নজরুলের স্বদেশ ভাবনা বা প্রেম কেবলমাত্র বাংলাকে নিয়েই গড়ে ওঠেনি, সমগ্রভারতবর্ষই তখন তাঁর স্বদেশপ্রেমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে তিনি গোটা ভারতবর্ষের মুক্তির এক দুর্বার আন্দোলনের পথিকৃত হয়ে উঠলেন। গোটা ভারতবর্ষে ইংরেজ অত্যাচার এবং আধিপত্যবাদকে ‘ভগবান’ সাজিয়ে তার বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেবার এক অদম্য এবং অসাধারণ দুঃসাহস তাঁর পূর্বে অন্য কোন কবি তো দুরের কথা, ভারতের কোন রাজনীতিবিদ বা দেশপ্রেমী সন্ত্রাসীরাও দেখাতে পারেননি। এই কবিতার ভাব ও ভাষা উপমা-উৎপ্রেক্ষা এ যাবৎকালের কোমল পেলব এবং কুসুমিত কাব্য লালিত্যকে ছিন্নভিন্ন করে পৌরুষ এবং শৈর্যের এক অমিত দুর্বার শক্তিতে পরিণত করল। হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মীয় ভাষা যা এতদিন কেবলমাত্র আত্ননিবেদনের ভাষা হয়েছিল, নজরুলের হাতে সে ভাষা এমন শক্তির প্রকাশ ঘটালো যে বাঙালী মাত্রেই তা অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ইংরেজীতে যাকে বলা যেতে পারে Spell bound হয়ে যাওয়া। এ যাবৎকালে সাহিত্যের ভাষাকে এক নিমিষে পাল্টে দিয়ে তদস্থলে যৌবনদীপ্ত এক অভিনব সাহিত্যের সৃষ্টি হল সৈনিক কবি নজরুলের হাতে।
অবশ্য ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের আগেই নজরুল কাব্য সাহিত্যে যে নূতন ভাবধারা ও বাক্যবিন্যাসের পাশাপাশি ধর্মীয় ভাষাকে নিত্য দিনের কাব্যিক ভাষায় পরিণত করলেন তাঁর প্রতি অকৃত্রিম সাধুবাদ জানিয়ে কবি মোহিতলাল নজরুলকে বরণ করে নিলেন। তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে লিখলেন : ‘‘কাজী সাহেবের কবিতায় কি দেখিলাম বলিব? বাংলা কাব্যের যে অধুনাতন ছন্দ ঝঙ্কার ও ধ্বনি চিত্রে এককালে মুগ্ধ হইয়াছিলাম, কিন্তু অবশেষ নিরতিশয় পীড়িত হইয়া যে সুন্দরী মিথ্যা রূপিনীর উপর বিরক্ত হইয়েছি, কাজী সাহেবের কবিতা পড়িয়া সেই ছন্দ ঝঙ্কারে আবার আস্থা হইয়াছে। যে ছন্দ কবিতায় শদার্থময়ী কন্ঠ ভারতীয় ভূষণ না হইয়া প্রাণের আকুতি ও হৃদয় স্পন্দনের সহচর না হইয়া ইদানিং কেবলমাত্র শ্রবণ প্রীতিকর প্রাণহীন চারুচাতুরীতে পর্যবসিত হইয়াছে। সেই ছন্দ এই নবীন কবির কবিতায় তাহার হৃদয় নিহিত ভাবের সহিত সুর মিলাইয়া মানবকন্ঠের স্বর সপ্তকের সেবক হইয়াছে। কাজী সাহেবের ছন্দ তাঁর স্বতঃউৎসারিত ভাব কলোলিনীর অবশ্যম্ভাবী গমনভঙ্গী। …………… ছন্দকে রক্ষা করিয়া তাহার মধ্যে এই যে একটি অবলীলা, স্বাধীন স্ফুর্তি অবাধ আবেগ, কবি কোথায়ও তাহাকে হারাইয়া বসেন নাই, ছন্দ যেন ভাবের দাসত্ব করিতেছে কোনখানে আপন অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে নাই। এই প্রকৃত কবিশক্তিই পাঠককে মুগ্ধ করে।’’
নজরুলের এই বিস্ময়কর প্রতিভার এক অসাধারণ স্বীকৃতি প্রদান করলেন মোহিতলাল। বস্তুত, নজরুল প্রতিভার উদ্ভব এবং বিকাশ ঘটেছিল তাঁর আজন্ম লালিত দেশপ্রেম ও ইংরেজদের হাত থেকে ভারত মুক্তির তীব্র আকাক্ষার কারণে।
মাত্র একুশ বছর বয়সে এক অসাধারণ কবিতা লিখলেন নজরুল। চোখের সামনে অত্যাচার এবং লুন্ঠনের প্রতীক বৃটিশরাজ এবং তাদের পদলেহনকারী একশ্রেণীর ভারতীয় কর্মকর্তাণ্ডকর্মচারী যারা ভারতবর্ষের সম্পদ এবং ঐশ্বর্য লুন্ঠনে বৃটিশরাজের সহায়তাকারী, অতঃপর বৃটিশ রাজকর্তৃক রায়বাহাদুর, খান বাহাদুর, জমিদার এবং ভূস্বামী হয়ে সরকারের তাবেদার। এরা দুশো বছর ধরে ভারতবর্ষে বৃটিশরাজকে শাসন এবং শোষণের দোসর।
এসময়ে নজরুলের স্বদেশ তখন কেবল বাংলা বা বাংলাদেশ নয়, গোটা ভারতবর্ষ এবং এদেশের নিগৃহীত, শোষিত মানব সমাজ। কমিউনিজম ভাবধারাপুষ্ট হয়ে নজরুল শ্রেণী শত্রুদের বিরুদ্ধে কলম ধরে ছিলেন। তাঁর ‘সর্বহারা’ ‘সাম্যবাদী’ ইত্যাদি কবিতা ও কাব্যগ্রন্থে জোতদার, জমিদার ও ধর্মের নামে শোষকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহ্বান।
নজরুল সমগ্র ভারতের মধ্যে একমাত্র কবি যার ১০টি গ্রন্থ সরকার বাজেয়াপ্ত করতে চেয়েছিল। তার মধ্যে ৫টি গ্রন্থ নিষিদ্ধ হয়েছে। ভারতের অন্য কোনো কবি ও সাহিত্যিকের এত গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হয়নি। বলতে কি ভারত সরকার নজরুলকে ভয় করেছে এবং লেখার প্রচার ও প্রসার নিষিদ্ধ করতে চেয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে নজরুল তাঁর সম্পাদিত সংবাদপত্র ‘ধুমকেতু’ ও দৈনিক ‘নবযুগে’ ভারতের স্বাধীনতার কথা যেমন দ্ব্যার্থহীন ভাষায় বলেছেন, তেমনি কবিতায় ও গানে সেই একই ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তাঁর পূর্বে উর্দু কবি ফজলুল হাসান হসরত মোহানী কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অধিবেশনে ভারতের স্বাধীনতার প্রস্তাব করায় তাঁকে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। নজরুল বৃটিশরাজের জুলুমকে ভয় না করে ‘ধুমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে সাধুবাদ জানিয়ে আশীর্বাদ করে লেখেন :
আয় চলে আয়, রে ধুমকেতু
আঁধারে বাঁধ সন্নিকেতু
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা
জানিয়ে দেরে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন!
নজরুলের ‘ধুমকেতু’ পত্রিকাকে স্বাগত জানিয়ে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ আগষ্ট দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হয় ‘‘We cordially welcome the advent of our new Bangali contemporary, The ‘Dhumketu’ a bi¬ weekly edited by Habilder Kazi Nazrul Islam published from 32, College street, Calcutta. The editor has already made his mark as a powerful poet and some of his recent poems, particularly the ‘Bidrohi’ are among the most wellknown in the Bengali literature. The articles from the editorial pen in the ‘Dhumketu’ fully sustain the reputation of the soldier poet and the collections he has been able to make one in tune with the fine and energy of his own writing. There is something novel, something enthralling in his new venture. We hope, the Dhumketu, or comet will not simply be an emblem of distribution in the hands of the soldier poet but will create something that is beautiful something that is abiding and holy.’’
নিঃসন্দেহে, অমৃতবাজার পত্রিকায় এই শুভকামনাকে ধারণ করে ‘ধুমকেতু’ ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য স্থায়ী ও পবিত্র কর্মকাণ্ডকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছিল। বস্তত, অমৃতবাজার পত্রিকা সে দিন সৈনিক কবি নজরুলকে সাংবাদিক জগতের ‘অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র’ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ১৯২২ সালে ১৫ই আগষ্ট (১ ভাদ্র) নজরুল ধুমকেতু পত্রিকায় লেখেন : ‘‘সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেন না ও কথাটার মানে এক মহারথী এক এক রকম করে দেখে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমানু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এ দেশে মোড়লী করে দেশকে শাসন ভুমিতে পরিণত করেছেন, তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা পুটলি বেঁধে সাগর পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না। তাঁদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদের এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকু দূর করতে হবে। পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল কিছু নিয়ম কানুন বাঁধন শৃঙ্খল মানা -নিষেধের বিরুদ্ধে।’’
আমরা দেখেছি স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য নজরুল জীবনবাজি রেখে ‘ধুমকেতু’ প্রকাশ করেছেন। ‘ধুমকেতু’ অষ্টম সংখ্যা (২৬ ভাদ্র, ১৩২৯ সাল) নজরুল ‘বিষবাণী’ প্রবন্ধে লেখেন : ‘‘মা ভৈঃ মা ভৈঃ ! ভয় নাই, ভয় নাই ওগো আমার বিষমুখ অগ্নি নাগ নাগিনী পুঞ্জুত! দোলা দাও, দোলা দাও ণ্ড তোমাদের কুটিল ফনায়ে ফনায়। তোমাদের যুগ যুগ সঞ্চিত কালো বিষ আপন আপন সর্বাঙ্গে জড়িয়ে ফেল! তোমাদের বিভূতিবরণ অঙ্গ কাঁচা বিষের গাঢ় সবুজরাগে রেঙে উঠুক। বিষ সঞ্চয় করো হে আমার তিক্ত চিত ভুজঙ্গ তরুণ দল! তোমাদের ধরবে কে? মারবে কে ?’’
নজরুলের স্বদেশ ভাবনা তাঁর রচিত প্রবন্ধ, কাব্য ও গানেই বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এ কারণে বিষেরবাঁশী, ভাঙার গান, প্রলয়শিখা, চন্দ্রবিন্দু, এই চারটি কাব্য গ্রন্থের সঙ্গে যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত হয়। এ ছাড়া আরও পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ সরকারের রোষানালে পড়ে এবং সেগুলো নিষিদ্ধ করার সুপারিশও করা হয়। এতদসত্বেও সেগুলো শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়নি। তবে এই গ্রন্থগুলির যেন প্রচার ও প্রসার না হয়, সে জন্য সরকারের গোয়েন্দা ও পুলিশ বিভাগ তৎপর ছিল। এই কাব্যগ্রন্থগুলি হলো অগ্নিবীণা, সঞ্চিতা, ফণিমনসা, সর্বহারা, এবং রুদ্রমঙ্গল। একজন কবির এতগুলো কাব্যগ্রন্থের উপর সরকারের এই আক্রোশ অচিন্তনীয়। দেশের জন্য নজরুলকে কারাবরণ করতে হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে নজরুল হিন্দু মুসলমানের ঐক্য চেয়েছেন। বাংলা এবং ভারতে বিভিন্ন স্থানে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা বাঁধলে নজরুল তাঁর অবিস্মরণীয় গান ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ লিখলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু নজরুলকে দেওয়া জাতীয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শতমুখে জানিয়ে দিলেন,’’ নজরুলকে বিদ্রোহী কবি বলা হয় এটা সত্য কথা। তাঁর অন্তরটা যে বিদ্রোহী, তা স্পষ্ট বুঝা যায়। আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তাঁর গান গাইব। আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সর্বদাই ঘুরে বেড়াই, বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত শুনবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু নজরুলের, দুর্গম গিরি কান্তার মরু’র মতো প্রাণমাতানো গান কখনও শুনেছি বলে মনে হয় না। কবি নজরুল যে স্বপ্ন দেখেছেন, সেটা শুধু নিজের স্বপ্ন নয়, সমগ্র বাঙালী জাতির।’
এই অনুষ্ঠানেই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ঘোষণা দিলেন, ‘নজরুল একজন জীবন্ত মানুষ।’ সংগীত শিল্পী দিলীপ কুমার রায় বলেছেন, নজরুল যখন ‘দুর্গম গিরি’ গানটি গাইতো তখন দেশবন্ধু চিত্তঞ্জন দাশ আকুল হয়ে উঠেছেন। তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতো। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু দারুণভাবে উজ্জীবত হতেন। নজরুলের স্বদেশ ভাবনা সম্পর্কে লিখতে গেলে কয়েক হাজার পৃষ্ঠায় তা শেষ হবে না। এত সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা শেষও করা যায় না। তাঁর গ্রন্থগুলি কেন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তা জানলেই নজরুলের দেশপ্রেম সম্বন্ধে জানা আর বাকি থাকে না।
নজরুলের লেখা শুধু যে তাঁকে বৃটিশরাজের রোষানলে ফেলেছিল তা নয়, হিন্দু মুসলমানদের একটি বড় অংশ তাঁকে ‘কাফের’ ‘যবন’ শয়তান ইত্যাদি বলে তাঁর প্রতি ক্ষিপ্ত হয়েছিল। এর একটি বড় কারণ তিনি তাঁর সাহিত্যে ধর্মের ভাষাকে নিয়ে এসেছেন। রূপক অর্থে ‘খোদা’ ও ‘ভগবান’ দু’জনকেই তীব্রভাবে ‘ঘায়েল’ করেছেন। খোদার আসন ভেদ করতে চেয়েছেন, পদচিহ্ন আঁকতে চেয়েছেন ‘ভগবানের বুকে’। এ সবই রূপক এবং ব্যঙ্গার্থে তাঁর বিরুদ্ধে যাদের আক্রমণ হয়েছিল। তা হয়েছিল সাহিত্য ও ভাষা সম্পর্কে তাদের সম্পুর্ণ অজ্ঞানতার কারণে। নজরুলকে এই শ্রেণী কখনও বুঝতেই সক্ষম হয়নি। জ্ঞানে কমতি’র জন্য এমন ঘটেছে। আবার যখন তিনি ইসলাম ও মুসলিম জীবন নিয়ে লিখেছেন, মুসলমানেরা তখন তাঁকে মুক্তির অগ্রদূত, ‘জাতীয় কবি’ ইত্যাদি ভূষণে ভূষিত করেছেন। হিন্দুদের জন্য শ্যামাসংগীত লিখলে সকলেই তাঁকে ধন্য, ধন্য করেছেন। তাঁরা অবাক হয়েছেন, এমন অপূর্ব শ্যামা সংগীত তাঁর মতো করে অন্য কেউ লিখতেই পারেনি।
নজরুল ইব্রাহীম খাঁ লিখিত তাঁর চিঠির উত্তরে তাঁর মনের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, সাহিত্য অসাম্প্রদায়িক। এখানে হিন্দু মুসলমান কোনো ভেদাভেদ নেই। ধর্মের ভাষা যে কত শক্তিশালী হতে পারে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা-সহ অন্যান্য কবিতা ও সাহিত্যে তার পরিচয় রয়েছে। এ কথা বলা তাই অত্যুক্তি হবে না যে নজরুলই সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে এক ঘেয়েমী থেকে সরিয়ে এনে তাকে গতিময় ও সমৃদ্ধ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁকে আধুনিক পৌরুষীয় বাংলা ভাষা’র জনক’ বললে বোধকরি বেশী বলা হবে না। এক্ষেত্রেও তাঁর মধ্যে এক অসাধারণ দেশপ্রেম লক্ষ্য করা যায়। জীবনে হিন্দু মুসলমানকে তিনি শত চেষ্টা করেও মেলাতে পারেননি। কিন্তু সাহিত্যে, গানে তা পেরেছেন।
১৩৪৯ সনে ৩রা বৈশাখ ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধে নজরুল বাংলা ও বাঙালী সম্পর্কে যা বলেছেন তা অতুলনীয়। এদেশে হিন্দুরাই আজীবন কাল নিজেদেরকে ‘বাঙালী’ হিসেবে দাবী করে আসছে। বাঙালী মুসলমানদের তারা বহিরাগত বলে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু তারা ভুলে গেছে, আর্যসম্প্রদায় এবং বহিরাগত মুসলমানদের আর্বিভাবের পূর্বে তারা ‘অনার্য’ নামে একটি জাতি হিসেবে পরিচিত ছিল। আর্যদের আগমণের পর তাদের ধর্মগ্রহণ করে এই অনার্যেরা ‘বাঙালী’ হয়ে পড়ল, আর মুসলমানদের আগমণে তাদের ধর্ম গ্রহণ করে এই অনার্যরাই হ’ল অবাঙালী।
এই হিন্দুরা ভুলে গেল যে আর্য ধর্মাবলম্বী সেন রাজারা বাংলা ভাষার চর্চাকে নিষিদ্ধ করে সংস্কৃতকে রাজভাষা করেছিল। ঘোষণা দিয়েছিল যে যারা বাংলাভাষা চর্চা করবে তাদেরকে রৌরব নামক নরকে নিক্ষেপ করা হবে। আজ ‘চর্যাগীতিকা’ বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হতে পেরেছে, বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ গোপনে তাদের এই বাংলাভাষা চর্চা করেছেন বলে।
অপরদিকে তুর্কী দেশ থেকে আগত মুসলমানেরা বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করে ‘বাঙলা ও বাঙালী’ উভয়কে যে সম্মানজনক স্থান দিলেন তাঁদেরকে এদেশের আর্য হিন্দু সম্প্রদায় তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাইলেন। নজরুলই সর্বপ্রথম বাঙালীর এই উত্তরণ ঘটিয়েছেন। নজরুল বললেন, ‘বাঙালি যে দিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে ‘বাঙালীর বাংলা’। সে দিন তারা অসাধ্য সাধন করবে।’
নজরুলের আবির্ভাব এমন এক সময়ে হয়েছিল যে সময়টা ছিল জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের এক যুগসন্ধিক্ষণ। সৈনিক জীবন থেকে ফিরে এসেই নজরুল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণ ও ত্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠল। রুশ বিপ্লবের প্রত্যক্ষ প্রভাব এবং মুজাফ্ফর আহমদ, কমরেড আব্দুল হালিম এবং আরও বিপ্লবীদের সাহাচর্যে এসে নজরুল দেশের মুক্তি আন্দোলনে নিজেকে উজাড় করে দিলেন। তাঁর কবিতা, গান, প্রবন্ধ সব কিছুই ছিল ভারতের তথা সাম্রাজ্যবাদের দোসর পুঁজিবাজীদের বিরুদ্ধে লড়ায়ের আহ্বান। সমস্ত অন্যায়, অবিচার, ভীরুতা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নজরুল দুর্বিনীত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর কবিতা তখন একটি জাতির বেঁচে থাকার লড়াই ছিল। নজরুলের কবিতা তাই বাঁধভাঙ্গার গান ছিল। নজরুলকে দেখেই রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও গানেও পরিবর্তন এসেছিল। নজরুলের সমকালে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান পর্যালোচনা করলে এ সত্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যাঁরা তাঁর কবিতাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন তাঁদের জন্যে নজরুল তাঁর ‘আমার কৈফিয়াৎ’ এ সব বলেছেন। কিন্তু যখনই নজরুলকে নিন্দুকেরা বিদ্রুপ ও বিদ্বেষের কষাঘাতে জর্জারিত করেছিলেন, ততই তিনি আরও শক্তিধর হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর সব রচনাবলীতে ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি। তাঁর কাব্য, গান এবং প্রবন্ধ সব কিছুর ভাষাই ছিল এক জাগরণী মন্ত্রের সাহসী উদাহরণ, সাহিত্যে এ এক নূতন যুগের সূচনা। আর সন্দেহাতীতভাবেই এই নূতন যুগের নৈয়ায়িক হলেন কবি নজরুল ইসলাম।
বৃটিশ ভারতে মুসলমানদের উজ্জ্বীবনী শক্তি হিসেবে নজরুলকেই নির্বাচন করা হয়েছিল একথা সত্য। কিন্তু নজরুল নিজে হিন্দু-মুসলমান এমন সাম্প্রদায়িক চিন্তা কখনও গ্রহণ করেননি। তবে তার সাহিত্য চর্চার শুরুতে মুসলমানেরাই এগিয়ে এসেছিলেন। প্রথম দিকে যে সমস্ত সাহিত্য পত্রিকায় নজরুলের কবিতা স্থান পেয়েছে, তার সবকটি মুসলমান পরিচালিত ও সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা। ইতোমধ্যে মুজাফ্ফর আহমদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতার নজরুলের কবিতা, গল্প ইত্যাদি যে সব সাহিত্য পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তার মধ্যে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’, ‘মোসলিম ভারত’, ‘সওগাত’, ‘নওরোজ’, ‘সোলতান’ অন্যতম।
নজরুল ইসলাম লালফৌজদের দ্বারা এতই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে তাঁর গল্প উপন্যাসের নায়কেরা প্রায় সকলেই লালফৌজের বীর সৈনিক হয়ে উঠেছিল। নজরুলের জীবনে ও কর্মে লালফৌজ এবং লাল নিশানা যে কতদূর প্রভাব বিস্তার করেছিল তা তাঁর কাব্য, উপন্যাস ও ছোট গল্প পাঠ করলেই বুঝা ঝায়।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে নজরুলের কাব্যে সাম্যবাদ এবং মানবতার যে উদ্বোধন ঘটেছিল তাঁর মূলে ইসলামের প্রভাব কম নয়। নজরুল ইসলাম আরবী ও ফার্সি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। যুদ্ধে থাকাকালীন সময়ে তাঁর এই জ্ঞানলাভ হয়েছিল। এসময় তিনি একজন শিক্ষকের কাছে ফার্সি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। দিওয়ান হাফিজ, ওমর খৈয়ামসহ আরও অনেক ফার্সি কবির কাব্যের সঙ্গে সৈনিক থাকাকালীন সময়ে তার পরিচয় হয়। অসাধারণ মেধাবী ছিলেন বলে অল্প সময়েই তিনি ফার্সি ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
সৈনিক জীবন থেকে ফিরে এসে তিনি যে সাহিত্য সৃষ্টি করলেন তাতে মুসলমান কবি সাহিত্যিক তথা মুসলমান জাতি উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। বৃটিশ আমলে ভারতবর্ষে হিন্দুরা অগ্রগামী ছিল। হিন্দু জাতীয়তাবাদকেও তাঁরা লালন করতেন। সে সময় মুসলমানেরা হিন্দুদের নিকট ‘অস্পৃশ্য’ ‘স্বেচ্ছ’ এবং ‘যবন’ নামে পরিচিত ছিল। সে সময় মহামেডান স্পোটিং ক্লাব যেমন মুসলমানদের প্রেরণার উৎস ছিল তেমনি ছিলেন কবি নজরুল। নজরুলের মতো বড় কবি সে সময় মুসলমানদের মধ্যে আর কেউ ছিলেন না। মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের দুর্র্র্ব্যবহার এবং হেয় জ্ঞান সে সময় মুসলমানদেরকে পীড়িত করেছিল। এ কারণেই তারা ভারতীয় হিন্দুদের সঙ্গে থাকতে চায়নি।
নজরুলের লেখনি ছিল সমস্ত অন্যায় এবং অবিচারের বিরুদ্ধে। নজরুলের মতো কোন কবি প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেননি। তাঁর এই লেখায় নজরুল শুধু যে ইংরেজদের নিষ্ঠূরতাকে দেখিয়েছেন তা নয়। এর মধ্যে এদেশের একশ্রেণীর প্রভুভক্ত পরজীবি মানুষদের বিরুদ্ধ তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। মানুষের মধ্যে যতদিন হীন কদর্যতা, স্বার্থপরতা, শ্রেণীবৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা এবং দারিদ্র থাকবে ততদিন নজরুল এদেশের মানুষের মনের কোঠায় চিরজাগ্রত থাকবেন। নজরুল নিজেই তো বলেছেন তাঁর বিদ্রোহী কবিতায় :
মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন ধ্বনি
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবেনা
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীমরণভূমে রণিবেনা
সুতরাং সেই দিন যদি আসে তবে নজরুলর কবিতা, গান, সাহিত্য তার যথাযথ কাজটি সমাধা করলো।
রুশ বিপ্লবের প্রত্যক্ষ প্রভাব এবং মুজাফ্ফর আহমদ, কমরেড আব্দুল হালিম এবং আরও বিপ্লবীদের সাহাচর্যে এসে নজরুল দেশের মুক্তি আন্দোলনে নিজেকে উজাড় করে দিলেন। তাঁর কবিতা, গান, প্রবন্ধ সব কিছুই ছিল ভারতের তথা সাম্রাজ্যবাদের দোসর পুঁজিবাজীদের বিরুদ্ধে লড়ায়ের আহ্বান। সমস্ত অন্যায়, অবিচার, ভীরুতা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নজরুল দুর্বিনীত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর কবিতা তখন একটি জাতির বেঁচে থাকার লড়াই ছিল। নজরুলের কবিতা তাই বাঁধভাঙ্গার গান ছিল। নজরুলকে দেখেই রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও গানেও পরিবর্তন এসেছিল। নজরুলের সমকালে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান পর্যালোচনা করলে এ সত্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যাঁরা তাঁর কবিতাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন তাঁদের জন্যে নজরুল তাঁর ‘আমার কৈফিয়াৎ’ এ সব বলেছেন। কিন্তু যখনই নজরুলকে নিন্দুকেরা বিদ্রুপ ও বিদ্বেষের কষাঘাতে জর্জারিত করেছিলেন, ততই তিনি আরও শক্তিধর হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর সব রচনাবলীতে ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি। তাঁর কাব্য, গান এবং প্রবন্ধ সব কিছুর ভাষাই ছিল এক জাগরণী মন্ত্রের সাহসী উদাহরণl সাহিত্যে এ এক নূতন যুগের সূচনা। আর সন্দেহাতীতভাবেই এই নূতন যুগের নৈয়ায়িক হলেন কবি নজরুল ইসলাম।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ১৯২০ সালে ভারতবর্ষের একটি আন্দোলন হয়েছিল যার নাম ছিল হিজরৎ আন্দোলন। এই আন্দোলনের ফলে আঠারো হাজার কিংবা তারও বেশি মুসলমান ভারতবর্ষ ছেড়ে আফগানিস্তানে চলে গিয়েছিল। ভারতে ইংরেজদের অত্যাচারে মুসলমানেরা ভারতবর্ষ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। সে সময় বৃটিশ সরকারের গুলিতে যাঁরা মুহাজিরিন বা দেশত্যাগী তাদের হত্যা করা হয়। নজরুল ইসলাম এই ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং তাঁর দৈনিক নবযুগে তিনি এ সম্বন্ধে সম্পাদকীয় লেখেন।
সাংবাদিক হিসেবে নজরুল অসামান্য কৃতিত্ব রেখেছেন তাঁর সম্পাদকীয় নিবন্ধসমূহে এবং সংবাদ পরিবেশনার মাধ্যমে।
প্রসঙ্গত, মুজাফ্ফর আহমদের কথা বলতেই হয়। তাঁর কারণে নজরুলের অনেক অনুল্লিখিত দিকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে। বয়সে তিনি বড় ছিলেন কিন্তু তাঁদের বন্ধুত্বে তা বাঁধা হয়নি। নজরুল আজীবন কারও অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেননি। তিনি নিজে যা ভালো বুঝেছেন তাই-ই করেছেন। এতে সব সময় যে তাঁর ভালো হয়েছে, তা নয়। তাঁর চরিত্রটাই ছিল এমন। মুজাফ্ফর আহমদ তাঁর ‘স্মৃতিকথা’য় যা বলেছেন তার সবটুকুই এখানে পর্যালোচনা করা সম্ভব নয়। অনেক অজানা তত্ত্ব এখানে এসেছে। অন্যেরা নজরুলের জীবনচরিত লিখতে গিয়ে যে ভুল করেছেন, মুজাফ্ফর আহমদ তা সংশোধন করেছেন। আবার নিজের ভুলও তিনি দ্বিধাহীনভাবে সংশোধন করেছেন। দৈনিক ‘নবযুগে’ শ্রমিকদের প্রতি মালিকদের অবিচারের কথাও তিনি লিখেছেন। মালিকদের হাতে শ্রমিক নিধনের ঘটনাটিকেও তিনি টেনে এনেছেন। এসব লেখার কারণে দৈনিক ‘নবযুগ’ শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায় এবং ইংরেজ সরকার নজরুলকে নানাভাবে দমন করারও চেষ্টা করেছে।
‘দৈনিক নবযুগ’ এর পরে নজরুল ‘ধুমকেতু’ পত্রিকা বের করেছিলেন। নজরুলের সঙ্গে মাওলানা আকরাম খান সাহেবের ভালো সম্পর্ক ছিল না। নজরুল তাঁকে তেমন পছন্দ করেননি। ‘সওগাত’ প্রসঙ্গে তার বিবরণ পাওয়া যাবে।
নজরুল তাঁর সাহিত্যকর্মকে এদেশের গণমানুষের উত্থান, কমিউনিজমের বিকাশ, দেশপ্রেম ও ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি বিরাট মাধ্যম হিসেবে প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি তাঁর কাব্যের এক স্থানে লিখেছেন :
রক্ত ঝরাতে পারিনি একা
তাই লিখে যাই এই রক্ত লিখা
যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটির মুখের গ্রাস
যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।
বৃটিশ ভারতে নজরুলের সমকালে বহুবার দাঙ্গা হয়েছে। বহু হিন্দু-মুসলমান এই দাঙ্গায় নিহত হয়েছে। নজরুল এসব দেখে খুব কষ্ট পেতেন। তিনি নিজে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন এবং একজন হিন্দু নারীকে বিয়ে করে তিনি উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। ইসলামধর্ম নিয়ে কবিতা-গান লিখলেন। হিন্দুদের জন্য শ্যামাসঙ্গীত রচনা করে তাদের অনেকের প্রিয় হলেও মুসলমান ও হিন্দু সমাজ তাঁকে কখনও পুরোপুরি গ্রহণ করেনি। নজরুল ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ লিখে সকলকে এককাতারে আসতে আহ্বান জানালেন। কিন্তু কোন কিছুতেই কিছু হল না। নজরুল এক সময় অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন।

ড. আনোয়ারুল করীম ১৯৩৮ সালের ২৩ অক্টোবর, বাংলা ৮ কার্তিক ১৩৪৫ যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার লাউড়ি গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস কেশবপুর উপজেলার কড়িয়াখালি গ্রামে। পিতা মরহুম মৌঃ করীম বখশ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় শিক্ষাকাল, শৈশব ও কৈশোর কাটে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায়। যশোর জিলা স্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক, কলেজের শিক্ষা কুষ্টিয়া এবং উচ্চ শিক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬২ সালে ইংরেজিতে এম.এ. এবং ১৯৭৭ সালে বাংলায় পিএইচ-ডি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনিই সর্বপ্রথম বাউল বিষয়ে পিএইচ-ডি লাভ করেন। তিনি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দেন ১৯৬২ সালে। ১৯৭১ সালে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার স্বাধীন বাংলা সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন ও সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালে ভারতে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন মাস অবধি ফোকলোর ও বাউল বিষয়ে বক্তৃতা প্রদান করেন। ১৯৮৫ সালে হার্ভার্ডে ভিজিটিং স্কলার হিসেবে যোগ দেন। সেখানে বিশ্বনন্দিত প্রফেসর এ্যানমেরি শিমেল-এর তত্ত্বাবধানে সুফি-বাউল এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে গবেষণা। এ সময়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগে Shamanism in Bangladesh Ges Divinity School-এর Center for the Study of World Religion-এ রবীন্দ্রনাথও বাংলা বিষয়ে বক্তৃতা করেন। মিনদানাও স্টেটের গভর্নর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট তাঁর বক্তৃতাদানের জন্য তাকে সম্মানজনক সনদপত্র প্রদান করেন। ওই সালেই তিনি জাপানে ওকাইমা ফোকলোর সোসাইটির আমন্ত্রণে সেখানেও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাউল ও ফোকলোর বিষয়ে বক্তৃতা প্রদান করেন। সম্প্রতি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাউল বিষয়ে নতুন তত্ত্ব প্রদানের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন। ড. আনোয়ারুল করীম ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সরকারের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির একজন সম্মানিত সদস্য ছিলেন। তিনি লালন একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এবং ফোকলোর রিচার্স ইনস্টিটিউট, কুষ্টিয়ার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি দীর্ঘ আট বছর আমেরিকাস্থ International Council for Traditional music-এর Liaison Officer হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে সম্মানিত হন। তিনি ১৯৯৬ সালে অধ্যক্ষ হিসেবে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে অবসরে যান এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, ট্রেজারার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে কাজ করেছেন। প্রফেসর করীম ইংরেজি ও বাংলা বিষয়ে নানা গবেষণা গ্রন্থের প্রণেতা। তিনি বর্তমানে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ খুলনা ক্যাম্পাসের ইন-চার্জ এবং ইংরেজি বিভাগের প্রধান।