নজরুলের বীররসের গান : বাঙালির বীর হয়ে ওঠার মন্ত্র

বাঙালি জাতির আলসেপনা, ভীরুতাপপ, উদ্যোগহীনতা, দাস্যসুখে হাস্যমুখ স্বভাব দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গভীর কষ্ট পেয়েছিলেন এবং নিবিড় দুঃখভরা মনে লিখেছেলেন “দুরন্ত আশা” শিরোনামের একটি কবিতা যার কয়েকটি পঙক্তি এমন: “ ভদ্র মোরা, শান্ত বড়ো,/ পোয-মানা এ প্রাণ/ বোতাম-আঁটা জামার নীচে/  শান্তিতে শয়ান।/ দেখা হলেই মিষ্ট অতি, /মুখের ভাব শিষ্ট অতি,/ অলস দেহ ক্লিষ্টগতি, / গৃহের প্রতি টান—/ তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু/ নিদ্রারসে-ভরা,/ মাথায় ছোটো বহরে বড়ো বাঙালিসন্তান।/ ইহার চেয়ে হতেম যদি/ আরব বেদুয়িন!/ চরণ-তলে বিশাল মরু / দিগন্তে বিলীন। ছুটেছে ঘোড়া, উড়েছে বালি, /জীবন-স্রোত আকাশে ঢালি/ হৃদয়-তলে বহ্নি জ্বালি /চলেছি নিশিদিন—/ বর্‌শা হাতে, ভর্‌সা প্রাণে,/ সদাই নিরুদ্দেশ/ মরুর ঝড় যেমন বহে/ সকল-বাধা-হীন।”

বাঙালি জাতির সৌভাগ্য যে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই  আবির্ভাব ঘটে চিরতারুণ্য, অফুরন্ত যৌবন ও অসম সাহসের অভিযানপ্রেমিক কবি কাজী নজরুল ইসলামের। কাজী নজরুল ইসলাম যৌবনের কবি, বীরত্বের কবি, বিদ্রোহের কবি, সংগ্রামের কবি, যুদ্ধের কবি এবং প্রেম ও শান্তির কবি। তাঁর চিরবিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় যে-আমি এর স্ফুরণ তা বীর আমি। সেই আমি বীররসে বীর, প্রেমরসেও বীর। সে বিশ্ববিজয়ী; আবার আত্মবিজয়ীও। বাঙালি জাতির যুগ যুগের ভীরুতা, অলসতা, অভিযানবিমুখতা দূর করে ‘বিদ্রোহী ’ সর্বজয়ী পরিপূর্ণ বীর। সে সংগ্রামকে ভয় পায় না; সে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভীত নয়। সে বৈরী সবকিছুর সাথে যুদ্ধ করেই বীরদর্পে বিরাজ করার ক্ষমতার অধিকারী। নজরুলের বীররসের গান রচনা করে জানিয়ে দিলেন যে এখন থেকে বাঙালির কণ্ঠে শুধু শান্ত-করুণ রসের বাউল গান, লোকগান, মেয়েলীগীত উচ্চারিত হবে না, সংগ্রামের আগুনঝরা বীররসের গানও উচ্চারিত হবে।

রবীন্দ্রনাথে উপরিউক্ত কবিতার বরাতে ধরেই বলা যায়, স্বভাবগতভাবে বাঙালি কিছুটা আরামপ্রিয়, আয়েশী জাতি। বাউল গান তার এতটা প্রিয় হওয়ার এটি অন্যতম কারণ। অভিযান, অ্যাডভেঞ্চার, এসব তার স্বভাববিরুদ্ধ। একারণে বাঙালি বারবার বহিরাগত শক্তি দ্বারা নিজদেশে শাসিত হয়েছে কিন্তু সে কখনো অন্যদেশ অভিয়ানে যায়নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে তাকে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়েছে, একথা সত্য কিন্তু তার বীরত্বের ইতিহাস নেই বললেই চলে। বঙ্গদেশে যুগযুগ ধরে প্রচলিত বাউল গান, ভাটিয়ালি গান, ভাওয়াইয়া গান, জারি-সারি গান, আলকাপ, গম্ভীরা, ঝুমুর, ঝাপান প্রভৃতি গানে বীররসের কোনো উপাদান নেই। পরাধীন ভারতে জন্মগ্রহণ করেও নজরুল ছিলেন স্বাধীন কবি, স্বাধীন মানুষ। ব্যতিক্রমী বাঙালি হয়ে তাঁর জন্ম এবং বিকাশ। গ্রীক-পারসিয়ান-তুর্কী বীরদের মতো তাঁর স্বভাব ও সাহস। ‘আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস/ আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ’ এটা শুধু তাঁর কবিতার সত্য নয়, এটি তাঁর ব্যক্তিজীবনেও সত্য। এই নজরুল যখন কবিতা লিখেছেন, অভিভাষণ দান করেছেন, গান রচেছেন, তখন বীর নজরুল উপস্থিত থেকেছে সেসব সৃষ্টিতে। যে কালবোশেখী ঝড় দেখে ভয়ে আধমরা হয়ে যায় বাঙালি, তিনি সেই ঝড়কে স্বাগত জানিয়ে রচেছেন, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর, তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ ঐ নূতনের কেতন উড়ে কালবোশেখীর ঝড়!’ এই গানে তিনি বলেছেন, ‘আসলো এবার অনাগত প্রলয়-নেশার নৃত্য-পাগল/ সিন্ধু-পারের সিংহদ্বারে ধমক হেনে ভাঙলো আগল!/ মৃত্যু-গহন অন্ধকূপে, মহাকালের চন্ডরূপে ধূম্র-ধূপে/ বজ্র-শিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ংকর!/ ওরে ঐ আসছে ভয়ংকর/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর! ’  এসব চরণ পাঠে এবং অগ্নিঝরা সুরে শিল্পীদের কণ্ঠে শ্রবণ করে বসে থাকা যায় না। এ গান শুনে গায়ে শিহরণ জাগে, লোম খাড়া হয়ে ওঠে এবং রক্ত গরম হয়ে যায়। বীরের পক্ষেই বীরকে সাদরে বরণ করা সম্ভব। কাপুরুষ বা ভীরু যদি বীরের আগমনের কথা শোনে তবে সে ভয়ে  পেছন দরোজা দিয়ে পালিয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু বীর বলে তাঁর পক্ষে কালবোশেখীকে স্বাগত জানানো সম্ভব হয়েছে। তিনি কালবোশেখীর মধ্যে ধ্বংসলীলা দেখেছেন কিন্তু একইসাথে দেখেছেন তার নতুন করে সৃজন করার শক্তি। তিনি সেই শক্তিকে বশে এনে কাজে লাগাতে চেয়েছেন। ‘ভয়ংকর’কে দেখে উল্লাস করার এবং তাকে উল্লসিত আবেগে স্বাগত জানানো একেবারে অভিনব ও অচিন্তিতপূর্ব বিষয় ছিল বাঙালির কাছে। নজরুল সেই অসাধ্য সাধন করেছেন তাঁর গানে। রাষ্ট্রের অবাধ্য যারা, তাদের জন্য জেলখানা। জেলখানায় বন্দী জীবন । কোনো স্বাধীনতা নেই সেখানে। শাসক যত স্বৈরাচারী হয়, স্বাধীন সত্তার মানুষের জন্য ততো বাড়ে দুঃসময়। তাদেরকে যখন তখন পুরে দেয়া হয় কারাগারে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম নিজেও বৃটিশের কারাগারে বন্দী ছিলেন। কারাগারে বছরের পর বছর আটক ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বিশ্বের আর বহু জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বীরনেতা। কিন্তু যিনি প্রকৃত বীর, তিনি ভেঙে ফেলতে চান অন্যায়ের বাস্তিল দুর্গ। নজরুল, নেলসন ম্যান্ডেলা, শেখ মুজিব কেউই অন্যায় শাসকদের সাথে হীন আপোষ করেননি। কারণ তাঁরা প্রকৃত অর্থেই বীর মানুষ ছিলেন।  নজরুল ইসলাম তাঁর গানে-কবিতায়-প্রবন্ধে অন্যায়ের কারাগারকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। বীর সেই যে উৎখাত করতে পারে অবিচার আর অন্যায়ের সকল প্রাচীর। তাঁর সেই বীরত্বব্যঞ্জক প্রণোদনা সবচেয়ে বেশি পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে গানে বিশেষত ‘‘ভাঙার গান” শিরেনামের গানটিতে যার শুরুটা এমন: “ কারার ঐ লৌহ কপাট / ভেঙ্গে ফেল করবে লোপাট/ রক্তজমাট/ শিকলপূজার পাষাণবেদী/ ওরে ও তরুণ নিশান/ বাজা তোর প্রলয় বিষাণ। ধ্বংস নিশান/ উঠুক প্রাচীর  প্রাচীর ভেদী।।”

অনিঃশেষ তেজস্বিতায় আগুনঝরা সুর ও বারুদগর্ভ বাণীর রচিত শৃঙ্খলা ভাঙ্গার  এই গানটির তুলনা গানের ইতিহাস নেই; কবিতার জগতের ও নেই। পরাধীনতার শঙ্খল ভাঙার অগ্নিবাণী ও অগ্নিবীণা সমবেত ও সম্মিলিত হয়ে গানটিকে করে তুলেছে যাবতীয় অন্যায় বাঁধা ভাঙা ও বাঁধন ছেঁড়ার অপ্রতিরোধ্য শক্তির জোয়ার। গানের প্রথমাংশটা অভিনব, অভূতপূর্ব শব্দ, চিত্র ও বক্তব্যকে হাজির করেছে। জেলখানার লৌহকপাট ভেঙে ফেলে লোপাট করার আহবান রাজদ্রোহ, সেই আইনকে মান্য করার বাধ্যবাধকতার চিহ্ন কারণ আইন অমান্যের পরিণাম জেল বাস। তাকে ভেঙে ফেলার  আহবান মানে শাসকের সরকারের যাবতীয় কর্তৃত্ব ও নির্দেশকে অমান্য করার উদ্ধত প্ররোচনা। সুতরাং এটি করতে হলে সে আহ্বানে মধ্যে এমন উন্মাদনা, নিদের্শনা যুক্তিরা জোর ও সম্মোহনী ক্ষমতা থাকতে হবে যাবে সরকারে/ শাসকের সকল শক্তিকে অস্বীকার ও পরাজিত করার গভীর প্রণোদনা ও প্রতীতি জন্ম নেয় আহুতদের মনে ও মগজে। এ কাজ গেলে প্রচন্ড বাঁধা আসবে, মৃত্যু আাসবে, জেলজুলুম আসবে জেনেও যেন তারা ভাঙার অভিযানে অকুতোভয় ও অটল থাকে। ফলত গানের সমস্ত শরীরপ্রাণে নজরুল  সেই উন্মাদনা, যুক্তি, মাদকতা, সাহস ও সম্মোহন জুড়ে দিয়েছেন অতুলনীয় পারঙ্গমতায়। গানের প্রথমাংশই রক্ত জমাট শিকলপূজার পাষাণবেদী বিশেষণ দ্বারা জেলখানার অন্যায় ও ভয়ংকর অস্তিত্বকে প্রতিপন্ন করেছেন। এই অন্যায় লৌহকপাটের নির্মাতা যে অত্যাচারী, স্বেচ্ছাচারী শক্তিমান, তার পেছনে জনসমর্থন নেই, স্রষ্টার ও সমর্থন নেই, সে শুধু গায়ের জোরে মোড়ল। তার ধ্বংসসাধন ন্যায্য কাজ; তাই তো তরুণদের মাতোয়ারা হতে গাজনের বাজনা বাজতে হবে।  এ কাজে কোনো ভয় নেই, কারণ বিপ্লবীদের পক্ষে আছেন স্রষ্টা। জনগণই ক্ষমতা উৎস, জনগণই দেবতা। জনতার রায় মানেই ভগবানের রায়। কাজেই অত্যাচারী অসুরতুল্য শাসক জনতারূপী ভগবানকে শাস্তি দেবে এই অযুক্তির যুক্তি,  এই হীন তথ্য বিশ্বাস করার এবং তা বিশ্বাস করে রাজা সম্পর্কে ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে ওঠার কোনো কারণ নেই। এটা এতটাই অবিশ্বাস্য যে তাকে হেসে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন কবি। এই শাসকরূপী, অত্যাচারী অসুর দানবকে পরাজিত করতে যুবকদেরকে, দেবতার মতো নির্ভীক ও সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। তাই ধ্বংসে দেবতা শিবকে আহবান জানানো হয়েছে প্রলয়দোলা দিতে। সে দোলায় একদিকে নেচে উঠবে বিল্পবী তরুণপ্রাণ, অন্যদিকে নড়ে উঠবে অন্যায়ের প্রতীক জেলখানার ভিত। অতঃপর মানব সংগ্রামে সত্য ইতিহাস হতে হযরত আলীর হায়দরী হাঁকের উদাহরণ এনে বিপ্লবীদের সাহস ও শক্তিকে উদ্দীপ্ত করা হয়েছে। এই পর্বে বিল্পবীদের সক্রিয় হয়ে উঠে হ্যাঁচকা টানে গারদগুলোর ভিত্তি নড়িয়ে দেয়ার আহবান জানানো হয়েছে। ভাঙচুর শুরু হয়ে যাওয়ার ছবিও দৃশ্যমান এই পর্বে। মৃত্যুকে ডাক দেয়ার পানে কথাগুলো দ্বারা মরণকে জয় করার দেবমন্ত্র কানে তুলে দেয়া হয়েছে। নাচে ঐ কাল বোশেখী কাটাবি কাল বাস কি এই দৃশ্যকল্প ও আহ্বান বিল্পবীদের সামনে বিপ্লবের নৈসর্গিক উদাহরণ ও তাৎক্ষণিকের কর্তব্যকর্মে ক্রিয়াশীল তাকেই অনুসরণ করতে হবে। এখন বসে সময় নষ্ট করার সময় নয় পিছুভাবারও সময় নয়। গানের শেষাংশে অন্যায় আধিপত্য ও ইস্টাব্লিশমেন্টে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার আহবানের মধ্যে বারুদগর্ভ প্ররোচনা ও প্রণোদনা প্রজ্বলিত ও বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছে। গানটির যদি আগ্নেগিরি হয় তবে আবেগ অংশটি উদগীরণরত জ্বালা মুখ; গানটির যদি বারুদের স্তুপ হয়, শেষাংটি দেশালয়ের জ্বলন্ত কাঠির অগ্নিসংযোগ। এভাবে গানে ন্যায় সত্য, জনতা ও স্রষ্টা মিত্রশক্তি এবং মিথ্যা, অন্যায়, অত্যাচারী শাসকরূপী অসুরশক্তি অক্ষশক্তিতে মেরুকরণকৃত হয়েছে। অক্ষশক্তিকে পরাজিত ও ধ্বংস করার যাবতীয় যুদ্ধোপকরণ যথা: দুন্দুভি, হায়দরী হাঁক, আহ্বান, গাজনের বাজনা, শিবের প্রলয় দোলা, কাল বোশেখীর সমর্থন এই গানে উপস্থিত। এতকিছুর আয়োজনসমৃদ্ধ ও সমর্থিত বিপ্লবীশক্তির সঙ্গে যুদ্ধে কোনো শক্তিই টিকতে পারে না। গানে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দ তো নয় যেন বুলেট্, বারুদগর্ভ বোমা, ছুড়ামাত্র প্রচন্ড বিস্ফোরণে কাঁপিয়ে দেবে চারপাশে। তা শুনে জেগে উঠবে অর্ধমৃত প্রাণ, ভয়ে ছুটে পালাবে অন্যায় প্রতিপক্ষ প্রতিটি, শব্দ, চিত্রধ্বনির আবেদন যেন অস্ত্রাঘাত করে চলে শত্রুর দুর্গ ভাঙার। সত্যিকার অর্থেই এ গানের আবেদন অফুরন্ত ও চিরকালীন। তাই তো বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ, সকল সংগ্রামে এই গানটি সংগ্রামীদের শক্তি, সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে। এমনকি ২০০৬ সাল বিবিসি পরিচালিত শ্রোতাজরীপে গানটি হাজার বছরের ২০টি শ্রেষ্ঠতম গানের অন্যতম হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। সমকালের প্রণোদনায় রচিত এ গান সুর বাণীর ঐশ্বর্যগুণে ও আবেদনের চিরকালীনতায় হয়ে গেছে চিরকালের।

বিদ্রোহী কবি তাঁর সুবিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় আত্ম-উদ্বোধনের সুরে বলে উঠেছিলেন, ‘আমি সহসা আমারে চিনেছি আমার খুলিয়া গিয়ছে সব বাঁধ’। এই যে বাঁধ ও বাঁধন খুলে ফেলে নিজের নিজস্বতাকে তার আপন শক্তিতে ও মহিমায় বলীয়ান ও উদ্ভাসিত করে তোলা এরই মাঅেঝ ব্যক্তির বা জাতির মুক্তির বীজ নিহিত। ব্যক্তির যদি তার আত্মকোটরে বন্দী থাকে আর সমষ্টি যদি ব্যক্তিত্বহীন হয় তবে সে সমাজ বা জাতির মুক্তি আসে না। দুর্গতি ঘোচে না। এই গান ব্যক্তির সংকীর্ণ কোটর হতে মুক্ত হওয়ার উন্মাদনা যন্ত্র। একমাত্র সুশিক্ষিত যুবশক্তিই এমন অফুরান ও মুক্ত প্রাণপ্রাচুর্য ধারণ করতে পারে। বীর মানেই যুবক-যুবতী। বৃদ্ধের পক্ষে বীর হওয়া সম্ভব নয়। শিশুর পক্ষেও নয়। বীরকে হতে হয় আপন শক্তিতে সচ্ছল, সাহসে অকুতোভয়, গতিতে দুর্বার এবং মানসকিতায় আকাশসম উদার। নজরুলের বীররসের গানে এমন ছবিই আমরা দেখতে পাই: “মোর ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম, মোরা ঝর্ণার মত চঞ্চল।/ মোরা বিধাতার মত নির্ভয় মোরা প্রকৃতির মত স্বচ্ছল।।/  আকাশের মত বাঁধাহীন,/ মোরা মরু- সঞ্চর বেদুঈন,/ (মোরা) বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন, চিরমুক্ত শতদল।।” এই গানটি কোরাস অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরপুর। অনেক কয়টি প্রাণ সমন্বরে মেতে উঠেছে এই গানে ও সুরে। তারা নিজেদের ঝড়ের মতো উদ্দাম ঝরনাধারার মতো চঞ্চলসুন্দর, সৃষ্টিকর্তার মতো নির্ভীক এবং প্রকৃতির মতো স্বচ্ছল বলে দাবি করছে। তার মানে তাদের সবই আছে শৌর্য বীর্য সাহস সম্পদ প্রাণ চাঞ্চল্য কোনোটিরই সামান্যতম অভাব নেই। এই সম্মিলিত শক্তিকে কে বন্দি করে রাখতে পারে? কোন তুচ্ছ প্রলোভের খাঁচায় তারা কি বন্দি হতে পারে? কোনো ক্ষুদ্র ভূগোলের সংকীর্ণ আবেষ্টনী তাদের বদ্ধ জলের মতো আটকিয়ে পারে? সব প্রশ্নের উত্তরই নেতিবাচক। সেটাই তারা জানিয়ে দিয়েছে গানের পরবর্তী চরণসমূহে। তার আকাশের মতো বাধাহীন, তার মধ্যপ্রাচ্যের বেদুঈন যাযাবরদের মতো বাঁধনহারা, তারা জন্মগতভাবেই স্বাধীন। সমুদ্রজোয়ারের মতো তাদের আহবান গীত, আবার তাদের কণ্ঠে ঝোরাজলের মতোই মধুর কল কল গান। তার হৃদয়টা খোলা প্রান্তরের মতো উন্মুক্ত ও উদার। কোনো বদ্ধ বাতাস বা দূষিত জল সেখানে বাসা বাঁধতে পারে না। কোন ক্ষুদ্রতা কোনো মলিনতা তাদের স্পর্শ করতে পারে না। আবার তারা সত্য ও ন্যায়ের প্রশ্ন পবর্তের মতো অটল ও স্থিরচিত্ত। তেমনি তাদের দেহমনের খাদ্যও প্রকৃতির নিস্কুলষ দান। কোনো তুচ্ছ লোভ তাদের আকর্ষণ করতে পারে না, কোনো বাজে খাবারেও তাদের রুচি নেই। এভাবেই নজরুল মুক্ত স্বাধীন মানুষের যাত্রাপথের গান রচনা করেছেন বিশেষ  পরিস্থিতিতে লিখা হলেও বাণী সুর ও অর্থময়তার চিরকালীনত্বের গুণে গানটি সর্বকালের হয়ে রয়েছে। ছন্দের মাধুর্য, অনুপ্রাসের অনুরণন, উপমার যথার্থতা উৎপ্রেক্ষার করেছে। এ গান শুনে আসল্য ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ায় অলস ভীরু ফিরে পায় সাহস, গতিহীন পায় প্রবলগতির প্রচন্ডতা, বদ্ধপ্রাণ ফিরে পায় বাঁধভাঙা জোয়ারের বেগ। রবীন্দ্রনাথ যুবাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন ‘‘চিরাযুবা তুই সে চির জীবী/ জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে/ প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি।’’ এই গান সেই অফুরান প্রাণ ছড়িয়ে দেওয়ার সমবেত মন্ত্র। রুদ্ধ পাহাড়ভাঙা প্রাণের ঢল ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় এঁদো ডোবা, প্রাণহীন চর আর জরাজীর্ণতার সময় সঞ্চিত স্তুপ। গতিময়তা, বলিষ্ঠতা, অরুগ্নতা ও ছন্দহিল্লোলের চমৎকার সমন্বয় গানটিকে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা জীবনের থিম সঙ্গীতে উন্নীত করেছে। এই গানটি নজরুলের বীররসের একটি ক্লাসিক সৃষ্টি।

এটা সর্বজনীনভাবে সত্য যে, যারা যুবক, যারা ছাত্রছাত্রী, তাদের মধ্যেই বীরের তেজ ও শক্তি থাকে। তারা কোনো বাধাকেই বাধা বলে মানতে চায় না। সব বাধা পেরিয়ে পায়ে দলে সব কাঁটা তারা এগিয়ে যায় লক্ষ্যে। নজরুল এই ছাত্রছাত্রী ও তরুণদের নিয়ে বহু গান রচেছেন। তবে দুটি গান বীররসে অতুলনীয়ভাবে সমৃদ্ধ ও সার্থক। ‘আমরা শক্তি আমরা বল/ আমরা ছাত্রদল/ মোদের পায়ের তলায় মুর্চ্ছে তুফান/ উর্ধ্বে বিমান ঝড়বাদল! ’ এবং ‘চল্ চল্ চল্ উর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল/ নিম্নে উতলা ধরণীতল/ অরুণপ্রাতের তরুণদল/ চল্ চল্ চল্ ! ’প্রথম গানটি কিছু কিছু চরণ রক্তের বর্ণমালায় রচিত যা বীররসের চূড়ান্ত প্রকাশ। যেমন, ‘মোদের আঁধার রাতে বাধার পথে যাত্রা নাঙ্গা পায়/ আমরা শক্ত মাটি রক্তে রাঙাই বিষম চলার ঘায়!/ যুগে যুগে রক্তে মোদের সিক্ত হলো পৃথ্বিতল। ’আমরা যদি আমাদের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে উনিশ শ একাত্তর সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত আন্দোলন-সংগ্রামের হালখাতা করি, তবে দেখা যাবে ছাত্রছাত্রীদের আত্মত্যাগ ছিল সবচেয়ে বেশি। মূলত তাদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে বারবার। তারাই শহিদ হয়েছে, মার খেয়েছে, জেল খেটেছে এবং সব যন্ত্রণা ও জেলজুলুমকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। অনুরূপভাবে বীরত্বব্যঞ্জক প্রণোদনা, প্রেরণা, প্ররোচনা ও প্রত্যয় জাগানিয়া দুঃসাহসে ভরা গান ‘চল্ চ্ল্ চল্ উর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল ’গানটি। মার্চের তালে ও সুরে রচিত এইগান শুনলেই আধমরা মানুষও মিছিলে/ অভিযান-যাত্রায় শরীক হতে পায়ে ভর দিয়ে বুকে সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার শক্তি পায়। উর্ধ্বে আকাশে মাদলের মহাবাদ্য, নিচে উতলা পৃথিবী, সামনে অন্ধকার। উষার দুয়ার বন্ধ করেছে রেখেছে কোনো অশুভ শক্তি। এমন পরিবেশে ‘অরুণ প্রাতের তরুণ দল’  প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এই বলে, ‘উষার দুয়ারে হানি আঘাত/ আমরা আনিব রাঙা প্রভাত/ আমরা টুটাব তিমির রাত/ বাধার বিন্ধ্যাচল।’ বিন্ধ্যাপর্বতের মতো বাধাকে তুচ্ছজ্ঞানে ডিঙিয়ে যাবে তারা। এবং ‘মহাশ্মশান’-এ নুতন প্রাণ ঢেলে তাকে করে তুলবে ‘সজীব’। এর জন্য যদি প্রাণ দিতে হয়, তা দেবে তারা হাসিমুখে। কারণ তারা জানে আত্মত্যাগের বিনিময়েই আসে নতুন প্রাণ, নতুন সৃষ্টি, নতুন দেশ। গানটির শেষের দিকের বাণী প্রচন্ড অগ্নিগর্ভ প্ররোচনায় উত্তপ্ত : ‘চল্ রে নও জোয়ান/ শোন্ রে পাতিয়া কান/ মৃত্যু-তোরণ দুয়ারে দুয়ারে জীবনের আহ্বান/ ভাঙ রে ভাঙ আগল/ চল্ রে চল রে চল্/ চল্ চল্ চল্।’ ‘মৃত্যু-তোরণ দুয়ারে দুয়ারে জীবনের আহ্বান’ এই চিত্রকল্প বা কল্পচিত্রটি অতুলনীয় ও অভূতপূর্ব সাহস, প্রত্যয় ও প্ররোচনায় ভরা। এমন অগ্নিগর্ভ বাণী, অনবদ্য চিত্রকল্প আর যুদ্ধযাত্রার তাল-সুরে রচিত গানের সাথে পরিচয় ছিল না বাঙালির, এমনকি বৃহত্তর ভারতীয় উপমহাদেশীয় মানুষের। এই গান বুকে ও বিশ্বাসে, প্রত্যয়ে ও প্রাণে, কথায়  ও কাজে ধারণ করতে পারলে সকল ভীরুতা, দুর্বলতা, উদ্দমহীনতা, দ্বিধা ও আলসেমী দূর হয়ে যেতে বাধ্য। এই গান ভীরুকেও বীরে উত্তীর্ণ করার সাহস ও শক্তি জোগাতে সমর্থ। এই গানই হচ্ছে যথার্থ বীররসের গান। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্যে, গানটির এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই তা বাঙালির একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের রণসঙ্গীতের মর্যাদা লাভ করেছে রাষ্ট্রীয়ভাবেই। অনুরূপভাবে ‘শঙ্কাশূন্য লক্ষ কণ্ঠে বাজিছে শঙ্খ ঐ/ পুণ্য-চিত্ত মৃত্যু-তীর্থ-পথের যাত্রী কই’, ‘ঝড়-ঝঞ্ঝার ওড়ে নিশান, ঘন-বজ্রে বিষাণ বাজে’, ‘ঝড় এসেছে ঝড় এসেছে কাহারা যেন ডাকে’ প্রভৃতি গান রক্ত গরম করে তোলে, দুঃসাহসী হতে প্ররোচনা জোগায়।

আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, নজরুল বাংলা ভাষায় গণসংগীতের পথিকৃৎ। তিনি কৃষক, জেলে, তাঁতি, বেদে, শ্রমিক, নারী সবার জন্য গান রচনা করেছেন। সেসব গানের বাণী সাহসকিতার ঐশ্বর্যে এতটাই ঋদ্ধ যে সেসব কোনো পূর্বনজির পাওয়া যায় না। অর্থাৎ সেসব গানও বীররসের ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ। তিনি অনেক ইসলামী সংগীত এবং শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন যেসব শুনলে দুর্বল শরীরে ফিরে আসে শক্তি, ক্ষীণপ্রাণে ফিরে আসে প্রাণশক্তি, ভীরু সত্তা ভরে ওঠে সাহসিকতায়।  ‘আল্লাহ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়’, ‘বাজলো কিরে ভোরের সানাই নিদ-মহলার আঁধার-পুরে’, ‘বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা উঁচু করি শির মুসলমান’, ‘দিকে দিকে পুনঃ জ্বলিয়া উঠেছে দীন-ই ইসলামী লাল মশাল’, ‘উঠরে চাষী জগদ্বাসী ধর কষে লাঙল’, ‘আমরা নীচে পড়ে রইবো না আর  শোন রে ও ভাই জেলে’ প্রভৃতি গান মানুষকে অসাধ্য সাধনে অসীম সাহস ও প্রবল প্রণোদনা জোগায়। নারীজাগরণের উদ্দেশ্যে রচিত ‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’ গানটি তো এক কথায় এতটা তেজদীপ্ত বাণীতে রচিত যে এই গান কানে শুনলে বা কণ্ঠে ধারণ করলে পুরুষশাসিত সমাজে নানাভাবে নিস্পেষিত নিপীড়িত নারী জাতি নিজেদের অধিকার আদায়ে যুগবাহিত পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে মিছিলে নামার প্রেরণা লাভ করতে পারে। তাঁর অনেক প্রেমের গানেও বীররস সঞ্চারিত হয়েছে প্রবলভাবে। তবে এটাই অধিকতর সত্য যে তাঁর সংগ্রামী এবং গণসংগীত প্রকৃতির গানগুলোতে বীররস সঞ্চারিত হয়েছে যার তুলনা বাংলা গানে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তেমন একটি গান ‘এই শিকল পরা ছর মোদের এই শিকল পরা ছল/ এই শিকল পরে শিকল তোদের করবো রে বিকল।’ তখন ভারতবর্ষ পরাধীন। কারাগারে যেতে হচ্ছে এক এক করে বিপ্লবীদের। কারাগারে যেতে হচ্ছে নজরুলের মতো সংগ্রামী কবিকেও। আর বৃহত্তর অর্থ গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ তখন একটি বৃহৎ কারাগার যেখানে বন্দি তেত্রিশ কোটি মানুষ। জেলজুলুমকে ভয় পায় সাধারণ মানুষ এবং বিশেষত ভীরুরা। কিন্তু বীরদের কাজ হলো সেই জেলজুলুমকে অকার্যকর করে তোলা। বৃটিশরাজের সকল বাধানিষেধ অমান্য অগ্রাহ্য করে বিদ্রোহী কবি বীর কবি নজরুল সেই কাজটি করে গেছেন একের পর এক। এই গানে প্রতিটি চরণ অমিত তেজে অগ্নিগর্ভ। বিশেষত ‘তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়/ সেই ভয়ের টুঁটি ধরব টিপে করব তারে লয়!/ মোরা আপনি মরে মরার দেশে আনব বরাভয়/ মোরা ফাঁসি পরে আনব হাসি মৃত্যু-জয়ের ফল।’ এই অন্তরায় সংগ্রামী সাহস সকল মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এটি ক্ষমতাসীন মহাশক্তিশালী দুঃশাসনকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করা। এই গানের অগ্নিগর্ভ বাণীর সাথে ছন্দ-তাল-সুরের ঝংকার গানটিকে অব্যর্থ যুদ্ধাস্ত্রে উন্নীত করেছে।

পরাক্রমশালী বহিঃশত্রুর আগ্রাসন এবং অন্যায় যুদ্ধের মুখে দেশজাতিকে বিপদ থেকে বাঁচাতে দেশবাসীকে হতে হয় অকুতোভয় ও মরণজয়ী। বিপদ বা মৃত্যুর ভয়ে ভীত যারা তাদের পক্ষে জন্মভূমি বা জাতিকে দুর্দিনে রক্ষা করা সম্ভব নয়। মরণে ডরে না বীর। নজরুল তাঁর দেশবাসীকে মরণজয়ী দুঃসাহস ও সমরজয়ী শক্তি জুগিয়েছেন গানে গানে। অগ্নিগর্ভ বাণী আর বারুদমাখা সুরে রচিত ‘বীরদল আগে চল/ কাঁপাইয়া পদভরে ধরণী টলমল’ গানটি মানুষকে সকল পিছুটান ও ভীরুতা কাটিয়ে উঠে দেশের জন্য জাতির জন্য সম্মখ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার অগ্নিমন্ত্রণা জোগাতে সক্ষম। এই গানের সুরে, তালে,ছন্দে, কথায় যে প্ররোচনা, তা ঘুমন্তকে জাগিয়ে দিতে সক্ষম। তেমনি বীররসের আরেকটি অগ্নিগান ‘দুরন্ত দুর্মদ প্রাণ অফুরান/ গাহে আজি উদ্ধত গান’। এই গান শুনে রক্তগরম হয়ে ওঠে; পায়ে প্ররোচনা জাগে জোরসে সামনে চলার। নজরুলের আরও অনেক গানে মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা ও প্ররোচনা আছে। ‘বজ্র আলোকে মৃত্যুর সাথে হবে নব পরিচয়, জয় জীবনের জয়’ চরণযুক্ত গানটি একইভাবে মরণের সাথে পাঞ্জা লড়াই করার দুঃসাহস ও অগ্রিমন্ত্রণায় উচ্চকিত। দেশের দুর্দিনে এই গান মানুষকে সমরে-সংগ্রামে-বিপদে-বাধায় ঝাঁপিয়ে পড়ার শক্তি জোগাতে, সাহস দিতে, প্রেরণাদানে অত্যন্ত কার্যকর  ভূমিকা পালনে সক্ষম। নজরুলের “দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার হে/ লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার’’ এই মহামিলনের গানটিও একইসাথে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এবং বীররসের গান যা আজও বাংলা গানের জগতে অতুলনীয়। প্রকৃত পক্ষে নজরুলের বীররসের সফল গানের সংখ্যা এত বেশি এবং সেসব গান গুণে-মানে এতটাই সমৃদ্ধ যে সেসব নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করতে গেলে একটি আলাদা গ্রন্থ রচিত হয়ে যাবে। নজরুল একাধারে সংগ্রামী এবং প্রেমিক কবি। আসলে প্রকৃত বীরের ধর্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় করত প্রেম-শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। নজরুল তেমনই এক বীর কবি ছিলেন। তাই সকল প্রকার গানেই কমবেশি বীররসের সঞ্চারণ ঘটেছে।

নজরুলের বীররসের গানের আরেকটি বিরাট ও স্থায়ী প্রকৃতির অবদান আছে। বিদ্রোহী কবির বীররসের গান-কবিতা প্রথমবারের মতো এবং সবচেয়ে প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এই সত্য যে বাংলা ভাষা শুধু রোমান্টিক কোমল কবিতা আর মেয়েলি ভাবাপন্ন নরম সুর-বাণীর ভাষা নয়। এই ভাষার ধারণ ক্ষমতা এবং প্রকাশ-শক্তি পৃথিবীর যে কোনো শক্তিশালী-সমৃদ্ধ ভাষার অনুরূপ কিংবা তারও বেশি। এই ভাষা শুধু  বাউলদের ভাষা নয়, লোকগায়কদের ভাষা নয়। এই ভাষা শুধু মেয়েলী গীতরচনার ভাষা নয়। এই ভাষা কেবল কান্নার ভাষা নয়। এই ভাষা মরণজয়ী বীরের ভাষা, সশস্ত্র সংগ্রামের ভাষা, সম্মুখ সমরের ভাষা, বিপুল বিদ্রোহের ভাষা, অগ্নিগর্ভ বিপ্লবের ভাষা। এই ভাষার ভেতরে শান্তির জল আছে, আগুনগর্ভ বারুদও আছে। এই ভাষার ভেতরে মৃদুমন্দ হাওয়া আছে, কালবোশেখির প্রচন্ডতাও আছে। এই ভাষার মধ্যে শীতনদীর শান্ততা আছে, সাইক্লোন-সমুদ্রের উত্তালতাও আছে।  নজরুল তাঁর বীররসের গান-কবিতার মাধ্যমে বাংলাভাষার অনাবিস্কৃত ও অব্যবহৃত অগ্নিশক্তির শুভ উদ্বোধন ও উপযুক্ত প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। নজরুল তাঁর বীররসের গান রচনা করতে গিয়ে বাংলা ভাষার দুটি মহা-উপকার করেছেন। প্রথমত বাংলা ভাষার প্রাণে, সুরে, শব্দে যে অগ্নিগিরিতুল্য বিষ্ফোরক শক্তি আছে তার শুভ উদ্বোধন ঘটিয়েছেন। নজরুলের পূর্বপর্যন্ত বাংলাভাষার এই শক্তি এই প্রাণ অবরুদ্ধ ছিল, অনাবিস্কৃত ছিল। দ্বিতীয়ত এই ধরনের গান রচনার প্রয়োজনে তিনি বহু আরবি-ফারসি-উর্দু-সংস্কৃত শব্দ বাংলাভাষায় পুনঃপ্রচলন ঘটিয়েছেন। এতে করে বাংলা ভাষার শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে এবং তার প্রকাশক্ষমতায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। ফলাফল এই যে তারপর থেকে বাংলা ভাষা যুগপৎভাবে রোমান্টিক গানের কোমল ভাষার পাশাপাশি সংগ্রামের-বিপ্লবের-বিদ্রোহের-প্রতিবাদের অগ্নিভাষাও। আর বাঙালি প্রেমিকজাতির পাশাপাশি বীরের জাতি। এটা জাতি হিসাবে বাঙালির জন্য বিশাল সম্মানের ব্যাপার। গৌরবেরও।

রবীন্দ্রনাথের বাস্তবভিত্তিক ন্যায্য আক্ষেপ ও ক্ষোভের অবসান ঘটিয়ে বাঙালিকে সাহসী, গতিমান, উদ্যোগী ও বিজয়ী জাতিতে উন্নীত করতে চেয়েছেন নজরুল তাঁর কবিতা ও গানে। তাঁর বীররসে সমৃদ্ধ গানগুলো এক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক বলবৃদ্ধিতে টনিকের মতো কাজ করতে চেয়েছে। ন্যায্যভাবেই নজরুল শনাক্ত ও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন যৌবন, তারুণ্য ও গতিময়তার কবি-সংগীতকার হিসেবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *