‘বসুমাতা থির’ নিয়ে এক চিলতে অনুভব

বসুমাতা থির, লেখক : গীতা দাস, ধরন : উপন্যাস, প্রচ্ছদ : প্রদ্যোত দাস, প্রকাশ : ২০২৫, প্রকাশক : প্রতিকথা

বই পাঠে প্রধানত আমি ভালোলাগার মাত্রায় আপ্লুত হই। আর নিজের সাথে নিজেই এই ভালোলাগাটা উপভোগ করি। কখনো দু’কলম লিখে অনুভূতি প্রকাশ আর হয়ে ওঠে না। কিন্তু গীতা দাসের উপন্যাস ‘বসুমাতা থির’ পাঠে ভিন্নতায় ভাসলাম।

উপন্যাসটির নামকরণে কথ্য ভাষার প্রয়োগ আমায় নাড়িয়ে দিয়েছে। অপরিমেয় ভালোলাগা বোধ মুহূর্তকাল থির থাকতে দেয়নি। বইটি শেষ না করে স্থির হতে পারিনি। পাঠ যত এগিয়েছে বাংলার ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্য বহু প্রবাদ ও প্রবচনের সাথে পরিচিত হয়েছি। কাহিনি এবং চরিত্রের সাথে প্রবাদের যথার্থ প্রয়োগ উপন্যাসটিকে বাহুল্য দোষের অপবাদ থেকে বাঁচিয়ে শিল্পঘন অবয়ব দিয়েছে। গ্রামীণ সমাজের চির প্রচলিত ‘থির থির থির বসুমাতা থির’ প্রবচন দিয়ে উপন্যাস শুরু। ঠাকুমারা তাদের মতো বয়ানে সেসব তুলে আনায় বিষয়টি অধিকতর মনোগ্রাহী হয়েছে। বয়নদাকে ঠাকুমা শুনিয়েছেন- “সাইজ্যা পইরা রইলাম রাই/ এই লগনে বিয়া নাই।”- পৃষ্ঠা ২৯

গল্প এগিয়েছে দুই সখীর পর্যায়ক্রমিক কথনে। চরিত্রের বিশেষত কলাবতী ও জলশ্রীর মনস্তত্ত্ব উন্মোচনে লেখক সবিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন। জীবন ও জীবিকা নিয়ে তাদের লড়াই, মূল্যবোধ, স্বাবলম্বিতা, সমাজ মনস্তত্ত্ব, ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা, পাঠককে সাথে নিয়ে পথচলা এক মুহূর্তের তরেও চোখ সরাতে দেয়নি। এমন কী, পরবর্তী প্রজন্মের আবর্তিত মূল্যবোধ বর্ণনায় লেখকের কলম যথেষ্ট আগলমুক্ত, বিস্তৃত। প্রত্যয়ে পরিশুদ্ধ। লেখকের বক্তব্য মনোগ্রাহী। ভাষা ঝরঝরে, সাবলীল। তাই উপন্যাস ছুঁয়েছে শিল্পের মাত্রা। উত্তর প্রজন্ম উজান ও চেতনা চরিত্র সৃষ্টি, তাদের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য ও বর্তমান পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর কৌশল পাঠককে বিমোহিত করবেই।

বইটি পড়তে পড়তে আমি ভুলে গেছি, এটি লেখকের প্রথম উপন্যাস। মনে হয়েছে- প্রথম সৃষ্টিশীল রচনা নয়। অবশ্যই তাই। কথাসাহিত্যে এটা তার দ্বিতীয় গ্রন্থ। ২০২৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ছোটগল্প সংকলন ‘গৃহ পালিত স্বামী’। তাছাড়া একটি সামাজিক রূপান্তরের জার্ণাল তখন ও এখন প্রকাশিত হয়েছিল ২০১১ সালে।
ভালো লেগেছে চরিত্রগুলোর সরলতা ও কপটতাহীনতা। জলশ্রীর কন্যা চেতনার উচ্চারণ- “মা, নাগরিক জীবন ভাড়া করে গ্রামে নিও না। আমরা বিদেশের মতো কোনো দ্বীপে যাচ্ছি না”- পৃষ্ঠা ৬০

নিরেট পল্লীপ্রেম। যেন প্রকৃতির উদারতায় শিকড় প্রোথিত করে মুক্ত হাওয়ায় ডালপালাসমেত আন্দোলিত চিরহরিৎ বৃক্ষ। যা সুরুচির পরিচায়ক।

চরিত্রের নামকরণও আধুনিক, অর্থবহ এবং প্রাসঙ্গিক। যৌক্তিক ভাবেই বয়নদাকে তুলে আনা যায়। দৃশ্যত বয়নদা দক্ষ বয়ন শিল্পী হয়ে ওঠতে পারেনি। না নিজের জীবন, না কলাবতীর জীব্ন ভালোবাসার বর্ণিল সুতায় বুনতে পারেনি। কিন্তু অর্ন্তগত দিক থেকে একে অপরকে জড়িয়ে থেকেছেন জীবনভর। অন্যদিকে জীবনে নিজের পারিবারিক ও সামাজিক বলয় থেকে বের হয়ে প্রতিষ্ঠিত হবার অদম্য স্পৃহা, দারিদ্রের কঠিন বেড়াজাল থেকে পরিবারকে নিষ্কৃতি দেওয়ার সংকল্প কলাবতীকে কৈশোর ও নব্য যৌবনে বয়নদাকে সযত্নে এড়িয়ে যেতে প্রাণিত করেছে।

পাঠক হিসেবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, মনের কোনো অতল গহীনে যেন বয়নদা ছিলই। কলাবতীর মনোজগতে বয়নদার বার বার ফিরে আসা- এমনিতর ভাবনার যোগান দেয়। এখানেই লেখকের ক্যারিশমা। ঝঞ্ঝা সঙ্কুল জীবনে বিপর্যস্ত মানুষের অন্তর্মূল নাড়িয়ে দেওয়া তো সহজ কাজ নয়!

জীবনের বহুমাত্রিক দিক উপস্থাপন উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সমসাময়িক নানা বিষয় ওঠে এসেছে। সমসাময়িক বিষয় অবতারণাকালে কখনো নিম্নকন্ঠ প্রবন্ধের আমেজ অনুমিত হলেও এসব বিষয় চরিত্রের মনোবিস্তৃতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বলেই মনে হয়েছে। স্বল্প পরিসরে বহুবিচিত্র বিষয়াদি ছুঁতে গিয়ে লেখক কাহিনিকে মুখ থুবড়ে পড়তে দেননি। নিঃসন্দেহে এটি ধন্যবার্দাহ।

স্বল্প পরিসরে লেখক ছুঁয়েছেন, দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে উন্মূল উদ্বাস্তুর বেদনার্ত আর্তি। তাদের অন্তঃক্ষরণ যা আবেদনে সুদূরপ্রসারী। প্রজন্মান্তরে এর মালিন্য উপস্থাপনে লেখকের কলম স্পষ্ট ও দৃঢ়।

“রক্তীয় ও আত্মীয়দের সংস্পর্শবিহীন জীবন তো শিকড়হীন আগাছা। পরিপূর্ণ জীবনপ্রবাহে মাতৃকুল ও পিতৃকুল উভয়েরই প্রয়োজন। কোনো নদীর তো এক কূল হয় না।”- পৃঃ ৪৭

মাছের কাঁটা বাছার বকলমে চরিত্রেদের সমাজমনস্কতা তথা নানাবিধ কাঁটা বাছার প্রক্রিয়াটি আনন্দ দিয়েছে। আসুন দেখি-

“আর মাছের কাঁটার মতো রাজনৈতিক জীবনে বিরোধী দলের অসহযোগিতা, গণতান্ত্রিক সরকারের নামে যথেচ্ছাচার নাগরিক অধিকার উপভোগে বাধা, সামাজিক জীবনে তথাকথিত সমাজপতিদের ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি মানানোর নামে ফতোয়া … … … গ্রামীণ জীবনকে নির্ঞ্ঝাট থাকতে দেয় না।… … … কাঁটাবিহীন জীবন নেই। কাজেই আজকাল মানবজীবন উপভোগ করা দুরূহ।” পৃষ্ঠা- ১৪৭

উদ্ধৃতিটুকু সমসাময়িকতায় ভীষণই প্রাসঙ্গিক।

লোকজীবন কাহিনির পরতে পরতে। কেন্দ্রিয় চরিত্র জলশ্রী ও কলাবতীর শিকড় গ্রামে প্রোথিত। চেতনা বিদেশে বেড়ে ওঠায় তার সাথে পাঠকদেরকেও লেখক ভূমিজ মুখনিঃশ্রিত সীমায়িত এলাকার নির্দিষ্ট কিছু শব্দগুচ্ছের সাথে পরিচিত করান। এসব শব্দাবলি গ্রামীণ মানুষের পরিচয় পত্র। চরিত্রগুলো যেন এসব শব্দবন্ধের মাধ্যমে নিজকে চেনার অবলম্বন পেয়েছে। মাটি মানুষ দেশকে ভালোবেসেছে। নিজস্ব সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ ও সংস্কৃতিতে অবগাহন করে তৃপ্ত হয়েছে। মোদ্দা কথা, শিকড়ের সন্ধান পেয়েছে। লেখক উপন্যাসের অন্তিমে এসে তাদের উত্তর প্রজন্মকে শক্ত মাটির সতেজ শিকড়ে প্রোথিত দেখার আকাঙ্ক্ষায় আকুল থেকেছে। সেই সাথে লেখক পাঠকদের মনোজগৎকেও নিজকে চেনার বাসনায় উদ্দীপিত করতে সক্ষম হয়েছেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *