মজিদ মাহমুদের কবিতা : সামগ্রিক জীবনের অভিজ্ঞতা

আজ কবি মহীবুল আজিজ এর ৬৩তম জন্মদিন। গল্প-উপন্যাস-কাব্য-প্রবন্ধ-গবেষণা-অনুবাদ ইত্যাদি মিলিয়ে চল্লিশের অধিক গ্রন্থের রচয়িতা। গত ১৬ এপ্রিল ছিল কবি মজিদ মাহমুদ এর জন্মদিন। মজিদ মাহমুদের কবিতা নিয়ে মহীবুল আজিজের লেখাটি প্রকাশের মাধ্যমে ‘আশ্রম সংলাপে’র পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

২০১৯-এর জুলাইয়ে লেখা কবি মজিদ মাহমুদের ‘কাব্যসমুচ্চয়’-এর ভূমিকাংশটুকু সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে পড়লে এটিকেই বরং একটি পরিপূর্ণ কবিতা বলে অন্তত আমার কাছে মনে হত। এখনে তাই মনে হয় যদিও এটি (‘কবিতামালা’ শিরোনামাঙ্কিত) সর্বদা ভূমিকার মতোই বিরাজিত থেকে যাবে। তা থাকুক। একজন কবির জীবন ও জগতকে, ভাবনা ও দর্শনকে, কবিতার বিষয় ও শৈলীকে উপলব্ধিতে আনবার জন্য এমন ভূমিকা ধন্বন্তরীর মতন। এই ভূমিকাটুকু পাঠ করে কবির কাব্যোপনিবেশে প্রবেশ করলে দেখতে পাব মজিদ মাহমুদ সেই কবি যাঁর রয়েছে বাংলা কবিতা পৃথিবীর কবিতা বাংলা ও ভারতবর্ষের ইতিহাস পৃথিবীর ইতিহাস এমনতর অবলম্বন। কবি সেই নাগরিক যাঁর দৃষ্টিতে থাকে দেখা ও অদেখার বাস্তব, যাঁর পা থাকে তাঁর দৃশ্যমান এবং তাঁর অদৃশ্যমান মাটিতে গাঁথা। শুধু অভিজ্ঞতা নয়, অভিজ্ঞতাকে প্রকাশের বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিনি লাভ করেন অসাধারণত্ব। মজিদ মাহমুদ বাংলাদেশের কবিতায় সেই অসাধারণত্বধারী কবি।

তাঁর ‘মাহফুজামঙ্গল’ পাঠের স্মৃতি এখনো মাত্র সেদিনকার ঘটনা বলে প্রতিভাত হয়। কিছু কিছু ম্যাজিক-পংক্তি জলভ্রমির মতো ঘুরপাক খেতে থাকে করোটি-অভ্যন্তরে। ‘ঈশ্বরকে ডাক দিলে মাহফুজা সামনে এসে দাঁড়ায়’ কিংবা ‘মাহফুজা তোমার শরীর আমার তছবির দানা/ আমি নেড়েচেড়ে দেখি আর আমার এবাদত হয়ে যায়’- পড়ে মনে হয়েছিল কোথাও কি রুমির ঘণ্টা শুনতে পাই। না, আসলে রয়েছে গহিনে রুমি-অভিজ্ঞতা আর তা অনূদিত হয়ে গেছে মজিদিয় কাব্যিকতায়। হ্যাঁ, মাহফুজা হয়তো ঐ গ্রন্থে একটি উপলক্ষ্য ছিল যেটিকে আঁকড়ে কবি বাঁকের দিকে মুখ ঘোরানোর একটা উপায় খোঁজেন কিন্তু সেখানে সমকাল পুরাণ ইতিহাস প্রেম এমনকি ধর্মও হাজির। সত্যি কথা বলতে কি আমার মনে এতটাই চমক লেগেছিল তাঁর সেই কাব্যপংক্তিটি পড়ে (‘মাহফুজাং শরণাং গচ্ছামি / নির্বাণং শরণাং গচ্ছামি’), প্রথমটায় মনে হতে পারত মশকরা নাকি কিন্তু পরে দেখা গেল, তা আসলে জীবনের কিছুই যাবে না ফেলা থেকে সংগ্রহ করে নেওয়া একটি পালক। খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে ১২-পংক্তির এ-কবিতায় গৌতম বুদ্ধের জীবন এবং ধর্মাভিজ্ঞতা প্রভৃতি উপাদানকে এক বাঙালি ব্যক্তি-কবির জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে এমন বোধে উপনীত হওয়া সম্ভব যে হ্যাঁ, গৌতমের জীবনটা সাধারণ থেকে যেমন অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে, আবার তেমনই মজিদ মাহমুদের জীবনচেতনার মধ্যেও মহাত্মার প্রতিচ্ছায়া থাকা সম্ভব। হয়তো কবিতার মধ্য দিয়েই এমন ব্যক্তিগত যাপনকে শিল্পে উত্তীর্ণ করতে পারা যায়।

এছাড়াও মজিদ মাহমুদের ‘সিংহ ও গর্দভের কবিতা’, ‘ভালোবাসা পরভাষা’, ‘ধাত্রী ক্লিনিকের জন্ম’, ‘গ্রামকুট’, ‘দেওয়ান-ই-মজিদ’, ‘কাটাপড়া মানুষ’, ‘শুঁড়িখানার গান’, ‘সমীরণজেঠুর বারান্দা’, ‘বায়োস্কোপ’- এইসব কাব্যগ্রন্থের কথা মনে পড়বে। তাঁর কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম কেন ‘গোষ্ঠের দিকে’ (১৯৯৬) সেটা ভাবতে গিয়ে দেখি, আমরা সকলেই আসলে সেই কৃষিজীবিতার উৎসজাত এবং যত দূরেই আসি কিংবা যাই চরে বেড়াতে থাকি সেই যৌথ অবচেতনার ছায়ায় যেখানে চেনা-অচেনা গল্পকে ঘিরে জোটবদ্ধ মানুষ, মানুষের সেই সমষ্টিবদ্ধতার মধ্যে থাকে কবিরও কণা-অনুকণা কিন্তু কবি তাঁর অহংলুপ্ত সত্তায় খুঁজে পান জেগে উঠবার চেতনা- “জলের নিচে গ্রাম/ গ্রাম শেষে সবুজ প্রান্তর/ সেই প্রান্তরে জলাশ্ব চরিতেছে/ আমি তার ক্ষুরের শব্দে/ বারুণীর চিরনির শব্দে/ আবার জেগে উঠছি।” মজিদ মাহমুদের কবিতার একটা শক্তির দিক হল ধারাবাহিকতার রেখায় তাঁর স্থিতি। তাঁর ইতিহাস তাঁর পৌরাণিকতা যে-যৌথ চেতনাবচেতনার বাণীর প্রচারক তা বিলাসজ্ঞাপক বিচ্ছিন্নতার বার্তা নয় বহন করে এক অবিমিশ্র জাতিগত চেতনার, এক সর্বভারতীয়, এক বাংলাবাসীয় অভিজ্ঞান। পৃথিবীতে তিনি এবং তাঁর মানুষেরা আছে, এবং আছে যথেষ্ট ঋদ্ধ উত্তরাধিকার নিয়ে আর সেই অধিকারের সম্পদ রণ-রক্ত-ঘাম ও নিত্যকার চলমানতার ধ্বনিমুখরিত। কবেকার সেই প্রাচীনতা বাক্সময় জোড় তৈরি করে হয়ে যায় স্থানীয়-

অথচ আজ বড় দুর্দিন
ভাগিরথির কন্যার
সোনার সীতারে হরণ করেছে লংকার রাবণ
যুবকের জন্য তার বাড়ে চিন্তা
কাঁদে রাতদিন
দিনরাত কাঁদে।

‘সুরের যাতনা’ নামের কবিতার বেদনার্ত চিত্রকল্পে ব্যক্তিতার স্পর্শ থাকলেও অচিরেই সেটি মাত্র কয়েকটি শব্দের মোচড়ে ভিন্ন পরিস্থিতি এবং ভিন্ন ইতিহাসের স্মারক হয়ে ওঠে- “এক বোষ্টমী আসবে ভেবে/ একজন পুরুষ হয়ে গেল লালন/ লাউয়ের একতারায় লেঙ্গুট নেড়ে/ তুললো সুর আর সুরের উপমা।” লালনের চিরন্তন মানবিকতার আবেদনের নেপথ্যে ‘বোষ্টমী’র উপস্থিতি বাঙালির আট-প্রাহরিক জীবনের কথাই মনে করিয়ে দেয় এবং লালন ও বোষ্টমী এই দুই বাস্তবজাত চিত্রকল্প আমাদের নিয়ে যায় আরো অতীতে যেখানে কোন এক রাজপুত্র (‘রাউত’) নিজেকে সমর্পণ করে এই গোষ্ঠনিবাসী এক মৃত্তিকার সৌরভময় ‘ডোম্বি’র সাদামাঠা সত্তার নিকটে; তাঁকে গ্রহণ করবার (‘সাঙ্গা’) অপরিসীম নির্লিপ্ততা তাঁর কণ্ঠে। ঠিক এক্ষণে আবার ফিরে আসে ধ্রƒবপদের মতন ‘মাহফুজাং শরণাং গচ্ছামি’। তারপর কী আশ্চর্য, কাহ্ন আর ডোম্বি, লালন আর বোষ্টমী এবং কবি আর মাহফুজা সব মিলেমিশে একাকার। কবিতা এমন জাদুময় আবেশেরই হয়তো নিয়ামক। মজিদ মাহমুদের কবিতায়, তাঁর ‘গোষ্ঠের দিকে’তেও সেই আবেশের বিরাজমানতা লক্ষণীয়।

অল্প আগেই কবি মজিদ মাহমুদের কবিতার ইতিহাস এবং পৌরাণিকতার মধ্যে এক অনিবার্য ধারাবাহিকতা ও পরম্পরার সংযোগের কথা বলা গিয়েছিল। পুরাণকাল যতই দেবদেবীবহুল হোক না কেন সংখ্যায় তারা মানুষের তুলনায় খুব-খুবই কম। তখনও সেই পুরাণেও মানুষই বৃহত্তর ও বৃহত্তম পক্ষ। কবি সেই মানুষেরই পক্ষে, মানুষের পক্ষাবলম্বনই তাঁর অধিকারচেতনার মৌল উচ্চারণ- ‘আবার গৌতম’ শিরোনামের ১৬-পংক্তির অসাধারণ কবিতাটি সম্পূর্ণ পাঠ করা গেলে মজিদ মাহমুদের কবিতার করণকুশলতা ও কাব্যিক উপাদান সম্পর্কে খানিকটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে যদিও আপাতত আমরা সীমাবদ্ধ দুই স্তবকেই-

অশ্বত্থের তলে জানু পেতে বসেছি গৌতম
হে বোধি! হে বৃক্ষ! সুমতি দাও
আমার মাথার পরে উড্ডিন হাইড্রো-শকুন
এটোমের মণ্ডপে পূজার মালা … …
বৃক্ষের তলে আবার জানু পেতে বসেছি গৌতম
হৃদয়ে উৎক্ষেপণ হোক তোমার বাণী
জীবকে প্রেম করো; সৎ আর অহিংসাই স্বর্গের ছবক
অন্ধকার কেটে আনুক জীবন নির্বাণ।

মজিদ মাহমুদের কবিতাপাঠ এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা যে-আনন্দে থাকে প্রত্যাশার পূর্ণতা। কবিতা কেবলই পংক্তির পর পংক্তি বিন্যস্ত সুন্দর শব্দাবলিই নয় যদি না সেই বিন্যাসে থাকে অর্থময়তার ব্যঞ্জনা আর সেই অর্থময়তা ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে সমষ্টির অভিসারী। কবিতা যতই ব্যক্তিগত কারুকাজ হোক না কেন কবিতার অন্তর্গত সত্তায় ব্যক্তি-অতিরেক জীবনের বার্তা অনস্বীকার্য। মজিদ মাহমুদ তাঁর ব্যক্তিতানিষিক্ত পদাবলিকে করে তোলেন জীবনান্বেষী, বৃহত্তর-যৌথ চেতনাবচেতনার অনুষঙ্গী। কবিতার রয়েছে স্বাধীন পর্যটনের এক অপরিমেয় সক্ষমতা। একমাত্র কবিতাই পারে মুহূর্তে এশিয়া থেকে আফ্রিকা, বাংলা থেকে লাতিন আমেরিকা কিংবা মহাস্থানগড় থেকে মাচুপিচুর দিকে গমনাগমনের সংঘটন তৈরি করতে- কবিতাই পারে স্থানীয় আর অস্থানীয়কে দারুণ মেলবন্ধনে মেলাতে। কৈশোরে গল্প পড়েছিলাম ‘কাজীর বিচার’, যে-গল্পে এক বিচক্ষণ সুলতানের চরিত্রকে আঁকা হয় কুশলতায়। বহুকাল পরে এসে মার্কিন কবি লুইজ গ্লুক-এর ‘এ ফেবল্’ কবিতাটি পড়ে চমকে উঠি যে-কবিতার প্রথম চার পংক্তি এক নিমিষে আমাকে নিয়ে যায় আমার সেই কৈশোরাভিজ্ঞতার দিনে- “টু উওম্যান উইথ/ দ্য সেইম ক্লেইম/ কেইম টু দি ফিট অব/ দ্য ওয়াইজ কিং। টু উওম্যান,/ বাট ওন্লিওয়ান বেবি,/ দি কিং নিউ/ সামওয়ান ওয়াজ লাইয়িং।” কিন্তু কবিতাটি শেষ পর্যন্ত চলে গেছে এমন এক মায়ের দিকে যে-মা তাঁর দুই কন্যার মধ্যকার বাৎসল্যবোধের টানাপড়েনে ক্লিন্ন। কবিতার স্বাধীন পর্যটনের সক্ষমতাকে দারুণভাবে কাব্যকর্মে নিয়োগ করেন কবি। মজিদ মাহমুদের অনেকানেক কবিতার দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে যেখানে তিনি এমন কৌশলে পারঙ্গম। তাঁর ‘কবিতা ফিরে আসবে’ কবিতাটি সম্পূর্ণ পাঠ করলে বোঝা যাবে এটি তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতাই শুধু নয়, তাঁর কাব্যবোধকে অনুভব করবার পক্ষেও এটি একটি অপরিহার্য অবলম্বন-

কবিতা আবার ফিরে আসবে ভেবে
পরিত্যক্ত আবাস ছেড়ে কোথাও যাই না আমি
রেড়ির প্রদীপ জে¦লে সারারাত বসে থাকি
চর্যার ডোম্বির সাথে; আমার
জাগ্রত সত্তা কুঁড়ে খায় ভুসুকুপার মুষিক
বানের জলের মতো ভেসে আসে অকবিতা
আমি তার অপ্রতিরোধ্যতা পারি না ঠেকাতে
শব্দের চতুরঙ্গে হেরে যাই।
ছন্দের উচ্ছেদে নড়ে ওঠে আমার ভীত
কখনো বা পেয়ে বসে পোড়ো বাড়ির ভৌতিক ভয়
আহা কী নূপুর কেঁদে ওঠে বেহুলার পায়
আমি জানি কবিতা ফিরে এলেই আসবে
মুকুন্দরাম কালকেতু ফুল্লরা
কবিতা এলেই বৈকুণ্ঠের গান গা’বে চণ্ডীদাস
কবিতা এলেই অশ্বত্থের তলে জানু নত হবে গৌতম
কবিতা এলেই আসবে প্রেম ভালবাসা
মানুষের হৃদয়
ধ্বংস হবে এটোম হাইড্রোজেনের হরিদ্রাভ ছোবল
এই যদি আমার বিশ্বাস
তবে আর রাত কাটাই কেন অকবির আবাসে।

মজিদ মাহমুদ তাঁর কবিতার মাধ্যমে তাঁকে বাংলাদেশের কবিতার অনিবার্য কণ্ঠস্বরে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁকে বাদ দিয়ে নয় বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *