির কণ্ঠে করুণ একটি আর্তি শোনা যায়। মা বলে ওঠে। হয়তো আল্লা খোদার নাম নিয়ে থাকবে।