সংবাদপত্র পোড়া ছাই দিয়ে তৈরিকৃত পুতুলের বয়ান


এক ভোর। চমৎকার একটা ড্রইংরুম। যেখানে বসার সোফা তার পিছনের দেয়ালে শিংসহ হরিণের মাথা আর তার নিচে চামড়া টাঙানো আছে। ছবির নিচে হাতের চমৎকার লিপিতে লিপিত আছে-
‘ঋষ্যশৃঙ্গসহ ঋষ্যের মস্তক এবং ঐণেয়। ঐণিক : বরিদুর রহমান।’

সংবাদপত্র হাতে নিয়ে বসে আছে মতিয়া। সংবাদপত্রের ভেতর থেকে বেশকিছু উকুন বেরিয়ে মতিয়ার মাথার দিকে হাঁটা ধরে। হাঁটার সময়েই কয়েকটি উকুন নিহত হয় মতিয়ার সুন্দর নখযুক্ত আঙুলের পিষণে। বেশির ভাগ উকুন নিহত হয় না। বেঁচে থাকা উকুনগুলো মতিয়ার মস্তকভূ-র গভীর চুলের ভেতর অবস্থান নেয়।

সংবাদপত্রের পাতা উল্টায় মতিয়া। এমন সময় মহামন্ত্রি বরিদুর আসেন মতিয়া যেখানে বসে সংবাদপত্রকে হাতের আর মনের তাপ দিচ্ছে সেখানে। তার হিংসা হয় সংবাদপত্রকে। তিনি হেসে হেসে বসে পড়েন মতিয়ার পাশে। ঘুম ঘুম চোখ। মতিয়া তার দিকে ঈষৎ বিরক্তিতে তাকিয়ে সংবাদপত্রের দিকে চোখ ফেরাল।

মতিয়ার চোখের শীতল তল দেখে বরিদুরের খারাপ লাগে; এমন অনাহ্লাদিত হয়ে বসে থাকা দেখে খারাপ লাগে। মেয়েটা কত চমৎকার ছিল; একটা ফুলের মতো, ফুলের মতো হাসি। সে বুঝতে পারে না পুষ্পের হাসি বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে কেন। তবু সেসবকে দূর করে বরিদুর বললেন-

: ‘আমার কী ইচ্ছে করে জানো?’

মতিয়া তার দিকে তাকায়। ঘুমের কয়েকটা চানাচুর দানা বরিদুরের চোখ থেকে ঝরে পড়ল। চোখ দুটো আরো উজ্জ্বল হল।

: ‘আমার ইচ্ছে করে, তোমার হাতের সংবাদপত্র হতে, যা তুমি রোজ ভোরে পড়ো। আমার ইচ্ছে করে, তোমার শাড়ি আর চুড়ি আর অন্তর্বাস হতে। আমার ইচ্ছে করে তোমার সব গয়না হতে।’

মতিয়া বলে-

: ‘আমি হতে ইচ্ছে করে না? মানে, তোমার ইচ্ছে করে না মতিয়াই হয়ে যেতে? মানে, সবসুদ্ধ আমি হতে?’

ভেতর ভেতর চমকে বরিদুর মতিয়ার চোখের দিকে তাকান। একধরনের বিহ্বলতা তার ভেতর কাজ করে। চঞ্চলতার একটা ঘোড়া তার বুকের ভেতর দাপাতে শুরু করে। তার হাঁচি আসে। ঘোড়াটি হাঁচির সাথে বেশ বেগে বেরিয়ে আসে আর সামনে থাকা কাঁচের টেবিলের ওপর আছড়ে পড়ে। ঘোড়াটি নাক মুখ ফেটে মারা যায়। মরা ঘোড়ার রক্ত ছিটকে এসে তার সাদা পোশাকে লাগার আগেই আস্তে করে সরে যান। রক্তগুলো মতিয়ার শাড়ির ওপর পড়ে। রক্তগুলো কান্না শুরু করে। বরিদুর মরা ঘোড়াকে বাইরে ফেলে এসে আবার বসেন। মহামন্ত্রি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন-

: ‘তুমি কী বিষণ্ন প্রিয়তমা?’

সে বিষণ্ন কিনা সেটা বলতে যাবার সময় ‘বিষণ্নতাটা’ গলার কাছে আঁটকে যায়। মতিয়া বাথরুমে গিয়ে গলায় আটকানো ‘বিষণ্নতাটা’ বের করে বেসিনের পানিতে ভালো করে ধুয়ে আবার গিলে ফেলে। ফিরে এসে মহামন্ত্রির কাছে বসে। মহামন্ত্রি বলেন-

: ‘গতরাতে আমি খুব চমৎকার একটা স্বপ্ন দেখেছি। খুব আনন্দ পেয়েছি। স্বপ্নে দেখেছি, জনগন আমাকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে, ফুলের মালা আমার গলায় পরিয়ে দিচ্ছে।’

এ সময় মতিয়ার শাড়িতে লেগে থাকা মৃতঘোড়ার রক্তরা আরো জোরে কেঁদে ওঠে। মতিয়া সংবাদপত্রের প্রথম পাতা বের করে দেখায়-

: ‘এগুলো কী লেখা আছে পেপারে?’

মহামন্ত্রি পেপারের দিকে তাকায়, লেখা আছে- ‘মহামন্ত্রির লোকেরা বারো বছরের এক কন্যাকে ধর্ষন শেষে হত্যা করেছে।’

: ‘তুমি কি জানো, তোমার লোকেরা কী করেছে?’

: ‘আরে কী বল, আমাকে না জানিয়ে কোনো কাজ করতে পারে আমার লোকে?’ এ সময় মাথার মাঝখানে অবস্থান নেয়া উকুনগুলো যে কথা বলছিল তা মতিয়ার কানে প্রবেশ করে। বিস্ময়বিমূঢ় মতিয়া কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলে-

: ‘তুমি সবই জানো!’

: ‘তুমি এসব বুঝবে না প্রিয়তমা। মেয়েটার বাপকে পোষ মানাতে গেলে এর চেয়ে কম কিছু করার ছিল না; সে বেশ ডিস্টার্ব করছিল। আর পেপারে আমার বিরুদ্ধে লিখলেও কিছুই হবে না আমার। আমাকে নিয়ে তুমি ভেব না। আমার কিছু হবে না।’

‘তুমি ভেব না’ বাক্যটিকে একটা ফ্রিজের ভেতর থেকে এনে তাকে দান করল বলে মনে হলো মতিয়ার। ‘তুমি ভেব না’ কথাটি সত্যি ফ্রিজ থেকে এনে দিয়েছে কিনা দেখার জন্য মতিয়া ফ্রিজের রুমে ঢুকে ফ্রিজ খুলে দেখে। ফ্রিজ দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ; অজস্র ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ‘তুমি ভেব না’ রাখা আছে এখানে। এতগুলো ‘তুমি ভেব না’ কখন কখন নিয়ে এসে রেখেছেন বুঝতে পারেনি। বিভিন্ন ফাইলে বিভিন্ন সারিতে এসব ‘তুমি ভেব না’ সাজানো আছে। একটা সারির শিরোনাম ‘জনজনের জন্য’, একটা সারির শিরোনাম ‘নিজ দলের লোকের জন্য’, একটা শিরোনাম ‘চাকর বাকরদের জন্য’। এভাবে কোনোটা সরকারি কর্মচারি জন্য, কোনোটা এনজিওগুলোর জন্য। মতিয়া তার নাম লেখা একটা সারিও দেখতে পেল। আরো একটা সারি দেখল যেটাতে একটামাত্র অক্ষর ‘র’ লেখা আছে। হতে পারে কোনো মানুষের নামের প্রথম অক্ষর। হতে পারে ‘র’ মানে রহিম বা রহিমা।

ফ্রিজের ঘর থেকে মতিয়া ফিরে এসে বসলে, মহামন্ত্রি বললেন-

: ‘আমার স্বপ্নটা মজার না? এমন স্বপ্ন প্রায়ই দেখি আমি।’

মতিয়া কিছু বলে না। বরিদুর চলে গেলেন। মতিয়া ডাঙায় বেঁচে নাই যেন, জলে ভেসে ভেসেও বেঁচে নাই যেন, সে ডুবে ডুবে বেঁচে আছে। মাঝে মাঝে শ্বাস নিতে ওঠে তিমির মতো। গভীর রাতে সে গান শোনে রাগ মালকোশ বা রাগ ঝিঞ্ঝোটি বা অন্যকোনো গান। এই সুর শোনাই ডুবে ডুবে বেঁচে থাকার শ্বাস। বরিদুরের থেকে মনের ভেতর থেকে খুব দূরের মতিয়া। বরিদুরের প্রিয়তমা ম্রিয়তমা হয়ে নিজের মনের ভেতর বসে থাকে।


আরেক ভোর। মতিয়া ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে। সংবাদপত্র এখনো আসেনি। মতিয়া একটু দূরে দেখতে পেল, বিরাট একটা গোরুর পাল এগিয়ে আসছে রাস্তা ধরে। সে খেয়াল করল গোরুর পালটার বেশ খানিকটা সামনে সংবাদপত্রের হকার বেশ জোরে সাইকেল চালিয়ে আসছে।

‘এখন তবে সংবাদপত্র পড়া যাবে’, এই ভাবনাটা তার ভেতরে আসার পরপরই আর একটা ভাবনা আসে, ‘এতবড় গোরুর পাল এই শহরের ভেতর কোথা থেকে এলো?’ পালটা আরো কিছুদূর এগিয়ে এলে মতিয়া বড়োই লজ্জিত হয়। গোরুর পাল নয়, মানুষের পাল। একটা বিরাট মিছিল। মানুষের মিছিল। ঊনপাঁজুরেগুলোর হাতে ফুল আর ফুলের মালা। মহামন্ত্রিকে তারা ফুল আর ফুলের মালা দেবার জন্য আসছে।

এর মধ্যেই মহামন্ত্রি খবর পেয়ে ঘুম থেকে উঠে ব্যালকনির দিকে গসগস করতে করতে এলেন-

: ‘শালা গোরুগুলো এত সকালে চলে এলো! একটু ঘুমাতেও দেবে না দেখছি!’

কতদূরে মিছিলটা আছে দেখে মহামন্ত্রি ওয়াসরুমে গেলেন। এর মধ্যেই মিছিলটা পৌঁছে গেছে বাড়ির সামনে। দারোয়ানরা তাদের কাছে থেকে ফুলের মালা আর ফুলের তোড়া সংগ্রহ করে নিয়ে বাসায় ঢুকে। মতিয়া দেখল, মহামন্ত্রি ফুলের মালা গলায় দিয়ে চলছে। মতিয়া ভাবছে, সে চলছে কিন্তু কোথায় চলছে; সে বলছে কিন্তু কি বলছে, সে ছলছে কিন্তু কাকে ছলছে; যারাকে ছলছে তারাও তো রক্তমাংসেরই মানুষ। মহামন্ত্রির খাদ্যতালিকায় রয়েছে মানুষ, বসে বসে খায়; তার বাদ্যতালিকায় মানুষ; সে এদের বাজায়, এরা বেজে বেজে নাচে।

মহামন্ত্রি ব্যালকানিতে এসে দাঁড়ায়; মালার আলোয় তার মুখ ঝলমল করছে; তাকে দেখে মানুষপতঙ্গ একেবারে ভনভন করে উঠল। মতিয়া ততক্ষণে ব্যালকনি ছেড়ে বসার ঘরে সংবাদপত্র পাঠের উদ্যোগ করছে। মহামন্ত্রি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে হাত নাড়ে মানুষগুলোর উদ্দেশ্যে।

তার গলায় ফুলের মালা, তার মুখে দাঁতের মালা; সে ভাষণ দেয়-

: ‘আপনারা এসেছেন কষ্ট করে। আমার খুব ভাল লাগছে। যদিও আপনাদের আসার দরকার ছিল না। আমি তো আপনাদেরই গোলাম। আমিই যাব আপনাদের কাছে। যে ব্রীজ হয়েছে তার জন্য আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন এতে আমি খুশি। যদিও এসব কাজের আমার কৃতিত্ব তেমনকিছুই নাই; তালগাছের শেষ তিন হাত তো আপনাদেরই। যাহোক, আমাদের উন্নয়ন অব্যহত থাকবে। আপনারা ভাববেন না।’
এই ‘ভাববেন না’ টা উচ্চারণের সাথে সাথে মতিয়া ফ্রিজের ঘরের দিকে যায়; সে দেখে জনগনের সারি থেকে ‘ভাববেন না’ এর একটা শিশি নেই।

গতকাল ব্রীজ উদ্বোধন হয়েছে। লোকজনের উপকার হয়েছে। তারা ফুল দিয়ে গেল; যেন মহামন্ত্রি তার টাকা খরচ করে ব্রীজ বানিয়েছে। তারা বুঝতেই চায় না এসব রাস্তা, সেতু, কালবুদ, ড্রেন সবই তাদেরই টাকাতে তৈরি; এখানে মহামন্ত্রির কোনো দয়া নাই। তবু লোকগুলো বোঝে না, মনে করে মহামন্ত্রি ঋণদ আর তারা ঋণিক।

মতিয়া পেপারটি কোলের ওপর নিয়ে বসে। সে সংবাদপত্রের ভেতর ঢুকে। এটা একটা সমুদ্র। সে হাঁসফাঁস করতে থাকে। দুরঘটনা-দূর্ঘটনা। ধর্ষণ-ধর্ষণা। খুন্য-খুনি। চুরি-ডাকাতি। সংবাদপত্রের ভেতর ঢুকে তার মাথা গুলিয়ে ওঠে, বুক ধড়ফড় করে।
লোকজন বিদায় করে মহামন্ত্রি এসে মতিয়ার কাছে বসেন। মহামন্ত্রি মতিয়ার দিকে তাকিয়ে একটু হাসেন। তার হাসির ভেতর থেকে গোরুর চামড়ার তৈরি কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র বেরিয়ে এসে মতিয়ার কানের কাছে গিয়ে স্থির হয়। মতিয়ার কানের হাত বাদ্যযন্ত্রগুলোকে কানের ভেতর নিয়ে যাবার জন্য ধরতেই, মতিয়া এক ঝটকায় কানের হাতটাকে ধরে ফেলে। কানের হাত থেকে বাদ্যযন্ত্রগুলো খুলে পড়ে যায় মেঝেতে। ব্যাপারটা মহামন্ত্রি খেয়াল করলেন না। তিনি তার গলা থেকে কয়েকগাছি মালা মতিয়ার গলাতে পরাতে চাইলে, মতিয়া বলে-

: ‘আমি সংবাদপত্র পড়ছি।’

সংবাদপত্র থেকে একটা শেয়াল বেরিয়ে মহামন্ত্রির গলা খামচে ধরতে যাবার সময় মতিয়া সংবাদপত্র বন্ধ করে মহামন্ত্রির দিকে তাকায়। শেয়ালটা ছাড়বে কিনা বুঝতে পারে না। মহামন্ত্রি বলেন-

: ‘আজকে রাতেও খুব মজার স্বপ্ন দেখেছি। বেশ আনন্দ পেয়েছি’।

তিনি স্বপ্নটি হাতের ওপর নিয়ে মতিয়াকে দেখাতে গেলে মতিয়া সংবাদপত্রের শেয়ালটা ছেড়ে দেয় মহামন্ত্রির দিকে। মহামন্ত্রি সংবাদপত্রটির পাতা দেখে, যেখানে মতিয়া আঙ্গুল দিয়ে আছে-

: ‘ব্রীজে কয়েক কোটি টাকার দুর্নীতি।’

: ‘আরে তুমি এগুলো তুমি কী দেখ! পেপারওয়ালাদের কাজ!’

সে আবার হাসে- ‘টাকা আমি লোপাট করেছি ঠিকই কিন্তু তুমি এসব নিয়ে ভেব না। আমার কিছুই হবে না। আরও কয়েকটা রাস্তাঘাটের প্রকল্প রয়েছে সেগুলোতেও ভালো টাকা আসবে।’

বরিদুরের মুখ চকচক করে উঠল। লোভে আতুর মানুষটার দিকে মতিয়া ঠাণ্ডা হয়ে তাকিয়ে থাকল। মহামন্ত্রি বিরক্ত হয়ে উঠে গেলেন গসগস করতে করতে-

: ‘এ রাক্ষুসী কিসে খুশী কে জানে। আমার ভেতর ভেঙে দিয়ে সবসময় একা একা বসে থাকে।’

মতিয়া এসব শুনতে পায় না। তবে বুঝতে পারে মহামন্ত্রি তাকে খারাপ কিছুই বলেছে। মহামন্ত্রি খুব করেই তাকে চায় হাসিখুশিভাবে কিন্তু মতিয়া যতদিন যাচ্ছে তত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে মহামন্ত্রির প্রতি।

মানুষের স্বাভাবিক ক্ষুৎ মেটে অস্বাভাবিক ক্ষুৎ কোনোদিনই মেটে না। বরিদুরের ক্ষুৎপিপাসা, লোভ সবই অস্বাভাবিক; গাছেরও খায় তলেরও খায়; খেতে চায়। এমন লোভ-বৈকল্য লোকটার ভেতর যে মতিয়া ঘৃণা করে তাকে; তার সঙ্গসাথে থাকার চেয়ে ঐকল্যই ভালো লাগে তার। এক ভবনে দুই ভূবনে তারা বাস করছে; দুজনের প্রেমপ্রতিমা তৈরি হচ্ছে না।

মহামন্ত্রি উঠে যাবার পর, মতিয়া পেপারটাকে হাত দিয়ে ঘষে ঘষে আগুন ধরিয়ে ফেলে। ছাই হয়ে গেল পেপার। ‘পেপারের ছাইগুলো দিয়ে কিছু একটা করতে চাই, এই যেমন- কথা বলা পুতুল বা ছারপোকার ডিম বা দূরে যাবার ঘোড়া’ এমন কথা মনে মনে ভাবল। ছাইগুলো দিয়ে ঠিক কী করবে তা ঠিক করার আগেই পানি দিয়ে গাঢ় লেই তৈরি করে। পোড়ানোর সময় পেপারের ভেতর থেকে অজস্র আর্তচিৎকার ভেসে আসছিল। পানি দেবার ফলে থেমে গেছে আর্তি। মতিয়া চুপ। চুপচাপ। লেইগুলো নাড়াচাড়া করতে থাকে। নাড়াচাড়া করতে থাকে। সে নাড়াচাড়া করতে থাকে অনেকক্ষণ ধরে কারণ সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না লেই দিয়ে সে কী করবে।

এ সময় আবার মহামন্ত্রি ঘরে ঢোকে আর মতিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে-

: ‘বাহ্ ছাই দিয়ে বেশ চমৎকার পুতুল তৈরি করেছ তো।’

মতিয়া তার হাতের দিকে তাকায়। মতিয়াও অবাক হয়। সত্যিই সুন্দর একটা পুতুল তার হাতে। লেই নাড়াচাড়া করতে করতে কখন তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু পুতুলটি ছাই দিয়ে তৈরি; এটা কালো হবার কথা কিন্তু একেবারে ধবধবে সাদা হয়েছে। যেন দুধের তৈরি। তার হাতে যে ছাই লেগে আছে তা কালোই আছে। সে ভীষণ অবাক হয়ে ঘরের এককোণে রেখে দেয় শুকানোর জন্য। মহামন্ত্রি কোনো এক জনসভাতে যাবার জন্য বেরিয়ে গেলেন।


আরেক কোনো ভোর। মতিয়া খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বসার ঘরে পেপার কোলে করে বসে। আজকেও মন্ত্রির বিরুদ্ধে রিপোর্ট- ‘বস্তির লোকদের ঘর জ্বালিয়ে তাড়িয়ে দিয়ে মন্ত্রির বস্তি দখল।’

দোস্তির চেয়ে জবরদস্তিতে কাজ করতে পছন্দ করে এরা। মতিয়ার ভেতর বিতৃষ্ণায় ভরে যায়।

হৃৎপিণ্ডের ভেতর মতিয়া একটা শব্দ শুনতে পায়, যেন একটা ব্যাঙকে একটা সাপ কামড়ে ধরে আছে। সে একটা ছুরি নিয়ে আসে, বুক ফেড়ে এই সাপ আর ব্যাঙকে বের করার জন্য। সে তার শাড়ি খুলে ফেলে। ব্লাউজ খুলে ফেলে। সে ছুরিটা ঠেঁকিয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করে, বুকের ভেতরের কোনদিক থেকে শব্দ আসছে। যেখান থেকে ব্যাঙের করুণ শব্দ আসছে, সেখানটাতেই ছুরি দিয়ে সুন্দর করে কাটতে হবে। সে তার নিশানা ঠিক করে। ছুরি ঢুকবে এখন সুন্দর বুক চিরে। সে চোখ বন্ধ করে।

‘আজ থেকে তোমার পেপার পড়া বন্ধ’- মহামন্ত্রি বললেন। হঠাৎ করেই তিনি ঘরে ঢুকেছেন। ছুরিটা কেড়ে নিয়ে দূরে ফেলে দিলেন তিনি। তিনি মতিয়াকে জড়িয়ে ধরে বসতে বসতে বললেন-

: ‘পেপার পড়ে পড়ে তুমি বিষণ্নতায় ভুগতে শুরু করেছ।’

তিনি তাকে ব্লাউজ পরিয়ে দেন। শাড়ি পরতে সাহায্য করেন। তাকে সহজ করার চেষ্টা করেন।

: ‘আজকেও একটা মজার স্বপ্ন দেখেছি। প্রতিদিন আমি মজার মজার স্বপ্ন দেখি। ঘুমুতে বেশ ভালো লাগে আর তুমি পেপার পড়ে পড়ে শুধু বিষণ্নতায় ভুগো। পেপারগুলোর কাজই অবশ্য আমাদের ভোগানো।’

মতিয়া চিন্তা করে, এই লোকটা কিভাবে প্রতিরাতে মজার স্বপ্ন দেখে। মহামন্ত্রি বাসা থেকে বেরিয়ে গেলে মনে পড়ে তার পুতুলটির কথা। পুতুলটি সে দেখতে যায়। কিছুটা শুকিয়েছে। আরো একটু উজ্জ্বল হয়েছে। পেপার পোড়া ছাইয়ে তৈরি ধবধবে সাদা পুতুল।


ঘুমুতে গেলেন মহামন্ত্রি। মতিয়া মনে মনে ভেবে নিল, আজকে মহামন্ত্রির স্বপ্ন দেখা দেখব। মহামন্ত্রি নাক ডেকে ঘুমুতে শুরু করেছেন। ডিমলাইট জ্বলছে। অন্ধকার যত বাড়ছে ডিমলাইট তত উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। মতিয়া মহামন্ত্রির দিকে তাকিয়ে আছেন। মন্ত্রি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন কিনা বুঝতে পারছে না মতিয়া। সে পায়চারি করছে আর একবার করে তাকিয়ে দেখছে বরিদুরের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল কিন্তু মন্ত্রি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে কিনা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না মতিয়া। কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে না সে। সে ওয়াসরুমে গেল। চোখে মুখে ঠাণ্ডা জল ছিটাল। ফিরে আসার সময় তার নিজের বেডরুমের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখে। ‘মতিয়া তার বেডরুমে নাই’ মতিয়া উচ্চারণ করল। যেন সে আশা করেছিল, সে তার বেডরুমে শুয়ে থাকবে আর তার নিজের শুয়ে থাকার দৃশ্য দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে পাবে; যেমনভাবে মহামন্ত্রিকে দেখে এসেছে কিছুক্ষণমাত্র আগে।

সে তাকে তার রুমে শুয়ে থাকতে দেখতে না পেয়ে হাঁটা ধরে। পরের রুমটা তাদের মিলন কক্ষ। তারা একসাথে ঘুমায় না। দুজনের দুটি বেডরুম। শুধু সংগমের প্রয়োজন দেখা দিলে মহামন্ত্রি তাকে এ রুমে ডেকে নেন; মতিয়াও গিয়েও হাজির হয়। মতিয়ার মাংসের ভেতর সে আগুন খোঁজে; জল খুঁজে; তুফান খুঁজে। কখনো পায় কখনো পায় না। শরীর ভেতর আগুন খোঁজা, শরীরের ভেতর আগুন গোঁজা যখন ঠিকমতো হয় না দেখে তখন খুব মন খারাপ করে বরিদুর। বলে, মনে শরীরে এমন অনাহ্লাদ সেঁটে রাখো কি করে? ছোঁয়া দাও না গভীর করে; ছোঁয়ার ছায়া ছোঁয়াও শুধু।

মতিয়া ভেবে দেখেছে, খাবার- দরকার ও বিনোদন; যৌনতা- বিনোদন ও দরকার; ক্ষমতা- এই দুটোকে সংগ্রহ করতে পারে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় মন্ত্রি তাকে খুব ভালোবাসে কখনো মনে হয়, কোনো বিনয়বিদ্যা, কোনো প্রণয়বিদ্যা তার আছে কি? আমাকে একজন ভোক্তব্য নারী ছাড়া আর কিছু ভাবে কি?

তবু অবশ্য কখনো কখনো মতিয়া যৌনতার বিনোদনটুকু মন্ত্রিকে দেয় নিজেও কখনো নেয় কিন্তু সবসময় দরকারটুকুকে এড়িয়ে যায়। যৌনতার দরকার মানে তো জন্ম দেওয়া; পরে জন্মিতের হাতেই খুন হওয়া; সংবাদপত্রে কতই তো দেখা যায় নিজ সন্তানের হাতে পিতামাতা খুন হয়েছে। আবার, জন্ম দেওয়া মানে মানুষেরই জন্ম দেওয়া যারা লোভে, ক্ষোভে, হিংস্রতায়, ধুরন্ধরতায়, অন্ধতায়, কপট কথায়, কূটচালে অপূর্ব; অন্যকে ঠকানো, লুণ্ঠন, ঘামিয়ে নিয়ে বেড়ানো। মানুষ জন্মের পর শিশুকালে মায়ের কোলে হয়ত কিছু ভালো থাকে যদিও তখনও নানারকম রোগে কষ্ট পায়; আর বড়ো হলো তো দুঃখ যাতনা বেদনার কোনো ইয়ত্বা থাকে না; একটা প্রাণের ভেতর কতরকম জীবন, কতরকম যন্ত্রণা গোঁজা থাকে সোজা হতে দেয় একদিনও মানুষকে।

সে জন্ম দিতে চায় না। সঙ্গম শেষ হবার সাথে সাথে ওয়াসরুমে গিয়ে প্রস্রাব করে; এতে করে বীজ বেরিয়ে যায়। এটা অবশ্য তার নিজের আবিষ্কার করা ধারণা এতে কাজ হয় কিনা জানে না কিন্তু এটা করে এবং এখন পর্যন্ত গর্ভ হয়নি তার; হয়ত এমনিই হয়নি কিন্তু তবু সে সঙ্গম করার পর প্রস্রাব করেই।

সে তাদের সঙ্গম বেডের দিকে তাকাল। দুটো বিড়ালের মিলন দেখতে পেল। বিড়াল দুটোর একটা সাদা একটা কালো। বাসাতে এমন দুটো বিড়াল যে থাকে তা তার জানা ছিল না। তাদের রুমে, তাদের সঙ্গম বেডে বিড়াল দুটোর রতিক্রিয়া দেখে ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে যায় মতিয়ার। বিড়ালদের বিরক্ত না করে সে পা বাড়ায়। এরপরেই মহামন্ত্রির বেডরুম। মতিয়া মহামন্ত্রি বরিদুরের দিকে তাকাল।

তার ঠোঁট দুটো ঈষৎ হাস্যন্মুখ। নীরব হাসি হাসছে মহামন্ত্রি। এরপর কিছুটা শব্দ করে হাসছে। মতিয়া বুঝতে পারল, মহামন্ত্রি স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন। সে তার দিকে তাকিয়েই আছে। অনেকক্ষণ পর খেয়াল করে, মহামন্ত্রি দুচোখের কোণ বেয়ে অজস্র অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তার হাসিমাখা ঠোঁট দেখাতেই এতক্ষণ ব্যস্ত ছিল সে। লাল রঙের হাসি, কালো রঙের হাসি, হলুদ রঙের হাসি তার ঠোঁট দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। সে একটা লাল হাসির ফিতা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছিল। হলুদরঙের হাসিটা হাতে তুলতে যাবার সময় তার চোখের দিকে চোখ যায় মতিয়ার।

মতিয়া ভেবে পায় না আজকে, এখন, মহামন্ত্রি মজার স্বপ্ন না ব্যথার স্বপ্ন দেখছে। তার ঠোঁট থেকে রঙবেরঙের হাসির ফিতা পড়তেই আছে। অপরদিকে তার চোখ থেকে জলের ধারা বইতেই আছে। সে তার রুমে ফিরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায়। তার ঘুম দরকার।

