মূল: অজিত কৌর;
ইংরেজি : সুধীর; বাংলা : মজিদ মাহমুদ
এক উনুন-তপ্ত নীরবতা।
সূর্য আকাশের বুকে বাঁকানো ধনুকের মতো উল্টে আছে। সব কিছু জ্বালিয়ে খাক করে দিচ্ছে। যেন এক জ্বলন্ত চুল্লি।
অসহ্য গরম ও স্যাঁতসেঁতে আদ্রতা!
এমন তাতানো রোদ্দুর যে চারদিকে বোধহীন নিস্তব্ধতা। এমনকি চড়–ইয়ের কিচিরমিচির পর্যন্ত থেমে আছে। পাখিরাও ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত ও বাকহীন।
এমন এক ভয়াবহ গরমের বিকালে, সরাসরি তপ্ত আকাশের নিচে একটি লোক ক্ষেতে কাজ করছিল। খুব সাদামাটা ধরনের একজন কৃষক। জমিটিও খুব আহামরি নয় এবং গ্রামটিও ঠিক অন্য গ্রামগুলোর মতোই সাধারণ। সেখানে একটি ইট-সুরকির সেমি-পাকা বাড়ি। বাকি বাড়িগুলো রোদে-তাতানো মাটির তৈরি।
যাই হোক, এ সময়ে লোকটি তার জমি চাষ করার জন্য গ্রামের বাইরে ছিল।
‘আহ! কী অদ্ভূত পারম্পার্য, হে বিশ্বের স্রষ্টা! কেমন অদ্ভূত তোমার রীতি! এই দীর্ঘ সময় ধরে সূর্য এমন তাপ না দিলে গম কিছুতেই পাকত না। লাঙল চালানোর সময় মাটির উপর নিশ্চয় ঘামের ভারি ফোটা ঝরে পরে। মানুষের ঘামের ফোটা গমের দানার চেয়ে ছোট নয়। এই হলো সকল সৃষ্টির পথ। তুমি নিশ্চয় জানো, কারণ তুমিই তো সৃষ্টি করেছ এইসব নিয়ম। এরই মধ্যে কর্তনের সময় সমাগত, সূর্য তপ্ত লোহার মতো লাল দগদগে হয়ে উঠছে। শুধু কি লাল? না, প্রিয় মঙ্গল সিং, কেবল লাল নয়, উজ্জ্বল তপ্ত, গাঢ় কমলা রক্তবর্ণ লাল।’
এটাই তার অভ্যাস, যখন সে কাজ করে তখন সে নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলে; নিজের নাম ধরে ডাকে, মঙ্গল সিং। ‘ঠিক আছে চলো, এবার আমরা ¯œান করে আসি!’ কিংবা ‘¯œান করেই বা কি! পরক্ষণেই তো আমরা ঘামে ও ধূলোয় একাকার হয়ে যাব। আর তাই তো, মঙ্গল সিং, আমরা কোনো পূজা-আর্চি করতে পারি না।’
তার বড় ছেলে কারতার খুন হওয়ার পর সে শোকে-দুঃখে ভূপাতিত হয়ে পড়েছিল; যেভাবে একটি কর্তিত বৃক্ষ মাটিতে পড়ে যায়। মাটির উপর সটান শুয়ে মৃত বাহু দুটি প্রসারিত করে ছিল। মৃত! খালি মাটির উপর শুয়ে সে তেমনটিই বোধ করেছিল।
এই নিয়ে প্রত্যেকেই তার নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দাঁড় করায়। কেউ কেউ বলেছিল, পুলিশ তাকে গুলি করে মেরেছে; আবার অনেকেরই ধারণা সে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল, এবং তারাই তাকে শেষ করে দিয়েছে। পাশাপাশি, এ কথাও চালু আছে যে, পারিবারিক পুরনো শত্রুতার জের ধরে তাকে খুন করা হয়। আবার কিছু লোক বলে, মদ খেয়ে বাজারের মধ্যে মাতলামি করার সময় তার প্রতিপক্ষরা তাকে শেষ করে দেয়।
পুলিশের অনুমান একটু ভিন্ন রকম ছিল, কারণ কোনো রোমাঞ্চকর ঘটনাই হয়তো এ ধরনের ভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে।
শেষমেষ মঙ্গল সিং একদিন খাড়া হয়ে উঠলো, বললো, ‘এসো মঙ্গল সিং, কারতার যেহেতু এখন নেই। সম্ভবত সে আমার অতীত জীবনের সকল ঋণ পরিশোধ করে গেছে। সে তার মা ও আমার জন্য একমাত্র অবলম্বন ছিল। হিসাব যেহেতু পরিষ্কার হয়ে গেছে; সে যেহেতু তার নিজের পথে চলে গেছে। তখন তুমি হতাশ হয়ে বসে পড়লে বাকি পরিবারের জন্য কে খাবার জোগাড় করতে যাবে? ঈশ্বর? ঈশ্বর বিশ্রাম নিচ্ছেন, মঙ্গল সিং। তিনি তার নীলাভ স্বর্গে আরামসে ঘুমাচ্ছেন। দোলনায় দোল খাচ্ছেন, সে তোমার সাহায্যে আসবে না। ওঠো। কাজে যাও।
সে তা-ই করেছিল। এরপর আর সে কখনো থেমে যায়নি।
লোকে বলত সেই সময়ে তার আহত গোড়ালির কথা। মঙ্গল সিংয়ের ক্ষত আর কখনো পরিদৃশ্য হয়নি। তবে সে জানতো, চামড়ার নিচে সেই ক্ষতগুলো এখনো অক্ষত আছে। সামান্য আঁচড়েই সেখান থেকে পুনরায় রক্ত বের হতে শুরু করবে। নানা রকম চিন্তার দ্বারা সে নিজেকে অন্য মনস্ক রাখার চেষ্টা করত; কারণ অল্পতেই তার মৃত সন্তানের ব্যাথা তার মস্তিস্ক এলোমেলো করে দিতো। সে সর্বদা করতারের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে সব রকম চেষ্টা করত; তবু স্মৃতির অন্ধকার সুড়ঙ্গ দিয়ে সেই কণ্ঠস্বর ভেসে আসতো।
এটা ছিল নতুন ফসল চাষের মৌসুম। মাটিকে ওলোট-পালট নরম করার সময়। এর জন্য চায় কঠোর পরিশ্রম।
তবে প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ চলতো না; সে অনুভব করতো এক, কাজ করতো আরেক। সে নিজেকে বলতো, ‘মঙ্গল সিং! এই মন কি চায়? ঘোড়াকে স্বাধীনভাবে চলতে দাও! শক্ত করে লাগাম ধরে থাকো; এই যথেষ্ট!’
কিংবা বলবে, ‘মঙ্গল সিং, ঈশ্বরের কাছে তুমি কি পেতে চাও? তিনি তো এ ধারকা মাল ও ধার করেন। একখান থেকে তুলে, অন্যখানে লাগিয়ে দেন। এ কথাই তো দরবেশ বুল্লে শাহ ফকির বলেছিলেন, না কি?’
প্রকৃতপক্ষে সে কখনো ঈশ্বর নিয়ে ভাবত না। নিশ্চয় সে অন্য কিছু নিয়ে ভাবত, মঙ্গল সিংয়ের কাছে যার সমাধান ছিল। স্বর্গসুখ অনুভবের জন্য সে সৃষ্টি করেছিল, অনায়াস বিশ্রামের মধ্যে ঘুম। সে জেগে উঠতো যখন নরম কুয়াশার চাদর সরিয়ে দিয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়ে উঠতো, সূর্য পুনরায় আলো দিতে শুরু করতো এবং দূর দিগন্তে সাতটি রঙের শিল্পকর্ম দেখা যেতো।
বেবি (মা) বলতেন, ভগবান রঙধনু বানিয়েছেন, সুতরাং তিনিই এটি সঞ্চালন করতে পারবেন।
আসলে সে খুব একটা ঈশ্বরের কথা বলতো না; বিশেষ করে কারতার খুন হওয়ার পর থেকে। ভগবান যদি সত্যিই থাকতেন তাহলে তার হিসাবে এমন ভয়ঙ্কর গোল বাঁধত না। তাছাড়া কারতারের মতো এক যুবক পোলা, জীবনের বাইশ বসন্ত না পেরুতেই কিভাবে খুন হতে পারে? এমনকি মাঝে মাঝে পাতওয়ারি গ্রামটির হিসাবও এলোমেলো হয়ে যায়; আর জনৈক মঙ্গল সিং, যার স্বর্গের আকাশের পুরোটা জুড়েই তার হিসাবের খাতা! সবটা পূর্ণ হয়ে গেলে সে কি করবে? সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে মঙ্গল সিং!
সেটাই সম্ভবত সে চেষ্টা করছে। অন্যথায় সে আর কি করতে পারে মঙ্গল সিং? সাতরঙা রঙধনুর দোলনায় দোল খাওয়া, শাদা মেঘের নরম বিছানায় রাজার মতো ঘুমিয়ে থাকা, আর নীল আকাশে পায়চারি করা ছাড়া কি-ই বা করার আছে তার? যদি এই তপ্ত বিকালের মাঝখানে তাকে লাঙল চালানোর কাজ করতে হতো, তাহলে এই ক্ষুদ্র তৃণরা টের পেত আসলে কি ধরনের পৃথিবীতে তারা জন্মেছে; আর তার জন্যই বা এমন কি কৃতিত্ব হতো!
লাঙল বাওয়ার সময় বলদ দুটিকে উৎসাহ দেয়ার জন্য সে মুখ দিয়ে, দাঁত ও ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে চুকচুক শব্দ করছিল; এবং প্রত্যেকবারই সে তাকিয়ে দেখছিল গ্রাম থেকে চলে আসা ধূলোধূসরিত রাস্তাটি। হ্যা, দিনের এই সময়, পথ সর্বদা গ্রাম থেকে এখানে চলে আসে। আবার সন্ধ্যার সময় একই পথ গ্রামে ফিরে যায়।
‘বসন্ত কাউর আজ দীর্ঘ সময় ধরে খাবার আনা নিয়ে কথা বলছিল। আমি ভীষণ তৃষ্ণার্ত, যেন আমার কণ্ঠে কণ্টক কীকার জন্মাচ্ছে। পানি ঢাললেও তাতে লাভ হবে না, আমার পাকস্থলি এখন জ্বলন্ত চুল্লি, বিদ্যুতের মেঘের মতো মুহূর্তে বাষ্প হয়ে যাবে। ফলে আমি কিছুই খেতে পারব না! আর তখন বাসন্তি আমাকে পুরোপুরি দোষী ঠাঁওরাবে- আমি অনেক ঝামেলায় আছি..’ সে দোষ দেবে ও রাগ করবে।
ঠিক তখনই সে দূরে, অনেক দূরে পায়ে চলা পথের দিকে তাকিয়ে সচকিত হয়ে উঠলো, সেটি অবশ্য গ্রামের দিকে নয়; বরং বিপরীত দিকে চলে গেছে। বাইরে থেকে গ্রামের দিকে আসছে।
‘লোকটি কে হতে পারে মঙ্গল সিং, যে এই উত্তপ্ত রৌদ্রের মধ্যে এদিকে হেঁটে আসছে?’
সে কি কোনো আগন্তুক? আগে মানুষ দূরে থেকে কাউকে আসতে দেখলে খুব কৌতূহলী হয়ে উঠতো। শিশুদের মতো কৌতূহলী ও আনন্দিত হয়ে উঠতো। তারা খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইত, কে আসলে তাদের গ্রামে বেড়াতে এসেছে। সে যারই অতিথি হোক, মামা, চাচা, ভাই যেই হোক না কেন। কিংবা কোনো নতুন বধূর বাপের বাড়ির দিককার কোনো আত্মীয়। সে যারই অতিথি হোক না কেন তাতে কিছু এসে যায় না। পরিচিত না হয়ে তার উপায় ছিল না; তাকে টাটকা শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো।
অথচ সময় কিভাবে পাল্টে যায়! এখন কোনো অপরিচিত লোকের ছায়া দেখলেও মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। মনে হয় সে যেন সাক্ষাৎ সন্ত্রাস! একজন মানুষকে দেখে মানুষ কিভাবে ভীতগ্রস্ত হয়! ‘মঙ্গল সিং! একটি সিংহ অন্য সিংহকে হেঁটে আসতে দেখলে ভয় পায় না; এমনকি সে যদি তার চেয়ে দশগুণ বড়ও হয়। অথচ মানুষ পায়.. .!’
এতক্ষণে দূরে দেখতে পাওয়া মানুষের আকার আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দূরের সেই আবছায়া আলোতে চলে আসছে।
মানুষটি পুরনো দিনের ঢঙে জুট্টিস পরে আছে, তার পা ময়লা ও ধূলি-ধূসরিত। তার প্রতি পদক্ষেপে কিছুটা ধূলি বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। একটি পদক্ষেপের পর আরেকটি পদক্ষেপ ফেলার সময় ধূলোগুলি তাকে অনুসরণ করছে। দেখে মনে হচ্ছে সে অনেক দূর থেকে হেঁটে আসছে। তার পদচ্ছাপ বেশ ভারি, যদিও সে ক্লান্ত। প্রতি পদক্ষেপের সাথে তার গতির জড়তাও বেড়ে যাচ্ছে।
তার পরনের কুর্তা-পাজামা ধূলায় ঢেকে গেছে। সে অযত্নের তার মাথায় একটি পাগড়ির মতো কাপড় বেঁধে রেখেছে। আর তার ঘাড়ের উপরও পুটলির মতো কিছু একটা আছে! সম্ভবত সে ক্ষুদ্র-ব্যবসায়ী, ফেরিওয়ালা। দেখে মনে হয় সে শহর থেকে কিছু মনোহারি জিনিসপত্র কিনে কাছের গ্রামগুলোতে পায়ে হেঁটে বিক্রি করে। সম্ভবত তার এই কাপড়ের মোটা পুটলিটা দিনে রোদের তাপ থেকে রেহাই পেতে ব্যবহৃত হয়; আর রাতে মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে থাকার কাজে।
তার মাথা এমনভাবে নিচু হয়ে আছে দেখে মনে হয় সে যেন প্রতি পদক্ষেপে তার দূরত্ব মাপছে। সে তার পদক্ষেপগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে; আর ধূলো উড়াচ্ছে। তার হাতে শক্ত কাঠের হাতলের একটি খোন্তা; মনে হয় সে এ দিয়ে মাটি খুড়বে। তার মুখের চামড়া গভীরভাবে ভাঁজ হয়ে আছে। তাকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে; খেয়ালি সময়ের অনেকখানি সে পার করে এসেছে।
তাকে দেখে মঙ্গল সিংয়ের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, কিছুই বলবে না; সে যে পথে আসছে সেই পথেই চলে যাক। ‘সে যেই হোক না কেন, তা জেনে আমার কি! আমরা খুব খারাপ সময় পার করছি মঙ্গল সিং! কে জানে সে কে! কে বলবে তার পুটলির মধ্যে এ.কে-ফোর্টি সেভেন রাইফেল লুকিয়ে নেই? তার পরিচয় নিয়ে লাভ নেই মঙ্গল সিং; সব মানুষ আজ একা হয়ে গেছে; তাকে চলে যেতে দাও, মঙ্গল সিং।
লোকটি আরো কাছে এসে, মঙ্গল সিংয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
তার দৃষ্টির প্রখরতা এতই তীক্ষè ছিল যে মঙ্গল সিং তাকে উপেক্ষা করতে পারল না।
সে খুব মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘একটু পানি হবে?’ তার কণ্ঠস্বর ছিল খুব গভীর ও নিখাদ। সম্ভবত সে দুর্বল ছিল, আবার এমনও হতে পারে তার কণ্ঠনালিতে কোনো কিছু ঢুকেছিল।
সেখানে শিশাম গাছের তলে একটি গোলাকার মাটির পাত্র কাঠের গুড়ির ওপর বসানো ছিল। মঙ্গল সিং লাঙ্গল চালানো বন্ধ করলো। সে বলদ দুটোকে জোয়াল থেকে মুক্ত করলো এবং দড়ি খুলে দিল। সে গরুগুলোকে খেদিয়ে নিয়ে গাছের নিচের ছায়াতলে গিয়ে বলল, ‘এ দিকে এসো বাপুজি।’এখানে পানির ঘাটতি নেই। তোমার ইচ্ছে মত পান করতে পারবা।
মঙ্গল সিং নিজে নিজে ভাবল, ‘বেশ তো সে দ্রুত জল খেয়ে যেখানে যাচ্ছিল সেখানে চলে যাক।’
নরম চষা মাটির উপর পা ফেলে বৃদ্ধ লোকটি গাছের ছায়ায় চলে এলো। মঙ্গল সিং কলস থেকে একটি বাটিতে জল ভরে তার দিকে এগিয়ে দিল। এ সময় সে বৃদ্ধ লোকটির বুকের কাছে চেপে ধরা পুটলির দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো।
মঙ্গল সিং অনুভব করলো সে গভীরভাবে তার বুকের কাছে পুটলিটি ধরে রেখেছে। ঠিক তেমন করে যেমন সে তার মৃত পুত্র করতারের নশ্বর দেহের অবশিষ্ট ছাইভস্ম রাখা থলিটি বুকের কাছে চেপে ধরে করতারপুর সাহিবে গিয়েছিল। কে জানে, হয়তো বৃদ্ধ লোকটির দশাও তার মতো..। সে তার হৃদয়ের করুণা অনুভব করলো।
অকস্মাৎ এক সর্বগ্রাসী ভয় তাকে পেয়ে বসলো। ‘মঙ্গল সিং, তার থলিতে বিস্ফোরক দ্রব্যও তো থাকতে পারে!’
সে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। সম্ভবত বসন্ত কাউর যাত্রার সময় কিছু খাবার বেঁধে দিয়েছিল। হয়তো সে মিসি পরাটা দিয়েছিল তার ক্ষুধার সময় খাওয়ার জন্য। আর সে যদি মিসি পরাটা দিয়ে থাকে তাহলে সেগুলোর সঙ্গে আমের তৈরি আচারও দিয়ে থাকবে।
‘শোন মঙ্গল সিং, এ দুনিয়ায় আর কেউ নেই যে বসন্ত কাউরের চেয়ে ভালো রাঁধতে পারে। এই দুনিয়ায় কি আর কোনো মেয়ে মানুষ আছে যে গম ও বুটের আটার সঙ্গে মাখন মিশিয়ে এমন পরোটা বানাতে পারে? কে এমন আছে যে এর সাথে মসলাযুক্ত আমের আচার করতে পারে। সে এর মধ্যে চুল্লির উপর বসন্ত কাউরের পরোটা ভাজার সুঘ্রান কল্পনা করতে শুরু করেছে।
কিছু মনে করব না। বৃদ্ধ যদি এখানে এই গাছের নিচে তার খাবার খেতে চায়, তাহলে তাকে বাসন্তির আনা লাচ্ছি খেতে দেব। তাহলে আমাদের বিষয়টি তার জন্য একটি স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। এভাবে তার মাথায় অসার সব যুক্তি পেয়ে বসল।
মঙ্গল সিং, সে যদি পাঞ্জাবি না হয় তাহলে কি হবে! তার পোটলার ভিতরে মিসি দিয়ে তৈরি রুটির বদলে আগুনে ভাজা ছোলা, মুড়ি কিংবা রান্না করা ভাতও হতে পারে, কে জানে আরো কত কি আছে এর ভেতর।
আমি তার মুখ দেখে সঠিক বলতে পারছি না কোথা থেকে এসেছে সে। ঠিক আছে, কিন্তু তাতে কি এসে যায়…? যদি তিনি একজন বহিরাগত হন, তবে কেন তিনি পাঞ্জাবের ধূলোভরা গ্রাম্য রাস্তায় ইতস্তত বিচরণ করছেন?
যেখানে ভরদুপুরেও বিপদের আশঙ্কা বিরাজমান; এই বিপদ থেকে কেউ মুক্ত নন… এমনকি বিহারি দিনমজুরেরা পাঞ্জাব ত্যাগ করা শুরু করেছে…। অন্যদিকে লোকটিকে কোন ধরনের দৈহিক শ্রমদানে সক্ষম বলেও মনে হচ্ছে না। এই বয়স তো তার নিজের গৃহের আঙ্গিনায় পাতা চারপাইয়ার উপর বসে সময়কে উপভোগ করার কথা। একটা অপরিচিত ও আতঙ্কগ্রস্ত এলাকায় তার কালাতিপাত করার উপযুক্ত সময় নয় এটা।
এতক্ষণে বসন্ত কাউর তার সামনে একটা গোলাকার রুটির ঝুড়ি ও ছোট লাচ্ছির পাত্র রেখেছে। বিভিন্ন চিন্তায় মগ্ন হয়ে মঙ্গল সিং বুঝতেও পারেনি কখন বসন্ত কাউর এসেছে অথবা কখন সে এসে তার পাশে বসেছে। বসন্তও বৃদ্ধ লোকটির দিকে তাকিয়েছিল।
মুষ্টিবদ্ধ হাতের এক ঘায়ে মঙ্গল সিং পিয়াঁজকে দুভাগ করল। পুরাতন ও জীর্ণ কিন্তু ধুয়ে পরিষ্কার করা এক টুকরা কাপড়ের ভিতর থেকে মঙ্গল সিং রুটিগুলোকে বের করল। আচারের সুগন্ধ বের হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল।
মঙ্গল সিং দুটো রুটি বের করে পিয়াজের অর্ধেকটা ও এক দলা আচার তার উপরে রেখে রুটি দুটোকে বৃদ্ধ লোকটির দিকে ধরল। বৃদ্ধ লোকটি চুপচাপ সেগুলোকে গ্রহণ করলেন এবং ছোট ছোট টুকরো করে খাওয়া শুরু করলেন।
সমস্যা ছিল একটি মাত্র তামার পাত্র; যেটি মাটির তৈরি পানির পাত্রের উপর মুখ উল্টো করে রাখা ছিল; এই পাত্রে ইতোপূর্বে বৃদ্ধ লোকটিকে পানি দেয়া হয়েছিল। বসন্ত কাউর পাত্রটিকে এবার লাচ্ছি দিয়ে ভরে বৃদ্ধ লোকটিকে দিল। সম্পূর্ণ লাচ্ছি শেষে না হওয়া পর্যন্ত বৃদ্ধ গড়গড় করে পান করে চলল।
বৃদ্ধ লোকটি তৃপ্তিসহকারে মৃদু হেসে বললেন, “মঙ্গল সিং, শুষ্কগলা বাচ্চা ও বৃদ্ধ উভয়ের নিকটেই সমান সমস্যা।”
পরক্ষণে বসন্ত কাউর অল্প জল দিয়ে পাত্রটিকে ধূয়ে ফেলল এবং তাতে পুনরায় লাচ্ছি দিয়ে পূর্ণ করে মঙ্গল সিংয়ের সামনে রাখল। একবারেই মঙ্গল তা গিলে ফেলল। লাচ্ছির ঘাটতি যেন না পড়ে সেটি নিশ্চিত করার জন্য বসন্ত কাউর আলাদা পাত্রে খানিকটা জল মিলিয়ে পান করল।
খাওয়ার সময় বৃদ্ধ লোকটি মঙ্গল সিং বা তার স্ত্রীর দিকে একটিবারও তাকাননি। বসন্ত নিশ্চিতভাবেই হয়ত ভেবেছে যে বৃদ্ধ লোকটি তার স্বামীর পূর্ব পরিচিত। কারণ, সে সেখানো পৌঁছে দু’জনকেই গাছের ছায়ায় বসে থাকতে দেখেছিল।
দুজনের খাওয়া শেষ হলে, বসন্ত বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। বৃদ্ধি লোকটি তার পোটলাটি শরীরের সাথে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ও মাটির দিকে তাকিয়ে গাছের নিচেই বসে থাকলেন। মনে হচ্ছিল, তিনি যেন শক্ত মাটিতে হেঁটে চলা পিঁপড়াদের সংখ্যা গুণছেন।
এবার মঙ্গল সিং নীরবতার ইতি টালল এবং বলল আপনি বিশ্রাম নিতে চাইলে আমি গাছের ছায়ায় চাদর পেতে দিতে পরি?
লোকটি নিশ্চুপ থাকলেন। মঙ্গল সিং বৃদ্ধ লোকটির মৌনতাকে সম্মাতি হিসাবে ধরে নিল। সে একটি মোটা চাদর ঠিক গাছের ছায়ায় পেতে দিল। বৃদ্ধ লোকটি উঠে দাঁড়ালেন। যথাযথ সতর্কতার ও ভক্তির সাথে পোটলাটিকে চাদরের উপর রাখলেন। দেখলে কারো মনে হতে পারে যে, পোটলার ভিতর ভঙ্গুর কোন কিছু রয়েছে। এরপর তিনি চোখ বন্ধ করে পোটলার উপর মাথা রেখে শায়িত হলেন।
“বেচারা! তাকে খুব পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছে” মঙ্গাল সিং চিন্তা করল।
মঙ্গল সিংয়ের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, “ক্লান্ত ও অবসন্ন বেচারা। ওকে ঘুমুতে দেওয়া দরকার। “কিন্তু পরক্ষণে হঠাৎ তার মনে হল সে, লোকটির পোটলার ভিতরে বিপদজনক কিছু থাকতে পারে। এগুলো বোমাও হতে পারে! সে জন্যই হয়েতো তিনি খুব যত্নসহকারে সেটিকে মাটিতে রেখেছেন!
মঙ্গল প্রশ্ন না করে পারল না। “আপনি কোথা থেকে এসেছেন, বাপুজী?
বৃদ্ধ লোকটি তার চোখ মেলল। তার চোখ হাজার বছরের পুরান হতাশা বিজড়িত। তবুও সেখানে অদ্ভূত এক ধরনের সম্মোহনী শক্তি বিদ্যমান, অদ্ভূত ধরনের তাপহীন প্রভা বিরাজমান। এটি অনেক দূরে অন্ধকারের কোটর থেকে নির্গত লণ্ঠনের মৃদু আলোর মত মনে হয়।
দীর্ঘক্ষণ নীরবে তার দুঃখ জাগানিয়া চোখ দিয়ে তিনি তাকিয়েছিলেন মঙ্গল সিংয়ের দিকে। আর সেই চোখ থেকে অহর্নিশ অস্থির প্রভার বিচ্ছুরণ ঘটছিল। মঙ্গল সিং এবার প্রশ্ন করল “কোথায় যাচ্ছেন?”
“কোথাও নয়,” লোকটি বললেন।
মঙ্গল প্রত্যুত্তরে বললেন “কিন্তু যিনি মধ্যাহ্নের গনগনে সূর্যের মধ্যে পা বাড়ান তবে বুঝতে হবে তিনি কোথাও না কোথাও যাচ্ছেন।”
মঙ্গল সিংয়ের মনে বিস্ময় এবং সন্দেহের দানা বেঁধে উঠছিল।
“তেমন কোথাও নয়। এমনিতেই বেরোলাম। আমার খুব অস্থির লাগছিল তাই বেরিয়ে পড়েছি।”
“কোন জায়গার উদ্দেশ্যে রেরোলেন”?
“কোথাও নয়! এমনিতেই.. . আমাকে শেষ পর্যন্ত ত্যাগ করতেই হলো এবং চলে আসলাম!”
তার কণ্ঠস্বরে এক ধরনের ক্লান্তি তাড়িত আত্মসমর্পনের সুর।
“হে শ্রদ্ধাষ্পদ, আপনার নাম জানতে পারি?”
“নাম!”
“হ্যাঁ, আপনার নাম!”
“আমার নাম “ঈশ্বর।”
গোঁফের নিচে আত্মগরিমাযুক্ত হাসি দিয়ে মঙ্গল চিন্তা করল। “মঙ্গল সিং, রৌদ্রের মধ্যে হেঁটে হেঁটে বৃদ্ধ লোকটির মতিভ্রম হয়েছে!”
কিন্তু মঙ্গল আবরো সোজাসুজি জানতে চাইল, “ঈশ্বর আপনার নাম?”
“হ্যাঁ, ঈশ্বর।”
“ঈশ্বর, যার অপর নাম বাহিগুরু অর্থাৎ যিনি নির্বাণ লাভ করেছেন”
“তুমি আমাকে যে কোনো নামে ডাকতে পার। আমিই সকল কিছুর স্রষ্টা ও প্রভু”
“তাহলে, হে ঈশ্বর, আপনি এই ধূলোমাখা অভিশপ্ত স্থানে কি করছেন?”
“এমনিতে!” “বৃদ্ধি লোকটি হেলাফেলার ছলে কাঁধ ঝাকিয়ে বললেন, আমি অস্থির হয়ে পড়েছিলাম, তাই কিছু সময়ের জন্য বেরিয়ে পড়লাম।”
“আপনার কিছু সময় আলাদা করা দরকার? কার কাছ থেকে? আপনার কাকে জিজ্ঞাসা করা দরকার?”
“নিজেকে। আর কাউকে নয়!” বৃদ্ধ লোকটি অস্ফুট স্বরে অনিচ্ছুকভাবে বললেন। তার কণ্ঠস্বর ক্লান্ত শোনালেও খবুই পরিষ্কার।
“ঈশ্বর? মঙ্গল সিং, এটা কী হতে পারে! সৃষ্টিকর্তা তো অন্তরীক্ষে বিলাস ব্যসনে বসবাসে করেন। ভগবান নক্ষত্রের মধ্যে দিয়ে চলাচল করেন। ভগবান তো তিনি যিনি সূর্য ও চাঁদকে জ্বলতে সাহায্য করেন। ঈশ্বর তো তিনি যিনি রংধনুর সাত রংয়ের রাঙ্গা দোলনায় অনবরত দোল খান! এই লোকটি কী আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে! ” এই সমস্ত চিন্তা মঙ্গল সিংয়ের মনে বুদ্বুদের মত জেগে উঠেছিল, পরক্ষণে বিদায় নিচ্ছিল।
মনে হচ্ছিল স্বয়ং ঈশ্বর যেন মঙ্গল সিংয়ের হৃদয় দেখছেন। বৃদ্ধ লোকটি বললেন, আমি তোমাকে বোকা বানচ্ছি না। সত্যিই আমি ঈশ্বর। আমি কেন পৃথিবী সৃষ্টি করেছি সেটা ভেবে বিস্মিত হচ্ছি।
এখানে অনিয়ম মাৎসন্যায় চলছে। বিশ্ব তৈরির মূহূর্তে এরকম আমি চিন্তাও করিনি। আমি এক রকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছি, সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। যাদেরকে আমি আমার প্রতিরূপ হিসাবে গড়তে চেয়েছি তারা এখন কেমন দানবে পরিণত হয়েছে। আমি আর একাকিত্ব সহ্য করাতে পারছি না। হতাশায় নিমজ্জিত একজন মানুষের থেকে ভয়াবহ আর কিছু নেই। আমার ক্ষেত্রেও সেটি সত্য। চোখের জল তার কণ্ঠস্বরকে ভারাক্রান্ত করে তুলল।
“আমি! ঈশ্বর!”
“কিন্তু, ঈশ্বর মহাশয়, আপনি যদি এগুলো বোঝেন তাহলে আপনিতো আপনার ক্ষমতাবলে তাদেরকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে পারেন। আপনার ছুটি নেওয়ার দরকার কী?”
“না, আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তারা আমার নাম ভাংগিয়ে একে অপরকে হত্যা করছে। তাই আমি চিন্তা করলাম যে আমি যদি পৃথিবী ছেড়ে দেই তাহলে আর কোন সমস্যা থাকবে না। তারা একে অপরকে আমার নামে হত্যাও করতে পারবে না।
এই হত্যা কি থামবে? মানুষের স্বজাতি ধ্বংস করার পাগলামো কী কখনও বন্ধ হবে না?
“কে জানে!’’ ঈশ্বর খুব নিচু স্বরে বললেন। তিনি হতাশা সূচক ভঙ্গি করলেন।
মঙ্গল সিং চিন্তা করল যে লোকটির সম্পূর্ণভাবে হতাশাগ্রস্ত ও উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়েছে। আপনার বাড়িতে অতিরিক্ত বিছানা আছে কি? আমি আপনার উঠানে থাকব। সকালবেলা, আমি বের হব।”
“কিন্তু, এখনো আমার অনেক কাজ বাকি আছে। আমার জমি চাষ শেষ করতে হবে।
“মনে কিছু করবেন না, জনাব! তোমার কাজ করতে থাক। শিসাম গাছের নিচে বসেই আমি তৃপ্তি পেলাম। আমি স্বল্প সময় ঘুমিয়ে তোমার বাড়িতে যাব।”
মঙ্গল সিং কিছু বুঝে উঠতে পারল না। সে উঠল। সে তার গরুগুলোকে মৃদু গতিতে বয়ে চলা নদীটির দিকে নিয়ে যেতে লাগল। গরুগুলো তাদের উদর পূর্তি করে পান করল। মনে হচ্ছিল তাদের উন্নত শিংগুলো সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করছে।
এরপর সে তাদের খাওয়ালো। নিজের সাথে কথা বলতে বলতে জমি চাষ করতে থাকল।
মঙ্গল ভাবল যে, শিশাম গাছের নিচে বসে থাকা বৃদ্ধ লোকটি হয়ত একজন মানসিক রোগী যাকে তার সন্তান, তাদের স্ত্রীরা অপমান ও উপেক্ষার পাত্র করেছে, অথবা লোকটি একজন সন্ত্রাসীও হতে পারে।
মঙ্গল সিং নিজেকে নিজে বলল, “কেন নয়! সে তো সন্ত্রাসীদের চরও হতে পারে। হতে পারে। হতে পারে অস্ত্রবহনকারীও! বোমা বহনকারী হতে পারে! কিন্তু তার চোখে অমন আকর্ষণীয় সরলতা কেন? আমি কেন তাকে বিশ্বাস করতে চাই না?”
সূর্য দিগন্তের নিচে গিয়েছে। সে তার গরুগুলোর জোয়াল খুলল। মঙ্গল নিজের ঘাড়ে জোয়ালটিকে রেখে বৃদ্ধ লোকটিকে বললেন, “আমাদের এখন যাওয়া উচিত। সন্ধ্যা খুব শিগগির ঘনিয়ে আসবে। সময় খারাপ। দ্রুত বাড়ি যেতে হবে।
লোকটি তার জুতো পরে নিল। কাঁধে কাপড় গুটিয়ে নিল। পোটলাটিকে তার বুকের মধ্যে আগলে রেখে মঙ্গল সিংয়ের সাথে হাঁটতে লাগল।
মঙ্গল সিং চিন্তা করেই চলল। সে ভাবল লোকটি একজন গুপ্তচর অথবা সন্ত্রাসী হতে পারে। তাকে বাড়ি নেওয়া ঠিক হবে কিনা? “সময় সত্যিই খারাপ। এ রকম সময়ে মানুষের সন্ত্রস্ত ও সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক।
বৃদ্ধ লোকটি বলে উঠল। “তুমি কি আমার কাছ থেকে পরিত্রাণ চাও? তুমি কি আমার জন্য সন্ত্রাসী ও পুলিশের ভয় পাচ্ছে? আমি দুঃখিত। আমি এখন কাউকে কিছু দেওয়ার মত অবস্থানে নেই। আমি সময়ের কাছে থেকে ছুটি নিয়েছি। আমি ছুটিতে আছি।’
হতবিহ্বল হয়ে মঙ্গল সিং বলল, “অদ্ভুত ব্যাপারতো,” সে আমার মনের কথা বুঝল কি করে?
বসন্ত কাউর অতিথিকে দেখে কোনো কথা বলল না। এই অতিথিকে সে বিকালে দেখেছে। শুধু ময়দার পরিমান বাড়িয়ে নিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করতে লাগল।
বাড়িতে আগত অতিথির সেবা করে ও খাইয়ে তারা সবাই খুব খুশি হল। বাড়ির আঙ্গিনায় বিছানা পাতা হল। তার উপর চাদর বিছানো হল। বৃদ্ধ লোকটি তার জুতা খুলে ঝেড়ে মুছে বিছানায় নিচে রাখলেন। তারপর তিনি পোটলাটিকে সোজা করে ধরলেন। আলতোভাবে ঝাকালেন এবং বিছানার এক প্রান্তে রাখলেন। পোটলার উপর মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লেন।
মঙ্গল সিং নরমভাবে বৃদ্ধ লোকটিকে বলল, আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি যদি অন্য কিছু মনে না করেন?
“কি?”
“আপনার পোটলায় এমন কি আছে যেটি আপনি এক মুহুর্তের জন্যও হতছাড়া করছেন না?”
লোকটির মুখে আলতো হাসি দ্যাখা গেল। তার চোখ আরো বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার গলার স্বর মধুর হয়ে উঠল। সেটি খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। মিষ্টি ও নরম হয়ে উঠল।
“পোটলার ভেতর তেমন কিছু নেই। অল্প কিছু নক্ষত্র, এক টুকরো মেঘ, সকাল বেলার পাখির গুঞ্জন, নতুন গজিয়ে ওঠা কুঁড়ি, সবুজ ঘাসের পল্লব ও শিশিরের সামান্য শব্দ। নদী ও ঝরনা থেকে আঁজলায় তুলে আনা জল, দোলনায় থাকা শিশুর প্রথম ওঁয়াও শব্দ, আর কিছু স্বপ্নÑ এসবই এর ভিতর বর্তমান। আমি ভেবে দেখেছি যে, এগুলোকে অন্তত আমার রক্ষা করা দরকার।”
এরপর তিনি চোখ বুজলেন। তার মাথাকে আরামদায়কভাবে পোটলার উপর রাখলেন এবং ঘুমিয়ে পড়লেন।