জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামি। তাঁর উপন্যাস, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প জাপান ও বিশ্বজুড়ে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। হারুকি মুরাকামির লেখা অনূদিত হয়েছে ৫০টি ভাষায়। এখানে তার একটি অনূদিত সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলো। এটি প্রকাশ করেছিল ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান। সাক্ষাৎকারটি ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাষান্তর করেছেন রবিউল কমল।
‘দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস সার্টেন ওয়ালস’ ১৯৮০ সালে আপনার লেখা একটি উপন্যাস। এত বছর পর কেন আবার নতুন করে লেখা হলে?
এটিই আমার একমাত্র লেখা, যা আমি কখনো বই আকারে পুনর্মুদ্রণ করতে দিইনি। অন্যভাবে বলতে গেলে, আমি এই গল্পটি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম না। আমার ধারণা ছিল এই থিমটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ওই সময়ে আমার মধ্যে লেখার দক্ষতার অভাব ছিল। মানে আমি যেভাবে ভেবেছিলাম, সেভাবে লেখার দক্ষতা আমার ছিল না। তাই আমি সময় নিয়েছি। যখন মনে হয়েছে, লেখক হিসেবে দরকারি দক্ষতা অর্জন করেছি, কেবল তখনই গল্পটি পুনর্লিখন করেছি।
এর মধ্যে আমাকে আরও অনেক কাজ করতে হয়েছে। তাই এই কাজটা শুরু করতে পারিনি। এই সময়ে ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে এবং আমি সত্তরের দশকে পৌঁছেছি। তাই আমি ভাবলাম, কাজটা করলে এখনই করা দরকার। কারণ পরে আমার কাছে এত সময় নাও থাকতে পারে। একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে আমার দায়িত্ব পালনের প্রবল প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম।
আপনি লকডাউনের সময় বইটি লিখেছেন। তার মানে তখন খুব কমই বাড়ি থেকে বের হতে পেরেছেন। এটা কি গল্পের ধারা বা বিষয়বস্তুকে প্রভাবিত করেছিল?
অবশ্যই, যখন আমি এই উপন্যাসটি লিখতে শুরু করি, তখন আমার নিরিবিলি পরিবেশ দরকার ছিল। পুরো প্লট নিয়ে চিন্তা করতে সময়ের প্রয়োজন ছিল। আবদ্ধ শহরের পরিস্থিতিও ছিল বিশ্বব্যাপী লকডাউনের মতোই। এই চরম বিচ্ছিন্নতা ও সহানুভূতি, উভয়ের সহাবস্থান কীভাবে সম্ভব? এটিই ছিল এই উপন্যাসের প্রধান থিম। সেই অর্থে বলতে গেলে, এটি মূল উপন্যাসের চেয়ে একটি ভালো অগ্রগতি ছিল।
কিছু জাপানি পাঠক বইটি পড়ে বিভ্রান্ত হয়েছেন। অনেকে আবার আপনার উপন্যাসের অদ্ভুত ও পরাবাস্তব উপাদানকে সবচেয়ে বড় আনন্দ বলে মনে করেন। আপনি কি পাঠকদের জন্য উত্তরহীন প্রশ্ন রেখে যেতে পছন্দ করেন?
আমি মনে করি একটি ভালো উপন্যাস কিছু জোরালো প্রশ্ন উপস্থাপন করে। তবে তাতে কোনো স্পষ্ট ও সহজ সমাপ্তি থাকে না। আমি আমার পাঠকদের চিন্তার জগতকে উন্মুক্ত রাখতে চাই- তারা আমার বই শেষ করার পরে যেন কিছু চিন্তা করে। যেমন, এখানে কি সমাপ্তি হবে? আমি প্রতিটি গল্পের মধ্যে তার কিছু ইঙ্গিত দিই, যেন তারা এই চিন্তা করতে পারে। আমি যা চাই তা হল, পাঠকরা এগুলো ঠিক করুক এবং প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব চিন্তার মাধ্যমে সমাপ্তিতে পৌঁছাক। অগণিত পাঠক আমাকে বলেছেন, ‘আপনার একই বই পড়ে আমি অনেকবার আনন্দ পেয়েছি। অনেক ভাবে চিন্তা করেছি।’ লেখক হিসেবে এর চেয়ে বেশি খুশির আর কিছু হতে পারে না।
স্যালিঞ্জার, ফিটজেরাল্ড, চ্যান্ডলার, কার্ভার ও ক্যাপোটের মতো অনেক ইংরেজি ভাষার লেখকের লেখা আপনি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছেন, তাদের মধ্যে কে আপনার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
আমি প্রত্যেক লেখকের দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছি। আমি ফিটজেরাল্ড ও ক্যাপোটের মেধা ও লেখার শৈলীর প্রতি খুব আকৃষ্ট, যদিও আমার নিজের স্টাইল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ব্যক্তিগতভাবে আমি চ্যান্ডলারের স্টাইল খুব পছন্দ করি।
৪০ বছরেরও বেশি সময় আগে আপনি লেখালেখি শুরু করেন। এই সময়ের মধ্যে জাপানি সাহিত্যের দৃশ্যপট কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং আপনি সেগুলো অনুভব করেন কিনা?
আমি মনে করি, আজকাল তরুণ লেখকদের মধ্যে সাহিত্য নিয়ে কোনো লুকোচুরি নেই। তারা আরও মুক্ত ও নমনীয় স্টাইলে কথাসাহিত্য লিখছেন। আমি সত্যিই এটাকে সাধুবাদ জানাই। যদিও আমার ক্ষেত্রে কেবল নিজস্ব স্টাইলে কাজ করে চলেছি। তবে আমি বলতে পারব না, সাহিত্যের এই দৃশ্যপটের পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক থাকতে পারে।
জাপান ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের পাঠকদের মধ্যে কী কোনো পরিবর্তন দেখেছেন এবং আপনি যত এগিয়ে যাচ্ছেন ততই কি লেখা সহজ বা কঠিন হয়ে উঠছে?
মনে হচ্ছে, জাপান ও বিশ্বজুড়ে আমার পাঠকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে এবং প্রায়ই এই সংখ্যা আমাকে চমকে দেয়। লাওসে একজন থাই পাঠক আমাকে হ্যালো বলতে থামিয়েছিলেন, ড্রেসডেনে একজন পাঠক ছিলেন আলবেনিয়ার এবং টোকিওতে একজন ইন্দোনেশিয়ান পাঠকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমার প্রায়ই মনে হয়, আমি আমার আসল সত্তা নই, বরং এক ধরণের কাল্পনিক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছি…
কিন্তু এগুলো উপন্যাস লেখাকে সহজ বা কঠিন করে তোলেনি। আমি কৃতজ্ঞ যে, এত মানুষ আমার বইগুলো পড়েন। এই সংখ্যা আমি কখনই প্রত্যাশা করিনি। সবাই আমার মতো আশীর্বাদপুষ্ট নয়।
বর্তমানে ব্রিটেনে বিক্রি হওয়া সব অনুবাদ কথাসাহিত্যের এক চতুর্থাংশ জাপানি কথাসাহিত্য। আপনি কেন মনে করেন, জাপানি কথাসাহিত্যের ব্যাপক আবেদন রয়েছে?
আমি জানতাম না যে, জাপানি উপন্যাস ব্রিটেনে এত জনপ্রিয়। এর কী কারণ সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। আপনি হয়তো ভালো বলতে পারবেন, আমিও জানতে চাই। আজকাল জাপানের অর্থনীতি ভালো যাচ্ছে না। তাই আমি মনে করি, এটা একটা ভালো ব্যাপার। কারণ সাংস্কৃতিক রপ্তানি অর্থনীতিকে এক ধরনের অবদান রাখতে পারে। যদিও সাহিত্য রপ্তানি খুব বেশি হয় না, তাই না?
২০১৭ সালে আপনার বইয়ের নারী চরিত্রের সমালোচনা করেছিলেন জাপানের নারী লেখক মিকো কাওয়াকাম। এটা পরবর্তীতে নারী চরিত্র লেখার ওপর কোনো প্রভাব ফেলেছে?
বছরের পর বছর ধরে আমার বইগুলো এত সমালোচিত হয়েছে যে, আমি মনে করতে পারি না- কোন প্রেক্ষাপটে সমালোচনা করা হয়েছিল। আমি এগুলো নিয়ে খুব একটা ভাবি না। মিকো আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি খুব চালাক-চতুর, তাই আমি নিশ্চিত- তিনি যে সমালোচনাই করুন না কেন, তার স্পষ্ট কোনো কারণ ছিল। কিন্তু সত্যি বলতে, তিনি ঠিক কী সমালোচনা করেছিলেন তা আমার মনে নেই। নারী ও আমার কাজের কথা বলতে গেলে, ঘটনাক্রমে আমার পাঠকরা প্রায় সমানভাবে পুরুষ ও নারী। এই ব্যাপারটি আমাকে খুব আনন্দিত করে।

রবিউল কমলের জন্ম বান্দরবানের আজিজনগরে। বেড়ে ওঠা একটি কৃষক পরিবারে, দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরাতে। পড়ালেখা ব্যবসায় প্রশাসনে। পেশা সাংবাদিকতা, কাজ করছেন দ্য ডেইলি স্টারে। ছোটদের জন্য লিখতে ভালোবাসেন, ঘুরতে পছন্দ করেন। স্বপ্ন দেখেন পথশিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য কাজ করার। মাদকবিরোধী একজন সক্রিয় কর্মী, এজন্য স্কুল জীবনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। রবিউল কমলের জন্মদিন ২৮ অক্টোবর, তিনি বৃশ্চিক রাশির জাতক। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সাত।