কোনো এক ছ্যামড়িকে
তুমি চলন্ত রেলের কামরায়— থায় দাঁড়িয়ে কচ্ছো রাজ্যের কত কথা
সেই কবেকার হবে— অতীতস্মৃতি; হাতড়ে জীবনের গান
ভোরবেলা একটি কাক, উড়ে বসে ঘরের হাতনেতে
দেখতে দেখতে পাড়ার ছাওয়াল-পাল ছুটে চলে রেলের দিকে—
মা তখনও হারিকেন আর কুপি জ্বালায়ে রাখে ঝড় হবে ভেবে
আমিও মৃত মানুষের পাশে রেখে আসি কত চাল আর ধূপকাঠি
দিনোমানে গাছের কাছে মিনতি সবার— মরণ এক প্রতারণার নাম
বিবর্ণ গতর নিয়ে কেন মানুষ ঘুমায়— এই প্রশ্ন সবার।
পাড়ার মদ্দরা দল বেঁধে চলে— এক ছটকা পিরিতের মেয়েকে
দেখবে বলে— ফুটন্ত গুলাপ
ভাঁজ করে রেখে ঠোঁট— ছিটাতে থাকে মায়া
কনে যাবি— যাচ্ছি বলে সেই অতীত ব্যাধি
বিষমেখে হাতির পায়ে পড়েছে লুটিয়ে— মানুষের যত লোভ
হলে প্রকাশ— নিশ্চুপে ঘনীভূত হয় নীরবতা।
কতা কচ্ছি— কবো কয়েও হচ্ছে না কওয়া
আন্ধারে হারিয়ে গেছে মা’র হাতের বালা
বৃষ্টির ঝাপটায় তোমার ঠোঁট শুকোয়ে গেছে; তবুও
বিনিময়ে পেলাম নিঃশব্দের বাস্তুহারা—
ছ্যামড়িদের বুকখোলা ন্যাতানোস্তন…
জীবনলিপি
চোখ; চূড়ান্ত কোনোকিছু দেখার আগেই
দেখে নেয় ভ্রান্ত— প্রজাপতি
আঙ্গুলগুলো ধবধবে সাদা— চৌদিকে ফেটে পড়ছে
চমৎকার সময়; দুঃখের মুখে লাগাম…
ফড়িংয়ের বিয়ে হবে বলেই সাজানো বাড়ি
একাকি আমি, চোখে ক্ষীণতা…
কষ্টেরপাখি— নিমগ্ন বন্দনায়
শতভাগ মেলেছে ডানা
অন্ধ-বধির হলেও তুমি
পাখিবংসের লোক— নিজের নির্জনতায়
বিরহ দিনে— চেয়ে থাকো দূরে
স্মৃতিভূক হয়ে— লিখে চলো জীবনলিপি…
অন্তর দহন
আমি আর ফিরব কি না জানি না;
মাঝে মাঝে বলেছি ভুলব বলে
মারাত্নক এক রোগ-বেঁধেছে বাসা
শূন্যে উড়ে যায়— ভেতর পাখি
তবু জেগে থাকে আঁখি; তাবৎ অনুভূতি ছায়া হয়ে
ঘোরে চারিপাশ। নিরালায় অস্তিত্বহীন হব ভেবে-
ধুলোমাখা হাত বিনীত ভালোবাসায় নত
তোমার প্রতীক্ষায় নিয়ম ডিঙ্গিয়ে আমি
ফিরব তোমার নিরবতায়… ভাবিনি কখনও।
ভাষাহীন ভাষায় তোমাকে ভাসাব— মুদ্রিত কম্পনে
এই ভেবে সমর্পণ করেছি তোমার কাছে—
দুঃখ নির্মাণ করে জ্বলব বলে।
তীব্র বিষাদে— শিঙ্গায় ফুঁ দিলে— গভীর উল্লাসে
আচ্ছা কানকথা— গানকথা— শুনে কী তুমি
তীব্র বিষাদে— শিঙ্গায় ফুঁ দিবে
গভীর উল্লাসে? নাকি জলেধোয়া
এক বেদনাবকুল— পরাজিত দহনে
খামখোলা নির্ভরতার আশ্বাসে লিখবে
পরাস্তজীবনের চিঠি—
তোমাকে বেসেছি ভালো— কোন এক গোধূলি সন্ধ্যায়
লেখা আছে তা— গাছের পাতায় পাখির ডানায় কিংবা শিশির রেখায়।
ওভাবে লুকাতে পারি না— যেমন করে তুমি লুকিয়ে রাখো নিজেকে
ভালোবাসি বলে— উল্লাসে মেতে পড় ধানদূর্বা বনে…
কিছুটা অসহায় ভেবে
খেলতে চেয়েছো খেলা— ঘুরাতে চেয়েছো পিছে
মানুষ তো আমি; অবশেষে তোমায় চিনি লক্ষ্মীটি…
জানি না ছলনা— দেখাতে নগ্নলোকালয়।
এই বুক পেতে রেখেছি-যতখানি ব্যথা দেবে তুমি
মানিয়ে নিব অনায়াসে
ছেঁড়ে যেতে তো আসিনি তোমায়
কালকেউটে অসুখ বুকের মধ্যে লুকিয়ে
তোমার ভালোবাসা পাব বলে—
তাকিয়ে আছি ঐ সবুজাভ চোখের নেশায়
পোড়া ক্ষত পুষে বুকে…
সীমাহীন কথার পাহাড়— একদিন আমি
ছুঁড়ে দিয়েছি তোমার পানে— হতবাক আমি
মৃত্যুদণ্ডের আসামী— মা-বোন বুনেছে স্বপ্ন
উঠোনে রোপিত জবার বুকেও— ছিঁড়ে ফেলা
বোনের স্তনের বোঁটা— নাড়িয়ে দেয়
বেয়নেট নামক কথার খোঁচা— আজও আমি
রেখেছি বুকের কাছে— জামার পকেটে পুরে।
এই হলো বিস্ময়— দেখে নাও স্মৃতিগুলো আরাধনা করে
পূনর্বার অভিলাষী মন— শুনেছে কত বোনের ইজ্জত হারানো গল্প
অদূরে বালিকা মন ছুঁয়েছে তোমায়— আমাকে ভুলে তুলে নিলে ভুল
যারা তোমায় চারিদিকে কালিমা করেছে লেপন— অদ্ভূত চরিত্র তোমার
এসব আকুলতা আজ — নিষ্প্রয়োজন
বুঝেছো তুমি— আমিও গভীর বেদনায়
পাখির কাছে লিখেছি চিঠি
ভালো থেকো তুমি— প্রিয় ভূমি—
উল্টে-পাল্টে শকুনেরা খাচ্ছে স্বদেশ।
রক্ত রক্ত খেলা
তোমার লোভ ও স্মৃতিচিহ্ন দিন দিন বেড়েই চলেছে…
মৃত্যুস্মৃতি বুকে গুজে হাঁটলে খোলা মাঠের দিকে
আর বললে লুন্ঠিত বিবেকের দাহ্যতা সহ্য করবে কী করে?
গাছের ডালে সঙ্গমরত যে চড়ুই সেও তো জানে
তীব্রতার স্ফুলিঙ্গের মানে কিংবা বিষাক্ত ছোবল।
তুমি বলো আজ সব বিস্মৃতি-অতীত
পাখিজন্মের ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে—
হরিণেরও চোখে ছিল মায়া
বিক্ষিপ্ত বাড়িটির উঠান জুড়ে-পাতারা খেলে
গুহামানবের খেলা আর
রক্তিম আদিমতায় ভরে গেলে মন—
আমিও নীলছবিচ্ছলে কঙ্কাল হয়ে যাই
নিরবতায় ভাসি-নম্রতায় খেলি কুসুম কুসুম খেলা
বিষের মত দিন দিন ঘুম কেড়ে নিয়েছে সকাল
প্রতিবেশীর মুখে জমে বিষাক্ত বিষণ্নতার হাওয়া
আর রূপালী পর্দার নারী কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে
ধুলোয় নিজের নম্রতাকে বিলিয়ে দেয় নিজের অজান্তে
তবুও ছায়ার সাথে খেলে রক্ত রক্ত খেলা…

বঙ্গ রাখাল, কবি ও গবেষক। জন্ম ১২ জুন, ঝিনাইদহ। গণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষা-যোগাযোগ ও সংস্কৃতিতে স্নাতকোত্তর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ঢাকা স্কুল অফ ইকনোমিকস থেকে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন ইকোনমিকস ডিগ্রি এবং গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র থেকে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি অর্জন করেন। এম.ফিল করছেন-রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগে। তার প্রবন্ধগ্রন্থ—সংস্কৃতির দিকে ফেরা [২০১৫], মানবতাবাদী লালন জীবন অন্বেষণ [২০১৭], মনীষা বীক্ষণ, ও অন্যান্য [২০১৮], কবিতার করতলে [২০২০], বিপ্লবী লীলা নাগ ও অন্যান্য প্রবন্ধ [২০২৫]; কাব্যগ্রন্থ—হাওয়াই ডাঙ্গার ট্রেন [২০১৮], লণ্ঠনের গ্রাম [২০১৯], যৈবতী কন্যা ইশকুলে [২০২০], অন্ধ যাজক [২০২১], জন্মান্ধ ঘোড়া [২০২৪]; সম্পাদনা—অগ্রন্থিত রফিক আজাদ [২০১৯], পাগলা কানাই ও তাঁর তত্ত্ব দর্শন [২০১৯]; গবেষণাগ্রন্থ—লোক মানুষের গান ও আত্ম অন্বেষণ [২০১৬], ছোটবোয়ালিয়া-জয়ন্তীনগর-বসন্তপুর গণহত্যা [২০২১]। পেয়েছেন আবুল মনসুর আহমদ পুরস্কার [২০২০], জলধি সম্মাননা [২০২১] অনুপ্রাণন সাহিত্য সম্মাননা [২০২২] ও দেশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার [২০২৫]। পেশায় তিনি উন্নয়নকর্মী।