পেরুর স্প্যানিশভাষী কবি কার্লোস হুগো গ্যারিডো শালেন বিশ্বসাহিত্যে একটি পরিচিত নাম। পেরুর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কালচার (INC) তাঁকে লিভিং কালচারাল হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ট্রুজিলো’র জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে সাংবাদিকতা ও আইনে ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনি পেরুর টাম্বেস প্রদেশের জোরিটস জেলায় ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। পেশাগত আইনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন ১৯৭০ সাল থেকে ৭৬ সাল পর্যন্ত এবং তিনি ট্রুজিলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় অধ্যায়নরত ছিলেন ১৯৯০ থেকে ৯৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৭ সালে তিনি জাতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নজরে আসেন এবং জাতীয়ভাবে সম্মানিত হন। বিশ্বসাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০০৯ সালে কবিতায় ‘অ্যান্ড্রেস বেলো’ পুরস্কার পান ভেনিজুয়েলা থেকে। এটা একটি বিশ্বমানের পুরস্কার। এ ছাড়াও তিনি দেশে-বিদেশে অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন। ১৯৮৫ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এবং IPPNW অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক ভাইস চেয়ারমযান আর্নেস্টো কানান এই কবি সম্পর্কে বলেছেন ‘পেরুর কবিদের মধ্যে তার উচ্চতা অনেক ওপরে এবং তিনি এমন এক ব্যতিক্রমধর্মী কবিব্যক্তিত্ব, যিনি আবির্ভূত হয়েছেন মানব ইতিহাসের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে। এস্পানিওল জগতে তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তী। তাঁর কবিতায় সমুদ্র ও তার বিস্তৃতি অন্যভাবে প্রতিভাত হয়েছে। যিনি বলেন- ’আমি কবিতা লিখি যাতে গাংচিলগুলো অনেক উঁচুতে ফিরে যেতে পারে’ তার দিকে আমাদের নিবিষ্টচিত্তে তাকাতেই হয়। তিনি পশু-পাখি-উদ্ভিদ-সামুদ্রিক শেওলা-কোরাল-গুল্ম ইত্যাদির মধ্যে যে বিশালতার, যে শক্তির আভা দেখেন, তিনি তা তাঁর কবিতায় উচ্চকিত করেছেন। ম্যামোথকে মেটাফর হিসেবে ব্যবহার করে নানামাত্রিকভাবে যে কবিতাবিশ্বকে তিনি পরিভ্রমণ করেছেন, তা তুলনাহীন। তিনি একেবারেই আলাদা ধরনের কবিতা লিখেন। এমন এক ভাষায় তাঁর অধিকার রয়েছে , যা কেবল তাঁরই নিজস্ব ভুবনের আলো-আঁধারের রহস্যময়তার মৌলিকত্বকে চিহ্নিত করে। খুব সাবধানে না পড়লে তাঁর কবিতার মৌলিক দিগন্ত স্পর্শ করা যাবে না। গত বছরের নোবেল প্রাইজের লিস্টে তাঁর নাম ছিল। তিনি দীর্ঘদিন ধরে Founder Executive President of Union Hispanomundial de Escritores (UHE- Spanish Writers Union) এর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি এখন পরিবার নিয়ে পেরুর লিমায় বাস করেন। অনূদিত কবিতা তিনটি তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ The Returned To The Promised Land এবং সম্প্রতি প্রকাশিত The House of The Mammoth (LA CASA DEL MAMUT) এবং CONFESSIONS OF A TREE এর অন্তর্ভুক্ত। সমালেচকরা তাঁর The House of The Mammoth-কে The ode of the century হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর কবিতা পৃথিবীর অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কবিতাকে এক পবিত্র উঁচু জায়গা থেকে দেখেছেন তিনি। পেরুর লোককাহিনি, লোকজীবনের বিচিত্র সম্ভার, সমাজের ভেতরের নানা টানাপড়েন, ব্যক্তিজীবনের নানা সংঘাত, দুঃখবেদনা-ভালোবাসা-বিরহ সবই রূপক কিংবা প্রতীকের আশ্রয়ে নিবিড় সাজুয্যে কবিতায় গাঢ়ীকৃত হয়েছে। একজন বড় মাপের প্রতিভাবান সাধক কবির হাতেই কেবল সমাজ-ইতিহাস-রাজনীতি-জীবন একাকার হয়ে মহাকালের দিকে গড়িয়ে যেতে পারে শিল্পের আশ্রয়ে। কার্লোস হুগো শুধু একজন বড় মাপের কবিই নন, তিনি একজন বড় মাপের ফিকশন রাইটারও বটে। তাঁর গল্প-উপন্যাসেও এক গভীর জীবনান্বেষী শিল্পীর পরিচয় পাওয়া যায়। এস্পানিওল জগতে এখন তাঁর মতো বড়ো মাপের লেখক খুব কমই আছেন। তাঁর LA CASA DEL MAMUT কাব্যগ্রন্থটি স্প্যানিশ ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে তো বটেই, সারা পৃথিবীতেই একটি স্বতন্ত্র ও অসাধারণ কাব্যের মর্যাদা পেয়েছে। বাংলাদেশে এই কবি খুব পরিচিত নন। বাংলাদেশের পাঠকদের সাথে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই আমার আজকের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। কার্লোস হুগো গ্যারিডো শালেন-এর এই কবিতা তিনটি স্প্যানিশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন নব্বইয়ের দশকের রোমানিয়ার কবি লিডিয়া পোপা।
কারণ গাংচিলগুলো তাদের উচ্চতায় ফিরে আসে
জনগণ বলছে কিন্তু কে সেই যে সেগুলি একদিন লিখবে
যা কিছু ভালোবাসার কথা বলে বিষাদের গান গায়,
কে সেই যে কবিতা লিখবে শিহরিত না হয়ে মৃত্যুকে পাত্তা না দিয়ে
কে হৃদয় দিয়ে ভালোবেসে মানব হতে চায় পিছু না হটে
যে বলতে জানে, আমি দুঃখিত, আমার অনুমতি দরকার
কে সেই যে সূর্যের তীব্র আলোয় ভয় না পেয়ে সটান আকাশের দিকে তাকায়
অনবরত বলতে থাকে ভালোবাসো, কাছে আসো,
আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি তোমাকে চাই
ওই বিষাদময় চেহারা কার
যে মায়ার কথা বলে এবং পাইন গাছের গন্ধের।
এবং আমি তাদের বলি: তোমরা কেন জানতে চাও আমি কে,
যদি আমি পুমা হই
আমি যদি ক্ষমা চাই তোমরা কিভাবে তা দেখবে
এমন কি যদি আমি ঈগল পাখি হবার ইচ্ছে পোষণ করি
এবং সীমাহীনভাবে ঘুরি।
কিন্তু লোকে জেদ করে
এবং আমি যখন নিজেকে কোনো শহরের বাসিন্দা বলে কল্পনা করি
তুমি বলো আমার শরীর কেন কোনো ছায়া ফেলে না।
কিন্তু তুমি আমাকে খুশি মনেই চেনো, এবং আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি তখনো
আমার অভিভাবক দেবদূত মানুষের মতো পোশাক পরিধান করে
এবং প্রত্যুষকে উপভোগ করে
এবং তুমি তাকে ভার্জিলের জায়গায় স্থান দাও।
তারা এখনো অনেক কথা বলে যাবে
যে সব মৃতদের আমি এখনো খুন করতে পারি নি তারা জেদ করবে
তারা তাদের উন্মত্ত হিংসায় আমাকে ধ্বংস করবে
এবং তারা আমার বক্ষের কেন্দ্রভূমিতে একটি গর্ত করবে
আমার জরুরি কাজগুলো নিতে
কিন্তু তুমি সর্বদা আমার পাশে থাকবে
ওয়ালপেপার দিয়ে রাস্তা তৈরি করবে
তারা কি বলছে এটা কোনো বিষয় নয়
আমি আমার ভগ্ন আত্মা দিয়ে বলতে থাকব ক্রুদ্ধ পরিখার কথা।
আমি কবিতা লিখি যাতে গাংচিলগুলো অনেক উঁচুতে ফিরে যেতে পারে
এবং সেজন্য আমি বলে যেতে থাকি : ভালোবাসো, কাছে আসো,
আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি তোমাকে চাই,
তুমি আমার চরম প্রসারণ
আমার চূড়া
আমার পর্বত।
যখন আর জিলগুয়েরোর শব্দ শোনা যাবে না
তার মৃত্যু অবধি তার তিন মিটার সূচালো দাঁত
বেড়েছে শুধু
হস্তীটি আমার বাড়ির যত্ন নিত
ঘোষণা দিয়েই তারা তাকে পরিধান
করাত প্রকৃতির সহস্র রঙের পোশাক
কালো জাম রঙ
নীল কালো কাঁটা ফল
এবং আরো কাজু বাদাম
এবং এটা অনুধাবন করত না
টুনেরা ফুল
এবং শক্ত কঙ্কালের মতো কোরাল
উজ্জ্বল কালো কোরাল
বায়ুপরাগী পুস্প এবং আরো অভিজাত বিষয়
কখনো কখনো যখন বৃষ্টি হয় না,
যারা তাদের নিজেদের মধ্যে গর্ব করে-
উত্তপ্ত নারীলিপ্সু জিমন্যাস্ট
সামুদ্রিক লাল শেওলা
আমব্রেলা-গুল্ম
এবং প্রবাহমান জল
এবং এটা মিথ্যাও মনে হয়
যেভাবে তারা গান শুরু করে
যেমন চক্রবাক
ডুবপাখি
ফ্লেমেনকো
ভবঘুরে পাখি
এবং বালিহাঁস,
কিভাবে তারা সমুদ্রের গভীরে
বুদবুদের সৃষ্টি করে
অ্যাগ্লান্টা, গ্যারার্দিয়া এইসব শেওলা
শক্ত কঙ্কালের মতো কোরাল
এবং তারাও অনেক ওপরের
সূর্যকে সম্মানিত করেছিল।
যেভাবে হেঁটে হেঁটে ইতিহাস শেখা যায়
আজ আর সেইসব বন্ধুরা নেই
যারা আমার সাথে আলাপ জমাতো শান্ত পরিবেশে।
আর আমি কেমন করে পারি অনুভব না করে
এই রসাতলের শেষটা।
গঙ্গাফড়িংয়ের শান্তির কথা আমি কিভাবে ভুলে যাই
যারা ভালোবেসে আমার আনন্দ ঘিরে ঘিরে নাচতো
এবং সত্যটা হল আমি ওইসব জিনিসের
প্রাকৃতিক ভাষাটা খুঁজে বেড়াই-
পাইনগাছের সেই ভীষণ বার্তাগুলো
যারা রাত্রে কথা বলত
আমার ছায়ার সাথে।
আজ জীবন ও মৃত্যুর পরিবর্তন এসেছে
নাটকীয়ভাবে
এবং জলের পাদদেশে দীর্ঘ সুন্দর কোনো জলপ্রবাহ নেই
নাই কোনো বিনম্র নদী-পাথর, এক উদ্বিগ্নতার মধ্যে আছি
কারণ পাহাড়ের খাড়ির ভালোবাসায় আমি
অনেকদিন গাছ হয়ে আছি
আমি এখন নিঃসঙ্গতাবোধ করি।
পাখিদের মধ্যে বন্ধুদের খোঁজে
খোঁযাড়ের দিকে গিয়ে
আমি নিজেকে মাঝে মাঝে দেখি যে
আমি বরফের মধ্য দিয়ে উঠে যাচ্ছি কিংবা
চূড়া থেকে নেমে আসছি
সেইসব পুরানো বন্ধুদের খোঁজার জন্য
কিন্ত আমি তাদের আর দেখি না।
এবং তারপর আমি তীর্থযাত্রা শুরু করি
প্রবল তুষারঝড় আমার মাথার ভেতরের সবকিছু
অবশ করে দিচ্ছে
কেউ যেন আলো নিভে দিচ্ছে
কাজুবাদামের গাছের নিচে।
কিন্তু পৃথিবী তার নিয়মেই চলছে, যেন কিছুই হয়নি, লজ্জাকর।
নিজের ওপর জোর খাটিয়ে আমি পরে বুঝেছি যে
চারিদিকে হেঁটে হেঁটেই ইতিহাস শিখতে হয়।
* jilguero- Europian goldfish bird, flamenco- ব্যাপক অর্থে এখন এটা দ্বারা স্প্যানিশ সংগীতের বিভিন্ন স্টাইলকে বোঝায়।
কার্লোস হুগো গ্যারিডো শালেনের কবিতার বিস্তৃত উঠোনে দাঁড়িয়ে সেই মায়াবী ভুবনের কুয়াশাময় দিগন্তের নন্দনবনের সুরভী পাওয়া যায়। কবিতা যে highest form of art এ কথা বার বার মনে হয় যখন কার্লোস হুগো গ্যারিডো শালেনের কবিতা পড়ি। কবি যখন নস্টালজিয়ায় ভোগেন, তখনো আমরা দেখি এমনসব চিত্রকল্প, এমনসব মেটাফরের মধ্য দিয়ে সুদক্ষ কারিগরের মতো তিনি যে জাল বুনে যান কবিতার, তা সত্যিই আমাদেরকে কবিতার নতুন সত্যের দিকে মনোযোগী করে। শেলী একসময় বলেছিলেন- poetry is something divine. কার্লোস হুগোর কবিতা পড়লে সেই কথা স্মরণে আসে। তাঁর কবিতা পড়ার সময় মনে হয় যে এক জোনাক-জ্বলা বিশাল ঘন অরণ্যের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, এ যেন ভয় ও আনন্দের যৌথ যাত্রা। ‘যে সব মৃতদের আমি এখনো খুন করতে পারিনি তারা জেদ করবে/ তারা তাদের উন্মত্ত হিংসায় আমাকে ধ্বংস করবে/ এবং তারা আমার বক্ষের কেন্দ্রভূমিতে একটি গর্ত করবে’ (কারণ গাংচিলগুলো তাদের উচ্চতায় ফিরে আসে)। কবিতা যদি এক গভীর চিন্তার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে এক নতুন দর্শনকে প্রতিফলিত করে যা আমাদের চমকে দেয়, তাহলে তা সত্যিকারের কবিতা হয়ে ওঠে। দেরিদা থেকে আমরা জানি ভাষা সেই সীমাহীন বেলাভূমি যেখানে বারবার সমুদ্রের ঢেউ এসে পড়ে আর রেখে যায় অনেক চিহ্ন, শঙ্খ-শামুক ও অনেক কিছু। ঐতিহ্য ও প্রাচীনপ্রত্নের রেখাচিহ্ন ভাষায় সংস্থিতি পায় কবিতার মাধ্যমে এবং কবিতা-ই সেই বেলাভূমে রেখে যায় অনেক চিহ্ন ও মণি-মুক্তো, যা ভাষার দিগন্তকে আরো বিস্তৃত করে, এগিয়ে যায় তার অনন্ত যাত্রায়।

কামরুল ইসলাম, জন্ম কুষ্টিয়া জেলার ফিলিপনগর গ্রামে। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। সর্বশেষ রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি একজন দ্বিভাষিক কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও ছোটগল্পকার।
কাব্যগ্রন্থ: দ্বিধাান্বিত সুখে আছি যমজ পিরিতে (১৯৯৯), ঘাসবেলাকার কথা (২০০১), যৌথ খামারের গালগল্প (২০০৬), সেইসব ঝড়ের মন্দিরা (২০০৮ ), চারদিকে শব্দের লীলা (২০১০), অবগাহনের নতুন কৌশল (২০১১), মন্ত্রপড়া সুতোর দিকে হাওয়া (২০১৪), দীর্ঘশ্বাসের সারগাম (২০১৬), বিহঙ্গখচিত লন্ঠন (২০১৭), নির্বাচিত কবিতা (২০১৯), কিছুটা ভোর, বাতাসের গদ্যসহ (২০২০, কলকাতা), আগাছার ইন্দ্রজাল (২০২১), গোপাল সাঁইয়ের কবিতা ( ২০২২)
ছোটগল্প: বিনির্মিত ভাসান, জল থেকে জলে ( ২০২০)
প্রবন্ধগ্রন্থ: কবিতার বিনির্মাণ ও অন্যান্য (২০০৯), রবীন্দ্রনাথ: বিচিত্রের দূত (২০১৩), কবিতার স্বদেশ ও বিশ্ব (২০১৫), কবি ও কবিতা: কবিতার আলো ও আঁধার (২০১৮), রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ (২০২১), কবিতার রংরক্ত, নিমগ্ন করতল (২০২৪)।