‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ : একটি পাঠ পর্যালোচনা

বাংলাদেশের আশির দশকের একজন শক্তিমান কবি মজিদ মাহমুদ (জ. ১৯৬৬)। কিশোর কবিতার বই ‘বৌটুবানী ফুলের দেশে’ (১৯৮৫) লিখে লেখালেখিতে আত্মপ্রকাশ করলেও মূলত তাঁর শুরু হয়েছিল গল্প দিয়ে। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘মাকড়সা ও রজনীগন্ধা’ (১৯৮৬)। এর প্রায় তিরিশ বছর পরে দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘সম্পর্ক’ (২০১৬) প্রকাশিত হয়। প্রথম কাব্য ‘মাহফুজামঙ্গল’ (১৯৮৯) দিয়েই তিনি কবি হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে আরোহন করেন।

মজিদ মাহমুদ ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ উপন্যাস রচনায় প্রচলিত ছকের বাইরে পদক্ষেপ রেখেছেন, এজন্য তিনি প্রয়োগ করেছেন চেতনাপ্রবাহ বা Stream of conciousness রীতি। এই চেতনাপ্রবাহ রীতি বলতে বোঝায় এমন এক বর্ণনাত্বক কৌশল, যা ব্যক্তিক বা সমন্বিত চেতনায় বহমান বিচিত্র চিন্তা ও অনুভবকে কথাসাহিত্যে রূপ দেয়। পদ্ধতিটি প্রথম প্রযুক্ত হয় ডরোথি রিচার্ডসনের লেখায়। এরপর পর্যায়ক্রমে এটা সমৃদ্ধ আকার লাভ করে ভার্জিনিয়া উলফ ও জেমস জয়েসের হাতে। উলফের ‘মিসেস ড্যালাওয়ে’ এবং জয়েসের ‘ ইউলিসিস’ উপন্যাস দুটিতে এর ব্যাপ্ত ও সার্থক রূপ দেখা যায়। এ বিষয়ে জেমস জয়েসকেই সবচেয়ে বড় গুরু মনে করা হয় এখনো। বাংলা উপন্যাসে চেতনাপ্রবাহ ধারার সার্থক প্রয়োগকারী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। তাঁর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ এই ঘরানার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একটি নদীর ক্রমশ মরে যাওয়ার কথা বলার সমান্তরালে নদীতীরবর্তী জনপদের কিছু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে এখানে। সেই বর্ণনার ভেতর দিয়ে আখ্যান আকৃতিপ্রাপ্ত হয়েছে। নদী এ গ্রন্থে জীবনের প্রতীক।

মজিদ মাহমুদ

Stream of consciousness-এর মূলকথা হচ্ছে, মানবমনের চিন্তা নদীর স্রোতের মতো। কিন্তু একটা পার্থক্য আছে এখানে। নদীর প্রবাহমানতা সর্বদা একমুখী। মানুষের চিন্তাভাবনা সবসময় একমুখী নয়। আগামী দিনের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার অতীতের কথা মনে হয়। আবার বর্তমানের ভাবনা তাকে আচ্ছন্ন করে। গল্প বলার একরৈখিক অগ্রগতি- সনাতন ধারার এই ঢঙটি থেকে উপন্যাসকে মুক্ত করার অভিপ্রায় থেকেই চেতনাপ্রবাহ রীতির উপন্যাসের আবির্ভাব।

আলোচ্য ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ উপন্যাসে চেতনাপ্রবাহ রীতি কিভাবে প্রযুক্ত হয়েছে এবং সেদিক থেকে উপন্যাসটি কতটা সফলতা অর্জন করেছে, এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজতে ব্যাপক বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ধারণা আরো পরিষ্কার করতে এখন প্রচলিত এবং চেতনাবাহী উভয় ধারার উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যের তুলনামূলক আলোচনা করে নেওয়া যাক। প্রচলিত ধরনের উপন্যাসে গল্প প্রাধান্য পায়। পূর্বপরিকল্পিত একটাই প্লট, প্লট গড়ে তোলাই আসল কাজ এবং তার ভেতরে একাধিক গল্প। ধারা বর্ণনাকারীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে চেতনাপ্রবাহী উপন্যাসে গল্পের চেয়েও তার পরিবেশনরীতি গুরুত্বপূর্ণ। চরিত্রকেন্দ্রিক এক বা একাধিক প্লট নির্মাণের ভেতর দিয়ে গল্পটা এগিয়ে যায় এবং পরিণতি পায়। এই পদ্ধতিতে ধারা বর্ণনাকারীর একচ্ছত্র আধিপত্য থেকে উপন্যাস অনেকখানি বেরিয়ে আসতে পারে। এবার উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর আলোকে মজিদ মাহমুদের ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ নিয়ে আলোচনায় আসা যাক।

আশ্রম প্রকাশনার প্রচ্ছদ

‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ উপন্যাসের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে চারটি ভিন্ন শিরোনামের চারটি অধ্যায়ে, সেগুলো হলো- প্রথম অধ্যায় : ইয়াছিন মেমোরিয়াল ক্লাব, দ্বিতীয় অধ্যায় : বেথেল হেমের পথে পথে, তৃতীয় অধ্যায় : ছয়কুলার রাত, চতুর্থ অধ্যায় : শঙ্খলগন। চেতনাপ্রবাহ রীতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তৃতীয় পুরুষের বর্ণনায় হাসান ও বিলু চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন ভিন্ন প্লটে সমগ্র কাহিনি বিস্তার লাভ করেছে। কথকের বর্ণনা, হাসানের স্বপ্ন ও বিলুর চিন্তনে উঠে আসা বহু ছকভাঙা বিবৃতির মধ্য দিয়েই আমরা উপন্যাসের অন্যসব চরিত্র- ইয়াছিন, মর্জিনা, আকলিমা, আব্দুল খালেক ও মৌলবী আব্দুল কাদেরের পরিচয় পাই। এখান নায়ক হাসানের গল্পের সমান্তরালে অন্যান্য চরিত্রের গল্পও আমরা দেখতে পাই। মূলগল্পে নায়ক হাসানের পরিণতি গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়কের মতো নিয়তি নির্ধারিত। যে অপরাধের জন্য সে নিজে দায়ী নয়, অথচ সেই অপরাধের গ্যাঁড়াকল তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে- কিছুতেই গিঁট খুলতে পারছে না। গভীর রাতে সংবাদপত্রের অফিসের কাজ শেষ করে পায়ে হেঁটে বাসায় ফেরার পথে দুই বালিকা দেহপসারিণীর সঙ্গে তার দেখা হয়ে যাওয়া, তাদের সঙ্গে বসে কথা বলার অপরাধে রাতের টহল পুলিশ তাকে থানায় ধরে নিয়ে যায়। তারপর একের পর এক অনভিপ্রেত ঘটনা, নানা সামাজিক জটিলতা তার সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এই সংকটকালে তার চেতনাপ্রবাহে ধরা দেয় ফেলে আসা অতীত জীবনের সব ঘটনাবলি।

অন্য চরিত্রদেরও আমরা নিয়তি নির্ধারিত পরিণতিই ঘটতে দেখি। যেমন ইয়াছিন চরিত্রে দেখা যায়, ইয়াছিন নাকি অমাবশ্যার রাতে তার বিধবা চাচির ঘরে ঢুকেছিল। কিন্তু তার চাচি তো তা বলেনি। তাকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছিল ইয়াছিনের গ্রাম সম্পর্কীয় ভাবি আঞ্জেরার মা, যার সঙ্গে ইয়াছিনের চাচির অনেকদিন কথা বন্ধ। সকালে উঠেই আঞ্জেরার মা পেয়ারাকে বলেছিল। এভাবে এক কান দুই কান করে খবরটি গ্রামে চাউর হয়ে গেল। গ্রাম ছেড়ে পাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। সেদিন ছিল শুক্রবার- জুমার নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিদের দাবিতে ইয়াছিনের অপরাধের বিচার করলেন মসজিদের ইমাম মওলানা আব্দুল কাদের। দশটি কঞ্চি এক সঙ্গে করে ইয়াছিনের পিঠে আঘাত করা হলো। আর সেই সঙ্গে তার চুল কেটে ন্যাড়া মাথায় ঘোল ঢেলে মুখে চুন-কালি মেখে তাকে একটা মহিষের পিঠে চড়িয়ে সারা গ্রাম প্রদক্ষিণ করানো হলো। নির্দোষ ইয়াছিনের এই শাস্তি প্রাপ্তির মাত্র তিনদিন পরে গ্রামের মানুষ তাকে একটি তেঁতুল গাছের ডালে ঝুলতে দেখেছিল।

Memorial Club from Gaudy Boy

আকলিমা চরিত্রে আমরা দেখি, বিলুর বড় ফুপুর বাড়ির কাজের মেয়ে আকলিমা। তার বয়স তেরো/চৌদ্দ বছরের বেশি হবে না। দেখলে আরও কম মনে হয়। আকলিমা যখন কেবলই বড়দের পরিত্যক্ত সালোয়ার কামিজ পড়তে শুরু করেছে। তার আগেই আকলিমার পেটের মধ্যে একটি মানব শিশু বড় হচ্ছিল। আর বাচ্চাটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারেনি আকলিমা একজন চোরাই গর্ভবতী। আকলিমাও জানে না এ সন্তান তার পেটের মধ্যে কী করে এলো। এজন্য অকথ্য নির্যাতন সইতে হয়েছিল তাকে।

মর্জিনা চরিত্রে পাই, মর্জিনাদের বাড়িতে থাকত মওলানা আব্দুল কাদের। বাইরের খানকা ঘরে একটা অংশে পার্টিশন দিয়ে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ঘরের বাকি অংশে সকাল ও রাতে আব্দুল কাদের বাড়ির বাচ্চাদের স্কুলের পড়া তৈরি করে দিত। বাড়ির মূল আঙিনা থেকে এই ঘরটি অনেকটা বিচ্ছিন্ন। এই ঘরেই এক রাতে আব্দুল কাদের মর্জিনাকে একা একা পড়াচ্ছিল।

বাংলাপ্রকাশ-এর প্রচ্ছদ

সেইদিন মর্জিনা আগুনে পুড়ে মারা যায়। সবাই জানতো কেরোসিনের হারিকেনটা মর্জিনার পায়ের আঘাতে উল্টে গিয়ে, তার পায়জামা-কামিজে আগুন ধরে। সেই আগুনে পুড়ে মারা যায় মর্জিনা। কিন্তু অক্ষত রয়ে যায় আব্দুল কাদের। ঘটনার সময় প্রকৃতির ডাকে তাকে নাকি বাইরে যেতে হয়েছিল।

আব্দুল কাদের চরিত্রে দেখি, চরবিলকাদা গ্রামের স্কুলের ধর্মীয় শিক্ষক আব্দুল কাদের এ গ্রামের লোক নয়। নোয়াখালি জেলার সুধারাম থেকে এসেছিল। হালকা-পাতলা গড়নের মানুষ। চেহারা দেখে বয়স অনুমান করার উপায় ছিল না। ধর্মের অনেক কেচ্ছাকাহিনী তার জানা ছিল। নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় সে যখন ওয়াজ করত তখন শ্রোতারা বেশ মজা পেত। সবাই তাকে পছন্দ করত। তবে তার বর্ণিত বিষয় ছিল নারী-পরুষের যৌন সম্পর্ক। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া মর্জিনার দাফন নিয়ে যেদিন প্রত্যেকেই ব্যস্ত ছিল। একে একে সবাই উপুর হয়ে মর্জিনার কবরে তিন মুঠো মাটি ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন আর মুখে জোরে জোরে আওড়াচ্ছিলেন, মিনহা খালাকনাকুম ওয়া ফিহা নুইদিকুম ওয়া মিহা নখরিজুকুম তানাতান উখরা- এই পবিত্র আয়াত উচ্চারণের মধ্যেই আর্তনাদ করে মর্জিনার কবরের ওপর ঢলে পড়লেন আব্দুল কাদের। সকলের অজান্তেই মর্জিনার চাচাতো ভাই আলমগীর গরু জবাইয়ের একটি ধারালো ছুরি মৌলবি আব্দুল কাদেরের গলার নিচে পিঠের দিক থেকে হৃৎপিন্ড বরাবর বসিয়ে দিয়েছে।

ভোরের কাগজ প্রকাশনার প্রচ্ছদ

আব্দুল খালেক চরিত্রে দেখা যায়, সে খুব গাছ বাইতে পারতো, চরবিলকাদা গ্রামে পাক অপারেশনের সময়ে মিলিটারিরা আব্দুল খালেককে নির্দেশ দিয়েছিল এলাকার সবচেয়ে উঁচু খেজুর গাছটিতে উঠে তাদের একটু মজা দিতে। আব্দুল খালেক গাছে পুরোটা ওঠার পর জোয়ানেরা সবাই তাকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিল। আর তার এই সাফল্যের পুরস্কার স্বরূপ পিঠের দিকে রাইফেলের একটি গুলি চালিয়ে তাদের সেদিনের মৃগয়া উদযাপন করেছিল।

মূলত এ উপন্যাসে আমরা দেখি একটি রাতের দুর্ঘটনায় বদলে যায় এক সময়ের মেধাবী ছাত্র বর্তমানে খ্যাতনামা সাংবাদিক হাসানের জীবন। তাকে হারাতে হয় জীবনের সুখ-শান্তি, হারাতে হয় স্ত্রী ফারিয়াকেও। তবে হাসান ও বিলকিস বেগম ওরফে বিলুর প্রচ্ছন্ন প্রেম-পরিণতি এক নতুন মাত্রায় ধরা পড়ে।

চেতনাপ্রবাহ রীতি অনুযায়ী এই উপন্যাসের কাহিনি বর্ণনার ক্ষেত্রে কোলাজধর্মী বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা নিশ্চিতভাবে রয়েছে। কিন্তু চেতনাপ্রবাহ রীতিতে লেখা উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো উপন্যাসে এমন কোনো চরিত্র থাকবে না যাকে কেন্দ্র করে মূলত উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হবে। তবে মজিদ মাহমুদের ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ উপন্যাসে অবশ্য একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র রয়েছে। যাকে ঘিরে এই উপন্যাসের কাহিনি শেষ পর্যন্ত আবর্তিত হয়েছে। তবে এখানে আমরা দেখতে পাই একটি কাহিনির বদলে অনেক উপ-কাহিনি। অনেক সংস্কার, কুসংস্কারের দ্বন্দ্ব, সেই সঙ্গে পুরাণ ও মিথের সমাবেশ এবং পটভূমি ও চরিত্রগুলো উপস্থাপনের ক্ষেত্রে লেখক এমন এক শিল্পরীতি অবলম্বন করেছেন, যা অভিনব ও স্বতন্ত্র এবং সর্বোপরি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে নতুন এক মাত্রা সংযোজিত হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *