১
ডিমপাড়া তরতাজা মুরগিটা মোরগ হয়ে উঠল সহসা। এমন আজব ঘটনা বাপের জন্মে শোনেনি মজিলা, চোখে দেখা তো দূরস্ত। কিন্তু চোখের সামনে ঘটা ঘটনাটাকে সে অবিশ্বাসই-বা করে কী করে? ঘটনাটা এমনই আকস্মিক আর অভাবনীয় যে কী করবে ভেবে পায় না বেচারা।
মরচে ধরা খাঁচাটার দিকে বিষণ্ণ, হতাশ চোখে তাকিয়ে নিজের ভাগ্যকেই শাপ-শাপান্ত করে খানিক স্বস্তি পেতে চায় সে অতঃপর। এই নিয়ে সারাদিনে প্রায় দশবার ছাদে উঠল, মুরগিটা ডিম দিল কি দিল-না খোঁজ নিতে গিয়ে পায়ে ব্যথা ধরে গেল তার, তবু বজ্জাত মুরগিটার ডিম পাড়ার কোনো নাম-গন্ধও নাই। অথচ সারাদিন কোঁকর কোঁ কোঁকর কোঁ ডেকে তার কানমাথা প্রায় ঝালাপালা করে দিল এই হারামি মুরগিটা। একই সময়ে কেনা বাকি মুরগি দুটো দিব্যি ডিম দিচ্ছে প্রতিদিন, ভোর হতে না হতেই তারা ডিম দিয়ে পৃথিবীসুদ্ধ লোককে ডেকে জানিয়ে দিচ্ছে সে খবর, অথচ এই ছেনাল মাগীটার ডিম দেওয়ার কোনো নাম-গন্ধও নাই আর। রাগে নিজের মনেই গজগজ করে মজিলা। মুখে আসা গালিগুলো উজাড় করতে করতে অপরাধী মুরগিটার দিকে বিষচোখে তাকিয়ে মনের ঝাল মেটায়।
পেল্লায় চেহারা হয়েছে দামড়ি মুরগিটার। জেল্লা ফিরেছে নধর শরীরে, যেন গা চুঁইয়ে পড়ছে তেল। চকচকে লাল-সাদা বুটিদার শরীরে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছেন তিনি সেই কবে থেকে, ডিম পাড়ার কথাটিও যেন ভুলে বসেছেন মহারাণী! মাত্র সতেরোটা ডিম পেড়েছে মাগী, এরমধ্যেই তার কুঁচে হওয়া সারা! সারা তো সারা, সে-তো গেল তিন মাস আগের কথা, কুঁচে ছেড়েছে সেই কবে, তবু আর ডিম পাড়ার রা নেই তার! অথচ সারাদিন তার কড়কড়ানির চোটে এলাকায় কান পাতা দায়। ফাউমি মুরগি, ডিমের রাণী, আরো কত কত সব স্তোকবাক্যে ভুলে নগদ তিনশ টাকা ব্যয়ে চারটা বাচ্চা খরিদ করেছিল মজিলা। কেনার কদিন পরেই বলা নেই কওয়া নেই ফট করে একটা বাচ্চা মরে গেল তার। তা যাক, বাচ্চাটা মোরগ ছিল জানলে ওটা তখন কিনতই না মজিলা, সে চেয়েছিল মুরগি, ভেবেছিল নিয়মিত ডিম দেবে তারা, প্রতিদিন চারটা মুরগি ডিম দিলে আপাতত তাকে আর ডিম কিনতে হবে না কিছুদিন। কিন্তু মুরগি কেনার কদিন পরই দেখা গেল চারটা বাচ্চার মধ্যে একটা মোরগ, সে মোরগও আবার ফট করে মরে গেল এক রাত্তিরে। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে দেখল মরে শক্ত হয়ে আকাশের দিকে ঠ্যাং উঁচিয়ে আছে বাচ্চা মোরগটা। তা সে-ও না হয় মেনে নিল মজিলা, কিন্তু এই যে ডবকা মুরগিটা মাত্র সতেরোটা ডিম দিয়ে কুঁচে হল, আর এখন কুঁচে ছাড়লেও সারাদিন কড়কড়ায় অথচ ডিম পাড়ার ক্ষেত্রে লবডঙ্কা, এ আর কাঁহাতক সহ্য করা যায়? খাঁচার মধ্যে রাখা পাত্রে খাবার আর পানি দিয়ে রাগে গজরাতে গজরাতে প্রায় তিনমণা শরীর নিয়ে নিচে নামে মজিলা। আড়চোখে পাশের ছাদের দিকে দেখে একবার। নাই। কাজ সেরে সব সন্ধ্যানাগাদই চলে গেছে যে যার ডেরায়। হাতের ফোনটা সাবধানে আগলে সেদিকে তাকিয়ে বড় একটা শ্বাস ছাড়ে সে। রাতে ফোন দেবে বলেছে। দেবে কি না কে জানে! আজকাল রাতগুলো বড় অসহ্য কাটে তার। বড় যন্ত্রণায় গড়ায় সময়। জীবন তো ফুরিয়ে এল প্রায়, তবু যন্ত্রণাগুলো যেন দীর্ঘায়িত হতে থাকে আরো, প্রলম্বিত হতে থাকে সময়ের সাথে সাথে। কেউ তো বোঝে না সেসব! কেউ তো গোণে না তার যন্ত্রণার ভার! রাগে, দুঃখে নিজের চুল নিজেই টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করে মজিলার। ছেঁড়েও মাঝে মাঝে।
২
ঘরে ঢুকতেই জাকিরের দুই বছরের মেয়েটা দৌড়ে আসে কাছে।
কই গিছিলি, ডাডি? মুগ্গির ডিম আনতি গিছিলি?
-বলে জড়িয়ে ধরে দাদিকে। প্রবল স্নেহে নাতনিকে কোলে নেয় সে, চুমু খায়।
সংসারে এই একটুকরো শান্তি তার। জাকিরের মেয়ে আর আলেয়ার মেয়ে একই বয়সী। অল্প কদিনের ছোট-বড় তারা। এদের মুখে দাদি আর নানি ডাক শুনলে মন বড় চঞ্চল হয়, স্নেহ উথলে ওঠে মনে। তবু মাঝে মাঝে সে বিরক্তও হয় খুব। সবে চল্লিশে পড়েছে মজিলা! এই কি দাদি-নানি হওয়ার বয়স তার!
কিন্তু বাস্তবতাকে উপেক্ষাই বা করবে কী করে সে! পনেরোয় পা দিতে না দিতেই সেই যে প্রেমের বদ হাওয়া এসে উড়িয়ে নিয়েছিল তাকে, সে হাওয়ায় উড়তে উড়তে বশিরের বউ হয়ে ষোলোতেই জমজ দুই বাচ্চার মা হয়ে গেছিল মজিলা। আর তারই জেরে সে এখন ছেলে জাকির আর মেয়ে আলেয়া দুজনের দুই মেয়ের দাদি আর নানি বনে গেছে।
তখন কি আর ভেবেছিল জীবন এমন হবে তার! ভাবেনি। বশিরের প্রেমে তার দুনিয়া তখন বহুবর্ণা। ভেবেছিল জীবন এমনই হাওয়ায় উড়বে, এমনই স্বপ্নঘোরে ডুবে থাকবে সংসার জীবন। কিন্তু যত দিন গেছে, সংসার তত তার উদোম, উৎকট চেহারা নিয়ে হাজির হয়েছে মজিলার সামনে, জীবন তত তার খোলস খুলে দেখিয়েছে নিজের কঙ্কালসার, বিভৎস রূপ। আর সেসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই মজিলার পাঁচফুট সাতের ছিপছিপে দীর্ঘ শরীরে ক্রমশই মেদ জমে তাকে ঢেকে দিয়েছে গিন্নি-বান্নি চেহারার দুর্ভেদ্য মোড়কে। বিপরীতে বশির শুকিয়েছে সংসারের সঙ্গে দারুণ সামঞ্জস্য রেখে।
অত অল্প বয়সে শুধু প্রেমই আরাধ্য ছিল মজিলার, ভেবেছিল এতেই দিব্যি সুখের স্রোতে ভাসতে থাকবে জীবন। কিন্তু সময় গড়াতেই ভুল ভাঙল তার, মোহ টুটল। সে দেখল প্রেম, তা যত আরাধ্যই হোক, যতই দুর্মূল্য হোক পৃথিবীতে, তবু শুধু প্রেমে ভারি পানসে আর অর্থহীন এই জীবন। সে দেখল শরীর এখানে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুসঙ্গ। সুখি হতে গেলে তাকে উপেক্ষা করার কিছুমাত্র সুযোগ এখানে নাই। আর তাই যত সে শরীর চিনল জীবনের আলপথে হেঁটে, বশিরের প্রতি প্রেম তত ফিকে হল, তত বিতৃষ্ণা জমল তার সংসারের প্রতি। উড়ু উড়ু মনে তার জমা ছিল যতটুকু প্রেম, শরীরের তাপে তা উবে গেল কর্পূর হয়ে, বিপরীতে থাকল শুধু শরীর। ক্রমশ তা প্রকট হল আরো, আরো বেশি অসহ্য, অবোধ্য হল সে নিজের কাছেই নিজে। প্রথম প্রথম বড় অস্বস্তিতে ভুগত মজিলা। বড় অশান্তিতে পুড়ত ভেতরে ভেতরে। কিন্তু ধীরে ধীরে খোলস থেকে বের হল সে। নিজের ভেতরে জমা অস্বস্তি আর লজ্জাকে সে অতিক্রম করল অবশেষে। ততদিনে তার হাতে চলে এসেছে স্মার্টফোন, চলে এসেছে নেট কানেকশন। ফেসবুক, ইমো আর হোয়াটসঅ্যাপের রঙিন হাতছানিতে ততদিনে সে ঢের দূর এগিয়েছে যান্ত্রিকযুগের ধোঁয়াশার পথে। বশির বুঝেছে সব, কিন্তু নিজের অক্ষমতাকে অস্বীকার করার সাহস কিংবা মজিলাকে থামানোর শক্তি, কোনোটাই সে অর্জন করতে পারেনি শেষতক। ফলত আরো বেপরোয়া, আরো রাখঢাকহীন হয়ে উঠেছে মজিলা ধীরে ধীরে।
৩
জাকিরের মেয়েকে পাশে শুইয়ে নিজেও শুয়ে পড়ে মজিলা। আবার কী ভেবে উঠে বসে। চুল আঁচড়ায়, গাঢ় করে কাজল দেয় চোখে, টকটকা লাল রঙা লিপস্টিক লাগায় ঠোঁটে। তারপর ইমোতে ভিডিওকল দেয়। ইমন ধরে সাথে সাথেই। সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে মাত্র স্নান সেরে একটা বিড়িতে আগুন ধরিয়ে মনের সুখে টানতে শুরু করেছে তখন ইমন। উনিশে পড়েছে সে। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ে পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে অগত্যা রাজমিস্ত্রির যোগালি হিশেবে কাজ শুরু করেছিল সে। অভাবের সংসারে সে-ই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সংসারে। বাবা মারা গেছে ঢের আগে, মা আর একমাত্র ছোটবোনটার দায়িত্ব কাঁধে। ফলে ইচ্ছে থাকলেও পড়াশোনাটা আর চালাতে পারেনি ইমন। অবসর সময়ে গান শুনে আর ফেসবুকে ঢুঁ দিয়েই কাটাত সে বরাবর। নতুন এই কাজটা পাওয়ার পর এবার তার দিনলিপিটা হঠাৎই পাল্টে গেছে খানিকটা। যখন তখন ইমোতে নইলে মেসেঞ্জারে কল আসে তার আজকাল। কন্ট্রাকটরের নজর এড়িয়ে সেসব সামাল দিতে বহু কসরত করতে হয় তাকে।
ইমন ফোন ধরতেই বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসল মজিলা। আহ্লাদি, নাঁকি সুরে বলে, কী করতাছ?
এই তো, গান শুনতাছি। তুমি কী করতাছ?
আমি আর কী করমু? বইসা আছি। সেই যে গেলা, আর তো ফোন দিলা না তুমি! আমি অপেক্ষা করতেছি সেই কখন থেইকা!
শুনে লাজুক, অপ্রস্তুত একটু হাসে ইমন। বুড়ি বেটির ঢং দেখে মনে মনে খাবি খায়। মজিলা অতসব খেয়াল করে না। সে নিজের মনে বকে যায়। ইমনের অত রং-ঢং পোষায় না। সারাদিন গাধার খাটুনি শেষে শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে অবসরে সে খানিক বিনোদন চায়, চায় স্বস্তির পরশ। সেখানে মজিলা কচি খুকিটি সেজে তার সঙ্গে রং-ঢং করতে চায়, সুযোগ পেলেই গতর দেখানোর পাঁয়তারা করে। ভালো লাগে না একদম। তার উঠতি বয়স। সে চায় বিয়ে-থা করে থিতু হতে। কিন্তু বোনটার বিয়ে না দিতে পারলে আপাতত সেটা সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাই মজিলার রং-ঢং আর কচি খুকি সাজার ন্যাকামিটা আপাতত সয়ে নিচ্ছে সে। তাছাড়া বিনা পয়সায় রথ দেখা আর কলা বেচার সুযোগ হাতছাড়া করার মতো বোকাও নয় আদতে ইমন। যে বিল্ডিংয়ে নির্মান কাজ করছে সে এখন, তার পাশের বিল্ডিংয়েই ভাড়া থাকে মজিলা। বাসার ছাদে মুরগি পালে, পাশাপাশি বিল্ডিংয়ের ছাদ, ইমনের সঙ্গে সেখান থেকেই আলাপ। প্রথমে অতকিছু বোঝেনি ইমন। সে ভেবেছে মায়ের বয়সী নারী, স্বাভাবিক কৌতূহলেই তার দিকে তাকিয়ে থাকে হয়তো। কিন্তু ক্রমশ ভুল ভাঙে। অল্পদিনেই সে আবিষ্কার করে, নারীটি অকারণেই যখন তখন ছাদে এসে বসে, ভরদুপুরে সেজেগুজে এলোচুলে ছাদে এসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, কেমন রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে রাখে ঠোঁটে।
পাঁচফুট সাতের থলথলে স্বাস্থ্যের মধ্যবয়সী এক নারীর অমন বিসদৃশ আচরণে প্রথম দিকে বড় অস্বস্তি হত ইমনের, সঙ্গের মিস্ত্রিরাও ব্যাপারটা খেয়াল করে হাসাহাসি করত এ নিয়ে, কান-গরম করা সব ঠাট্টা-তামাশা করে আরো ভয়ানক লজ্জায় ফেলে দিত তাকে। অতঃপর সব ভুলে সময়ের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে চাইল ইমন। বয়সের চাহিদাকে সেই-বা কতদিন অস্বীকার করবে আর! মজিলার ন্যাকামিকে তাই প্রশ্রয় দিয়ে ধীরে ধীরে নিজেও সে ভাসতে চাইল সময়ের স্রোতে। সাধা ঠাকুর পায়ে দলতে নেই, গুরুজনদের মুখে শোনা এই আপ্তবাক্যটা মনে মনে আওড়ে সে-ও মজিলার দিকে ঝুঁকল অবশেষে। ‘মাগনা যতদিন খাওয়া যায়’, নিজেকে সে প্রবোধ দিল এই বলে। আর তারপর ফোন, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার শেষে আশেপাশে অতিসস্তার হোটেলগুলোতে ঘণ্টাখানেক করে সময় কাটানোতে গড়াল ব্যাপারটা। বিলটা অবশ্য মজিলাই দিল বরাবর। দুজনের কেউই বিলের ব্যাপারে যদিও কোনো আলাপ করেনি তারা কখনো, তবু অলিখিত নিয়ম হিশেবেই এটা ধরে নিল তারা প্রথম থেকেই। তারপরও সময়-অসময় নাই মজিলার, যখন-তখন ফোন, দুঃখের ফিরিস্তি, প্রেমের কাসুন্দি। শুনতে শুনতে কান পচে গেল প্রায় ইমনের। আর এ ব্যাপারটা শুধু একা তার সঙ্গেই চলছে না মজিলার, ইমনের মতো অল্পবয়সী ছেলে-ছোকরা আরো অনেকের সঙ্গেই এমন কঠিন প্রেম চলছে তার, এতদিনে সেটাও ভালোমতই টের পেয়েছে ইমন। ব্যাপারটাতে অতি শীঘ্রই ইতি টানতে হবে তাকে, কেন-না কন্ট্রাকটর লোকটার কানে খবরটা পৌঁছে গেছে ইতোমধ্যেই এবং ইমনকে এ নিয়ে কথাও শুনিয়ে গেছে লোকটা। কাজ ফাঁকি দিয়ে এমন নষ্টামি করলে কাজ থেকে বিদায় করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে গেছে তাকে।
৪
জাকিরের মেয়ে জারাকে পাশে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে সেই যে কার সঙ্গে ভিডিও কলে আলাপ জুড়েছে মা, রাখার আর নামগন্ধ নাই তার। বউয়ের সামনে নিজের মায়ের এমন বেসামাল আচরণ বড় চোখে লাগে জাকিরের। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায় খুব। কিন্তু নিজের মা, সন্তান হয়ে কী বলে সে বিরত করবে মাকে? হিমি এসব দেখে খুব বিরক্ত হয়, তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে উল্টাপাল্টা কথা-বার্তা বলে, সেসব নীরবে হজম করা ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না তার। ছোট্ট দুকামরার বাসা তাদের, ডাইনিংয়ে পেতে রাখা ছোট্ট চৌকিটায় অতিথি কেউ এলে ঘুমায়, তেমন কেউ হলে মা-বাবাও অনেক সময় ঘর ছেড়ে দিয়ে এখানে ঘুমায়। সন্ধ্যায় গুমোট গরম পড়েছে আজ, বিদ্যুৎ না থাকায় ডাইনিংয়ের জানালাটা খুলে দিয়ে চৌকির ওপরেই বসে ছিল জাকির। পাশে পাখা নিয়ে বাতাস করছিল হিমি। ছোট্ট বাসা, দরজা খোলা রেখে এক ঘরে কথা বললে অন্য ঘর থেকে স্পষ্ট শোনা যায়, বিশেষত বিদ্যুৎ না থাকলে ফ্যান ঘোরে না, তখন ঘরের মধ্যে বলা কথাগুলো কানে এসে ধাক্কা দেয় জোরে। ঘণ্টাখানেক ধরে এই অত্যাচার সহ্য করছে জাকির, গরমের জন্য নিজের ঘরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকবে তারও জো নাই। খুব আহ্লাদী, ন্যাকা সুরে কারো সঙ্গে কথা বলছে তার মা। মৃদু গলায় বললেও কথাগুলো কানে এসে লাগছে, শুনে যে কেউ বুঝবে প্রেমালাপ করছে মজিলা। অথচ পাশের ঘরে জলজ্যান্ত বসে আছে তার দামড়া ছেলে আর ছেলের বউ!
কেমুন বেশরম বেডি! গরে এতডি মানুষ থাকতে কিবা এসব কতা কইতারে হেয়!
অতিষ্ট হয়ে অবশেষে কথাগুলো বলে ফেলল হিমি। শুনে মেজাজ খারাপ হল জাকিরের। মায়ের ওপর এমনিতেই মনে মনে রাগে ফুঁসছিল সে এতক্ষণ, এখন যেন ঘি পড়ল আগুনে। গলা তুলে বলল, এই মা, কার লগে এতক্ষণ কতা কস তুই?
তর কাকার লগে কতা কই!
আহ্লাদী গলায় উত্তর করল মজিলা। মার কথায় মাথায় আগুন ধরে গেল জাকিরের। টেবিলের ওপর রাখা পানিভর্তি কাচের জগটা টান দিয়ে ছুড়ে ফেলল সে মেঝেতে। সারা মেঝেতে পানি গড়াল, কাচের টুকরো ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তেই। সেসবে পাত্তা না দিয়ে উঁচুগলায় চিৎকার করল জাকির, কাকার কি বউ নাই? তর লগে অত কী কতা থাহে তার যে ভিডিও কলে এত কতা কওন লাগে?
ফোন কেটে দিয়ে ঘর থেকে বের হল মজিলা। সব দেখল চুপচাপ। ছেলের কথার কোনো জবাব না দিয়ে আবার নিজের ঘরে গিয়ে থম ধরে বসে রইল নির্বাক। হিমি মা-ছেলের এই নাটক নীরবে হজম করল, সাবধানে মেঝে পরিষ্কার করে মুছল। অতঃপর মেয়েকে খাওয়াবে বলে শাশুড়ির বিছানা থেকে তুলতে গেল তাকে।
হিমিকে দেখে নড়েচড়ে বসল মজিলা। দুঃখিত, নিচুস্বরে বলল, আইচ্ছা হিমি, এই যে জাকিরে আমারে কতাডি কইল, এইডা কি অয় ঠিক করল, কও? পোলা অইয়া তার কি উচিত অইল অই কতাডি আমারে কওন?
আপনেরই তো দুষ! আপনেরে না কইছি হের সামনে কতা না কইতে? আপনে আপনের দামড়া পোলা-মাইয়াডি গরে থাকতে অইন্য মাইনষের লগে ফুনে কতা কইতে যান ক্যারে? আর কতা যেডি কন বেবাকই তো হিয়ানথা শুনন যায়, আস্তে কতা কইতারেন না আপনে?
জারাকে নিয়ে গজগজ করতে করতে হিমি চলে গেলে তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অগত্যা মজিলা। জগতে তার কষ্টটা কেউ বুঝল না। সে কারো বউ, কারো মা, কারো শ্বাশুড়ি, কারো দাদি, কারো নানি, সবই সত্যি। কিন্তু সব ছাপিয়ে সে তো একজন মানুষও বটে! এবং তার বয়স সবে চল্লিশে পড়েছে কিংবা পড়েনি। বাচ্চা জন্মদানে বশির যতটা পারঙ্গম, সফল, সঙ্গমে সে ততটাই অক্ষম, এই নিদারুণ সত্যিটা মজিলা কী করে বোঝায় সকলকে! প্রবল মনোকষ্টে অবশ্য একদিন কথায় কথায় সে হিমিকে বলে ফেলেছিল বশিরের অক্ষমতার কথা। নিতান্তই নীরিহ, গোবেচারা গোছের একটা বাক্যমাত্রই শুধু বলেছিল মজিলা, ‘তোমার শ্বশুরে পারে না’।
ব্যস!
‘ছি ছি! এডি আপনে কী কইন আম্মা? এই কতা আপনে আমারে কইন ক্যারে? পোলার বউয়ের কাচে এমুন খাচ্চইরা কতা কইতারেনি কেউ? আপনের দেহি লাজ-শরম নাই মোডেও!’
বলতে বলতে হিমি তখনই উঠে গেছিল মজিলার সামনে থেকে। জারাকে নিয়ে হিমি আজও চলে গেল সেদিনের মতোই। যাক। তারই-বা কী করার আছে তাতে! জীবন যখন তার, যাপনও তাকেই করতে হবে বৈ কি! কেউ এসে হালকা করে দেবে না যাপিত জীবনের দুঃসহ ভার। জীবন একা তার। তারই। কাজেই নিজের ভাবনা নিজেই ভাববে সে।
৫
ফোনটা হাতে নিয়ে আবার ছাদে যায় মজিলা। অন্ধকার ছাদ। চুপচাপ বসে থাকে কতক্ষণ। ফোনের লাইট জ্বেলে মুরগিগুলোকে দেখে। আলো পেয়ে ছটফটিয়ে ওঠে মুরগিগুলো। খুঁটে খুঁটে দানাপানি খায়, একে অন্যের সঙ্গে খুনসুটি করে, ডাকে। দেখে মজিলা। দামড়ি মুরগিটাকেও দেখে। মুরগিটার হাবভাব ইদানীং কেমন কেমন। মাথার ঝুঁটিটা মোরগের মতো বড় হয়ে ঝুলে পড়েছে অনেকটাই। অন্য মুরগিদের সঙ্গে তার আচরণেও পরিবর্তন এসেছে ঢের। অন্য মুরগিগুলোও এই মুরগিটাকে দেখে কেমনতর রংঢং করছে আজকাল। আর কদিন থেকে এই মুরগিটা মোরগের মতো বাঁক ছাড়ছে হঠাৎ হঠাৎ। প্রথমদিন ভারি চমকে গেছিল মজিলা। চোখে অবিশ্বাস নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল মুরগিটার দিকে। নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না সে। ভেবেছিল মনের ভুল। কিন্তু না। তারপর থেকে খানিক পর পর অবিকল মোরগের মতো বাঁক ছাড়ে মুরগিটা। কোঁকর কঁক কঁক, কোঁকর কঁক কঁক! জীবনে এরচে বিস্মিত আর কখনো হয়নি মজিলা আগে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে মুরগিটার দিকে সে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর হুড়মুড়িয়ে নিচে নেমে বশিরকে টেনে তুলেছিল ঘুম থেকে। ঘুমজড়ানো গলায় বশির বলেছিল, কী কও পাগলের মত? মুরগি আবার বাঁক পাড়ে কুন জন্মে? ওইডা তাইলে মোরগঅই! তুমি বুজবার পার নাই!
রাগে, ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে মজিলা। বলে, বলদা ব্যাডায় কয় কী! জলজ্যান্ত মুরগিডা আমার, ডিম পাড়ল কতডি, কুঁরচেও অইল শেষে! আর হেডি বলে মোরগঅই! তুমি ওঠ, উইঠা দেহছে আইসা কী অইল মুরগিডার! অমুন করে ক্যা হেয়? ডিমও পাড়ে না কতদিন অইয়া সারছে!
অগত্যা ঘুম চোখে উঠে বসে বশির। বউকে যমের মত ডরায় সে। নিজের অক্ষমতাকে ঢাকতে বউয়ের কোনো কিছুতেই আপত্তি করে না সচরাচর। মজিলার পেছন পেছন ছাদে ওঠে বশির। মুরগিগুলোকে সে দেখেছিল একেবারেই বাচ্চা অবস্থায়। এখন তারা বড় হয়ে ডিম দিচ্ছে রীতিমতো। একটা এনজিওতে নাইট গার্ডের চাকরি করা বশিরের দুনিয়া বড় ছোট। ভোর ছয়টায় বাসায় ঢোকে সে, কোনোমতে কিছু পেটে চালান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, দুপুরে উঠে চোখ-কান বুজে আবার কিছু খেয়ে শুয়ে পড়ে, মরার মত ঘুমায়। সন্ধ্যায় উঠে রাতের খাবার খেয়ে আবার সে বেরিয়ে পড়ে অফিসের পথে। ছকবাঁধা মাপা জীবন তার, কোনো কিছুতেই অতিরিক্ত আগ্রহ বা কৌতূহল নাই। মজিলার নির্দেশিত মুরগিটার দিকে তাকিয়ে সে বিরক্ত, ভারী গলায় বলে, চোখ কি গেছেগা তুমার? এডি মুরগি কেডায় কইছে তুমারে? এডি দেহি মোরগ!
খাচ্চইরা ব্যাডায় কয় কী? এডি কতডি ডিম পাড়ল আমার চউক্ষের সামনে, আর ব্যাডায় কয় এডি বলে মোরগ! হুনছ ব্যাডার কতা! -চিৎকার করে মজিলা।
তুমার বুল অইতাছে কুনোহানে। অইন্য মুরগি ডিম পাড়ছে, তুমি খিয়াল করা পার নাই, বাবছ হেয় পাড়ছে! -মিনমিন করে মজিলাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বশির।
যা ব্যাডা সামনেত্থিকা! আমার চউক্ষের সামনে বইয়া ডিম পাড়ছে প্রতিদিন, আর আমি বুল দেকছি, না?-মজিলার কণ্ঠ আরো উচ্চগ্রামে ওঠে ক্রমশ। চুপিসারে অতঃপর ছাদ থেকে নেমে পড়ে বশির। আবার সে ঘুমিয়ে পড়ে সহজেই।
৬
সেদিনের পর থেকে আর ডিম দেয়নি মুরগিটা। মোরগের মতো ডেকেই যাচ্ছে। চালচলন, হাবভাব সব মোরগের। চেহারায়ও কবে কবে যে অবিকল মোরগ হয়ে উঠেছে মুরগিটা, একদমই সেটা ঠাওর করতে পারেনি মজিলা। দুঃখিত, হতাশ চোখে মুরগিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ অন্য একটা ভাবনা উঁকি দেয় মজিলার মনে। মুরগিগুলোর প্রতি ভারি একটা মমত্ব জাগে তার। এই যে মুরগিগুলোকে খাঁচার মধ্যে এভাবে আটকে রেখেছে মজিলা, জন্ম থেকেই যারা বেড়ে উঠেছে কোনো মোরগের সংস্পর্শ ছাড়া, তার প্রতিবাদেই কি এই মুরগিটা হঠাৎ বিদ্রোহ করে বসেছে হঠাৎ? তাতেই কি রাতারাতি মোরগে রুপান্তরিত হয়ে গেছে তার ডিমপাড়া জলজ্যান্ত মুরগিটা? লেখাপড়া বেশিদূর করেনি মজিলা। বিদ্যেবুদ্ধি তার ঘটে নাইই বলতে গেলে। কিন্তু এই ভাবনাটা তাকে নাড়িয়ে দেয় সহসা। নিজেকে সে এই মুরগিগুলোর সঙ্গে তুলনা করে মনে মনে। বশির পুরোপুরিই অক্ষম। বিয়ের প্রথম দিকে ব্যাপারটা মজিলা বুঝতে পারেনি তেমন করে। তারমধ্যেই জমজ দুই বাচ্চার মা হয়ে গেছে সে। যখন বুঝেছে সে, তখন জীবন জুড়ে শুধুই অতৃপ্তি আর হাহাকার তার। ততদিনে সে বুঝেছে ‘শরীর’ উপেক্ষাযোগ্য নয় মোটেই। বরং তা ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ এক অনুসঙ্গ জীবনের। বস্তুত শরীর ছাড়া জীবনই তো অস্তিত্বহীন! কী করে একে উপেক্ষা করা যায় আদতে! কিন্তু সে যাবেই বা কোথায়! পড়াশোনা শেখেনি জীবনে, সমাজ তাকে শিখিয়েছে বউ হয়ে অন্যের ঘাড়ে চড়ে বসলেই নিশ্চিন্ত জীবন, নিরাপদ আশ্রয়। এই নিশ্চিন্ত জীবন আর নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে যমজ সন্তান নিয়ে তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াত সে তখন! অল্প বয়সে নিজের পছন্দে পালিয়ে বিয়ে করেছিল বশিরকে, বাপের বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেছিল তখনই তার। কাজেই বাহ্যত সে থেকে গেছিল বশিরকে আঁকড়েই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে মরিয়া হয়ে উঠেছিল ভীষণ। উঠতি বয়সি ছেলে-ছোকড়াদের নম্বরে ভরে উঠেছিল তার ফোন। এরমধ্যেই হাতে চলে এল স্মার্ট ফোন, এল নেট। অবাধ হয়ে গেল মজিলার দুনিয়া। রাতে, যখন নাইট ডিউটিতে চলে যায় বশির, জাকির আর হিমি শুয়ে পড়ে নিজেদের মত, নিঃসঙ্গতা তখন পেয়ে বসে তাকে। এপাশ-ওপাশ করে, উঠে বসে, লাইট জ্বালিয়ে পানি খায়, টয়লেটে যায়, এঘর-ওঘর করে, পা মেলে বসে পান খায়। কিন্তু রাত বড় দীর্ঘ হয়ে ওঠে ক্রমশ। দুঃসহ হয়ে ওঠে সময়। অতঃপর সে ফোন হাতে নেয়, ইমো, হোয়াটসএ্যাপ, ফেসবুক ঘাঁটে। বন্ধু জুটে যায় বিস্তর। চলে ভিডিও কল, কথা চলে রাতভর। দিনে সময়-সুযোগ বুঝে দেখাও করে তাদের কারো কারো সঙ্গে। শরীর তাকে ক্রমশ করে তোলে ভয়াবহ এক বিকারগ্রস্ত নারীতে। মজিলা এসব বোঝে না। সে শুধু শরীরী প্রয়োজন বোঝে। বাকিসব অর্থহীন তার কাছে, তুচ্ছ। তার এমন বেপরোয়া আচরণে ছেলে-মেয়েরা লজ্জায় মুখ লুকায়। কিন্তু হিমি বড় ঠোঁটকাটা। শাশুড়ির এমন অসংলগ্ন আর অরুচিকর আচরণ সে বরদাস্ত করতে পারে না মোটেই। মুখের ওপর বলে, আপনে এমুন খাচ্চইরা কাম কেমনে করেন? একদিন এমুন দরাডি খাইবেন, দ্যাখবেন মান-ইজ্জত সব যাইবগা আপনের। আপনের তো যাইবই লগে আমগো হগ্গলডিরই যাইব। মাইনষে থুতু দিব তহুন মুহে।
বস্তুত সেসবের তেমন কিছু বাকিও নাই আর। বাড়িঅলা এই সেদিন বাসা ছাড়ার জন্য বলে গেছে পইপই করে। পাশের নির্মিয়মান বিল্ডিংয়ের কন্ট্রাকটর নাকি নালিশ করেছে, মজিলার যন্ত্রণায় তার শ্রমিকেরা কাজ করতে পারে না। সে নাকি যখন তখন ছাদে উঠে মিস্ত্রিদের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর তা দেখে মিস্ত্রিরাও কাজ ফেলে হা করে দেখতে থাকে মজিলাকে, ইশারা-ইঙ্গিতে চলে আলাপ-সালাপ, চলে ফোনে কথাবার্তাও। ফলে তার কাজের ক্ষতি হয় ভীষণ!
কিন্তু এতকিছুর পরেও মজিলা নির্বিকার। তার কোনো হেলদোল নাই। নিজের জগতে সে বিভোর। তার জগতে ভাবের দাম নাই দুপয়সাও, নিরাকার মনের গুরুত্ব সে দেয় না আর মোটেও। শরীরই আরাধ্য, শরীরই অমোঘ সত্য তার কাছে।
মুরগি থেকে সদ্য রুপান্তরিত হওয়া মোরগটার কোঁকর কঁক কঁক ডাকে ধ্যান ভেঙে আচমকা চমকে ওঠে মজিলা। কখন বৃষ্টি নেমেছে খেয়াল করেনি সে। অন্ধকার রাতে বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে মুরগির খাঁচাগুলো। ফোনের লাইট জ্বেলে খাঁচাগুলো সরিয়ে দেয় আড়ালে। নিজেও কখন ভিজে গেছে অনেকটা, মশার কামড়ে জ্বলে যাচ্ছে শরীর। সেদিকে খেয়াল থাকে না তার। সন্ধ্যারাতের ফিকে অন্ধকারে ভৌতিক ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে মুরগিগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। নিজের চারপাশেও অমনই এক অভেদ্য খাঁচার অস্তিত্ব সে অনুভব করে ভীষণভাবে। সহসা সে টের পায় কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে, জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে অমনই কোনো একটা খাঁচার ভেতরে আটকা পড়েছে সে, যা থেকে বের হওয়ার সাধ্য তার নাই। কোন এক অদৃশ্য শৃঙ্খল তাকে তীব্র শক্তিতে বেঁধে রেখেছে এই খাঁচার বেড়াজালে। যতই সে মাথার মধ্যে চব্বিশ ঘণ্টা বহন করে চলুক কায়া, তথাপি খাঁচা নামক এই অদৃশ্য ছায়াটি তাকে আঁকড়ে রাখে আষ্টেপৃষ্টে, অক্ষম বশিরের কঙ্কালসর্বস্ব সংসার নামক খাঁচার ঘূর্ণাবর্তেই যা তাকে খাবি খাইয়ে মারে অহর্নিশ। মুরগিগুলোর মতোই সে সময় মতো দানাপানি পায়, বাঁচবার প্রয়োজনীয় সব রসদ পায়, কিন্তু স্বাধীনতার সুখটুকু সে পায় না কিছুতেই। সেটুকু ছুঁতে গেলেই তার দিকে তেড়ে আসে তীব্র ভ্রুকুটি, অসহ্য অপমান, আর অনুশাসনের সুতীক্ষ্ণ চাবুক।
বৃষ্টির তোড়ে ভিজতে ভিজতে বহুকাল বাদে নিজের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা ছায়াটার অস্তিত্ব টের পায় মজিলা। ঘুম ভেঙে যে তাকে বলে, কায়া নয়, তার ক্ষুধা মূলত এই ছায়ার। যেখানে লুকিয়ে থাকে অতৃপ্তির নিষিদ্ধ বীজ। যে চায় স্বাধীনতা, যে চায় মুক্তি। শুধু কায়ার নয়, ছায়ারও।

শিল্পী নাজনীন। জন্ম ১৪ জুলাই ১৯৮১, কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানায়। শৈশব, কৈশোর কেটেছে কুমারখালীর গোসাইডাঙ্গী নামক গ্রামের জল-কাদায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স। পেশা শিক্ষকতা। দেশের অধিকাংশ জাতীয় দৈনিক এবং দেশ-বিদেশের অনলাইন ম্যাগাজিনগুলোতে অনেক গল্প প্রকাশিত হয়েছে ইতোমধ্যে। প্রথম উপন্যাস ‘ছিন্নডানার ফড়িঙ’ প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। ২০১৭, ২০১৮ ও ২০২২ সালে প্রকাশিত ‘আদম গন্দম ও অন্যান্য’, ‘বিভ্রম’ এবং ‘মায়াফুল ও সাপের গল্প’ নামক গ্রন্থ তিনটি ছোটগল্পের। এছাড়া ২০১৮ তে প্রকাশিত হয় ‘তোতন ও ফড়িঙরাজা’ নামক একটি শিশুতোষ গল্পের বই। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘উলটপুরাণ’ প্রকাশিত হয়েছে বইমেলা ২০২৩-এ।