ঋত্বিক ঘটক : মানুষের মুক্তির জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ

ঋত্বিক কুমার ঘটক ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার ২নং হৃষিকেশ দাস লেনের বিখ্যাত ঝুলনবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা রায়বাহাদুর সুরেশচন্দ্র ঘটক অবিভক্ত বাংলার একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। রাজশাহী নগরের মিয়াঁপাড়ায় তাঁর পৈত্রিক বাড়ি। ছেলেবেলায় কিছুদিন দাদা মণীশ ঘটকের সঙ্গে কলকাতায় ছিলেন তিনি। তখন পড়াশোনা করতেন দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাজশাহী শহরে ফিরে আসেন তিনি। শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের একটি অংশ কাটিয়েছেন পদ্মাপাড়ের পৈতৃক বাড়ি রাজশাহীতে। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়াশোনা করেছেন তিনি। জনশ্রুতি আছে রাজশাহী কলেজ এবং মিয়াঁপাড়ার সাধারণ গ্রন্থাগার মাঠে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে নাট্যচর্চা করতেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় তাঁর পরিবার কলকাতায় চলে যায়। বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে তাঁকে তুলনা করা হয় সত্যজিৎ রায় এবং মৃণাল সেনের সাথে। ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের কারণে তিনি যেমন প্রশংসা কুড়িয়েছেন, ঠিক তেমনিভাবে বিতর্কিতও হয়েছেন। ঋত্বিক ঘটক বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি বহুল আলোচিত নাম।

মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য ঋত্বিক ঘটক তাঁর পুরো জীবনটি খরচ করেছেন। জীবনের শুরু থেকেই একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে পথচলা শুরু করেছিলেন। বাবা কবিতা লিখতেন, তিনিও তাঁর জীবন শুরু করলেন কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। কবিতায় স্থির হতে না পেরে প্রবেশ করলেন গল্পের ভূবনে। প্রায় পঞ্চাশটি গল্প লেখার পরও তাঁর কাছে মনে হয়েছে, এই পথ মানবমুক্তির জন্য খুব একটা সহায়ক নয়। তখন তিনি গল্প থুয়ে নাটককে অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেন, কিন্তু তাতেও তাঁর মন ভরেনি। তাঁর মনে হয়েছে, নাটক দিয়ে বড়জোর পাঁচ-ছয় হাজার মানুষের হৃদয় স্পর্শ করা যাবে, কিন্তু মানুষের মুক্তির জন্য তো আরও বেশিকিছু করা প্রয়োজন। এই তৃষ্ণা, বঞ্চনাবোধ থেকেই মানবমুক্তির আন্দোলনকে লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে সিনেমাকে মাধ্যম হিশেবে যথোপযুক্ত মনে করলেন।

‘আমার ছবি’ প্রবন্ধে ঋত্বিক বলেছেন, ‘আমার সবচেয়ে যেটা জরুরী বলে বোধ হয়েছে সেটা, এই বিভক্ত বাংলার জরাজীর্ণ চেহারাটাকে লোকচক্ষে উপস্থিত করা, বাঙালিকে নিজেদের অস্তিত্ব, নিজেদের অতীত ও ভবিষ্যত সম্পর্কে সচেতন করে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা।’ ‘দলিল’ নাটকের ভূমিকায় ঋত্বিক ঘটক লিখেছিলেন, ‘ভাঙা বাংলার প্রতিরোধই আমার শেষ বক্তব্য। সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে বাংলা আজ চিৎকার করে উঠছে, বাঙালি এক, তার ঐতিহ্য এক, তার ভাষা এক, তার সংস্কৃতি এক। বহুযুগ অতীত থেকে বহুদূর ভবিষ্যত পর্যন্ত সে এক।’

উপরিউক্ত প্রবন্ধ এবং নাটকের অংশ থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি দেশভাগের যাতনা তাঁকে কতটা আঘাত করেছে। বস্তুত ঋত্বিক ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। অন্য কোনো প্রবন্ধ তাঁর জীবনসাধনার অন্যান্য শাখা নিয়ে আলোচনা করা যাবে। আজ জানব চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ঋত্বিক ঘটক কতটা প্রভাব বিস্তার করেছেন বা আলো ছড়িয়েছেন।

১৯৮৭ সালে “ঋত্বিক মেমোরিয়াল ট্রাস্ট” “Cinema And I” নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। আকাশ বিশ্বাস গ্রন্থটির অনুবাদ করেন। ৬৫-৬৮ পৃষ্ঠায় ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্পর্কিত যে জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়ের বর্ণনা আছে, হুবহু তুলে ধরা হলো :

চলচ্চিত্র নির্মাণ আমার কাছে গূঢ় কিছু নয়। প্রথমত, আমি চলচ্চিত্র নির্মাণকে একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার হিসেবে ভাবি। যদি কোনো ব্যক্তির দর্শন না থেকে থাকে, তাহলে সে নির্মাণ করতে পারে না। লোকে বলে গান শিল্পসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বিমূর্ত (Abstract)। যদিও আমি ভারতের সেরা গুরুদের একজন উস্তাদ আলাউদ্দিন খানের শিষ্য, আমি মনে করি চলচ্চিত্র নির্মাণ গানের চেয়ে বেশি বিমূর্ত। আমি চলচ্চিত্র নির্মাণের বেশি গভীরে যাব না। সেটা দর্শকদের দেখবার বিষয়। কিন্তু আমি এমন কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি যা নিয়ে অন্য কোন চলচ্চিত্রকার বলেন না, তা হচ্ছে জনগণের সহযোগিতা, যেটার অনুপস্থিতিতে কোনকিছুই নির্মাণ করা সম্ভব হত না।

আমি সুনির্দিষ্ট কিছু উদাহরণ দিতে পারি। তা করলে মনে হয় আমাদের দেশের সাধারণ মানুষেরা জানতে পারবে মানুষ হিসেবে আমাদের লোকজন কতটা ভাল। যখন আমি ‘যুক্তি তক্ক আর গপ্পো’ নির্মাণ করছিলাম, আমাকে একটি গ্রামে গিয়ে কিছুদিনের জন্য থাকতে হয়েছিল। যাদের সাথে আমাকে থাকতে হয়েছিল তারা ছিলেন আমার ‘আদর্শবান দিদি’ ইন্দিরা গান্ধীর অত্যাচারের শিকার একটি দরিদ্র কৃষক দম্পতি। সেসময় আমি অ্যাডভান্সড স্টেজের পালমোনারি টিউবারকিউলোসিসে আক্রান্ত। আমার বাম ফুসফুসে ৬টা ছিদ্র হয়েছিল, প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণ হতো। প্রতিটি শট শুরুর আগে আমি একবার করে রক্তবমি করতাম। এই কৃষক দম্পতি আমার দেখাশোনা ও খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব নেয় (যদিও আমার কাছে পরিমাণমতো কাঁচামাল ছিল)। একরাতে আমি স্ত্রীলোকটিকে জিজ্ঞাসা করি, “আপনাদের চলে কীভাবে?” তিনি উত্তর দেন, “চাল, আটা, বাজরা, ভুট্টা, সবকিছুই আমাদের কাছে নিছক স্বপ্ন মাত্র। আমাদের একটি ছোট্ট জমি আছে যেখানে ঢেঁড়স চাষ করে ১০ মাইল দূরের বাজারে গিয়ে বিক্রি করি; সেই টাকা দিয়ে অল্প সরিষার তেল কিনি। কেরোসিন তেল কেনার সামর্থ্য আমাদের নেই। তাই, একটি বাতি জ্বালানোর মতো সৌভাগ্যও আমাদের হয় না।”

এই দম্পতি আশেপাশের জঙ্গল থেকে প্রায়ই বিষাক্ত মশলা সংগ্রহ করে ও সারাদিনে খাবার খায় মাত্র একবার। আবার, পুরো রাতটাই তাদের কাটে অন্ধকারে। তিনি বলেছিলেন, “প্রশাসন আমাদের কাছ থেকে দুটি জিনিস এখনো চুরি করতে পারেনি। ঈশ্বরপ্রদত্ত বায়ু ও সূর্য, কিন্তু তারা একদিন সেটা করতেও সফল হবে।”

আমি একজন শক্ত মনের মানুষ। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সে রাতে আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। এই হলো আমার জনগণের অবস্থা আর আমরা কোন ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করি।

আরেকটা ঘটনা সম্পর্কে বলি। ১৯৭২ সালে আমি বাংলাদেশে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করছিলাম। ঢাকা শহর থেকে ৭২ মাইল দূরে একটি এলাকায় প্রায় ১৫ দিন ধরে আমি শ্যুটিং চালিয়ে যাই। আমার চলচ্চিত্রটি পদ্মা নদীর পাশে একটি হিন্দু গ্রাম ও মুসলিম গ্রাম দু’স্থানেই শ্যুট করা হয়। শ্যুটিংয়ের শেষদিন ফেরিতে উঠে হিন্দু গ্রামটির প্রধান তার পরিবারের সাথে বসে আমাকে দুপুরের খাবার খেতে আমন্ত্রণ জানান। যখন আমি ইউনিটের সদস্যদের আমাকে ছেড়েই দুপুরের খাবার খেতে বলি, তারা ভেবেছিল নিশ্চয়ই আমি মদ্যপানের কোন অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। কারণ সবাই আমাকে একজন মদ্যপ হিসেবে ভালোভাবেই চেনে। তাই আমি তাদের দূর করে দিয়ে গ্রামপ্রধানের স্ত্রীর হাতের রান্না করা অতি সাধারণ খাবার তৃপ্তিসহকারে খাই।

যখন আমি আমার লঞ্চে ফিরে যাচ্ছিলাম তখন আমাকে মুসলিম গ্রামটিও অতিক্রম করে যেতে হত। সেখানকার গ্রামপ্রধান আমাকে সম্ভাষণ করে বললেন, “তোমাকে আগামীকাল আমাদের সাথে খেতে হবে।” আমি প্রতিউত্তরে বলি আমার কাজ শেষ হওয়ায় আমি প্রথমে ঢাকা ও পরে কলকাতায় ফিরে যাব। তিনি বলেন, “খোদা চায় তো তোমাকে এখানেই থাকতে হবে আর আমার সাথে খেতেও হবে, ইনশাআল্লাহ।” আমি প্রথমে হাসি, তারপর লঞ্চে ফিরে যাই।

সেদিন ক্যামেরাম্যান আমাকে বলে, “দাদা, আমার মনে হয় ফিল্টারের ব্যবহারে কিছু ভুল রয়েছে। আপনি যদি আমাকে আপনার গাড়ি নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার অনুমতি দেন, তাহলে আমি ওই শটগুলো একরাতের মধ্যেই ঠিক করে ভোরের মধ্যেই ফিরে আসব।”

সংক্ষেপে যা ঘটে, তা হচ্ছে সে ফিরে এসে বলে সব শটগুলো NG’s ছিল। তাই আমাকে পুনরায় কাজ করা চালিয়ে যেতে হয়।

পরেরদিন সকালে যখন আমি মুসলিম গ্রামটিতে শ্যুটিং করতে যাই, গ্রাম-প্রধান আমাকে বলে, “শালা, গতকাল বলিনি যে আমার সাথে তোমাকে খেতেই হবে।” আমাকে ওই বদমাশটার সাথে বসে খেতে হয়, এবং তিনি আমাকে খুবই যত্ন সহকারে খাওয়ান।

তারপর মনে পড়ে ১৯৫৬ সালের কথা। আমি বিহারের রাচি জেলার অনেক ভেতরে; যেখান থেকে সবচেয়ে কাছের রেল স্টেশনের দূরত্ব ৪৬ মাইল সেখানে ‘অযান্ত্রিক’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করছিলাম। আমাকে ওরাওঁ নামক উপজাতির একটি নৃত্যের সিকুয়েন্স শ্যুট করতে হয়েছিল। তাদের অদ্ভুত সব সামাজিক রীতিনীতি ছিল।

সেগুলোর মধ্যে একটির নাম ধুমকুরিয়া, যা এক ধরনের গ্রাম্য সংগঠন। আমাকে সেখানে থাকতে হয়েছিল। যদিও আমার ইউনিট নিকটবর্তী বনের একটি বাংলো বাড়িতে থাকে। যেহেতু এই লোকগুলোর সাথে আমার ঘনিষ্ঠ হওয়া অত্যাবশ্যক ছিল, আমাকে তাই তাদের সাথে থাকতে হয় এবং একসাথে প্রতিসন্ধ্যায় মদ্যপান করে নৃত্য করতে হয়। হঠাৎ করে আমার খুব জ্বর জ্বর ভাব হতে থাকে, শরীরের তাপমাত্রাও অনেক বেড়ে যায়। তাদের মধ্যে প্রসাদী নামের একটি মেয়ে একেবারে মায়ের মতো করে আমার দেখাশোনা করে আমাকে সুস্থ করে তোলে। এটা ভুললে চলবে না ৩০/৪০ মাইলের মধ্যে কোন ডাক্তার ছিল না, স্থানটিও জঙ্গলের অনেক গভীরে ছিল। আমি ওই মেয়েটিকে কখনো ভুলব না। স্মৃতিটি আজও আমার মনের গভীরে দাগ কেটে রয়েছে। ইশ, আমি যদি তার ঠিকানা জানতে পারতাম!

আমি এ ধরনের আরও কৌতূহল জাগানিয়া হাজারো ঘটনা বলতে পারব, কারণ আমি আমার সুখী জীবনের দীর্ঘ ৩২ বছর চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যয় করেছি। এখন এই প্রবন্ধটি শেষ করার পূর্বে আমি আপনাদের আমরা “শহুরে মানুষেরা” কেমন তা সম্পর্কে কিছুটা ধারনা দেব।

কিছু মাস আগে আমি নয়া দিল্লীতে আনন্দ পর্বতের ঠিক শেষে একটি বাঙালি গেস্টহাউসে ছিলাম। আমার কিছু বন্ধুরাও সেখানকার পাশের জঙ্গলে বাস করে, যাদের দেখলে হোমোস্যাপিয়েন্স’দের চেয়ে ভালো বলে মনে হয়। উল্লেখ্য, আমার সেই বন্ধুরা হচ্ছে স্বর্ণকেশী বানর। প্রতিদিন সকালে কিছু ধনী লোকেরা গাড়িতে করে একগুচ্ছ কলা নিয়ে এসে বানরগুলোর উদ্দেশ্যে সেগুলো ছুঁড়ে দিত। একদিন এক দরিদ্র ভবঘুরে ছেলে সেই লোকগুলোর মধ্যে একজনের কাছে একটি কলা চায়।

এর ফল?

তাকে নির্দয়ভাবে গণপিটুনি দেওয়া হয়। আর কলাগুলো শেষপর্যন্ত বানরের পেটে চলে যায়।

এই হচ্ছে জীবন, আর আমরা কোন ধরনের চলচ্চিত্র বানাই! এসব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত উল্লেখযোগ্য সিনেমা

তিতাস একটি নদীর নাম
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ হলো ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ১৯৭৩ সালের একটি বাংলাদেশী চলচ্চিত্র। বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক অদ্বৈত মল্লবর্মণের ’তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে। সিনেমাটি প্রযোজনা করেছেন হাবিবুর রহমান খান, এটি তার প্রযোজিত প্রথম চলচ্চিত্র। সিনেমাটিতে শ্রেষ্ঠাংশে অভিনয় করেছেন প্রবীর মিত্র, রোজী সামাদ, কবরী ও গোলাম মুস্তাফা।

কোমল গান্ধার
’কোমল গান্ধার’ ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ১৯৬১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র। এই সিনেমার কাহিনিকার ঋত্বিক ঘটক নিজেই। সিনেমাটি ঋত্বিক ঘটকের ’মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০), ’কোমল গান্ধার’ ও ’সুবর্ণরেখা’ (১৯৬২) চলচ্চিত্র-ট্রিলজি। তিনি ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর শরণার্থী সমস্যা তুলে ধরেছেন এই সিনেমায়। অবশ্য ’কোমলগান্ধার’ এই চলচ্চিত্র-ট্রিলজির মধ্যে সর্বাপেক্ষা আশাবাদী সিনেমা। সিনেনাটিতে কাহিনির তিনটি মূল বিষয় একের পর এক চিত্রিত হয়েছে: প্রধান চরিত্র অনুসূয়ার দোলাচল, ভারতীয় গণনাট্য সংঘের নেতৃত্বের বিভাজন এবং ভারত বিভাজন-সংক্রান্ত মতভেদ।

সুবর্ণরেখা
’সুবর্ণরেখা’ ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ১৯৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া একটি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটি ১৯৬২ সালে তৈরি হয়েছিল, প্রকাশ পেতে তিন বছর দেরি হয়। ’সুবর্ণরেখা’ ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র ট্রিলজি বা চলচ্চিত্র-ত্রয়ীর শেষটি। এই সিনেমায় ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পরবর্তী পরিস্থিতি এবং শরণার্থীদের ফিরে আসার পর নানান প্রতিকূলতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। একজন নিখাদ রাজনৈতিক ইতিহাস নির্মাতার ঐন্দ্রজালিক বয়ান কিংবা দ্বান্দ্বিক হতে পারে তা সুবর্ণরেখা চলচ্চিত্র না দেখলে বোঝা সম্ভব না। একদিকে ঈশ্বরকে দিয়ে বলাচ্ছেন প্রচলিত সমাজের অসঙ্গতির ও অনাচারের কথা আবার ঈশ্বরকেই কেন্দ্র করে এক ঘোরময় আবহ তৈরি করছেন নিদারুন সংশয়ের আবর্তে। দেশভাগের দহন যাতনা ঋত্বিককে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছিল এতে কোনো সন্দেহ নাই। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত এবং বিভক্ত ভারতবর্ষের মানুষের সামনে নতুন দিনে কী অপেক্ষমান- ঋত্বিক সেই ভাবনাতেই সবচেয়ে মগ্নতার চরম শিখরে অবস্থান করছিলেন। ঈশ্বরের নতুন কর্মস্থান চালকলের ফোরম্যান যখন সুবর্ণরেখার তীরে নতুন বাড়ির বর্ণনা দিচ্ছিলেন ঈশ্বর তখন তাকে মিথ্যা বলতে বারণ করেন। কিন্তু ফোরম্যান ঠিকই বলছিলেন। ঋত্বিক আসলে ভয় করছিলেন মোহভঙ্গের কথা ভেবে। প্রবলভাবে শংসয়ে ঘোরাবৃত আবার এই সমাজের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বাক্যবাণগুলো প্রমাণ করে, ঈশ্বর আসলে দ্বিধান্বিত- তিনি কোন পথে যাবেন কোথাই থিতু হবেন। সংশয় এবং সিদ্ধান্তের মাঝপথের জীবনটাই চালকলের চাকার মতো ঘুরতে থাকে।

ঋত্বিক কুমার ঘটক সত্যিকার অর্থে একজন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন। তিনি যে একদিন অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিশেবে সমাদৃত হবেন, একথা নিজেও জানতেন। তাই তো তিনি সুরমা ঘটককে (স্ত্রী) প্রায়ই বলতেন, ‘লক্ষ্মী! টাকাটা তো থাকবে না, কাজটা থাকবে। তুমি দেখে নিয়ো আমি মারা যাবার পর সবাই আমাকে বুঝবে।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *