গৃহপালিত স্বামী, লেখক : গীতা দাস, ধরন : গল্প, প্রকাশ : ২০২৪, প্রকাশক : প্রতিকথা
বইয়ের নামকরণের মধ্য দিয়ে বইটির লেখার বিষয়বস্তুর আঁচ পাওয়া যায়। লেখক গীতা দাস জাতি ধর্ম বর্ণ শ্রেণি নির্বিশেষে একটা নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে গল্পগুলো লেখার চেষ্টা করেছেন। তাই তিনি গৃহিনীর বিপরীতে ‘হাউজ হাজব্যান্ড’ এবং ‘গৃহপালিত স্বামী’ শব্দযুগল ব্যবহার করেছেন।
বাংলাদেশের অধিকাংশ নারীর স্বামীরা উপার্জন করেন আর নারীরা গৃহে থেকে সংসার ব্যবস্থাপনা করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আপনি কি করেন- নারীদের এই প্রশ্ন করলে উত্তর আসে আমি কিছু করি না আমার স্বামী রোজগার করেন। অন্যদিকে পেশার প্রশ্নে গৃহে অবস্থান করা নারীরা নিজেদের গৃহিনী পরিচয় দিতেই অভ্যস্থ। গীতা দাস বিপরীত দিক থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন। ব্যতিক্রমী পুরুষ যিনি গৃহে অবস্থান করেন; অন্যকোন রোজগার করেন না তাকে গৃহপালিত স্বামী বললে সমস্যা কোথায়? পেশাগতভাবে তাকে তিনি গৃহপালিত স্বামী বলে উল্লেখ করেছেন।
হাজার হাজার বছর জুড়ে পিতৃতন্ত্র নারীর প্রতি খড়গহস্ত। পিতৃতন্ত্রের মূল মদদদাতা পুরুষতন্ত্র নারীকে নানাভাবে অধীনস্ত করে রেখেছে। দেশে দেশে গড়ে উঠেছে পুরুষতন্ত্রবিরোধী নারীআন্দোলন। বিংশ শতাব্দীতে দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তীতে রাশিয়া চীনসহ দেশে দেশে ঘটে যাওয়া বিপ্লবী আন্দোলন পৃথিবীতে নারীর অবস্থান নতুনভাবে স্থাপন করেছে। কিন্তু আমাদের এই বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে নারীর অবস্থান রয়ে গেছে সেই তিমিরেই। অবশ্য নানা পশ্চাৎপদতা সত্ত্বেও এদেশের স্বল্পসংখ্যক নারীরা শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করে বিভিন্ন পেশায় পুরুষের সমকক্ষতা অর্জন করেছে।
গীতা দাস যিনি একজন সাহিত্যিক কলামিস্ট এবং নারী অধিকারকর্মী। তাঁর লেখায় নারীর জীবন জীবিকা আবেগ অনুভূতি এবং অধিকার ও দাবীর কথা উচ্চারিত হয়েছে। তাঁর গল্পে স্থান পেয়েছে উচ্চপদস্থ চাকুরিজীবি নারী থেকে গ্রাম্যরমণী এবং গৃহকর্মী পর্যন্ত।
প্রথম গল্প ‘উজান বেয়ে চলা’ এই গল্পের নায়িকা পাতা। পাতাকে শান্তি দেবে কে? পাতা আপন মনে ভাবে- নারীর জন্য কেউ লেখেনি। যদিও নারীকে নিয়ে প্রচুর এবং প্রচুর লেখালেখি হয়। পাতা স্বামীর সঙ্গে ছাব্বিশ বছর কাটিয়ে অবশেষে একটা সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হয়। অবশেষে তেপ্পান্ন বছর বয়সে এসে নিজের জন্য শান্তি খুঁজতে গিয়ে স্বামীর সাথে আলাদা হয়ে যান। পাতার মনোজগতে খেলা করে- নারীর শান্তি খোঁজার স্থান, সময়, ব্যক্তি মনোনয়নেও অনেক দিক বিবেচনা করতে হয়। কে করে? শুধু নারী নিজে নয়- চারপাশের সবাই। তাই পাতা চারপাশের সব বাঁধা অতিক্রম করে একটি ঘর খুঁজে নেন যেখানে পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। প্রবেশাধিকার রয়েছে শুধুমাত্র সন্তানদের।
চাকুরী সংসার সন্তান সামলেও নারীরা নিজেদের ঘরের টিভির কন্ট্রোল হাতে পায় না। তাই ‘রিমোট কন্ট্রোল’ গল্পের নায়িকা মাটি নিজের জন্য আলাদা টেলিভিশন কিনে আনে; যে টেলিভিশনের রিমোট কন্ট্রোল থাকবে তার হাতে।
‘হাউজ হাজব্যান্ড’ গল্পের দুর্বা স্বামী হিসেবে পছন্দ করে নক্ষত্রকে। পছন্দ করার সময় দুর্বা তার পেশাকে বিবেচনা করেনি। নারীর প্রতি নক্ষত্রের দৃষ্টিভঙ্গি দুর্বাকে আকর্ষণ করেছিল।
একজন বলেছিল আরে নক্ষত্র বলো না। মেয়েমানুষ কলাগাছের মতো। এক বিয়ানেই বুড়া। নক্ষত্র প্রতিবাদ করেছিল- নারীরা সরিষা গাছের মতো। একসাথে ফুল মেলে ও দানা ছাড়ে। এভাবেই নারীর পাশে দাঁড়ায় নক্ষত্র। অন্যদিকে দুর্বার স্বামীর অন্য কোনো পেশা নেই সে ‘হাউজ হাজব্যান্ড’। এ ব্যাপারে বলিষ্ঠভাবে ইন্টারভিউবোর্ডে জবাব দেয়।
‘পাসওয়ার্ড’ গল্পের নায়িকা প্রথমা। যার বিশ্বাস সফ্টকপিতে। যে বিশ্বাস করে- পড়ো। হয় ফাইল করো বা মুছে ফেলো। প্রথমার অন্তরালে লেখকের ভাবনা হয়- ভালই তো উপভোগ করো- প্রিন্ট করার মতো ফ্যাসাদে যাওয়া কেন? থাকো, খাও, শোও, কিন্তু প্রিন্ট করার মতো স্থায়ীত্বের জন্য কীসের ঘর বাঁধা?
প্রথমার মনোজগতে খেলা করে নিজে চলার এক অসম্ভব অহংকার। জীবনের মতো জটিল বিষয়ে যাকে আনতে যাচ্ছে প্রথমা সেই অনাগতের দায়ভার সম্পুন্ন তার একার। তাই- প্রথমা তরুর সব আশ্বাস, বিশ্বাস, নিঃশ্বাস ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আযৌবন পালিত ধ্যানই ধারণ করে থাকবে আজীবন। অনাগতকে আলোর মুখ দেখাবে নিজের পরিচয়ে।
গল্পের ভিন্নতা মেলে ‘ফেনা স্নান’ গল্পে। আমাদের মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত পরিবারের অনুষঙ্গ হিসেবে বসবাস করে গৃহকর্মীরা। কখনও বাঁধা কখনও খন্ডকালীন। আমাদেও সুখসুবিধা বিলাসিতাসহ সবধরণের গার্হস্থকাজে ছায়া দেয় গৃহকর্মীরা। তাদের সেবাটুকু প্রাণভরে নিলেও তাদের সুখসুবিধা নিয়ে আমাদের কতটুকু দায় আছে? ‘ফেনা স্নান’ গল্পের গৃহকর্মী বৈচির গৃহকর্ত্রী অন্যদের থেকে আলাদা। সে বৈচির সুযোগ সুবিধার ব্যাপারে সচেতন। তারপরও বৈচির কিছু শখ রয়ে যায়। সে শখ বাথটবে শুয়ে আরাম করে স্নান করার। তাই করতে গিয়ে বাধে বিপত্তি এই নিয়েই গল্প। এভাবেই ভিন্ন ধরণের বিষয় আমাদের সামনে গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
আরও একটি ভিন্ন কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে ‘এক ছাইওয়ালির কথা’ গল্পটিতে। আমাদের প্রতিদিনের নাগরিক জীবনে ছাইবিক্রেতার ডাক আমাদের চিরচেনা। সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক স্তরে বাস করে এই নারীরা। বিনে পয়সায় বা নামমাত্র মূল্যে ছাই কিনে নিয়ে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে তারা। সাধারণ অসহায় এই নারীদের গল্প সকলের অগোচরেই থেকে যায়। এরকমই এক নারী সারদা যে শহরে এসে নাম পরিচয় বদলে হয়ে যায় শরীফা। সময়ের নিয়মে সারদা গ্রামে ফিরে গেলেও সেখানে টিকতে পারে না: আবারও ফিরে আসে শহরে। এরকমই বদলে যাওয়া জীবন নিয়ে লেখা হয়েছে গল্পটি।
গীতা দাসের গল্পগুলো নিয়ে আলোচনার জন্য প্রয়োজন বৃহৎ পরিসর। স্বল্প পরিসরে আলোচনা অত্যন্ত কঠিন। আমি আমার সংক্ষিপ্ত আলোচনায় কয়েকটি গল্পের বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি মাত্র। সবশেষে লেখকের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করছি।

নাজনীন সাথী একজন স্বাপ্নিক মানুষ। লেখালেখিই তার বর্তমান পেশা। পাশাপাশি বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংগঠনিক চর্চার সাথে যুক্ত। তন্মধ্যে শিশু সাহিত্য পত্রিকা ঝুনঝুনি, শিশু সংগঠন সূর্যবাড়ি এবং বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি পত্রিকা অন্যতম। বাংলাদেশের জন্মের সাথে বেড়ে ওঠা এবং নানা চড়াই উৎরাইয়ের সাক্ষী, ইতিবাচক ও নেতিবাচক অভিজ্ঞতায় পুষ্ট নাজনীন সাথী পুরোদস্তুর একজন আশাবাদী মানুষ। তার কলমে জীবনের শত জটিলতার ভেতরও উঁকি দেয় আলোকিত জীবন; সংগ্রামী মানুষের বিচিত্র অবয়ব। ছোট গল্পের পাশাপাশি উপন্যাস রচনায়ও তার নিরীক্ষা নিরন্তর চলমান। ইতিপূর্বে তার একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে- আমাজান লিলি (২০২০)। ইতিহাসমূলক বই- বঙ্গ পুণ্ড্র গৌড় হতে লালমনিরহাট (২০২৫)।