নারীবাদী তত্ত্ব : পুরুষতান্ত্রিক সমাজ

নারীবাদ শব্দটি ইংরেজি ফেমিনিজম শব্দের বাংলা পরিভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। অক্সফোর্ড অভিধানে ফেমিনিজম শব্দটির অর্থ করা হয়েছে : ‘বিলিফ ইন দ্য প্রিন্সিপল দ্যাট ওম্যান শ্যুড হ্যাভ দ্য সেম রাইটস অ্যান্ড অপরচ্যুনিটিস (লিগ্যাল, পলিটিক্যাল, সোশ্যাল, ইকোনমিক ইটিসি) অ্যাজ মেন।’১ অর্থাৎ মানুষ (পুরুষের সমান) হিসেবে নারীও রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার ভাগীদার। ফেমিনিজমের ব্যাখ্যায় এনসইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় বলা হয়েছে : নারীবাদ এমন একটি ধারণা যা ঊনিশ শতকের শেষের দিকে শুরু হয়ে আধুনিকতার দিকে যাত্রা করে এবং নারীর অধিকার নিয়ে কথা তোলে। একইসাথে এ ধারাণায় আত্মীকৃত হয় ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়াদিও; সামগ্রিকভাবে এটি এমন একটি আন্দোলনে রূপ নেয় যা মানুষ হিসেবে নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দাবি উত্থাপন করে।২

সুতরাং, আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য পুরুষের সমকক্ষতা লাভের যে আন্দোলন, তাই নারীমুক্তির আন্দোলন। নারীমুক্তির এ আন্দোলন থেকেই পরবর্তীকালে নারীবাদী তত্ত্ব বা ধারণার জন্ম। অর্থাৎ নারীসমাজ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে অনিবার্যভাবেই একটি তাত্ত্বিক ধারণার জন্ম দিয়েছে, যা নারীবাদ বা ফেমিনিজম হিসেবে পরিচিত।

ঊনিশ শতকের গোঁড়ার দিকে ইউরোপে নারীর ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নারীমুক্তির আন্দোলন শুরু হয়।৩ ইউরোপে এ সময় জন স্টুয়ার্ট মিল নারীর ভোটাধিকার প্রসঙ্গে পার্লামেন্টে দাবি উত্থাপনের পাশাপাশি তিনি লেখেন : ‘আমি নিশ্চিত যে-সামাজিক ব্যবস্থা আইনের দ্বারা এক লিঙ্গকে অধীন করে আরেক লিঙ্গের, সেটা সহজাতভাবেই খারাপ এবং সেটা মানুষের প্রগতির বিরুদ্ধে একটা বড় বাধা; আমি নিশ্চিত যে ওগুলো স্থান ছেড়ে দেবে বিশুদ্ধ সাম্যের জন্যে।’৪ মিল কর্তৃক উত্থাপিত নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিসেস ফসেটের নেতৃত্বে ইংরেজ নারীসমাজ রাজনীতিতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সংগঠিত হয়। একই সময়ে ফ্রান্সের নারীরা সংগঠিত হয় মারিয়া দারাইসেঁর নেতৃত্বে; তিনি ১৮৬৮ সাল থেকে ১৮৭১ সালের মধ্যে অনেকগুলো সম্মেলনে বক্তব্য-বিবৃতির দ্বারা নারীসমাজের প্রকৃত সামাজিক অবস্থা জনসমক্ষে বিশেষভাবে নারীর সামনে তুলে ধরেন। নারীবাদের আরেক প্রতিষ্ঠাতা লিয়োঁ রিশিয়ে ‘নারীর অধিকার’ বিষয়ে ১৮৬৯ সালে গ্রন্থ রচনা করেন এবং ১৮৭৮ সালে এ বিষয়ে তিনি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। এসব আন্দোলন ও সম্মেলনের মাধ্যমে ক্রমেই নারীর ভোটাধিকারের পাশাপাশি তাদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়। ফরাসি নারীসমাজকে ভোটাধিকার পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত; অবশ্য নিউজিল্যাণ্ডের নারীরা ১৮৯৩ সালে এবং অস্ট্রেলিায়ায় ১৯০৮ সালে ভোটাধিকার পায়। অন্যদিকে ইংরেজ নারীরা ১৯১৮ সালে নিয়ন্ত্রিত এবং ১৯২৮ সালে অনিয়ন্ত্রিত ভোটাধিকার লাভ করে। ফরাসি নারীদের ভোটাধিকার লাভে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণের কারণ অনুসন্ধান করে সিমোন দ্য বুভ্যুয়ার জানিয়েছেন :

তিরিশ বছর ধ’রে ফ্রান্সে ও ইংল্যাণ্ডে এ আন্দোলন থেকেছে খুবই ভীরু। স্থাপিত হয়েছে অসংখ্য সংঘ, কিন্তু অর্জন হয়েছে সামান্যই, কেননা লিঙ্গ হিসেবে নারীদের ছিলো সংহতির অভাব।৫

সময় থেমে থাকেনি, নারীসমাজও তাদের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে একের পর এক আন্দোলন, সম্মেলন, বক্তব্য-বিবৃতি দিতে থাকে; পরবর্তী সময় এ আন্দোলন ক্রমান্বয়ে বৃহত্তর পরিসরে তার কার্যক্রম শুরু করেছে। অন্যদিকে আমেরিকাতেও ঊনিশ শতকের শুরুতে নারীসমাজকে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছিল বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ নির্মাণের সময়, ফলে তারা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে পুরুষশাসিত সমাজে তখনো তাদের অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এ সময় আমেরিকায় নারীদের ভক্তি-শ্রদ্ধা করা হলেও পরিবারের বাইরে সমাজজীবনে তাদের কোনো কর্তৃত্ব ছিল না; কিন্তু ১৮৩০ সালের দিকে কতিপয় নারী রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে নিগ্রোদের পক্ষে সংগ্রাম শুরু করে। কুয়েকার নেত্রী লুক্রেশিয়া মোট এ সময় আমেরিকার নারীদের মুক্তির উদ্দেশ্য নিয়ে ‘নারী-মুক্তি সংঘ’ গঠন করেন। ১৮৪০ সালের এক সম্মেলনে লুক্রেসিয়া মোট এবং এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যানটন যৌথভাবে নারী-অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘সেনেকা ফলস-ডিক্লেয়ারেশন অব সেন্টিমেন্ট’ শীর্ষক যে ইশতেহার প্রকাশ করে, তার মধ্যে আমেরিকার নারীসমাজের মুক্তির সব বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়:

পুরুষ ও নারীকে সমানভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে, স্রষ্টা তাদের ভূষিত করেছে কতিপয় হস্তান্তর অযোগ্য অধিকারে […] সরকার স্থাপিত হয়েছে শুধু এসব অধিকার রক্ষা করার জন্য […] পুরুষ বিবাহিত নারীকে এক নাগরিক শবে পরিণত করেছে […] সে জোর করে নিজে অধিকার করেছে জিহোভার সমস্ত অধিকার, দাবি করেছে যে নারীর জন্যে এক পৃথক এলাকা বরাদ্দ করা তার অধিকার।৬

মূলত এ সময় নিগ্রোদের পক্ষ নিয়ে আমেরিকার নারীসমাজ রাষ্ট্রের নিকট তাদের ভোটাধিকার দাবি করতে থাকে। নারীসমাজের এই মুক্তি আন্দোলনের পক্ষে র‌্যালফ এমার্সন এবং প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনও সমর্থন দেন। এরপর আমেরিকার গৃহযুদ্ধের অবসান হলে নারীসমাজ দাবি উত্থাপন করে যে সংশোধনীর মাধ্যমে নিগ্রোদের ভোটাধিকার প্রদান করা হয়েছে, সেই সংশোধনীতে যেন সমগ্র নারীসমাজেরও ভোটাধিকার সংযুক্ত করা হয়। নিগ্রোদের ভোটাধিকার প্রদান বিষয়ক সংশোধনীর দ্ব্যর্থকতার সুযোগে এ সময় ১৪ জন নারীকে সঙ্গে নিয়ে সুজ্যান বি এ্যান্থনি রস্টারে ভোট প্রাদন করেন; এজন্য তাকে ১০০ ডলার জরিমানাও করা হয়। এতেও সুজ্যান বি এ্যান্থনি থেমে থাকেন নি; তিনি ১৮৬৯ সালে আমেরকিার নারীদের ভোটাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জাতীয় সংঘ গড়ে তোলেন। এ বছর উইমিংগে নারীসমাজের ভোটাধিকার প্রদান করা হয় এবং ১৮৯৩ সালে কোলোরাডোতে, ১৮৯৬ সালে আডাহো এবং ইউটাতে নারীর ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ধীর গতিতে হলেও নারীসমাজের মুক্তির লক্ষ্যে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অব্যাহত থাকে এবং পরিণতিতে ১৯২০ সালে আমেরিকায় নারীদের ভোটাধিকার আইনের স্বীকৃতি লাভ করে। সুতরাং আমরা বলতে পারি, নারীবাদ প্রাথমিক পর্যায়ে নারীসমাজের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে নারীমুক্তির নানামাত্রিক আন্দোলন, বাধা-বিপত্তির মাধ্যমে নারীসমাজের নাগরিক অধিকার এবং ভোটাধিকার প্রভৃতি ধারণা আরও পরিমার্জিত পরিশোধিত পরিবর্ধিত হয়ে তত্ত্বীয়ভাবে একটি দার্শনিক ভাষ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করে, যা পরবর্তীতে নারীবাদী তত্ত্ব বা ফেমিনিজম হিসেবে শিল্পে-সাহিত্যে-দর্শনে স্থান করে নিয়েছে।

প্রাথমিকভাবে নারীবাদী ধারণা বা তত্ত্ব যাই থাকুক না কেন [ভোটাধিকার, নাগরিক অধিকার, সামাজিক অধিকার প্রভৃতি] বর্তমানে নারীবাদী তত্ত্ব এমন একটি অবস্থায় উপনীত হয়েছে যার সাথে শিল্প-সাহিত্য-দর্শন এমনকি রাজনীতি কিংবা সামাজিক মূল্যবোধ নির্ধারণের ক্ষেত্রে নারীবাদী তত্ত্বের বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়। ফলে নারীবাদী চিন্তাচেতনার উদ্ভব, ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে অধ্যয়ন ও মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা একালের শিল্প-সাহিত্যে অনস্বীকার্য এবং অনিবার্য হয়ে উঠেছে। একজন নারী-লেখক যেভাবে তার চোখ দিয়ে সমাজবাস্তবতার মধ্যে নারী-জীবনকে দেখেছেন, তা হয়তো কোনো পুরুষ লেখক কখনোই দেখেন নি। সাহিত্য মানবজীবনকে ঘিরেই বিকশিত বিবর্তিত এবং পল্লবিত হয় বলে এতে নরনারী উভয়ের-ই জীবন চিত্রিত হয়। আমরা জানি, কোনো কোনো নারী-লেখক যেমন নারীকে পুরুষায়িত দৃষ্টিতে দেখেছেন তেমনি কোনো কোনো পুরুষ লেখকও নারীকে মানুষের মর্যাদায় কিংবা নারীবাদী দৃষ্টিতে শিল্পে-সাহিত্যে উপস্থাপন করেছেন। এ প্রসঙ্গে সমালোচকের মন্তব্য স্মরণীয় :

নারীর জৈবিক অস্তিত্ব যেমন তার তথাকথিত ‘হীনতা’র নির্ধারক হতে পারে না, তেমনি কেবলমাত্র পুরুষ হওয়ার সুবাদে কাউকে পীড়নযন্ত্রের প্রতিনিধি ভেবে নেওয়া যায় না। এটা ঠিক যে পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক হয়ে ওঠার সুযোগ পুরুষের পক্ষেই সহজাত ও স্বাভাবিক; কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন ও ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে আমরা তো জেনেছি, পুরুষতন্ত্র দ্বারা উপনিবেশীকৃত মন নিয়ে নারীসমাজের গরিষ্ঠ অংশ এখনো অক্লান্তভাবে নারীর যাবতীয় শৃঙ্খলাকে অটুট রাখতে সচেষ্ট। সুতরাং প্রতিটি নারী যেমন নারীচেতনাবাদী নয়, তেমনি প্রতিটি পুরুষও নয় পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি।৭

জীবনকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলা হয়, সংগ্রামই জীবন; আর এই সংগ্রামে সমাজের নারী-পুরুষ উভয়ই সমানভাবে ক্রিয়াশীল। অনস্বীকার্য, সমাজে নারীর অস্তিত্ব অপরিহার্য। অথচ পুরুষশাসিত সমাজে নারীকে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বীয় অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। এক্ষেত্রে নারীর জীবনসংগ্রাম এবং পুরুষের জীবনসংগ্রাম সমান্তরাল ভাবার অবকাশ নেই নারীকে শুধুমাত্র সমাজে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হয়; সেখানে পুরুষের জীবনসংগ্রামের লক্ষ্য নিজেকে মেধা-মননে প্রজ্ঞায় এবং শিক্ষা-দীক্ষায় বিকশিত করে তোলার। সুতরাং নারীর জীবনসংগ্রামের অর্থ পুরুষের থেকে আলাদা। ফলে তার জীবনচেতনা, জীবনবোধ ইত্যাদি প্রকাশের ভাষাও ভিন্নতর। পুরুষের চোখে নারী কখনো প্রোজ্জ্বল ক্লেদ, কখনো কামকলার আকর, আর কখনো অর্ধেক মানুষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার নারীসমাজের চমৎকার তথ্য দিয়েছেন এভাবে :

ঘরে কাজ করি শান্ত হয়ে
সবাই বলে ‘ভালো’।
তারা দেখে আমার ইচ্ছার নেই জোর।
সাড়া নেই লোভের
ঝাপ্টা লাগে মাথার উপর,
ধুলোয় লুটাই মাথা।
দুরন্ত ঠেলায় নিষেধের পাহারা কাত করে ফেলি
নেই এমন বুকের পাটা;
কঠিন করে জানি নে ভালোবাসতে
কাঁদতে শুধু জানি,
জানি এলিয়ে পড়তে পায়ে।৮

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নারীর যে জীবনচিত্র এখানে অঙ্কন করেছেন, তা সেকালে কতটা সত্য ছিল সে প্রশ্ন না তোলা হলেও সমকালে এ চিত্র যে বাস্তবানুগ নয়, তা কথাবাহুল্য। কেননা নারী শুধুই ‘কাঁদতে’ জানে, সমকালীন সমাজ প্রেক্ষাপটে একথা মেনে নেওয়া যায় না। কেননা আমরা দেখছি, একালে নারীও যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষ সৈনিকের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করার মতো সাহসী কাজেও লিপ্ত হয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায়ও পুরুষের সমকক্ষ অবদান রাখতে সক্ষম নারীসমাজ। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক চিত্রিত বাঙালি নারীর ক্ষেত্রে এ বাস্তবতা পুরোপুরি অস্বীকার করার খুব একটা সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখতে হয়, রবীন্দ্রনাথের কাল, বাংলার সমাজবাস্তবতা। সেকালের সমাজে বাংলা জনপদে রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক বর্ণিত নারীজীবনের এ চিত্রই সম্ভবত স্বাভাবিক ছিল। একাধারে এ বর্ণনায় সমাজবাস্তবতা এবং পুরুষবাদী দৃষ্টিতে নারীর সামাজিক পরিচয় বিধৃত হয়েছে। অন্যদিকে আরেক পুরুষ লেখক কাজী নজরুল ইসলামের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় :

জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান,
মাতা ভগ্নি ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।৯

এখানে কবি নজরুল একজন পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও মানবসভ্যতার বিবর্তন ইতিহাসে নারীসমাজের অবদান অবলীলায় স্বীকার করে নিয়েছেন। তাদেরকে প্রাপ্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতেও তিনি কুণ্ঠিত নন। কিন্তু এখানে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় নারীজীবন কী শুধুই ত্যাগের মহিমায় কীর্তিত হবে? নাকি নারীকেও তার স্বীয় অস্তিত্বের স্বীকৃতি প্রদান করে পুরুষের মতো দোষ-ত্রুটি, ভালো-মন্দ, আশা-নিরাশার অধীন রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে মানবীয় সাধারণ প্রবণতার স্বীকৃতি দেওয়া হবে? ফলে এরকম ভাবলে অন্যায় হবে না যে, নজরুল কর্তৃক নারীসমাজের ত্যাগমহিমা কীর্তনের মাধ্যমে কৌশলে নারীকে পুরুষের তথা পুরুষতন্ত্রের অধীনে রাখার ইঙ্গিত বহন করে। নারীকে নানা কৌশলে পুরুষসমাজ শৃঙ্খলিত করে রাখতে চায়, সম্ভবত এ কারণেই পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি কাজী নজরুল ইসলাম নারীজীবনের ত্যাগের মহিমা কীর্তনের মাধ্যমে নারীকে মানুষের মর্যাদায় সমাজে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ দিতে চাননি।

মানুষ (পুরুষের সমান) হিসেবে সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনই নারীবাদের মূল কথা। নারীবাদী ধারণা অনেক কণ্টকাকীর্ণ পথ-পরিক্রমার মধ্য দিয়ে দর্শনে শিল্প-সাহিত্যে, সমাজে-রাজনীতিতে একটি প্রতিষ্ঠিত মতবাদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। শিল্প-সাহিত্যে তত্ত্বগতভাবে বর্তমানে নারীবাদ স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক মতবাদ। কিন্তু বাস্তব সমাজজীবনে প্রকৃত অর্থে নারীসমাজ মানুষ হিসেবে পুরুষের সমকক্ষ মর্যাদা অদ্যাবধি সর্বত্র লাভ করতে পারে নি। নারীর এই সামাজিক পরিচয় প্রসঙ্গে সিমোন দ্য বুভ্যুয়ার তাঁর ‘দ্য সেকেণ্ড সেক্স’ গ্রন্থে লিখেছেন :

আর্থিক জীবন, তাদের সামাজিক উপযোগিতা, বিয়ের মর্যাদা প্রভৃতিতে পুরুষ অধিকার ক’রে আছে যে-সুবিধাজনক স্থান, তাতে নারীরা উৎসাহ বোধ করে পুরুষদের খুশি করতে। নারীরা এখনো, অধিক অংশে, আছে অধীন অবস্থায়। তাই নারী নিজেকে দেখে না এবং তার পছন্দগুলোও করে না তার প্রকৃত স্বভাব অনুসারে, বরং করে যেভাবে পুরুষ তাকে সংজ্ঞায়িত করে।১০

বিশ শতকের মধ্য ভাগে রচিত ‘দ্য লাজিয়াম সেক্স’ গ্রন্থে নারী-সমাজ সর্ম্পকে ব্যুভুয়ার যে উচ্চারণ করেছিলেন, তা একুশ শতকের পুঁজিবাদী বিশ্বে আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। কারণ, এখনো নারীরা পুরুষশাসিত সমাজের অধীন এবং তাদের পছন্দ অনুযায়ী নিজেদের নির্মাণ বা তৈরি করে চলেছে; সেই অর্থে নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থানের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ তত্ত্বগতভাবে নারীবাদী চিন্তাচেতনার ব্যাপক বিকাশ ও প্রচার প্রসার ঘটলেও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে তথা বাস্তব সমাজজীবনে মানুষ হিসেবে নারীর অধিকার কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে!

তথ্যপঞ্জি ও টীকা :

1.  Sally wehmeier (ed.), Oxford Advanced Learner Dictionary, 6th edition, Newyork : Oxford University Press, 2002, P. 466
2. Encyclopaedia Britannica, By Encyclopaedia Britannica Inc. [Vol-9], Publisher : William Benton, Chicago, London, Toronto; 1959, P. 154 [ভাবানুবাদ]
৩. ‘[…] ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড, ও যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতিক অধিকার সহজে অর্জিত হয়নি। ১৮৬৭ অব্দে জন স্টুয়ার্ট মিল ইংরেজি সংসদে নারীদের ভোটাধিকারের পক্ষে প্রথম বক্তৃতা করেন, এটাই নারীর ভোটাধিকারের প্রথম সরকারিভাবে প্রদত্ত বক্তৃতা। তাঁর লেখায় তিনি পরিবারে ও সমাজে নারীপুরুষের সাম্যের জন্যে প্রবলভাবে দাবি জানান।’ Ñসিমোন দ্য বোভোয়ার, দ্বিতীয় লিঙ্গ, [অনুবাদ : হুমায়ুন আজাদ], ১ম প্র, ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, ২০০১, পৃ.১০৪
৪. সিমোন দ্য বোভোয়ার, দ্বিতীয় লিঙ্গ, পূর্বোক্ত; পৃ.১০৪
৫. তদেব
৬. তদেব, পৃ.১০৫
৭. তপোধীর ভট্টাচার্য, বাখতিন : তত্ত্ব ও প্রয়োগ, ১ম প্র, কলকাতা : পুস্তক বিপণি, ১৯৯৬, পৃ.৩৪
৮. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘বাঁশিওআলা’ (শ্যামলী), রবীন্দ্র-রচনাবলী [১০ম খণ্ড], ঐতিহ্য সং, ২য় মু, ঢাকা : ঐতিহ্য, ২০০৪; পৃ.১৭০
৯. কাজী নজরুল ইসলাম, ‘নারী’ (সাম্যবাদী), আবদুল কাদির সম্পাদিত, নজরুল-রচনাবলী (১ম খণ্ড), ১ম পুনর্মু [নতুন সংস্করণের], ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৯৬; পৃ.২৪২
১০. সিমোন দ্য বোভোয়ার, পূর্বোক্ত; পৃ.১১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *