
বিশ্ব-শিল্পকলায় স্পষ্টত শিল্পের দুটি ধারা পরিলক্ষিত হয়। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য। পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিক শিল্পবেত্তারা অনেকে ‘প্রাচ্য’ বা ‘ওরিয়েন্টাল’ টার্মটিকে ব্যাঙ্গাত্মক অর্থে ব্যবহার করতেন। তাঁরা প্রাচ্যশিল্পকে বর্বর কুৎসিত, অদ্ভুত (grotesque), হাস্যকর, (ludicrous) কৌতুকপ্রদ (comic) বলে আখ্যায়িত করেছেন। রেনেসাঁসের সময় ভাবা হত, যা সুষ্ঠ নয়, যা স্বাভাবিক নয় তা প্রাচ্যদেশীয়। রেনেসাঁস শিল্পাদর্শে কোনো ক্রটি লক্ষ্য করলে শিল্পী ও শিল্প-তাত্ত্বিকরা তাকে বলতেন ‘ওরিয়েন্টাল’।
এদতসত্ত্বেও বিশ্ব-শিল্পকলায় প্রাচ্যশিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তৃত বিষয় সন্দেহ নেই। প্রাচ্যশিল্পের সরল ব্যাখ্যা হচ্ছে নিকট-প্রাচ্য, মধ্য-প্রাচ্য ও দূর-প্রাচ্যের শিল্পকলা। অর্থাৎ এশিয়ার শিল্পকলা।
পৃথিবীর ভূমণ্ডলের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে এই প্রাচ্যদেশ বা এশিয়া অঞ্চলের অবস্থান। এশিয়ার পশ্চিমে রয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকা। ধর্মকর্ম, পোশাক-আশাক, সামাজিক পরিবেশ ও সংস্কৃতির দিক থেকে এই তিন অংশের ভিন্নতা রয়েছে। আর এ জন্যই প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের শিল্পকলার ক্ষেত্রেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। পোশাক-আশাকের দিক থেকে বিবেচনা করলে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর মানুষের মধ্যে এবং এশিয়ার দেশগুলোর মানুষের পোশাকের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য আমাদের চোখে পড়ে। এর প্রতিফলন আমরা লক্ষ্য করি শিল্পকলার ক্ষেত্রেও। এ ছাড়া এশিয়ার শিল্পকলায় রয়েছে ব্যাপক ধর্মীয় প্রভাব এবং সৃষ্টিশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। ফলে শিল্পীদের অনেক ক্ষেত্রেই কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে। যা প্রকৃত অর্থে শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এই কল্পনা বাস্তবকে পরিত্যাগ করে হয়নি, বরং বাস্তবকে হৃদয়ের গভীরে রোমন্থনপূর্বক বিষয়ের নির্যাসকে গ্রহণ করে হয়েছে। যেমন মানুষের টানা টানা অর্ধ-উন্মীলিত চোখ। এ চোখ বাস্তব বিবর্জিত কল্পনার ফসল মনে হতে পারে অনেকের কাছেই। প্রাচীনকালে এশিয়ার মানুষ ধর্মীয় অনুভূতি প্রবণ ছিলেন। ধর্মগুরুরা বেশির ভাগ সময় সৃষ্টিকর্তার ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। ফলে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তাদের চোখ প্রায় বন্ধ কিংবা অর্ধ-উন্মীলিত থাকত। শিল্পীর কল্পনার এই বাস্তব অবস্থাটিই প্রাধান্য পেয়েছে তাঁদের চিত্রকলায়। যেমন ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের চোখ। সমগ্র এশিয়া মহাদেশের দেশগুলোতে এই একই রূপ চোখ লক্ষ্য করা যায়। তা ছাড়া চীন, জাপান, কোরিয়াদের চোখ জন্মগতভাবেই অনেকটা অর্ধউন্মিলিত চোখের অনুরূপ। এ জন্য শিল্পীর আঁকা চিত্রে তাদের চোখ স্বপ্নে বিভোর কিংবা ধ্যানমগ্ন অবস্থার অর্ধউন্মিলিত চোখের অনুরূপ রূপ লাভ করে। রহস্যপূর্ণ রঙ, স্পষ্ট ও কোমল স্বভাবের রেখা, চমকপ্রদ নকশা, পোশাক এবং পরিবেশ প্রাচ্য শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। পশ্চিমা শিল্পে যা লক্ষ্য করা যায় না। পশ্চিমা সমাজে পরিবার এবং সামাজিক জীবনে যেমন অস্থিরতা রয়েছে তেমনি তাদের শিল্পকর্মেও সেই অস্থিরতার ছাপ স্পষ্ট।

শিল্পকলা সব সময়ই একপর্যায় থেকে আর একপর্যায়ে তার অবস্থান পরিবর্তন করে থাকে। আর এ জন্যই আদিম মানুষের অঙ্কিত গুহাচিত্র থেকে শিল্পকলা বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে। এই পরিবর্তনের ধাপগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা রয়েছে। পশ্চিমা শিল্পের প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, গুহাগাত্রে অঙ্কিত চিত্রের (লাস্কাস গুহা, আলতামিরা গুহা) সূত্র ধরেই পশ্চিমা শিল্পের অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। আবার ভারতের অজন্তা কিংবা ইলোরা গুহাগাত্রে অঙ্কিত চিত্রের সূত্র ধরে ভারতে, প্রাচ্যধারার বিকাশ ঘটেছে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই চিত্রকর্মে দ্বিমাত্রিকতার মিল রয়েছে। যেমন—প্রাচীন মিসরের চিত্র, এট্রুস্কান চিত্র, গ্রিক চিত্র, রোমান চিত্র, বাইজানটাইন চিত্র, ক্যারোলিঙ্গিয়ান চিত্র, অটোনিয়ান কিংবা রোমানেস্ক চিত্র, অস্ট্রেলিয়ার চিত্র, চীন, জাপান, কোরিয়া, ভারত, নেপাল, ভুটান, ইরানসহ বিভিন্ন দেশের চিত্র। পশ্চিমা দেশগুলোতে ফার্স্ট সেঞ্চুরি থেকে ত্রিমাত্রিক ধারার চিত্রকর্ম দেখা গেলেও এশিয়ার দেশগুলোতে তা দেখা যায়নি। এশিয়ায় দীর্ঘ দিন দ্বিমাত্রিক পদ্ধতিই চালু ছিল। ভারতে ব্রিটিশ আগমনের পর সম্ভবত ত্রিমাত্রিক পদ্ধতির প্রতি শিল্পীরা আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
সুতরাং ‘ওরিয়েন্টাল আর্ট’ বা ‘প্রাচ্যশিল্প’ বলতে সাধারণত প্রাচ্যদেশীয় তথা এশিয় অঞ্চলের শিল্পকলাকে বুঝায়। যেমন চীন, জাপান, কোরিয়া, তৎকালীন ভারতবর্ষ, নেপাল, ভুটান পারস্য, মধ্যপ্রাচ্যসহ প্রভৃতি দেশের শিল্প এবং শিল্পপদ্ধতি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিল্পকলায় নির্মাণ কৌশল, গঠন প্রকরণ ও অভিব্যক্তি প্রকাশের দিক থেকে পার্থক্য থাকলেও পাশ্চাত্যের সকল দেশের শিল্পধারায় যেমন মিল রয়েছে, তেমনি প্রাচ্যদেশগুলির শিল্পধারায়ও একাত্মতা প্রকাশ পেয়েছে। উভয় অংশের পার্থক্য সুস্পষ্ট। প্রাচ্যের শিল্পীরা সেই ইতিহাসপূর্ব যুগ হতেই বস্তুর অবিকল অনুকরণকে অত্যন্ত সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলেছেন। কিন্তু পাশ্চাত্যশিল্পে এই সেদিন পর্যন্তও রিয়ালিজমের চর্চাই ছিল শিল্পের আপ্ত বিষয়।
প্রাচ্যের শিল্পীরা প্রকৃতির মাঝেই পেয়েছেন শিল্পসৃষ্টির প্রেরণা। প্রকৃতি যখন শিল্প ভুবনে আবিষ্ট হয়, সেই প্রকৃতিতে এমন কিছু চোখে পড়ে, যা আমাদের চোখে এতদিন পড়েনি। প্রকৃতির হুবহু প্রতিফলন এবং পরিচ্ছন্ন বর্ণনা শিল্পকলার শেষ কথা নয়। প্রাচ্যশিল্পী প্রকৃতি হতে উপাদান সংগ্রহ করে সেই উপাদান দ্বারা এমন কিছু সৃষ্টি করেন যা প্রকৃতির জগৎ হতে পৃথক হয়েও রূপান্তরের মাধ্যমে প্রকৃত জগতের সৌন্দর্যকে কাব্যময় করে তোলেন। বাস্তবের অন্তরালে প্রকৃতির বুকের মধ্যে যে অতিপ্রাকৃত ভাবটি লুকিয়ে আছে তাকে খুঁজেছে প্রাচ্যের শিল্পীরা। বাস্তবশিল্প মানুষের অন্তরাত্মাকে স্পর্শ করে না। এ প্রসঙ্গে আচার্য সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তের বক্তব্যটি উত্থাপন করা যায়:

“শিল্প যদি কেবল মাত্র বাইরের হতো তবে আমাদের আধ্যাত্মিক জীবন স্বার্থকতা লাভ করতে পারতো না। শিল্প যদি কেবল অন্তরেরই হতো তবে তা’ কাল্পনিক হতো এবং সত্য-মিথ্যা, উচ্চ-নীচ আদর্শের কোন ভেদ থাকত না। দর্শনশাস্ত্র যেমন ভিতর বাহির এই উভয় মিলে যে মহাসত্য রয়েছে তার নিয়মশৃঙ্খলা আবিষ্কার করে আনন্দ লাভ করে, শিল্পও তেমনি ভিতর বাহির এই উভয়কে নিয়ে জাগতিক সৃষ্টির অনুপাতে আর একটি নতুন সত্য আবিষ্কার করে আনন্দ লাভ করে।”
‘অনুকৃতি’ শব্দটি পাশ্চাত্য (বিশেষত গ্রিসে) কিংবা প্রাচ্যে সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। শিল্পসৃষ্টির সাথে যে রূপকল্পনার যোগ রয়েছে—এ সংস্কার শিল্পীদের কমবেশি ছিল। এ সম্পর্কে ড. সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তের ‘ভারতীয় প্রাচীন চিত্রকলা’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যায়:
‘‘আমাদের সাহিত্যে একদিকে যেমন প্রকৃতি হইতে সৌন্দর্য আহরণ করিতে একত্র সন্নিবেশ দ্বারা সুন্দর মূর্তি কল্পনার কথা আছে, অপরদিকে তেমনি অন্তরের ধ্যান পরিকল্পিত রূপকে বাহিরের মূর্তি প্রদান করিলে যে সৌন্দর্য উৎপন্ন করা যায় তাহার কথাও উল্লেখিত আছে। … গ্রীক শিল্পে ভাস্ককরদের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল যে তিনি কেমন করিয়া কঠিন পাথরকে কাটিয়া কাটিয়া একটি মানুষের হুবহু সাদৃশ্য তাহার মধ্যে ফুটাইয়া তুলিবেন। কিন্তু ভারতীয় ভাস্করদের প্রধান দৃষ্টি ছিল এইখানে যে তিনি কেমন করিয়া একটি ধ্যানগৃহীত জীবন্তভাবকে রূপ দিবেন—জীবনের পরিস্পন্দে জড় প্রস্তরকে স্পন্দময় করিবেন, ভাবের বিদ্রুতিতে মূর্তিটিকে প্রাণময় করিবেন। শিল্পীর সমস্ত চেষ্টাই যেন এই দিকে প্রসারিত হইয়াছে যে তিনি কেমন করিয়া তাঁহার সাধনা দ্বারা প্রস্তরের জীবনকে আত্মাকে তাহার ধ্যানবৃত আত্মা বা জীবনের সহিত অখণ্ড ঐক্যে পরিণত করিতে পারেন। তাঁহারা রেখা সন্নিবেশের দ্বারা মূর্তির বাহ্য পরিচয় দিতেন, কিন্তু তাহার পর তাহাদের সমস্ত চেষ্টাই ছিল তাহাদের মূর্তিকে প্রাণময় করিবার জন্য। ‘বিষ্ণুধর্মোত্তরম্’—এ উল্লেখ আছে:
‘রেখাং প্রশংসন্ত্যাচার্যাঃ বর্তনাঞ্চবিচক্ষণাঃ।
স্ত্রিয়ো ভূষণমিচ্ছন্তি বর্ণাঢ্যমিতরে জনাঃ।।’
‒ইহার তাৎপর্য এই যে প্রাচীন আচার্যেরা রেখাসন্নিবেশ দ্বারা বস্তুর স্বাভাবিক আকারকে ফুটাইয়া তোলা প্রশংসার চোখে দেখিতেন। কিন্তু পণ্ডিতেরা চাহিতেন তাহার প্রাণপ্রদ রূপ।”
প্রাচ্যের চিত্রকলায় রেখাই হচ্ছে প্রধান, এই রেখার প্রাবল্যে রঙ হয়েছে গৌণ। শুধু তাই নয় রেখার বিশেষত্ব এবং ব্যঞ্জনার কাছে মডেলিং, শেডিং, পারস্পেকটিভ ও রঙ হয়েছে ম্লান। পাশ্চাত্যের ছবিতে রেখার কোনো কমতি নেই, কিন্তু তবু প্রাচ্যের রেখার পাশে তা বেমানান। প্রাচ্যের একজন শিল্পী রেখার যাবতীয় গুণাগুণ ও স্বভাবকে আয়ত্তে রেখে উঁচুনীচু বোধ, ফোরশটনিং, পারস্পেকটিভ, প্লাস্টিক গুণাগুণ ও অভিব্যক্তি প্রকাশের যে ক্ষমতা রাখেন তা পাশ্চাত্যের তুলনায় সত্যিই অতুলনীয়।
পারস্পেকটিভের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পারস্পেকটিভ একেবারে পরস্পরবিরোধী। প্রাচ্যের শিল্পীরা দৃশ্যমান জগতের বিষয়বস্তুকে বড় বেশি সরল করেছেন। ঘনবস্তুর গভীরত্ব ফুটিয়ে তোলার পরিবর্তে তাঁরা বস্তুকে সমগ্রভাবে, সম্পূর্ণভাবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে তাঁদের আপন বৈশিষ্ট্যের পরিচয় তুলে ধরেছেন। প্রাচ্যের কোনো কোনো চিত্রে পাশ থেকে দেখা মুখমণ্ডলে যুক্তিসংগত এক চোখের পরিবর্তে যে দুচোখ দেখা যায় তা এই বিশ্বাসেরই ফল। প্রাচীন ভারতে মিনিয়েচার শিল্পীরা সর্বদাই এই কাজটি করতেন। প্রচলিত বাংলার কাঁথায় এবং পটচিত্রে এই রীতির প্রচলন ছিল। কী ভাস্কর্য কী চিত্রে দেখা যায় শরীরের একপাশ থেকে অন্য পাশের যে অঙ্গগুলি চোখে দেখা যায় না সেগুলিকেও চিত্রে বা ভাস্কর্যে রূপ দেওয়া হত। চোখে দেখা যায় না অথচ শিল্পে তার রূপ দেবার এই যে প্রচেষ্টা তা পাশ্চাত্যশিল্পে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ‘কিউবিজম’ নামক সর্বাধিক আলোচিত এক শিল্পধারার জন্ম দেয়।
পিছনের বিষয়কে চোখে দেখা না গেলেও সুকৌশলে সেই বিষয়কে চিত্রে বা ভাস্কর্যে তুলে ধরবার রীতি, তাদের দেখবার ভিন্নতার ফসল। তাঁদের দেখা শাড়ীর ভাঁজ খুলে খুলে দেখার মতো। পাশ্চাত্যের শিল্পীর মতো দূরে একটি বিন্দুতে দাঁড়িয়ে দেখবার মতো নয়। এ দেখা চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখা। একই বস্তর প্ল্যান আর প্রোফাইলে দেখা। ফলে চতুর্ভুজ কোনো বস্তু, বসবার আসন বা সিংহাসনের পা-গুলিকে উপর দিকে লম্বায় বাড়িয়ে দিয়ে বেশি করে দৃষ্টির সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। কোনো দৃশ্যের পেছন বা পশ্চাৎপট অস্পষ্ট করার পরিবর্তে উপর থেকে বস্তু, মধ্যস্তর সম্মুখের স্তর এমনিভাবে সাজানো হয়েছে। দর্শক যেন ছবির মধ্যে প্রবেশ করে ঘুরে ঘুরে দেখেন। এই ঘুরে ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতার ফলে পারস্পেকটিভ হয়েছে পাশ্চাত্যের বিপরীতমুখী।
পাশ্চাত্যে পরিপ্রেক্ষিত, আলোছায়ার মাধ্যমে রঙের ঘণত্বের তারতম্য সৃষ্টির যে শিল্পবিজ্ঞান রয়েছে প্রাচ্যে সেই পরিপ্রেক্ষিতের সমর্থন নেই। প্রাচ্যের শিল্পীরা সম্ভবত পরিপ্রেক্ষিতের মূল সূত্রগুলো জানতেন কিন্তু পরিপ্রেক্ষিতের বাস্তব অবলোকনের কৌতূহলকে গ্রাহ্য করেননি। কোনো কোনো সময় উল্টো পরিপ্রেক্ষিতের আশ্রয় নেয়া হতো। অজন্তার প্রাচীর চিত্রে এ ধরনের উদাহরণ প্রচুর দেখা যায়। অজন্তাশিল্পীর রীতিকে শিশু বা আদিম শিল্পীর সরল, অশিক্ষিত অপটু রীতির সামিল মনে করা ভুল হবে। অজন্তাশিল্পীর সৃষ্টি হচ্ছে বস্তুকে নিজের মতো করে দেখার অভিজ্ঞতার ফল, যা শিল্পীর নিজস্ব প্রজ্ঞার উপর প্রতিষ্ঠিত। চারুশাস্ত্রের বহুমুখী দৃষ্টি বা ইংরেজিতে যাকে বলে মাল্টিপল ভিশনের টেকনিকের সঙ্গে অজন্তাশিল্পেীর টেকনিকের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ রয়েছে। পাশ্চাত্য চিত্রকলায় খ্রিষ্টীয় চৌদ্দ শতকের পর উনিশ শতকের শেষ অবধির পর বহুমুখী দৃষ্টি বা মাল্টিপল ভিশনের টেকনিকের কাজ আর হয়নি বলা যায়। এসেছে উনিশ শতকের শেষে বিশ শতকের প্রথমে পল সেজান, ভ্যান গখ, ক্লদ মনে প্রমুখ ফরাসি শিল্পীর যুগান্তকারী কাজে। এই টেকনিকের কল্যাণে দর্শক একই ছবি যেন একাধিক স্থান থেকে দাঁড়িয়ে দেখার সুযোগ পান, অর্থাৎ একই ছবির বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত বিন্দু থেকে আঁকা, সুতরাং একই ছবিতে একাধিক পারস্পেকটিভ পয়েন্ট থাকায় ছবিতে অসম্ভব গতির সঞ্চার ঘটে, যার ফলে স্থাণু বা অনড়ভাব কেটে যায়। অর্থাৎ দর্শক যেনো ঘুরে ঘুরে দৃশ্যটি দেখাবার সুযোগ পান। ভারতীয়শিল্পে এই টেকনিকটি প্রায় আবহমান কাল থেকেই প্রচলিত ছিল। বস্তুতপক্ষে পাশ্চাত্য ক্লাসিকাল ঐতিহ্যে দর্শক সব সময়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে ছবির দৃশ্যটি দেখবেন; সেই স্থান বা বিন্দুটি একেবারে মাপজোক করে ঠিক করা, তার নড়চড় হবার নয়। সুতরাং দর্শক ও চিত্র উভয়ই যে যার স্থানে চিত্রর্পিতবৎ স্তব্ধ হয়ে থাকবে, ঠিক যেন চলন্ত দৃশ্যের একটি খণ্ডমুহূর্তের ফটোগ্রাফ, যেখানে দর্শক ও দৃশ্য দুইই মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু অজন্তায় ঠিক বিপরীতটি ঘটে, সেখানে দর্শককে একেবারে ছবির মধ্যে প্রবেশ করানো হয়, দর্শকের স্থান ছবির মধ্যে। ছবিতে ঢুকে তিনি ইচ্ছামত ঘুরে-ফিরে বেড়ান, আস্তে আস্তে দৃশ্যের পর দৃশ্যে যখন উন্মোচিত হয় তখন তিনি নিজের মতো করে ঘুরে ঘুরে দেখার জন্য আমন্ত্রিত হন। ফলে দৃশ্যের যত কিছু জটিল ঘটনার মধ্যে তিনি মিলে যান, দৃশ্যের বাইরে দর্শক হিসেবে অস্তিত্ব তাঁর আর থাকে না।
অজন্তা গুহার চিত্রাবলীর প্রত্যেকটিই বাস্তবানুগ্ল—যাকে ইংরেজিতে Realistic বলা হয়। শারীর সংস্থান সম্বন্ধে পরিপূর্ণ জ্ঞান শিল্পীদের আয়ত্ত ছিল বলেই সেটি সম্ভব হয়েছিল। ‘ভারতীয় পদ্ধতি’ বলতে অনেকের এই ভুল ধারণা আছে যে, এই পদ্ধতিতে মডেল দেখে ছবি আঁকা হয় না, শারীর-সংস্থান বা Anatomy সম্পর্কে জ্ঞান থাকার প্রয়োজন নেই। এ ধারণা যে কত ভুল তা অজন্তার চিত্রাবলী দেখলেই প্রতীতি হবে। পরবর্তীকালে রাজস্থানী-গুজরাটী ‘মিনিয়েচার’ ছবিতে এবং বাংলার পটচিত্রে শারীর-সংস্থান জ্ঞানের অভাব দেখা যায়। সামাজিক নানা কারণেই হয়তো বাস্তবানুগ্ল দেহ-চিত্রণ প্রথা ক্রমে ক্রমে লোপ পেয়েছিল। অজন্তার চিত্রাবলী আঁকা হয়েছিল সম্ভবত ‘স্মৃতি-চিত্রণ’ পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে মডেল দেখে আঁকার প্রয়োজন নেই, কিন্তু শিল্পশাস্ত্র-সম্মত ও গুরু নির্দিষ্ট নিয়মাবলী সমৃদ্ধ এবং তাল-মান ও পরিমাপে চিত্রিত অবয়ব নির্ভুল হওয়া চাই। শুধু অজন্তা কিংবা বাগই নয়, প্রাচীন ভারতীয় চিত্রাঙ্কন শৈলী গড়ে উঠেছিল মুলত ‘স্মৃতি-চিত্রণ’ পদ্ধতি অনুসরণ করেই।
জেনে শুনে যুগে যুগে প্রচলিত রীতিকে এড়িয়ে গেছেন প্রাচ্যের শিল্পীরা। নবজাগরণের আগেই পশ্চিম ইউরোপে প্রধান প্রবণতা ছিল দৃশ্য জগতের হুবহু অনুকরণ করা। এই যে প্রথাসিদ্ধ বাস্তব রীতি তা দর্শককে পটের বাইরে একটি বিন্দুতে স্থির করে। দৃষ্টি শেষ পর্যন্ত অদৃশ্য বিন্দুতে মিলিয়ে যায়। ফলে ছবি হয় ত্রিমাত্রিক এবং ক্যানভাসের ভেতর আকারগুলো অনুপ্রবেশ করে। প্রাচ্যে পটকে চিরকালই দ্বিমাত্রিক ভূমি হিসেবে ধরা হতো। বাস্তব জগৎটা ত্রিমাত্রিক, কিন্তু পটে পুনচিত্রণ করার সময় তাকে দ্বিমাত্রার নিয়মকানুন মানতে হবে। ক্রমশ পাশ্চাত্যের শিল্পীরা পরিপ্রেক্ষিতের নিকট-দূরের তারতম্যকে নতুন করে ভেবে দেখছেন। ক্যানভাসের দ্বিমাত্রিক স্বভাবকে অক্ষুন্ন রেখে ত্রিমাত্রিক বস্তুকে দ্বিমাত্রিক স্বভাবে পর্যবসিত করেছেন। পোলকের এ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশসনিজম অথবা সেজানের পোস্ট ইম্প্রেশনিজমের চিত্রগুলোই তার যথাযথ উদাহরণ। চীনা ভূদৃশ্যে দূরত্ব আছে, সে দূরত্বের কোনো সীমা পরিসীমা নেই—আছে অসীমের বিন্যাস।

প্রাচ্যশিল্পে আমরা দুরকম প্রকাশ লক্ষ্য করি—একটি অন্তঃপ্রকাশ আর একটি বহিঃপ্রকাশ। অন্তঃপ্রকাশই শিল্পের হৃদয়। বহিঃপ্রকাশ যদি অন্তঃপ্রকাশের সঙ্গে একইরূপের মধ্যে বিধৃত ও ঐক্যবদ্ধ হতে পারে তবেই শিল্পের প্রকাশধর্ম সার্থক। তা না হলে বহিঃপ্রকাশ নিছকই কৃত্রিম কারুকলা। কল্পনার মাধ্যমে শিল্পী শুধু বহিঃবস্তুর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দিকটি নয়, তাতে প্রকাশিত হয় ভাব বা আবেগের দিকটিও। প্রাচ্যশিল্পে দেখা যাবে শারীরিক বা বস্তুগত কোনো বিষয় নিছক শরীর বা বস্তুরূপে স্বীকৃত নয়। শিল্পবস্তুতে স্বভাবতই সৃষ্টিশীল কল্পনার ভূমিকা মূখ্য এবং প্রত্যক্ষলব্ধ বস্তুর প্রতিচ্ছবি স্মৃতিতে ধরে রাখার ভূমিকা গৌণ। সৃষ্টিশীল কল্পনা বস্তুর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অংশগুলিকে সংঘবদ্ধ করে শিল্পবস্তুর রূপ দেয়।
পাশ্চাত্যের অনেক শিল্পবেত্তারাই মনে করতেন যে, প্রাচ্যদেশীয় শিল্পীদের অবয়ব প্রমাণ সম্বন্ধে কোনো যথাযথ জ্ঞান নেই। এই ধারণাটি যে ভুল তা চিত্রসূত্র পড়লে সহজেই বুঝা যায়। ভারতবর্ষীয় চিত্রশিল্পে ও ভাস্কর্যে সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের একটি বিশেষ নির্দিষ্ট মান রক্ষিত হত। এই মানকে বলা হতো ‘তাল’। মাথার পরিমাণকে আদিমাত্রা বা আদিতাল বলে ধরা হত। ভারতীয় শিল্পীরা মনে করতেন যে, সমগ্র দেহের সাথে মাথার এমন একটি সম্পর্ক রয়েছে যে, মাথার আকারের বিশিষ্ট ভগ্নাংশের পরিমাণের দ্বারা বা গুণকের পরিমাণ দ্বারা সমগ্র অবয়বের পরিমাণ করা যায়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, লিওনার্দো দা ভিঞ্চিও (১৪৫২-১৫১৯ খ্রি.) মস্তিষ্কের প্রমাণকেই আদিমানরূপে গ্রহণ করে তারই তুলনায় অবয়ববিশেষের মান গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁর A Treatise on Painting গ্রন্থে ঠিক এই মতই পোষণ করে বলেছেন : ‘A man has the length of two heads from the extremity of one shoulder to the other’. (p. 5) এভাবেই তিনি অন্য অঙ্গ-প্রতঙ্গের সাথে মাথার সম্পর্ক দেখিয়ে তাদের পরিমাণ নির্ণয় করেছেন।
ভারতবর্ষে মানব অবয়ব নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিমাণসূচক যে সকল শব্দ (পারিভাষিক) ব্যবহৃত হয়েছে তা এরূপ: এক মুষ্টির ১/৪ অংশ = এক আঙ্গুল, (মুষ্টি—হাতবদ্ধ করলে যে মুঠ হয়)। তালের দৈর্ঘ্য ১২ আঙ্গুল। ৫ তালে এক বাল (শিশু), ৬ তালে এক কুমার।
‘শুক্রনীতি’ গ্রন্থে মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে যে পরিমাপ নির্দেশিত হয়েছে তা নিম্নরূপ : সাধারণত বামন = ৭ তাল, মানুষ = ৮ তাল, দেবতা = ৯ তাল, রাক্ষস = ১০ তাল, স্ত্রী = ৭ তাল, কুমার = ৬ তাল, বাল (শিশু) = ৫ তাল।
৭ তাল পরিমিত মূর্তি পরিমাপ : মুখ = ১০ আঙ্গুল, গ্রীবা = ৩, হৃদয় = ৯, উদর = ৯, বস্তি = ৯, সবিথ = ১৮, জানু = ৩, জঙ্ঘা = ১৮, গুলফ = ৩।
৮ তাল পরিমিত মূর্তির পরিমাপ : মুখ = ১২ আঙ্গুল, গ্রীবা = ৪, হৃদয় = ১০, উদর = ১০, বস্তি = ১০, সবিথ = ২১, জানু = ৪, জঙ্ঘা = ২১, গুলফ = ৪।
এখানে কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করা হল। এরূপ প্রত্যেক মানব অবয়ব গড়ার ক্ষেত্রেই পরিমাপের নির্দিষ্ট মানের উল্লেখ রয়েছে। মেয়েদের সাথে পুরুষের যে সকল স্থানে মাপের ভিন্নতা রয়েছে, তাও সুস্পষ্টভাবে নির্দেশিত হয়েছে।
চিত্রসূত্রে নয় রকম স্থান বা Posture-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা—ঋজ্বায়ত, অনৃজ্জ, সাচীকৃত শরীর, অর্ধবিরোচন এবং তাদের বিশিষ্ট বর্ণনা রয়েছে। প্রত্যেক স্থান অনুসারে অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহের প্রমাণ ও অবস্থানের বিভিন্ন রকমের হ্রাস ও বৃদ্ধি ঘটে থাকে। একথা Leonardo da Vinci-ও উল্লেখ করেছেন: ‘It is very necessary that painters should have a knowledge of the bones which support the flesh by which they are covered, but particularly of joints which increase and diminish the length of them in their appearance. As in the arm which does not measure the same when bent as extended; its difference between the greatest extension and bending, is about one eighth of its length. …the wrist or joint between the hand and the arm lessens on closing the hand and grows larger when it opens. The contrary happens in the arm`s space between the elbow and the hand and all sides. … When a figure is to appear nimble and delicate its muscles must never be too much marked nor are any of them to be much swelled. Because such figures are expressive of activity and swiftness and never loaded with much flesh upon the bones’(P. 14-18). এর পর অনেকগুলো Posture-এর চিত্র দিয়ে তিনি তাঁর বক্তব্য বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। আমাদের চিত্রসূত্রের পরিভাষায় এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কমানো বাড়ানোর নাম ক্ষয়-বৃদ্ধি। এই স্থান অঙ্কনের প্রসঙ্গে বিভিন্ন প্রকার ছায়া বা shade দেওয়ারও উল্লেখ আছে। ‘কিঞ্চিচ্ছায়াগতৌ কার্যাবুপরিষ্টাদধঃ পুরঃ।’ স্থান অনুসারে ক্ষয়-বৃদ্ধির দ্বাদশ প্রকার বলেও বর্ণিত আছে। এছাড়া ১২ রকমের চলনভঙ্গির কথা উল্লেখ রয়েছে। এই চলনভঙ্গির বর্ণনা প্রসঙ্গে চিত্রসূত্রে লিখিত আছে যে শরীরাবয়বের ক্ষয়বৃদ্ধি সম্পর্কে বুদ্ধিমান চিত্রী নিজের বুদ্ধির দ্বারা চিত্রের ভারবাহী বা চলন্ত পুরুষের অবয়বের ক্ষয়বৃদ্ধির যোগ বিধান করবেন।
প্রাচ্য এবং প্রতীচ্য শিল্পের মধ্যে সব সময়ই একটি সুস্পষ্ট বিভেদ বিদ্যমান ছিল। যার রূপগত এবং নান্দনিক বৈশিষ্ট্যও ছিল স্বতন্ত্র। প্রাচ্যশিল্পের অন্তর্লীন রহস্য অত্যন্ত ব্যাপক ও গভীর। স্মরণাতীত কাল থেকে ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা শিল্পকলাকে প্রভাবিত করলেও প্রাচ্যশিল্পীরা তাদের নিজের সামগ্রিক সত্তা দিয়ে, স্বভাব দিয়ে অতীন্দ্রিয়ের আস্বাদ ও আনন্দকে খুঁজতে চেয়েছেন।
ভাবাভিব্যক্তিই প্রাচ্যচিত্রকলা পদ্ধতির প্রাণপ্রদ ধর্ম। সেইজন্যই ভাবটিকে ফুটিয়ে তোলার জন্য দেশকালের বুদ্ধি ব্যাহত করতে ভারতীয় চিত্রী কখনও দ্বিধা করতেন না। একটি চিত্রের মধ্যে জীবনের নানাস্তরের নানাঘটনা একজন চিত্রী একত্র করে প্রকাশ করতে প্রয়াস পেতেন। সম্ভবত তাঁদের উদ্দেশ্য এই ছিল যে, দৃষ্টির ক্ষণের মধ্যে সমগ্র জীবনটিকে যুগপৎ উপনীত করা। কোন ঘটনার পর কোন ঘটনা ঘটলো সময়ের এই পারম্পর্য তাঁরা চিত্রে অনেক সময়ই ফোটানো আবশ্যক মনে করতেন না। একবিন্দু শিশিরের মধ্যে যেমন সমস্ত বিশ্ব প্রতিবিম্বিত হতে পারে তেমনি শিল্পীর ধ্যানলোকের মধ্যে বর্ণনীয় জীবনটি একমুহূর্তে আবিষ্কৃত হতে পারে। এই আবিষ্কারটিকেই তিনি দর্শকের নিকট উপস্থাপন করতে চেষ্টা করতেন।
রূপের অন্তরালে অরূপের প্রকাশই হচ্ছে প্রাচ্যশিল্পের মর্মবাণী। শুধু নয়নের অভিরতি নয়, মননের উদ্বোধনই হচ্ছে শিল্প সৃষ্টির সার্থকতা। যা চোখ দিয়ে যাত্রা করে মনকে স্পর্শ করে। এ প্রসঙ্গে শিল্পী ওসেনফাঁ বলেন, “শিল্পকলা মহৎ তখনই যখন তা গভীরে নাড়া দেয়।” অনুকৃতির চেয়ে সত্ত্বানুপ্রবেশই শিল্পীর মুখ্য সাধনা।
ভারতীয় বিভিন্ন শাস্ত্রে, সংহিতায়, পুরাণে শিল্পতত্ত্ব-শিল্পরীতির করণ-উপকরণ নিয়ে আলোচনা আছে। শিল্পের সংজ্ঞা, লক্ষণ, উপাদান, রচনার প্রণালী এবং শিল্পীর কর্তব্য সম্পর্কে নিয়ম-নিষেধ ও সংকেতের আলোচনা ও বর্ণনাই হচ্ছে ব্যাকরণ বা শিল্পশাস্ত্র। গুরু-শিষ্য এবং পিতা-পুত্রের পরম্পরাগত শিল্পাচরণের বর্ণনা ও ব্যাখ্যা পণ্ডিতগণ ভারতীয় বিভিন্ন শিল্পশাস্ত্রে উল্লেখ করেছেন। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর আগে প্রণীত কোনো শিল্পশাস্ত্রের সন্ধান আমরা পাইনি, যদিও সুপ্রাচীন পালিগ্রন্থে শিল্পবৃত্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে লিখিত ভারতীয় বিভিন্ন শিল্পশাস্ত্রের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হচ্ছে : বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’, বরাহমিহিরের ‘বৃহৎসংহিতাসার’, শুক্রাচার্যের ‘শুক্রনীতিসার’, শ্রীকুমার লিখিত ‘শিল্পরত্ন’, ভরতের ‘নাট্যশাস্ত্র’, নন্দিকেশরের ‘অভিনয় দর্পন’, ধনঞ্জয় প্রণীত ‘দশরূপ’, এবং ‘অগ্নিপুরান’, ‘চিত্ররক্ষণ’, ‘সাধনমালা’ ও ‘বিষ্ণুধর্মোত্তরম্, স্বরস্বতীশিল্প, শিবতত্ত্বরত্নাকর, নারদশিল্প, শুক্রনীতিসার, শিরেশ্বরাতঙ্কারা, অভিলষিতার্থ, চিন্তামনি বা মানসোলাস প্রভৃতি গ্রন্থে শিল্পের বিশুদ্ধতা, শিল্পের বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রক্রিয়া সম্বন্ধে অনেক পরিপূরক তথ্য পাওয়া যায়। এসব গ্রন্থ থেকে প্রাচীন ভারতীয় শিল্পকলার আঙ্গিক সম্পর্কে আমরা ধারণা পাই।
সপ্তম শতাব্দীর শেষ ভাগে ‘কামসূত্র’ গ্রন্থের টীকা-টিপ্পনি সহ ভাষ্য প্রণয়ন করেছিলেন পণ্ডিত যশোধর। প্রাচ্যশিল্পের আলোচনায় এই ভাষ্য সবিশেষ মূল্যবান। গুপ্তযুগে রচিত ‘কামসূত্রে’ বাৎস্যায়ন চিত্রবিদ্যাকে চতুর্থ স্থান দিয়েছেন। বাৎস্যায়ন যা কিছু সৃষ্টিমূলক তাকেই শিল্প বা কলা আখ্যা দিয়েছেন। তিনি ‘চতুঃষষ্টিকলা’র কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। ইন্দ্রিয়ের উপলব্ধিকে আশ্রয় করেই ‘চতুঃষষ্টিকলা’র সৃষ্টি। বাৎস্যায়ন নিতান্ত দেশীয় মতে শ্রেণিবিভাগ করেছেন কাজেই তাঁর শ্রেণিবিভাগ সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি। এগুলোর মধ্যে মাত্র কুড়িটিকে আমরা শিল্প আখ্যা দিয়ে থাকি। তার মধ্যে প্রধান তিনটি হল গীত, বাদ্য, নৃত্য যা সংগীতের অন্তর্ভুক্ত। সমগ্র পৃথিবীতে শিল্পরূপে যা অভিনন্দিত হয়ে এসেছে, তার মধ্যে আছে গীত, বাদ্য, নৃত্য, চিত্রাঙ্কন, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, ইন্দ্রজাল, কাব্যপাঠ, কাব্যরচনা, সাহিত্যসৃষ্টি, নাট্যশিল্প, ছদ্মবেশ ধারণ, পুতুল বা নানা প্রকার খেলনা প্রস্তুতি, ছন্দজ্ঞান ও বিভিন্ন ছন্দে শব্দ যোজনার সামর্থ্য নানাবিধ যন্ত্রের জ্ঞান ও তার পরিচালনা, রন্ধনশিল্প ইত্যাদি।
অনেকে বলে থাকেন, গ্রিসের শিল্প সভ্যতা সর্বাপেক্ষা পুরাতন, কাজেই তার প্রভাব পড়েছে চীন, ইতালি, ইস্পেন, জার্মান, ইত্যাদি দেশের শিল্পকলায়। কিন্তু সমসাময়িক ইতিহাসে যা পাওয়া যায় তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় চৌষট্টি শিল্পকলার বহির্ভূত আর কোনো শিল্প নতুন করে আবিষ্কৃত হয়নি। চৌষট্টি শিল্পকলার প্রত্যেকটি শাখারই চর্চা ভারতবর্ষে আদিকাল থেকেই হয়ে এসেছে, এবং প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই ভারতবর্ষের একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। সেই তুলনায় চীনের শিল্পকলার বয়সও অনেক কম, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এর শুরু।
ইউররোপে শিল্প-কল্পনায় পশ্চাদভূমির উপর গুরুত্ব খুবই বেশী। সঙ্গে সঙ্গে বস্তুর সলিডিটি বা ঘনত্ব তারা সুস্পষ্ট করতে চেয়েছেন — এর ফলে মানুষের দৃষ্টি যতদূর গিয়ে শেষ হয় দৃষ্টির সেই প্রসারতাকে অঙ্কিত তাৎপর্যে তুলে ধরতে চেয়েছেন। ফলে বিভিন্ন সমতলকে তারা একটি বন্ধনীর মধ্যে নিয়ে আসবার প্রয়াস পেয়েছেন। তিন মাত্রার অভিনিবেশের ফলে তাদের চিত্রাঙ্কন ঘনত্বসম্ভভূত। তাদের মূল আকৃতি বৃত্ত বা ডিম্ব নয়। তাদের মূল আকৃতি হচ্ছে কিউব বা পলিহেড্রন। কিউব হচ্ছে সমান ছয়টি তল বিশিষ্ট একটি চতুষ্কৌনিক আকৃতি আর পলিহেড্রন হচ্ছে বহুবিধ তল বিশিষ্ট একটি ঘনক আকৃতি। বিষয়টি সুস্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় দৃশ্যত পারসপেক্টিভ বা পরিপ্রেক্ষিতগত শুদ্ধতা নির্মাণের জন্য তাদের কিউব বা পলিহেড্রনের আকৃতি বেছে নিতে হয়েছিল। তাছাড়া প্রাণীর শরীর আঁকতে গিয়ে শিল্পীকে শরীরের মূল কাঠামোর কথা চিন্তা করতে হয়েছে। মূল কাঠামো হচ্ছে অস্থি-সংস্থান। শরীরের অভ্যন্তরে অস্থির যে কাঠামো আছে সে কাঠামোকে বিবেচনার মধ্যে এনে ইউররোপের শিল্পীরা শরীরী গঠন নির্মাণ করতেন। এজন্য রেনেসাঁযুগে একজন শিল্পীকে শব-ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে দক্ষ হতে হত। অর্থাৎ যে পর্যন্ত না একজন শিল্পী একটি শরীরের অভ্যন্তরভাগের পূর্ণ তাৎপর্য না জানছেন সে পর্যন্ত শিল্পী হবার অধিকার তিনি পাচ্ছেন না। অবশ্য প্রাচীন গ্রীকশিল্পে শরীরী কাঠামোর যথাযথতা আবিষ্কারের চেষ্টা ছিল না, মিশরীয় শিল্পের অভিব্যঞ্জনায় প্রভাবিত হয়ে তারাও রেখাঙ্কনের বহিরঙ্গগত বৈশিষ্ট্যের উপর গুরুত্ব দিতেন। রেনেসাঁযুগ থেকেই ইউরোপে শিল্প একটি বাস্তবধর্মী একাডেমিক বিষয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। সুতরাং প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যশিল্পের এই মৌলিক পার্থক্যটি অনুধাবন করলেই উভয় শিল্পরীতির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়।
শিল্পকর্মে দৃষ্টিগত অভিজ্ঞতা বলে একটি কথা আছে, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ভিসুয়াল এক্সপেরিয়েন্স। পাশ্চাত্যে মুলত এর উপরই প্রধানত গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই দৃষ্টিগত অভিজ্ঞতার প্রধান বিবেচনাই হচ্ছে পরিপ্রেক্ষিত। কোনো বস্তুকে আঁকতে গেলে তার পশ্চাৎ সম্মুখ এবং প্বার্শদেশগুলো কী আকৃতি ধারণ করছে রঙ এবং রেখা উভয় ক্ষেত্রে ইউরোপিয় শিল্পীকে তা নির্ধারণ করতে হয়। কিন্তু প্রাচ্যের শিল্পীরা এর উপর কোনো গুরুত্ব দেননি। একটি পারসিক চিত্রকলায় আমরা দেখি যে শিল্পী পশ্চাতের বস্তুকে দৃষ্টিগোচর করবার জন্য তাকে ছবির উপরিভাগে বসিয়েছেন। আকৃতিতে মূল ছবির সঙ্গে তার কোনো তারতম্য নেই। কিন্তু একজন ইউরোপিয় শিল্পী দূরের বস্তুকে ছোট করে দেখাবেন অর্থাৎ সাধারণ দৃষ্টিতে দূরের বস্তু যে রকমটি দেখায় চিত্রকর্মে তারই একটি বিভ্রম বা ইল্যূউশন নির্মাণ করবেন। আরো স্পষ্ট করে বলা যায় যে শিল্পী একটি দৃষ্টির মায়া নির্মাণ করে বাস্তবকে প্রমাণিত করতে চান। প্রাচ্যের শিল্পকর্মে এরূপ ইল্যুউশনের উপর কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
পাশ্চাত্যের শিল্পীরা বস্তুর বস্তুত্বকে আলো-ছায়ার রূপান্তরের মধ্য যেখানে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন, প্রাচ্যের শিল্পী সেখানে শুধু বস্তুর প্রমাণিত আকৃতিকে গ্রহণ করেছেন। তাই আমরা দেখি যে, প্রাচ্যের শিল্পীরা আলো এবং ছায়ার কথা মোটেই ভাবেননি। একটি বস্তুর উপর আলো এসে পড়লে দৃশ্যত তার বর্ণগত ও আকৃতিগত যে পরিবর্তন চোখে পড়ে প্রাচ্যের শিল্পী তা কখনো বিচার্য করেননি। এর ফলে প্রাচ্যের শিল্পকলাকে ডেকোরেটিভ বা অলঙ্কৃত রূপকল্প বলে ইউরোপিয়রা আখ্যা দিয়ে থাকেন। বিখ্যাত চিত্রসমালোচক এরিক নিউটন একে বলেছেন একটি আদর্শ সত্যের অন্বেষণ। ইউরোপিয় শিল্পকলার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় একটি বস্তুর যথার্থ স্বরূপকে নির্ণয় করবার জন্য তারা বহুকাল কাটিয়েছেন। আমরা কী দেখছি, অর্থাৎ কোনো বস্তুকে দেখছি ইউরোপিয় শিল্পীর কাছে সেটি বড় কথা নয় বরং কীভাবে দেখছি সেটিই বড় কথা। বিভিন্ন যুগে এভাবে বস্তু দেখার কৌশলের পরিবর্তন হয়েছে এবং বস্তুর নির্ণেয় স্বরূপ নতুন নতুন তাৎপর্য পেয়েছে। কিন্তু প্রাচ্যের যেহেতু বস্তুই উদ্দিষ্ট সুতরাং যুগভেদে বস্তুর স্বরূপের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তাই দেখা যায় একজন প্রাচ্যশিল্পীর কাছে একটি সবুজ গাত্রাবরণ সর্বত্রই অনাবিল সবুজ কিন্তু একজন ইউরোপিয় শিল্পীর কাছে তা নয়। ইউরোপিয় শিল্পী আবরণের উপর আলো ছায়ার খেলা লক্ষ্য করে কোথাও সবুজকে কালো করবেন, কোথাও গাঢ় কোথাও হালকা। অর্থাৎ ইউরোপিয় শিল্পীর বিচারে আলো ছায়াই একটি বস্তুর রঙকে নির্ধারিত করে দিচ্ছে। কিন্তু প্রাচ্যে তা নয়।
বস্তুর আকৃতি নয় বস্তুর প্রাণধর্মকে স্পর্শ করাই প্রাচ্যের শিল্পকর্মের মূল উদ্দেশ্য। প্রাচ্যের একজন শিল্পী তাঁর শিল্পকর্মে দৃশ্যমান বস্তুর আকৃতি মূলত অঙ্কন করেন না বরং দৃশ্যমান বস্তুর ব্যাখ্যা উপস্থিত করেন। তাদের বিবেচনায় প্রকৃতি তার নিজস্ব যে আকৃতিগুলো আলোকসম্পাদের সাহায্যে নির্মাণ করে রেখেছে সেগুলোকে অবিকল উদ্ধার করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। শিল্পীরা শুধু এগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে পারেন এবং অনুপ্রাণিত হয়ে বিভিন্ন প্রকারের ভাবরূপ নির্মাণ করতে পারেন। একটি গোলাপ ফুলের রঙ আছে, আকৃতি আছে কিন্তু তা ছাড়াও তার একটি পবিত্রতা এবং সুগন্ধ আছে। স্বাভাবিকভাবেই চিত্রকর্মে আমরা আকৃতি এবং রঙকে ধরবার চেষ্টা করি কিন্তু তার সুগন্ধ বা পবিত্রতাকে নির্ণয় করতে পারি না। সুতরাং প্রাচ্যের একজন শিল্পী গভীরভাবে অনুধাবন করে চেষ্টা করেন যাতে তার একটি আদর্শ রূপ নির্মাণ করতে পারেন। একসময় গ্রীকদের উদ্দেশ্য ছিল আদর্শ-সৌন্দর্য নির্মাণ। দেবতা হোক মানুষ হোক সকল শ্রেণির ক্ষেত্রেই একটি আদর্শ আকৃতি নির্মাণ করা ছিল গ্রীকদের উদ্দেশ্য। সুতরাং তারা শরীরী অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পারস্পারিক তারতম্য এবং অনুপাত অনুসারে আদর্শ দেহের পরিকল্পনা করতেন। সকল মূর্তির ক্ষেত্রেই তারা একটি আদর্শ মাপ অনুসরণ করতেন। তারা চেয়েছিলেন নিরংকুশ সৌন্দর্যের একটি আদর্শ অবয়ব গড়ে তুলতে। জাপানী এবং চীনা শিল্পীরাও এরকমই একটি আদর্শ অনুসরণ করতেন কিন্তু তা আকৃতির আদর্শ নয়, তা হচ্ছে অনুভূতির আদর্শ। এক কথায় বলা যায় তা হচ্ছে পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ও সৌরভের আদর্শ। প্রকৃতির মধ্যে সৌন্দর্যের একটি রহস্যময়তা আছে। প্রাচ্যের শিল্পীরা সেই রহস্যময়তাকে উদঘাটন করার চেষ্টা করেছেন।

তারিক ফেরদৌস খান। টাঙ্গাইল সদর থানাধীন হুগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মো. শাহজাহান খান পেশায় শিক্ষক ছিলেন, মাতা পারুল বেগম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রাচ্যকলা বিভাগ থেকে বিএফএ সম্মান ও এমএফএ (প্রথম শ্রেণিতে প্রথম) ডিগ্রি অর্জন করেন। শৈশব থেকেই ছবি আঁকার প্রতি তার অদম্য আগ্রহ লক্ষ্যণীয়। বিদ্যালয় বা পারিবারিকভাবে কোনো শিল্পশিক্ষকের সহায়তা ছাড়াই চারুকলায় ভর্তি পরীক্ষায় কৃত্বিতের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেন। তিনি প্রাচ্যধারার একজন কৃতী-শিল্পী ও শিল্পগবেষক। বর্তমানে তিনি বাংলা একাডেমিতে কর্মরত।