অন্ধ ডেভিডের প্রেমপত্র
একটি মাইক্রো জলজাহাজের উপস্থিতি আমি টের পাই
আমার নির্জন কক্ষের অন্ধকার সমুদ্রে—
আর একটি শব্দ শুনি ‘আমি ক্যাপ্টেন ডেভিড,
আমাকে সাহায্য করে একটি বিচক্ষণ জার্মান শেফার্ড।
আমি প্রায় অন্ধ।’
মধ্যরাতের ডেকে নেমে আসে আকাশের আবাবিল
আর কল্কে ফুলের নির্জন গন্ধের বাতাসে লেখা হয়—
‘জাহাজখানি একদিন আ্যামিবাদের অট্টালিকা থেকে
ভালোবাসার পাঁজর ঘেঁষে নেমে আসে গভীর শূন্যে…’
আমার স্বপ্নের ভেতরে বেড়ে ওঠা তরুণ সজারুর
কাঁটা দিয়ে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা শব্দ গেঁথে গেঁথে
জাহাজের ডেক ভরে তুলি, আর জার্মান শেফার্ড এসে
অন্ধ ডেভিডের প্রেমপত্র ভাসিয়ে দেয় নীল সমুদ্রে—
জলপরীরা সেইসব চিঠি পড়তে থাকে ফসফরাসের
মায়াবী আলোয়, তারা বিশাল বিশাল ঢেউয়ের মাথায় বসে
অক্ষর ও শব্দের ভেতরে ঘুমিয়ে পড়া অশ্রু ও আবেগকে
জাগিয়ে তোলে—
তখন বিষণ্ন চোখ তুলে, সমুদ্রের বিজস্ব ভাষায় বাতাস কাঁপিয়ে
সমুদ্র দেবতা পসিডন অন্ধ ডেভিডের মাথায় হাত রাখে, আর
তিনি দেখতে পান জলপরীদের প্রেমাদ্র অবয়ব সুদূরের ঘাটে—
এ এক রঁদেভু, রক্তময় পালকের পিঠে
প্রেম চলে গেছে দূরে, মাথাভাঙ্গা নদীর ওপারে—
দেখা ও না-দেখার ভেতরে পড়ে আছে রৌদ্রময় শোক
বেউলার চোখের জলে ডুবে গেছে জোনাকির ঘুম।
স্বচ্ছ স্ফটিকের মাঝে কার চোখ দেখি?
ভয়ংকর অন্ধকারে উঠোনের কোণে দাঁড়িয়ে আছে
রহস্য মানব, রক্ত-বৃষ্টিতে ভরে গেছে সকাল
ওখানে কার মুখ ডুবে আছে? কোন সে ময়ূরীর নাচ?
এত এত রাবণের বনে মরে গেল বিকেলের রোদ
ভেসে যাচ্ছে নির্জনতা অবসন্ন বাতাসের পিঠে—
দিনশেষে শূন্য বারান্দায় ঝরে গেল বকফুল
উড়ে গেল সব গান, সুরের চাহনি, ঝর্নার গোপন তুলি—
কচি ডালে, নরম পাতায়, শিশির ধোয়া নাগিনীর ছায়া
এ এক রঁদেভু, রক্তময় পালকের পিঠে—
দূরে, আশ্চর্যপুরে
কঙ্কাল ও কুয়াশায় ঢেকে আছে ধুবুনীর ঘাট—
গোধূলি পার হলেই পাবে তারে
এতদিনে কিছুই হয়নি জেনে গেছেন স্বয়ং ঈশ্বর।
শান্ত শিশুর মতন ক্ষুধা নিয়ে ঘুমোতে যাই,
মায়ের আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকি, স্বপ্নে দেখি—
মৃত মেষপালকের চোখ দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে।
আমি পিঁপড়ার সারিতে ঢুকে পড়ি
চলতে চলতে পিঁপড়াদের ভাষাটাও শিখে ফেলি,
অতঃপর গোধূলি পার হয়ে এলে ওরা বলে—এবার হবে দেখো।
এ শহরে পিঁপড়ারা খাদ্যের খোঁজে আসে
গোধূলি পার হলেই পাবে তারে;
এপারে শিশির নয় রক্ত ঝরে ভোরে, পিঁপড়ারা সেই রক্ত পান করে
সেই রক্ত পান করে আমি গভীর জঙ্গলে ঢুকি, কড়া নাড়ি নিস্তব্ধ
প্রাচীন এক দালানের; পিঁপড়ার দল শস্যদানা নিয়ে ফিরে গেছে,
আমি নিস্তব্ধ দালানের দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। ভুলে গেছি মানুষের ভাষা,
পিঁপড়াদের ভাষায় ডাকাডাকি করি, বাতাসে শূন্য এঁকে অবাধ প্রতিধ্বনি
মহাশূন্যের ভাঁজে ভাঁজে লিখতে থাকে নদীর পয়ার—
জোনাকির রক্ত মাখা আগুনের নকশা
সংসারে একদিন অগাধ পূর্ণিমা এসে দেখা দেবে,
বলে, হাই তুলে
তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। জগৎ নির্বান্ধব হল।
অলৌকিক শস্য ঠোঁটে নীড়ে ফিরছে পাখিরা,
হেঁশেলে এখন উপবাসে আছে পুরনো বটিটা,
মগজের সেরিব্রামে বালি উড়ছে বেহালার সুরে।
সংসারে একদিন অগাধ পূর্ণিমা এসে দেখা দেবে,
বলে, হাই তুলে
লোকটা গোরস্থানের অন্ধকারে মিশে গেল…
জোনাকিরা দাঁড় টেনে টেনে, আলোতে শান দিয়ে
তরঙ্গহীন লোলচর্ম দেহে, আনন্দে চোখ খুলে
কবরে কবরে সাঁঝবাতি জ্বালে। এই গ্রামে
হয়তো কোনো মৃত প্রেমিক প্রেমিকার মিলিত হবার
দিন আজ,
তাদের দুজনার আত্মার ফিনফিনে পোশাকে
জোনাকির রক্তমাখা আগুনের নকশা—
অগাধ পূর্ণিমা ঝড়ে পড়ছে তামাম দুনিয়ায়…
সিডিউল চেঞ্জ হওয়ার পর
ধর্মকলের খুব কাছাকাছি তোমাদের গ্রাম
তোমাদের গ্রাম্য খামারে রচিত হয়—মায়াযোগ
পালক মেশানো গদ্যের বুননে; পিঁপড়াদের ভাতঘুম
বেয়ে পাহাড়ে উঠছে লড়াকু কষ্টের ঠাটগুলো
প্রজন্মের বোদ্ধা লাঠিয়ালরা কুড়োতে থাকে
ঘুম ও স্বপ্নের মধ্যবর্তী জলের ভাসমান সাহস—
সিডিউল চেঞ্জ হলে আমাদের সৌভাগ্যের চাঁদ-তারা
বুঝে উঠতে পারে না জল-হাওয়ার গোপন সিঁড়িটি,
আর এভাবে স্থির হয়ে যায় হাটের কোলাহল
কোনো সকালই আর দুপুরের দিকে হাঁটে না
হাতঘড়ির অন্ধকারে বাসা বাঁধে চতুর ভাইরাস—
আমাদের এই ধর্মরাজ্যে তখন ধূর্ত চিলেরাই
কাব্যকলায় হাত পাকাতে অদৃশ্য স্নানঘরে ঢোকে—

কামরুল ইসলাম, জন্ম কুষ্টিয়া জেলার ফিলিপনগর গ্রামে। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। সর্বশেষ রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি একজন দ্বিভাষিক কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও ছোটগল্পকার।
কাব্যগ্রন্থ: দ্বিধাান্বিত সুখে আছি যমজ পিরিতে (১৯৯৯), ঘাসবেলাকার কথা (২০০১), যৌথ খামারের গালগল্প (২০০৬), সেইসব ঝড়ের মন্দিরা (২০০৮ ), চারদিকে শব্দের লীলা (২০১০), অবগাহনের নতুন কৌশল (২০১১), মন্ত্রপড়া সুতোর দিকে হাওয়া (২০১৪), দীর্ঘশ্বাসের সারগাম (২০১৬), বিহঙ্গখচিত লন্ঠন (২০১৭), নির্বাচিত কবিতা (২০১৯), কিছুটা ভোর, বাতাসের গদ্যসহ (২০২০, কলকাতা), আগাছার ইন্দ্রজাল (২০২১), গোপাল সাঁইয়ের কবিতা ( ২০২২)
ছোটগল্প: বিনির্মিত ভাসান, জল থেকে জলে ( ২০২০)
প্রবন্ধগ্রন্থ: কবিতার বিনির্মাণ ও অন্যান্য (২০০৯), রবীন্দ্রনাথ: বিচিত্রের দূত (২০১৩), কবিতার স্বদেশ ও বিশ্ব (২০১৫), কবি ও কবিতা: কবিতার আলো ও আঁধার (২০১৮), রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ (২০২১), কবিতার রংরক্ত, নিমগ্ন করতল (২০২৪)।