মা ও মায়াগাছ, লেখক : শারদুল সজল, ধরন : কবিতা, প্রচ্ছদ : আইয়ুব আল আমিন, অলংকরণ : সারাজাত সৌম, প্রকাশ : ২০২৫, প্রকাশক : ঐতিহ্য, মূল্য : ২০০ টাকা
মাকে নিয়ে বিশ্বে অগণিত কবিতা, উপন্যাস লেখা হইছে। যা এখনও চলমান। এ বিষয়ে তবুও লেখকদের অতৃপ্তি থাকেই যায়। বাংলাদেশ তথা বাংলাভাষার কবি শারদুল সজল’র ফেসবুক ও পত্র-পত্রিকায় তার মা বিষয়ক লেখার সাথে আগেই আমরা পরিচিত আছি। এবার ২০২৫শে বইমেলায় কবি শারদুল সজল মায়ের প্রতি গভীর প্রেম শ্রদ্ধা রেখে তার অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন মা বিষয়ক কবিতাগ্রন্থের মাধ্যমে। যার নাম ‘মা ও মায়াগাছ’। বইটিতে কবি মা’র সাথে মায়াগাছ সাদৃশ্যরূপকে চিত্রায়িত করেছেন। কবি যেহেতু শৈশবে মাকে হারান— মায়ের স্মৃতিটুকুই তার সম্বল। কবি নিজস্ব জগতে মায়ের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চান ।
তিনি মনে করেন মা তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস। মা নেই এটা মানতে নারাজ। কেন না পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকূলের জন্মের মূল কারিগর মা। মা এক অবিনশ্বর। প্রাণীর অস্তিত্বকে জানান—প্রাণের সঞ্চার করে প্রেম মমতায় বন্ধনে বড়ো করে তোলার মহান কাজটি আনন্দ চিত্তে করে যান মা। দেখা যায় প্রত্যেক সভ্যতায় বিশেষ করে মানবজাতি মা’র গুণকীর্তন করে পুঁথি, কবিতা, গল্প, সিনেমাসহ নানান সৃস্টিকর্ম রেখে গেছেন গুণিজন। রুশ কথাসাহিত্যিক মাক্সিম গোর্কির (১৮৬৮-১৯৩৬) উপন্যাস ‘মা’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯০৬ সালে। জনপ্রিয় বাঙালি কবি ও ঔপন্যাসিক অনুরূপা দেবীর (১৮৮২-১৯৫৮) উপন্যাস ‘মা’। নোবেল পুরস্কার জয়ী আমেরিকান ঔপন্যাসিক পার্ল এস বাক-এর (১৮৯২-১৯৭৩) ‘দ্য মাদার’ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালে নিউ ইয়ার্ক থেকে।
মা বিষয়ক লেখাগুলো সবসময় পাঠক চাহিদায় এক নম্বর তালিকায় থাকে। যা বলছিলাম—কবি শারদুল সজল এ সময়ের কবি। আমাদের কবি। মা-বাবাকে হারিয়ে প্রবাস জীবনকে বেছে নিয়েছেন। বিশেষ করে জন্মদাত্রী মা’র প্রতি স্মৃতিকাতর হয়ে মাকে ঘিরে এবারের কবিতাগ্রন্থটি প্রকাশ হয়। কবিতার বইটিতে আমরা সে আবহ দেখতে পাই। মাকে ঘিরে কবি’র অভিব্যক্তি অনুপ্রাসের এক সাইরেন বাজিয়েছেন। যার ফলে মা বিষয়ক কবিতাগুলো পাঠককে আন্দোলিত করার সক্ষমতা রাখবে। মায়ের প্রতি কবি’র আকুলতার অন্যান্য সৃস্টি মা ও মায়াগাছ। কবি কবিতায় মোলায়েম শব্দের ব্যবহারের মা’র প্রতি পাঠক মনকে মায়ের শিথানে নেওয়ার ম্যাজিক হতে পারে মাও মায়াগাছ।
সহজ প্রাণচাঞ্চল্য শব্দের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। কিছু কবিতায় ছন্দ, তাল লক্ষনীয়। যার ফলে নানন্দিকতার সৌর্ন্দযের স্রোত কবিতায় প্রবাহিত হয়েছে। ছন্দ জানেন বলেই ছন্দ ভেঙে আরেক অনিন্দ্য সুন্দরের দিকে শব্দরা ছুটে চলেছে। কবির শব্দ উপস্থাপনা-উপমা-উৎপ্রেক্ষার এক মায়াজালে আবদ্ধ করেছেন। এটা সম্ভব হয়েছে কবি কবিতা নিয়ে চর্চার জায়গায় আগে থেকেই নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন বলে। মা ও মায়াগাছ দুটি শব্দের ক্ষেত্রে পাঠক দ্বিধায় পড়তে পারে। মূলত মাকে ঘিরে কবি’র হৃদয়ে বিশাল গাছের জন্ম হয়েছে। যেটিকে তিনি মায়াগাছ হিসেবে অভিহিত করেছে। তাই তো কবি মা’র প্রত্যেকটি বিষয়কে ধারণ করে কবি বেঁচে থাকার প্রেরণা খোঁজে পান। সেসব ব্যজ্ঞনার সুর তার কবিতায়। কবি যেখানে যে অবস্থায় থাকেন—মা থাকেন তার ধ্যানে-জ্ঞানে।
আমি আমার মায়ের পায়ের শব্দ
বুকে তুলে ঘুমাই
আর ডাক্তার বলে- ওটা আমার হৃৎস্পন্দন।
(পায়ের শব্দ -পৃষ্ঠা -৯)
এ যেন ছিল মলিন, ধূসর পৃথিবীর সবচেয়ে দুখিদের একজন। সংসারে কূটচাল বুঝতো না। তার ভিতর নেই কোনো কৌশল। চারদিকের ঘুণপোকা তার জীবন ঘিরে ছিল। সবাইকে খুশি করাই তার ব্রত অথচ নিজের ভিতর চাপা রাখত শত কষ্ট। কবি চাইতো অনাচার সহ্য না করুক। তিনি মা’র জ্বলে ওঠার প্রতিক্ষায় থাকতেন—প্রতিবাদ করুক। পক্ষান্তরে মা যেনো এক বরফখণ্ড—যে পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রণা একাই বহন করতে প্রস্তুত। কবি অভিমান করে বলেছেন—
মাকে মনে পড়লেই
সামনে আসে এক বোকা জীবন
যে নিজেকে ভেঙে
টুকরো টুকরো করে
তার আস্তা জীবনটা জ্বালিয়ে দিয়েছে
উনুনে;
সকল দুঃখের অগ্রভাগে
মায়েরা কেন যে এত বোকা
বোকা মা- পৃষ্ঠা ১৩
শত ঝড়ঝঞ্ঝা প্রতিকূল এর মধ্যে সংসারকে আগলে রাখার দক্ষ নাবিক হল মা। মাকে সেই অর্থে কবি সংসার বিজ্ঞানের জনক হিসেবেও অভিহিত করেছেন। বিজ্ঞানির মতো মা সংসারকে সুখি করতে রাতদিন মেধাকে সংসার গবেষণায় ন্যস্ত রেখেছেন। ভুলেছেন তার নাওয়া খাওয়া। কবি তাই উচ্চারণ করেছেন-
স্টিফেন হকিং
মা এখন আমার কাছে সংসার বিজ্ঞানের জনক
(মা- সংসার বিজ্ঞানের জনক- পৃষ্ঠা ১৪)
কবি একার সন্ন্যাস। নিঃসঙ্গতাই তার নিয়তি। কবি শারদুল সজল শৈশবে মা-বাবা হারিয়ে নিঃসঙ্গতাকে তার সঙ্গী হয়েছে। বরং এই যাপনকে কবি আনন্দ চিত্তে গ্রহণ করেছে। নিজেকে সঁপে দিয়েছেন কবিতার খাতায়। কবি এবং কবিতা একই সুতায় বাধা পড়ে। কবিতার ঘোরে জীবনকে নিয়ে যান চাঁদের কাছাকাছি। কথা বলেন নক্ষত্রের সাথে—সমুদ্রের সাথে। যার ফলে প্রকৃতি হয়ে ওঠে পরমাত্মীয়।। অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে তার ভিতর জন্ম নেয় বিশাল মায়গাছ। যে গাছ তাকে আগলে রাখে। অতি দুঃখের সময় কবি’র সিথানে আসে। কবি জানে মায়গাছটাই তার মা। জীবনকে নির্মোহভাবে উদযাপনের মধ্যে প্রবাস সময়কে আলিঙ্গন করে। কবি বুঝতে পারেন—আত্মীয় স্বজন আপন বলতে কেউ নেই। কবি আপন মনে মা’র কথা বলেন।
সত্যি বলতে আমার যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না
তাই একবার ঈদে খুব আহ্লাদ করে আমাকেই আমি একটি চিঠি লিখেছিলাম।
বলেছিলাম, সামনে ঈদে অবশ্যই অবশ্যই তোমাকে বাড়ি আসতে হবে
প্রেরকের ঠিকানায় লিখেছিলাম আমার মায়ের নাম
যেন মা আমাকে বলছেন—
তোকে বাড়ি আসতেই হবে।
অথচ মা নেই আজ বহুবছর—বাবা নেই আজ বহু বছর
(চিঠি- পৃষ্ঠা ১৭)
মা’র প্রতি আমাদের সবারই দুর্বলতা আছে। সেইদিক থেকে কবি শারদুল সজল ব্যতিক্রম। কবিতা লেখার পাশাপাশি মা ভক্তি’র এক অন্যান্য সাধক কবি শারদুল সজল। তার রোমান্টিক কবিতার এক পাশে রেখে অন্য কবিতাগুলোতে মায়ের প্রতিচ্ছবি কোনো না কোনোভাবে অংকন করেছেন। যা ইতিপূর্বে তার লেখাগুলোতেও আমরা পেয়েছি। শুধু মা নয় পৃথিবীর সকল নারী, কন্যা, শিশুর প্রতি তার অসামান্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আছে বলেই সেসব লেখায় প্রতিফলন ঘটিয়েছে। মা নিয়ে আরো কিছু কবিতার সাথে পরিচিত হই।
মার নাকফুল বাতাসে খসে পড়ার সাথে সাথে
তার ঈদ হারিয়ে গিয়েছিল তুফান জলোচ্ছ্বাসে
তিন সন্তানের ছায়া হতে গিয়ে তিনি
গোপনে
আস্ত পৃথিবী মাথায় তুলে
হাসির লোকমায় প্রতিদিন অন্ধকারে যেতেন
(ঈদ-পৃষ্টা ২১)
অথবা—
মা তোমাকে হারানোর বেদনা
সকল বেদনার ঊর্ধ্বে
তাই আর কোন বেদনা
আমাকে ভাবায় না
কাঁদায় না
(বেদনা-পৃষ্টা ২৭)
অথবা—
একা ঘরে একা একা খাবার খেতে ইচ্ছে করে না
পাড়া প্রতিবেশী আশপাশের কেউ জানে না
ঘরভরতি থাকলেও একা একা খাবার খেতে ভালো লাগে না
তাই তো খাবারের ছাল থেকে
আমার মায়ের মমতাগুলো ঝরে পড়ে
হাহাকারে
তৃষিত আত্মার ডেরায়
(নরক-পৃষ্টা ৫০)
উক্ত বইয়ে ৫২টি কবিতা’র মধ্যে ৪২টি মাকে কেন্দ্র করে লেখা। মা বিয়োগ এই কবি’র শেষ সম্বল মা-বাবার দিকের স্বজনরা। অথচ স্বজনদের দ্বারা তিনি উপেক্ষিত। কবি মনোজগতের দার্শনিক বলেই কবি আঁচ করতে পেরেছেন স্নেহ ভালোবাসা নয় বরং প্রচন্ড স্বার্থপরতায় লুকিয়ে আছে তাদের ভিতর। যার জন্য তাদের প্রতি কবি’র আক্ষেপ—একধরনের অভিমান কবিতায় ফুটে উঠেছে। তা থেকে কিছু ক্ষোভের কিছু লাইন তুলে ধরলাম।
আত্মীয়েরা যেদিন আমাকে জিন্দা লাশ দাফন করেছিল
সেদিন থেকেই যেন আমি
বেঁচে উঠতে লাগলাম
(জিন্দা দাফন- পৃষ্ঠা ৫৪)
অথবা—
আত্মীয়দের কেউ এখন
ভালোবাসার কথা বললে খুন হই
রক্তে ভিজে ওঠে শরীর
পৃথিবী যেমন ধসে পড়ে বোমায় বন্দুকে
তেমনি আমিও—
ছারখার হয়ে হয়ে কেঁপে উঠি, পুড়ে যাই
আত্মীয়দের মায়ায়
(মায়ার ছুরি- পৃষ্ঠা ৫৬)
অথবা—
কারো কাছে আমার কোনো চাওয়া নেই
সব লেনদেন শেষ করে
এই আমি
নিজের ভেতর নিজেকে দিয়েছি
বিসর্জন
(বিসর্জন- পৃষ্ঠা ৫৭)
কবির পূর্বে পাঁচটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এটি তার ৬ষ্ট কবিতাগ্রন্থ। মা বিষয়ক কবিতাগ্রন্থ প্রকাশনায় তাড়াহুড়ো পক্ষে আমি না। কেন না কবি’র সামনে আরো ব্যাপক সময় পড়ে আছে। মা’কে নিয়ে তার নিকট থেকে আরো অজস্র লেখা পাব। তবে কবি’র তাড়াহুড়ো ছিল পাঠক এবং জগতের সামনে মা এক মহাজাগতিক শক্তির রূপকে প্রদর্শনের পাশাপাশি নিজের অনূভুতিকে শেয়ার করা। প্রত্যেকটি পৃষ্ঠা উল্টানোর মধ্যে দিয়ে মায়ের ক্যানভাসকে প্রচ্ছদ শিল্পী অলংকরণ করে জীবন্ত করে তুলেছেন। পাঠকের নিশ্চিত মনে হবে যে— এই মা আমার চিরায়ত গ্রামবাংলার মা। এই মা আমাদের মা। পাঠক এখানেই তার পূর্ণাঙ্গা মা-কে পাবে। তবে মা বিষয়ক কবিতা কবি আর না লিখলেও কবি’র প্রতি পাঠকের অনুরাগ থাকবে না। কবিকে যতটুক জানি মা বিষয়ক লেখা তার অন্তরে জমা আছে অজস্র। তিনি মনে করেন সে বাসনা শেষ হলে কবি’র মৃত্যু হবে। মা—যেন কবি শারদুল সজল’র বেঁচে থাকার এক আশ্চার্য নিরাময়। মা’র স্মৃতি তাঁর সকলে শক্তির প্রেরণা। মা ছাড়া কবি যেনো এক নিঃসঙ্গ শেরপা। বায়োগ্রফি কবিতায় তিনি বলেছেন—
পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছিল নিঃসঙ্গতার যে প্রথম জল
সেই আমি শারদুল সজল

অনিরুদ্ধ দিলওয়ার, জন্ম ৪ জানুয়ারী (১৯৮১), উত্তরার সন্নিকটে অবস্থিত মোল্লারটেক। পিতা-মাতার আদিনিবাস ঢাকায়। পড়াশুনা স্নাতক। লেখালেখি-কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুই। উপন্যাস- মেঘ জমেছে আকাশে (২০১০), কবিতা- প্রবুদ্ধ মেঘের ঘুঙুর (২০১৭), । সম্পাদনা- কবিতাভূমি (সাহিত্যের ছোটকাগজ )।