মতিয়া সকালে ঘুম থেকে জাগার পর এসে বসেছে বসার ঘরে। এখানে এখন আর পেপার আসে না। কিছুক্ষণ পর মহামন্ত্রি এলেন। আজ খুব আগ্রহ নিয়ে তাকাল তার দিকে মতিয়া। তিনি শুরু করলেন তার স্বপ্ন বৃত্তান্ত। মজার স্বপ্ন বৃত্তান্ত। অবিশ্বাসের চোখে তাকায় মতিয়া-

: ‘তুমি কাল রাতেও মজার স্বপ্ন দেখেছ?’

সে গভীরভাবে মহামন্ত্রির চোখের দিকে তাকায়।

মহামন্ত্রি বলেন-

: ‘হ্যাঁ, কেন?’

মতিয়া মন্ত্রির চোখ আরো গভীর করে দেখে, যতক্ষণ কথা বলে ততক্ষণ কথার গতি পরীক্ষা করে মনে মনে। কিছু বুঝে উঠতে পারে না। মতিয়া আরো কয়েকদিন মহামন্ত্রির স্বপ্ন দেখা দেখে, রাত জেগে জেগে। প্রায় প্রতিরাতেই একই ধরণের অভিব্যক্তি দেখা যায় বরিদুরের মুখে। প্রতিদিনই মহামন্ত্রি সকালে এসেই মতিয়ার কাছে বলতে শুরু করেন, মজার স্বপ্ন বৃত্তান্ত।


কয়েকদিন পরের ভোর। মতিয়া বসে আছে বসার ঘরে। হঠাৎ তার চোখ যায় ঘরের কোণের দিকে। যে কোণের কাছে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট একটা পুতুল। সে সেদিকে এগিয়ে যায়। পুতুলটি একেবারে সাদা ধবধবে। এমন ধবধবে রঙ আর কোনোদিন দেখেনি বলেই মনে হলো তার। পুতুলটিকে সে হাতে নেয়। পুতুলটি হেসে জিজ্ঞাসা করে:

: ‘কেমন আছ তুমি?’

মতিয়া চমকে উঠে, তার হাত থেকে পড়ে যায় পুতুল। পুতুলটা কঁকিয়ে ওঠে-

: ‘উহ্, কেনো ফেলে দিলে আমাকে, আমাকে তোলো’।

মতিয়া অবাক হয়ে এদিকওদিক তাকায়। আবার পুতুলের দিকে তাকায়। কথা বলা পুতুল কথা বলতেই আছে-

: ‘আমাকে তোলো, আমাকে তোলো’।

মতিয়া ধাতস্ত হয়ে কথা বলা পুতুলটিকে তোলে-

: ‘তুমি কথা বলতে পার? তুমি আমার কথা বলা পুতুল, তোমাকে আর ফেলব না। তুমিই আমার আত্মা’।

তারা বহুক্ষণ কথাবার্তা বলে। একসময় মহামন্ত্রির প্রসঙ্গ আসে। তার স্বপ্নের প্রসঙ্গ আসে। স্বপ্নের ব্যাপারে সে পুতুলটার কাছে জানতে চায়-

: ‘মহামন্ত্রি সকালে যখন তার স্বপ্নের কথা বলে তখন নিশ্চয়ই মিথ্যে বলে?’ পুতুলটি বলে-

: ‘না, সে মিথ্যে বলে না। সে সত্যিই বলে। তার খারাপ বৈশিষ্ট্যগুলো এত প্রখর যে, সেগুলোই তাকে মজার স্বপ্ন দেখায় আর সে হেসে ওঠে স্বপ্নের ভেতর। কিন্তু আত্মাটি তার কেঁদে ওঠে। ঘুমের ভেতর থাকে যখন তখন তার আত্মার কান্না বেরিয়ে আসে চোখ দিয়ে। যেহেতু তার খারাপ বৈশিষ্ট্যগুলো বেশি শক্তিশালী সেহেতু আত্মার ব্যথা পাওয়াটা সকালে মনে থাকে না। এ ধরণের মানুষ তার আত্মার কান্না দেখতে পায় না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *