গোলাপ ফোটার গোপনীয়তা

গল্প কী? গল্প আসলে তেমন কিছু না। আমার কিংবা আপনার কথা তোমাকে বা তাকে শোনানো। এই ক্ষেত্রে আমি বা আপনি বক্তা হলে তুমি বা সে শ্রোতা। আমি বা আপনি লেখক হলে তুমি বা সে পাঠক।

‘আমার’ কথাই মূলত গল্প। কেমন করে যাই, কেমন করে গাই, কেমন করে বাঁচি-মরি, কেমন করে ভালোবাসি, মুখ ভেংচাই, দাড়ি কাটি, ক্ষুর ধরি ইত্যাকার বিষয়াদি। তবে কোনো ঘটনার বর্ণনা দেয়া বা কাহিনি বলা মানেই গল্প নয়। তা তো যে কেউই পারে। সত্যকে মিথ্যার আভরণে মহিমা দিতে পারলেই গল্প হয়। এইখানে মিথ্যা বলতে কল্পনাপ্রতিভাকে বুঝিয়েছি, যা মূলত সত্যাশ্রয়ী। সত্যের বাইনারি যে-মিথ্যা তাকে বুঝাইনি।

গল্পের ধরন কী? এর আসলে কোনো ধরন নেই এখন। একবাক্যে গল্প হয়, কাফকার এমন আছে। আবার চাইলে এক শব্দেও গল্প হয়। ধরুন, আপনি লিখলেন, ‘লাল’। এই একটা শব্দের ভেতর যে মাইল মাইল গল্প নিহিত তা প্রলম্বিত করবে পাঠক তার মাথার ভেতর। এই উদাহরণ পৃথিবীর মহান গল্পকারগণ আরো ষাট বা সত্তুর বছর আগে দেখিয়ে গেছেন। পাঠক এইসব আপনি খুঁজে নেবেন। আমি একটা গল্প লিখি:

ভোরবেলা রাস্তায় হাঁটতে বের হয়েছি। আজান হচ্ছে সবে মাত্র। আমাদের গেইটের বাইরে বেরিয়ে দেখি একটা পাগল আমাদের বিল্ডিংটার সামনে মাথা ঠুকছে, আর বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। স্বভাবতই আমি পাগলটা কী বলছে শোনার চেষ্টা নিলাম। তার পাশে বসে পড়লাম। শুনলাম, সে বলছে, ‘আল্লা! আমাকে নিষ্ঠুর হবার ক্ষমতা দাও, আল্লা! আমাকে নিষ্ঠুর হবার ক্ষমতা দাও, আল্লা! আমাকে নিষ্ঠুর হবার ক্ষমতা দাও, আল্লা! আমাকে…’ এই একটি কথার লুপে সে আটকে গেছে।

প্রমিত উচ্চারণে বলছে শুনে মনে হল শিক্ষিত পাগল। বয়স ৪০/৪২ এই রকম কিছু একটা হবে। চুল বড়ো। জটাও হচ্ছে। গায়ে একটা কালোরং শার্ট, শীর্ণ ময়লা আর একটা ছাইরং প্যান্ট। পায়ে কোনো জুতা বা স্যান্ডেল নেই। ময়লা পা, তাও মনে হচ্ছে তার পায়ের গড়ন সুন্দর। চোখ দেখা যাচ্ছে না, কারণ সে সিজদার মধ্যেই আছে।

পাগলটা নিশ্চয়ই বিল্ডিংটাকেই মসজিদ ভেবে এই করছে। একবার ভাবলাম তাকে পাশের মসজিদটা দেখিয়ে দিই, কিন্তু পরে আর দিলাম না। কারণ আমার হঠাৎ করে গালিবের একটা শায়েরি মনে পড়ে গেল।

এই গল্প প্রথাগত কাঠামোতে লেখা নয়। এইখানে পাঠকের জন্যে অনেক ফাঁকা জায়গা রাখা আছে। পশ্চিমারা এই ধরনকে বলে ফ্লাশ ফিকশান। এমন গল্প হঠাৎ করে শুরু হয়, হঠাৎ করেই শেষ হয়, যা শেষ না হবার মতোই।

ছোটোবেলা থেকেই আমার গল্পের সঙ্গে বসবাস। তখন মনে হত কাহিনি আকারে ছোটো হলেই গল্প হয়। আর বড়ো হলে হয় উপন্যাস। কিন্তু একদিন রবীন্দ্রনাথের পদ্য পড়লাম একটা,

ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা/ নিতান্ত সহজ সরল,/ সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি/ তারি দু-চারটি অশ্রুজল।/ নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,/ নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।/ অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে/ শেষ হয়ে হইল না শেষ।

শেষ হয়ে হইল না শেষ কথাটা মাথার ভেতর ঢুকে গেল। আর এই-ই হল গল্প। এইখানেই গল্পকারের মৃত্যু, পাঠকের শুরু। গল্পকার যেখানে শেষ করলেন, পাঠক সেখানে তার কল্পনার দ্বার উন্মোচন করবেন। তারপর রোঁলা বার্থ তার ‘ডেথ অব অথর’-এ লেখকের মৃত্যুর কথা বলেছিলেন। আর গল্পের প্রথাগত কাঠামো হল আদি-মধ্য-অন্ত নির্মাণ।

আমার কথা বলি, আমি লেখালেখির ক্ষেত্রে কাউকে অনুসরণ করি না। তবে নিজের লেখার মধ্যে মহান, অতিশয় ভালো কোনো লেখার প্রচ্ছন্ন প্রভাব থেকেই যায়। এটা এড়ানো সম্ভব না, আবার দরকারও নেই। এটা সকলের মধ্যেই থাকে। তবে নিজের স্বর আবিস্কারের চেষ্টাটা ভয়ানক জরুরি। আমি এক বসায় গল্প লিখি। আজকে একটু, কালকে একটু, সামনের বছর আরেকটু এইভাবে লিখি না। পরে অবশ্য অনেক কাটছেঁড়া করি। গল্প তো আসলে বানানোরই জিনিস, অনেকটা প্রতিমা বানানোর মতো, একটা কাঠামো বানিয়ে তার ওপর স্তরে স্তরে মাটি গুঁজে দেওয়ার মতো ব্যাপার। আমি যখন গল্প লিখি পাঠকের জন্যে অনেক ফাঁকা জায়গা রেখে দিই। কবিতায় সাধারণত আমি যে ধরনের স্পেস ব্যবহার করি, গল্পেও অনেকটা সেইরকম। আমার লেখা গল্প হঠাৎ করে শুরু হয়, যেন মাঝখান থেকে। যেন এর শুরু নেই, শেষ নেই। একজন গল্পলেখকের কাজ হল পাঠকের জন্য গল্পের ভিতরে আর শেষে ভাবনার জায়গা রেখে দেয়া, ফাঁকা জায়গা রেখে দেয়া।

ররীন্দ্রনাথ আমাকে ভাবাতেন। একদিন অনেকদিন পর তার ‘শাস্তি’ গল্পটা আবার পড়ে চন্দরাকে নতুনভাবে বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। তখন চন্দরা রাগ-ক্ষোভের ওপরে চলে গেছে, তখন আর রাগ কিংবা প্রতিবাদ করে কোনো লাভও নেই। রাগ থাকলে সে ভাসুরের দোষ নিজের মাথায় নিত না, কখনো। তার বয়স ১৭ কিংবা ১৮। সে স্বামীকে ভালোবাসতো। সেই স্বামী যখন বলতে পারে বউ হারালে বউ পাব, কিন্তু ভাই হারালে ভাই পাব না। ছিদামের এই স্বার্থপর বাক্য শুনে সে প্রথমে পাথর হয়, পরে তা অভিমানে রূপ নেয়, এবং আত্মবিধ্বংসী হয়েই খুনের দায় নিজের ঘাড়ে নেয়। চন্দরার ‘মরণ’ শব্দটি উচ্চারণের ভঙ্গি গল্প পড়ে আমি যা কল্পনা করি তাতে মনে হয় এই শব্দে লুকিয়েছিল অভিমান। আর তা তার অসহায় স্বামীর প্রতি যে ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বউকে বলি দেয়। এই অভিমান থেকেই চন্দরা সবখানে বলে খুনটা সে নিজেই করেছে।

১৯৯০ সালের ২৫ মে আমার নানি মারা গেলেন পানিতে ডুবে। শুক্রবারে সকালে তিনি পুকুরে স্নান করতে গিয়ে পুকুরে ডুবে মারা গেলেন। তখন আমি ফোরে পড়ি। ঘটনা শুনেই আমার মাথায় কল্পনা এল, মানে গল্প এল। আমার নানির এপিলেপ্সি ছিল। আমি ভাবলাম তিনি ভোরবেলা সেদিন শুক্রবার বাড়ির পাশের মসজিদের পুকুরের স্নান করতে গেলেন। ঘাটে বসে স্নানের আগে একটা বিড়ি খেলেন আয়েশ করে। বিড়ি খেতে খেতে উনার স্বামীর কথা মনে হল, কয়েকবছর আগে যিনি মারা গেছেন স্ট্রোক করে। যার কবর এই মসজিদের গোরস্তানেই। বিড়ি শেষে তিনি পুকুরে নামলেন। আর তার খিঁচুনি শুরু হয়ে গেল। মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে হতে তিনি পানিতে ডুবে গেলেন আর দম বন্ধ হয়ে মারা গেলেন। তারপর কিছুক্ষণ পর তার মৃতদেহ পানির ওপর ভেসে ওঠলো। গ্রামের পুকুরে শাপলা-শালুক, পদ্ম এইসব ফুল থাকে আমি দেখেছি। তো ভাবলাম, আমার নানির মৃতদেহ একটা পদ্মফুলের পাশে ভেসে উঠল, যেন নানির মুখটাও একটা পদ্মফুল। তখন একটা মাছরাঙা, পানকৌড়ি বা ডাহুক পুকুরপাড়ের ঝোঁপে বসে সমানে ডেকে যাচ্ছিল। জুমার আযান পড়ল। মুসল্লিরা পুকুর ঘাটে অজু করতে এসে নানির ভাসমান মৃতদেহ দেখতে পেল। ভাবলাম এইভাবে একটা গল্প হতে পারে। যদিও গল্পটা এখনো লিখিনি।

আপনি লেখক হলে খুবই তুচ্ছ ঘটনা, ছোট্ট বিষয় এইসব নিয়ে গল্প লিখে দেখতে পারেন। ধরুন, আপনি রাস্তায় হাঁটতে দেখলেন রাস্তায় একটা সেফটি পিন বা আলপিন বা এক টুকরো কাগজ পড়ে আছে। এটার পেছনে নিশ্চয়ই একটা গল্প লুকিয়ে আছে। সেই গল্পটাকে আপনি বের করে বিস্তার দিতে পারেন।

লেখক হবার পূর্বশর্ত পাঠক হওয়া। আমাদের প্রধান সমস্যা আমরা পাঠক হবার আগে লেখক হতে চাই। আমরা জানতে চাই না যে আমাদের জন্যে এটা অতিশয় খারাপ। এবং দুর্ভাগ্যের ব্যাপার।

আমরা দস্তইয়েফ্স্কি না পড়েই লেখক হয়ে যাই। এমন কি রবীন্দ্রনাথও তেমন পড়ি না। যদি দস্তইয়েফ্স্কির ছেলেটি, যার নাম রাসকোলনিকভ, তার যন্ত্রণা ধরতে পারেন তাহলে আপনি যথার্থ পাঠক। ‘অপরাধ ও শাস্তি’ একটানা পড়ে শেষ করে মনে আছে আমি পরদিন সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে রেড়িয়েছি। মনে হয়ে আমিই রাসকোলনিকভ, ভিড়ের মধ্যে গিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল, আমি খুনি, আমি খুনি…। আমরা নিকোলাই গোগোল না পড়েই গল্প লিখতে বসি। অন্তত তার ‘ওভারকোট’ পড়েন, পড়তে না পারেন খানিকটা পরে দেখেন। শতছিন্ন একটি ওভারকোটের ভেতর থেকে কেমন করে বাহির হয়ে আসে গল্পের নদীদল, তা আপনাকেই জানতে হবে। আমরা পুরাণ-কুরান, দর্শনবিজ্ঞান, ইতিহাস ভাসাভাসা জানি, এক লাইন মাইকেল পড়িনি। কিন্তু দুইলাইন ভাবালুতা করে বলি, ইহা কবিতা। লিখতে গেলে আমাদের সাহিত্যের মহান ওল্ডমাস্টার মাইকেল, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতি, মানিক, তারাশঙ্করসহ সকলের সব লেখাই পড়তে হবে, তাও জানি না। কারণ আমাদের ধৈর্যের বড়োই অভাব। সানগ্লাস পরে, দামি কাগজ আর মলাটে চারফর্মা আবর্জনা ছাপিয়ে লেখক হয়ে যাই।

হুমায়ূন আহমেদ গল্পের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ আর ইউনিক। আমাদের দেশে তার সঙ্গে তুলনা চলে এমন গল্পকার নেই বর্তমানে। বাইরে হারুকি মুরাকামির কথা বলা যায় । অবশ্য আমার মনে হয় হুমায়ূন মুরাকামির চেয়ে বড়ো গল্পকার। কেউ সংকলিত করুক বা না করুক হুমায়ূন আহমেদ রবীন্দ্রনাথের পরে বাঙলাসাহিত্যের সবচেয়ে বড়ো গল্পকার। এটা শিক্ষিত পাঠক মাত্রই জানেন। অবশ্য কতিপয় আঁতেল ঈর্ষাপ্রসূত হুমায়ূন আহমেদকে বর্জন করে থাকেন। তাতে তিনি মুছে যাবেন না।

একবার ওক্টাভিও পাসের একটা গল্প পড়ে আমি দীর্ঘদিন ঘোরের ভেতর ছিলাম, গল্পটার ভেতরই যেন সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াতাম, আমি হয়ে গিয়েছিলাম যেন সেই লোকটি, সমুদ্রের একটা ঢেউ যার পিছু নিয়েছিল, ঢেউটির জন্য তার জেল হয়, সে জেল থেকে বের হয়ে ঘরে ফিরে দেখে তার ঘর হয়ে আছে সমুদ্র, ঢেউটি তার জন্য প্রতীক্ষা করে আছে। হাসান আজিজুল হকের অনেক গল্প পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমার আলব্যের ক্যামুর কথা মনে হয়েছে। হাসান আধুনিক ও চমৎকার স্পেসের ব্যবহার জানেন। তারপর আসি শহীদুল জহিরের কাছে। তিনি অনন্য ছিলেন। তিনি গল্পে প্রচুর কথা বলতেন কিন্তু গতির কারণে বাহুল্য মুখ্য হয়ে উঠতো না। তার ভাষা অসাধারণ। যদিও তার ধরন বেরিয়ে এসেছে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘নিঃসঙ্গতার একশবছর’ থেকে, তারপরও সেটা তিনি নিজস্ব করে প্রকাশ করেছেন। এ ধরন অনেকটা মন্দিরের আঙ্গিনায় বসা কথকঠাকুরের মতো, মানে গল্পবলার ধরন। বড়ো কবি-শিল্পী-লেখকের সৃষ্টির মধ্যে খানিকটা রিপিটেশন থাকেই। যেমন আমাদের জীবনানন্দ দাশ, এস এম সুলতান ইত্যাদি। আর তাছাড়া শহীদুল জহির একটা ধরন ঠিকমতো তৈরির আগেই মারা গেলেন। আমাদের কতিপয় লেখকের মতো দিস্তায় দিস্তায় কাগজ নষ্ট করার বা কয়েক গিগাবাইট ওয়ার্ডফাইল ভরিয়ে ফেলার সময় পাননি। তার সমসাময়িকদের লেখার সঙ্গে তুলনা করলে তাদের দশভাগের একভাগও লেখেননি পৃষ্ঠার পরিমাণের দিক থেকে। তারা অনেকেই শহীদুলকে ব্যর্থ লেখক বলেন। আঙ্গিক নির্মাণের পর অনেক বড়ো লেখকই সেই আঙ্গিকে স্বাচ্ছন্দ্যে বন্দি থেকেছিলেন এটা বলা বাহুল্য। কিন্তু সেই দোষে শহীদুল জহিরকে যদি ব্যর্থ বলা হয় তবে তার প্রতি কি অবিচার করা হয় না? ‘ডুমোরখেকো মানুষ’-এ আমরা যে রিপিটেশন দেখি তা কতটা ‘ডলুনদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্পে’ প্রলম্বিত। কিংবা ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ আর ‘আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু’ কি এক জিনিশ? একজন লেখককে বাতিল করার আগে তার নিরীক্ষা ও ধরন নির্মাণের জন্যে তাকে লেখার যে সময়টা দেয়া দরকার সেই সময় কি শহীদুল জহির পেয়েছেন? তবে তিনি যদি গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের মতো সময় পেতেন তাহলে আমরা পাঠক হিসেবে আরো উৎকর্ষিত হবার সুযোগ পেতাম। সকলে তো আর সকল আঙ্গিকের বাইরে গিয়ে নিকোলাই গোগোল আর দস্তয়ভস্তির মতো ক্লাসিক সৃষ্টির মতো ব্যাপ্ততা নিয়ে লিখতে আসে না। শাহাদুজ্জামানের ‘মিথ্যে তুমি দশ পিঁপড়া’ পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। গল্পটা আসলে এক লেফটেনেন্টের চিঠি। তারপর তার অনেক গল্প পড়েছি ভালো লেগেছে। কিন্তু পরে বিরক্ত হয়েছি, যখন দেখি তিনি গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস আর হোর্হে লুইস বোর্হেসের গল্পবলার ধরনকে অনুকরণ করে গল্প লিখছেন।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ২০/২২ বছরের লেখালেখির জীবনে ৩২টার মতো উপন্যাস আর খুব সম্ভবত ৪০০টার ওপর গল্প লিখেছিলেন। তার একটা গল্পও ফেলে দেবার মতো নয়। তিনি চিন্তায় খানিকটা মার্ক্সবাদী ছিলেন এটাকে প্রধান কারণ বলব না আমি। মার্ক্সবাদ তাকে জীবন, সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা শিখিয়েছে এটা ঠিক। কিন্তু তিনি তাঁর গল্পে তা সফলভাবে প্রকট করার পেছনে যে কারণটাকে আমার সবচেয়ে বড়ো মনে হয়, তা হল চরম দারিদ্র্য।

জাকির তালুকদারের গল্প পড়তে পারেন। তিনি গল্পকার হিসেবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরাধিকার। তার মানে এই নয় যে স্টাইল এক বা, মানিককে অনুকরণ করেন। তার মানে বিষয় নির্বাচন আর নিরেট বাস্তবকে গল্পে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি মানিকের বরাবর।

আমার পছন্দের দুটো গল্পের কথা বলি। গল্প দুটোকে বাঙলা সাহিত্যের অনন্য সংযোজন বলেই আমি মনে করি। একটা আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘বৃষ্টি’, অন্যটা আল মাহমুদের ‘কালো নৌকা’। ‘বৃষ্টি’ গল্পটা আমার কাছে বানানো গল্প মনে হয় না, কিন্তু ‘কালো নৌকা’ গল্পটাকে মনে হয়। মনে হয় গল্পটা কতিপয় মানুষের অবদমিত বাসনাকে প্রকট করার চেষ্টা ছিল। গল্প মাত্রই যেকোনো ঘটনা বা কাহিনির বানানো রূপ। কিন্তু পাঠকের কাছে যদি তা বানানো মনে না হয় বা মনে হয় এমনটা ঘটতেই পারে, বা ঘটেছে তাহলেই সে গল্প সার্থক। যেমন সৈয়দ শামসুল হকের ‘রক্তগোলাপ’ বা শহীদুল জহিরের ‘ডুমুরখেকো মানুষ’ গল্পে এত জাদুকরী ব্যাপার থাকার পরও মনে হয় এমন ঘটেছিল কিংবা ঘটতেই পারে। যাদের গল্পে নতুন ধরন পাওয়া যায় তাদের কয়েকজনের নাম যদি করি তা এমন: কাজল শাহনেওয়াজ, সুমন রহমানের পড়তে পারেন মানস চৌধুরী, কৃষ্ণ জলেশ্বর, লাবণ্য প্রভা, হাসান মাহবুব, সাদিয়া সুলতানা, মাহমুদ মাসুদ, ইয়াসির আরাফাত, দুপুর মিত্র, ফজলুল কবিরী প্রমুখ।

আমরা জানি না যে, অন্যদের থেকে আলাদা হবার জন্যে, নিজস্ব ধরন তৈরি করার জন্যেই পড়তে হবে। দেখা যায়, লিখতে গেলেই অন্য অনেক লেখকের নকল হয়ে যায়। ধরা পড়লে বলি, আমি তো তার লেখা কখনোই পড়িনি। কিংবা বলি এটা নৈর্ব্যক্তিক অবচেতনের ফল। অনেকে আবার এটা কালেক্টিভ আনকনসাস। এমন বলে হয়তো কিছু সময়ের জন্যে পার পেয়ে যাই। কিন্তু সময় যে কী কঠোর জল্লাদ তা আমরা জানি না। জানি না যে সময় ঠিকই আমাদের গলা কেটে নর্দমায় ছুড়ে ফেলে রেখে যাবে, হয়ে যাব ইঁদুর আর গন্ধমুষিকের আহার। আহা! তারপরও জীবনানন্দকে নকল করে আমরা সময়কে বুড়ো আঙুল দেখাই, বলি, চমৎকার! ধরা যাক দুয়েকটা ইঁদুর এবার।

একবার আনিসুল হক মার্কেস আর মুজতবা আলীর দুইটা গল্প মিলিয়ে একটা গল্প লিখে ফেললেন। তারপর প্রথম আলোয় ছাপিয়েও ফেললেন। এ নিয়ে পড়ে গেল হইচই। তিনি বললেন এই ঘটনা তার জীবনে ঘটেছে, ঘটনার সাক্ষী তার স্ত্রী। এখন কথা হল আপনার জীবনে এমন অনেক ঘটনা আছে যা অনেক গল্পের সঙ্গে মিলে যায়, তো ওইসব ঘটনা নিয়ে আপনি লিখতে যাবেন কেন? আর লিখলেও একইভাবে লিখতে হবে কেন? একই ঘটনা তো অনেকভাবেই লেখা সম্ভব। ধরুন, আপনার ঘটনার মতো লেখা গল্প আছে তা আপনি জানেন না, তাহলে হয়তো আপনার আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে দুয়েকলাইন থাকতে পারে, তাও অতিশয় দুর্বল। কিন্তু যখন দেখা যায়, আপনার সবচেয়ে প্রিয় কথাসাহিত্যিক মার্কেস। আর আপনি নিজের জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে, আঙুলে এখনো কাটা দাগ আছে বলে, স্ত্রী সাক্ষী বলে তার গল্প ভেঙে নিজে একটা গল্প বানিয়ে ফেললেন তখন পাঠক আপনাকে ছাড়বে কেন? সকল পাঠককে অশিক্ষিত ভাবাও তো হঠকারিতা। আঙ্গিকগত মিল থাকতেই পারে। এইখানে আমি অনুকরণের কথা বলেছি। যেটা বলতে গেলে চুরির পর্যায়ে পড়ে। যেটা আসলে চোখে লাগে। চুরি করে যদি নিজের ধরনের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া যায় তাহলে শিল্পের সৃষ্টি হয়, এমন চুরি অনেক মহান লেখকই করেছেন। জীবনানন্দ চুরি করেছেন ইয়েটস, অ্যালেন পো প্রমুখ কবির কবিতা থেকে, সেটা তার নিজের কবিতা হয়ে গেছে। ইয়েটসের একটা কবিতা পড়ি, কবিতার নাম ‘He Reproves the Curlew’:

O Curlew, cry no more in the air,/ Or only to the water in the West;/ Because your crying brings to my mind/ Passion-dimmed eyes and long heavy hair/ That was shaken out over my breast :/ There is enough evil in the crying of wind.

এইবার পড়ি জীবনানন্দ দাশের একটা কবিতা। কবিতার নাম ‘হায় চিল’:

হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে/ তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!/ তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে।/ পৃথিবীর রাঙ্গা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;/ আবার তাহারে কেন ডেকে আনো?/ কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!/ হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে/ তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!

রবীন্দ্রনাথ অ্যালেন পো-এর গল্প থেকে নিয়েছেন। আবার তার ‘ডাকঘর’ নাটকের মতোই লাগে ল্যুসুনের কবিতা ‘দ্য পাসার বাই’। অ্যালান পো-এর ‘Annabe Lee’ আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এক গাঁয়ে’ দুই ভাষায় লেখা এক কবিতা। এর অর্থ কী? এর অর্থ রবীন্দ্রনাথ অ্যালান পোর কবিতা পড়ে ওই কবিতা লিখেছিলেন। কাজী নজরুল যেমন হুইটম্যানের কবিতা থেকে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখেছিলেন। শামসুর রাহমানের অনেক কবিতা ডিলান টমাস থেকে নেয়া। কিন্তু তা তার নিজস্ব হয়ে উঠেছে। শামসুর রাহমান যেমন, হুমায়ুন আজাদ যেমন এই রকম হাজার হাজার উদাহরণ আছে। হুমায়ূন আহমেদ একবার তার একটা গল্পের সঙ্গে হারুকি মুরাকামির গল্পের মিল খুঁজে পেয়ে অবাক হয়ে লিখেছিলেন। আমার ধারণা ভুলও হতে পারে যে হারুকি মুরাকামি হুমায়ূন আহমেদের লেখা পড়েছেন। তাই তাদের গল্পে মিল। ‘Blind Willow, Sleeping Woman’ বের হয়েছিল ২০০৬ সালে আর নব্বই দশকেই হুমায়ূন আহমেদের বই ইংরেজিতে বেশ কয়েকটা অনূদিত হয়েছে, এমনকি জাপানি ভাষায়ও সম্ভবত অনূদিত হয়েছে। আর জাপানে হুমায়ূন আহমেদ মোটামুটি পরিচিতও বলা যায়, জাপান টেলিভিশন তাকে নিয়ে ডকুমেন্টারি বানিয়েছিল। কিংবা হুমায়ূন মুরকামির গল্প পড়েও গল্প লিখে থাকতে পারেন। তবে সেই সম্ভবনা কম। মুরাকামি হুমায়ূনের সমসাময়িক হলেও হুমায়ূনের অন্তত ১০ বছর পর লেখালেখি শুরু করেন। ব্যাপারটা একবারে কাকতালও হতে পারে। কালেকটিভ আনকনসাসও একটা ফ্যাক্ট। এমন ব্যাপার বরাবরই ছিল। আমি তাদের কথাই বলেছি যারা চোরাইমালের ব্যবহার জানেন না। চৌকির মাঝখানে যা চোখা পেরেকের মতো হাঁ করে থাকে, শুলেই পিঠে বিঁধে। সময় এদের ক্ষমা করবে না।

প্রতি বছর আমাকে তরুণদের বেশকিছু পাণ্ডুলিপি পড়তে হয় অনুরোধে, কাজের সূত্রে সম্পাদনাও করতে হয় কিছু, এছাড়া প্রচ্ছদ ডিজাইন বা অলংকরণ করার সূত্রেও অনেক তরুণ বা নতুন লেখকের গল্প আমাকে পড়তে হয়। দুয়েকজন বাদ দিয়ে বেশিরভাগ নতুন ও তরুণলেখকের গল্প পড়ে আমি হতাশ হই। এদের একদল হুমায়ূন আহমেদের অনুকরণে গল্প লেখেন, অন্যদল শহীদুল জহিরের অনুকরণে। মাঝখানে একদল আছেন, যারা এখান থেকে এক কামড়, ওখান থেকে এক কামড় দিয়ে ঝুলে থাকেন। তার ওপর গল্পের প্লট সেই রকম স্টিরিও-টিপিকাল, কেবল বাঙলা সিনেমা আর প্যাকেজ নাটকের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, ইনিয়ে-বিনিয়ে সেই একই কাহিনি। এখন গল্পের নামে লোকজন নাটক লেখেন, সংলাপে ঠাসা, তারা জানেন না যে সংলাপবহুল গল্প সবচেয়ে দুর্বল গল্প। আর গল্পের নামে যারা নিচুস্তরের কাব্যিকতা আর হেঁয়ালি করেন। এরা বোঝেন না যে সহজ কথা সহজে বলতে পারলেই কথারা পূর্ণতা পায়।

লেখালেখির ক্ষেত্রে দায় ব্যাপারটা বাজে কথা। এইটুকু জানি ব্যক্তিসত্তা নৈব্যর্ক্তিক সত্তার পূর্বগামী। আমি সত্য হলে জগৎ সত্য, আমি মিথ্যা হলে জগত মিথ্যা। আমি বিন্দু। আমাকে ঘিরেই বৃত্ত, বৃত্তের পরিধি। প্রথমত রাস্তা বানাব আমি নিজে হাঁটার জন্যে। অপর সেই রাস্তাতেই হাঁটবে পরে। যেহেতু নিজের জন্যে বানাব, ভালো মতোই বানাব নিশ্চয়ই।

আমরা মনে করি লেখক হওয়া অনেক সহজ, অনায়াসে হওয়া যায়, যেন লিখতে পারলেই লেখক। কিন্তু জানি না যে, এ বড়ো কঠিন কাজ, অনেক সাধনার, অনেক পাঠপরিক্রমার। উদ্ভিদের মতো বীজ থেকে অঙ্কুরোদ্গম, তারপর চারা, ক্রমশ বৃক্ষ ও বৃক্ষের বয়স। বালিকার স্তন গজানোর মতো, দিনের পর দিন প্রতীক্ষা, অনেক রক্তের স্রোতে সাঁতার, ভয়, আনন্দ, সংকোচের ভেতর বঙ্কিম পথে হেঁটে হয়ে ওঠা গোপন গোলাপ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *