শূন্যের করতালিতে যাই

ফুটো পাথরের নিচে জমে থাকা জল শুঁকে দেখি। শিকড়ের ভাষা ছুঁয়ে ঘুরে দাঁড়ায় জোনাকির আলপথ। বৃষ্টির গায়ে ক্ষুধার দাঁত বসায় কেউ, তাদের জানাই গোধূলিতে বেঁধে রাখা ঘুড়ির খবর। তোমার কানে পৌঁছে দিতে চাই লৌহযুগের গান— মেঘভাঙা ছায়ার মূর্ছনায়।

যাও ধুলোর সমীকরণ লিখে রাখো। তবু ভাঙো না এই রাস্তার শিরস্ত্রাণ। তোমার চোখে জমা রাখো নদীর উল্টোমুখী প্রতিধ্বনি। শূন্যতায় হাত ঢুকিয়ে খুঁজে বের করো কোনো এক নিভে যাওয়া দূর্বাদলের আত্মা। কেন যে বাঁধা ছিল ধানখেতে ছুঁয়ে রাখা গলিত চাঁদ? এখানে প্রান্তিকতার উষ্ণতা জমা—তারপরও জ্বলছে মৃত মশালের ছাই।

দূরের বৃষ্টিস্নান নদী পেরিয়ে যদি ফিরে আসে, তাকে শোনাব মরচে ধরা নৌকার অস্থি। হৃদয়ের বাঁশিতে বিষাদের সুর, তবু বাজে নতুন ঢেউয়ের প্রতিধ্বনি। এখন কোনো এক দিন, যখন শীতল মেঘে শুয়ে থাকে দুপুর, তখনও দেখি চোখের কোণায় থমকে থাকা মরুভূমির সবুজ ক্ষরণ।

তোমার হাত বাড়িয়ে দাও শূন্যের দিকে, নক্ষত্রের সিঁথি ভেঙে দাও বালিঘাটের হাওয়ায়। জীবনের সমান্তরাল ছায়ায় একদিন হয়তো ফিরব সবাই, তোমার খোলা জানালা দিয়ে ঝরে পড়া অন্তিম সূর্যের আলো ছুঁয়ে।

নির্বাণ দিগন্তে যত গোধূলির সাঁকো, আলোর বিভ্রম খেলে দেবে হীরকাভরণ। এমনই আমার সন্ন্যাস, যেখান থেকে পিছু হটল প্রতিটি শব্দ—হৃদয়ের প্রগল্ভ বিকৃতির মত। বিশ্বের বিবর্তনে একসময় রক্ষিত ছিল তন্ত্র, এখন তা কেবল এক ভ্রমণের কাঁটাতার, পৃথিবী ভরা প্রতারণার মৌন সুর—এক সঙ্গমে মিলিয়ে যায় আলো ও ছায়া।

বিস্মৃত শঙ্খের শঙ্খনাদে শোনা যায় প্রতিধ্বনির কাঁপন, চিরস্থায়ী অন্ধকারে, যেখানে দিন ও রাতের দ্বন্দ্ব হয়ে যায় চিরন্তন, আর বসবাসের জলাভূমি এক মরীচিকা। আমি পদধ্বনি শোনাই অবজ্ঞায়, এক সময়ের সুরভি, এক পৃথিবী বরাবর নেমে আসে নিঃসঙ্গতার বিষণ্ন ছায়া, মুক্তির শ্বাস ধরা, দূর অতীতের নৈরাশ্য।

নদীর পথে প্রতিটি সঞ্চালন যেন এলোমেলো, তার বুক ভরে নক্ষত্রের কালো চোখের সুর, অথবা কীভাবে সূর্য অস্তাচলের দিকে ফেলে প্রেম ও বিদ্বেষের হাতুড়ি একসঙ্গে তোলায়—তবে একে একে চলে আসে সন্ধ্যাপ্রধান পাখি, যাদের নাম কোনও বার্তা ছড়ায় না, কেবল এক হাহাকার; কেউ পিপাসিত, কেউ মুষলধারে জল ও মাটির মধ্যরাতকে ছুঁয়ে গেছে।

এখন আমি জানি, আমার অগ্নিপথ ধুলো হয়ে যাবে, এমনই গতি, চিরকাল— পরাবাস্তব এক যাত্রা, যে পথে গোধূলি ও রাতের তলানিতে বিধ্বস্ত হবে সকল রেখা, সকল প্রার্থনা। শুধু প্রশ্নই থাকবে, অনন্ত অসীমের মধ্যে।

ভাঙা সময়ের বর্ননা ছড়িয়ে পড়ে, গোপন আশঙ্কায় ভোরের কিরণ নেমে আসে নক্ষত্রের উপাসনায়। বাঁশবন থেকে খসে পড়া পাতার শব্দ, এখনো কানে বাজে, এমনকি চন্দ্রাহত বিকেলেও।

ধূসর সূর্যের আরোহী বিষণ্নতা, নির্বাসনের অভিজ্ঞান প্রত্যুষের নাভিমূলে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার শ্লোক, অজানা ব্যাখ্যার রেখায় ভেঙে পড়ে ধ্রুবতারার নিস্তব্ধ প্রলাপ।

পৃথিবীর সমুদ্রস্তরে নীরবতা নিক্ষিপ্ত, নিহিত আঙুলের কাঁপন প্রতিস্রুত হয় জ্বলন্ত মহাকাশের অমোঘ পরিসরে। গভীর রক্তিম কুয়াশায় ছেঁকে নেয় মৃত শহরের ক্ষয়িষ্ণু কোলাহল। যেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক ভাঙনের মিথ্যা বেঁচে থাকে শিলায় খোদিত প্রতারণায়, কালের গুহামুখে দাঁড়িয়ে, আমি প্রেরণার মৃতদেহে নামাই অমলতাসের প্রস্তাব।

গণিতের ভগ্নাংশে, শূন্যই সত্য হয়ে ওঠে। অন্ধ আকাশের অচেনা বিভাজনে, নক্ষত্রের গ্রন্থি থেকে ছিঁড়ে পড়া আলো, উদ্ঘাটন করে শূন্যের তীব্র সাপেক্ষতা। শব্দের তলদেশে রচিত হয় অনুশোচনার ব্যূহ, মৃত্যুর ইঙ্গিতে নাচে ভাঙা বেহালার তার। তোমার স্পর্শের রেখায় ঝরে যায় অমরত্বের প্রগাঢ় বিভ্রম। ঘূর্ণির মধ্যে শুকিয়ে যায় চিরকালীন পৃথিবী, অথবা ফুটে ওঠে আলগা শব্দে, একাগ্র চিহ্ন। কিসে আঁকা হয় ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের চিত্র?

অধিকারহীন ক্ষোভ, নগ্ন চিত্রের আয়নায় কেন নীরব থাকে চিত্রলিপি বৃষ্টির অন্ধকারে? ফুলের গন্ধে মেশে শোক, প্রলয়ের গহীন সুর, চুড়ান্ত গতিতে রূপান্তরিত হয় পুরাণের কাহিনি।এখানে পৃথিবীর সকল গাছ পুড়ে যায় আলো-ছায়ার রহস্যে, তবুও বায়ুতে ভাসমান সমাপ্তির প্রতিধ্বনি শাসন করে অনন্তের নিষ্করুণ নৈঃশব্দ্য।

ধূলিধূসর সন্ধিক্ষণে ঝোলে মগ্ন মেরু, পলাতক বরফের স্তব্ধতায় জমে আছে কুঠারের গান। শিরার তলদেশে ডুবে যাওয়া কাচের গড়নে জেগে ওঠে মহাযুগের পিণ্ডিত শ্লোক—মৃত গিরির উপত্যকা জানে শৈবাল কেন রক্তপানে ব্যস্ত।

অন্ধকারের অভ্যন্তরে পুঁতে রাখা শব্দ—বজ্রপথে ছিঁড়ে গেছে তারার অক্ষাংশ। যেখানে কঙ্কাল বিষধর পাখিদের ছায়া টেনে আনে, সেখানে মৃত জলপ্রপাতের নিচে ঝুলে থাকে শতাব্দীর ম্লান আয়ু। ঘোড়ার চামড়ায় মোড়া নক্ষত্রের কপালে জ্বলে ওঠে অভ্যন্তরীণ দহন। তোমার মৃত ঊষর উরুর প্রান্তে পড়ে থাকে, কালের বিবর্ণ খাম। কোন মহাদেশের গভীর জঠরে কাঁপে পাথরের কুসুমিত ছাই—জেনে রেখো, সূর্যও একদিন অভিস্রবণ জানবে।

শত ছিদ্রের খনিজে ভাঙা ধূমকেতুর দণ্ড, তোমার শ্বাসের গহ্বরে রচে মিথ্যের কোলাহল। জ্বলে ওঠে তৃতীয় অক্ষির প্রলয়, যেখানে পৃথিবীর প্রান্তে গিলে ফেলে উল্কাস্রোতের মায়াবী প্রাচীন ধাতু।

বিপন্ন কাকের ঠোঁটে ছুঁয়ে আছে মৃত বৃক্ষের ঝরাপাতা, ঘুনধরা সময়ের কণ্ঠে বাজে বিষাক্ত ঝড়। সব শেষে ধূলিসাতের উৎসবে, তোমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সমস্ত মাংস নীরবতা হয়ে লেপটে থাকে কালের শেষ স্তম্ভে।

নক্ষত্রমগ্ন কোনো এক বিষণ্ণ প্রহরে, দাঁড়াই নির্বিকার শূন্যতায়। শেকড়ের দাগ বুকে, রক্তিম বর্ণের সূর্য অস্তাচলে ঢলে পড়ে। ছায়াগুলো তখন বুনে যায় রহস্যের ধাঁধা—কেউ কি আছে, যে বুঝবে? মেঘের অলিন্দে মিশে থাকে ছিন্নপত্র; বাতাসের নীরব সুরে বাজে কালের কাহিনি।

তোমার উপস্থিতি কি এক দৈব জাদু ছিল? আমি ভুলিনি এখনও সেই আরোহী দিন—প্রান্তরের কিনারে, হিমালয়ের বুকে, ঘাসের কোমলতার নিচে চাপা পড়া রক্তাক্ত নিদর্শন। সেখানে শুধু দগদগে অতীত, কার কণ্ঠে উঠে আসে মৃত সুর? আলোর বাঁক থেকে ছুটে আসা ঘূর্ণি কি নষ্টালজিয়ার ক্রন্দন?

তবু আমি পথে থাকি। ঝরাপাতার ফাঁকে ফাঁকে অন্ধকারের শরীর দেখি; সে শরীর জড়ায় ধূসর বিভ্রান্তি, থেমে যায় ইতিহাসের গতি। নদী তার খেয়া ভাসায় অজানার দিকে—কোনোদিন কি ফিরবে সেই নৌকা? চিৎকারে ভরে ওঠে আকাশ, নক্ষত্রদের শাণিত বিদ্রূপ ছড়িয়ে পড়ে।

অবশেষে আমি সাক্ষী—পরিব্রাজকের দীপ্ত চরণচিহ্ন, পুড়ে যাওয়া বালির গন্ধ, আর দূরের শহরে হারিয়ে যাওয়া কোনো এক প্রাচীন কালের সুর। পৃথিবী কী জানে, তার অভিমানের রূপকথা? সুরের বাঁধনে আমরা ছড়িয়ে দিই নিজস্ব অপূর্ণতা, টুকরো টুকরো স্বপ্নের গলিতে।

যেখানে শেষ হয় কথারা, সেখানেই শুরু হয় এক অদৃশ্য ফিসফিস। মনে হয়, কোনো পুরনো ভবঘুরে সুরকার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমায়—আলো-অন্ধকারের মাঝের সেই সেতুতে, যেখানে সমস্ত শব্দ, স্মৃতি, আর শূন্যতা মিলে এক হয়ে যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *