পর্ব-৫
চাচা বজলে করিমের লেটোদলে বায়না নিয়ে এসেছি পূর্ব বর্ধমানের মাথরুনে। গ্রাম থেকে এতটা দূর এর আগে কখনো আসা হয় নি। গ্রামটি চুরুলিয়া থেকে প্রায় সত্তর মাইল দূরে মঙ্গলকোট থানায়। এখানে একটি স্কুল মাঠে পৌষমেলায় আমাদের দলের গান গাইতে হবে। কাশিম বাজারের রাজা মণীন্দ্র চন্দ্র বছর দশেক আগে তার পিতা নবীন চন্দ্রের নামে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। মণীন্দ্র চন্দ্র কাশিম বাজারের রাজা হলেও তিনি পূর্বরাজা কৃষ্ণনাথ ও রানি স্বর্ণময়ীর সন্তান নন। কৃষ্ণনাথ মাত্র বাইশ বছর বয়সে আত্মঘাতী হলে স্বর্ণময়ী রাজকার্যের দায়িত্ব নেন। তার মৃত্যুর পর ভাগ্নে বর্ধমানের মাথরুন গ্রামের নবীনচন্দ্রের পুত্র মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দী কাশিম বাজারের রাজা হন। নবাব আমলে বাংলায় ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তনের সঙ্গে কাশিম বাজার কুঠির ষড়যন্ত্র ও রাজাদের ইতিহাস অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত। মুর্শিদাবাদ থেকে মাত্র দশ মাইল দূরে ভাগীরথীর তীরে কাশিম বাজার ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যাবসায়িক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছিল। নবাবের সঙ্গে যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে ক্ষুধার্ত হেস্টিংস যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন তখন এখনকার রাজার পূর্ব-পুরুষের খাদ্য গ্রহণে প্রীত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে হেস্টিংস বাংলার বড়লাট হয়ে সে প্রতিদান দিতে ভোলেন নি।
আমারও মনে সুপ্ত বাসনা ছিল একদিন আমিও চণ্ডীদাসের মতো মস্ত কবি হয়ে উঠব।
রাজা মণীন্দ্র চন্দ্র বাবা নবীন চন্দ্রের নামে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতি বছর পৌষ মাসে এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। সপ্তাহব্যাপী এই মেলায় বিচিত্র মনোহারি প্রদর্শনী ও বিক্রি পাট্টার সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের বিনোদনের জন্য নানা আয়োজনের ব্যবস্থা থাকে। প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য এখানকার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিবছর কোলকাতা থেকে যাত্রাপালা, কবিগান ও সার্কাসের পার্টি এখানে আসে। এই সময়টিতে অজয় নদীর দুই কূলে বীরভূম ও বর্ধমান জেলার বিভিন্ন স্থানে মেলায় মেলায় মুখরিত হয়ে ওঠে। মক্তবের লেখাপড়া শেষ করার পর আমিও প্রায় বছর খানেক কবিগান নিয়ে চাচার সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমার গান অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে গোদা কবিরা তাদের দলে টানার জন্য লোভনীয় প্রস্তাব দিচ্ছে। প্রচুর ব্যস্ততা হৈ-হুল্লোড়, সারাদিন ভাবা—রাতে মঞ্চে কিভাবে প্রতিপক্ষ কবিকে কথার প্যাঁচে ঘায়েল করা, অভিনয়ের কলা কৌশল নিয়ে সময় কেটে গেলেও আমার তাতে খুব একটা সুখ ছিল না। অভিনয় শেষে ভোররাতে যখন সবার সঙ্গে বিছানায় ঘুমাতে যেতাম তখন রাজ্যের চিন্তা এসে আমার মস্তিষ্কে সক্রিয় হয়ে উঠত। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম সহ-শিল্পীদের ঘুমন্ত মুখগুলো। রূপকথার মতো অভিনীত চরিত্ররা রুপালি আলোর মধ্য দিয়ে নেচে নেচে বেড়াত। আমি তখন অস্থির উন্মাদের মতো জীবন-জগতের বিশৃঙ্খলা, বিদেশি শাসন বৈষম্য, সম্পদের বণ্টনহীনতা এবং নিজের জীবনের অনিশ্চয়তার কথা ভাবতাম। বাইরে থেকে সবাই যদিও আমার হাসিখুশি ভাব দেখে, গান কবিতা শুনে ভাবত—আমার মধ্যে কতই না আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে যাচ্ছে। আমি আসলে এক অজানা আশঙ্কা আর গভীর অনিশ্চয়তার শিকার ছিলাম। মাঝে মাঝে আত্মঘাতী হওয়ার উপক্রম হতো, তখন সব কিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে অজানা গন্তব্যের দিকে ছুটে যেতাম।
দিন ও রাতের প্রচণ্ড খাটুনির পরেও আমি ঠিক মতো ঘুমাতে পারতাম না। খুব ভোরে জেগে উঠতাম, মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে যেত। মনে হতো, কোথাও পালিয়ে যাই, সেখানে একটু একা থাকতে পারি। অজয় নদের তীরে বালিয়াড়ির উপর শুয়ে শুয়ে স্বচ্ছতোয়ার কুলকুল ধ্বনির সঙ্গে সুর মিলিয়ে গান গাই। বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে গেলেই নদীর পাড়ে ঘন অরণ্যের সারি। শুকনো ঝোপঝাড় ডালপালায় ভর্তি। এসব কথা যখন আমি ভাবতাম তখন বনের মুনিয়া পাখিগুলো আমার সাথে গান গেয়ে উঠত। এক একটি গাছ হয়ে উঠত অনন্ত নক্ষত্র-বীথির চিরসাথি। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলতাম। গাছদের সঙ্গে কথা বলা, পাখিদের সঙ্গে কথা বলা, পায়ের নিচে বালির কণাগুলোও আমার সঙ্গে কথা বলে উঠত। আমার শৈশবের এই অভিজ্ঞতা ও বনানীর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে আমি ভাষাহীন জগতের সঙ্গে কথা বলার অভ্যাস রপ্ত করি তখন থেকেই—‘বাতয়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’গুলোর সঙ্গে রাত জেগে কথা বলি।
সেদিন মাথরুন নবীনচন্দ্র ইংরেজ স্কুলের মাঠে গান গেয়ে শেষ রাতের দিকে ঘুমাতে গেছি। কিছুতেই ঘুমাতে পারলাম না, এখানে এত বড় স্কুল দেখে আমার মনের মধ্যে আবার হুহু করে উঠল। নিজগ্রামে স্কুলের অভাবে, অর্থের অভাবে মক্তবের নিম্ন-প্রাথমিক পর্যন্ত পড়েই আমার ছাত্র জীবনের ইতি টানতে হয়েছিল। একজন পিতৃহীন দরিদ্র বালকের পক্ষে আজন্ম শিক্ষার তৃষ্ণা নিবারণ করা খুব সহজ নয়। জীবনের সব উদ্দেশ্য যখন লেটোগানের অভিনেতাদের মতো অনিশ্চতায় ডুবে যাচ্ছিল, তখন কেবল মনে হচ্ছিল, এই মাথরুনেই যদি আমি থেকে যেতে পারতাম। এই নবীনচন্দ্র ইংরেজি বিদ্যালয়ে যদি পড়তে পারতাম তাহলে কতই না ভালো হতো। তখনো রাজা মণীন্দ্র চন্দ্র বেঁচে আছেন। তার দানশীলতা তখন মাথরুন কাশেম বাজারের গণ্ডি ছেড়ে কোলকাতা হয়ে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষা প্রসারে তার নিরলস প্রচেষ্টা, বিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগ, স্বদেশি চিন্তা তাকে বিশেষ মর্যাদায় আসীন করেছে। আমি এখানে আসার মাত্র কয়েক বছর আগে রবীন্দ্রনাথও রাজার আমন্ত্রণে কাশিম বাজার গিয়েছিলেন। বর্তমান রাজার পূর্বসূরি মন্মথ রায় ডিরোজিও’র শিষ্য ছিলেন, ডিরোজিও’র মতো বাইশ বছরে জীবন শেষ করেছিলেন। তিনি কোনো মন্দির করেন নি। এই গ্রামে হিন্দু-মুসলমানের প্রায় সমান সংখ্যক বসতি; বর্তমান রাজা হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ করেন না। জীবনে তিনি দেবতার মূর্তি বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা না করে নিজগ্রাম মাথরুনসহ বাংলা ও বাংলার বাইরে অজস্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তার এসব গুণের কথা শুনে আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, তাহলে এই স্কুলে পড়ার জন্য আমার মতো একজন দরিদ্র বালকের পক্ষে রাজার আনুকূল্য পাওয়া এমন কোনো কঠিন নয়।
সে-বার কয়েকদিন আমাদের দল মাথরুনে থেকে গিয়েছিল। তারই এক নির্ঘুম কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে দলের অস্থায়ী আশ্রয় ছেড়ে একা একা ঘুরতে বেড়িয়েছি। পথ-ঘাট যদিও অচেনা তবু অনন্ত কৌতূহল আমায় সারা জীবন পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। কাল রাতে শুনেছিলাম, মঙ্গলকোটের মাথরুন—বাংলার ইতিহাসের এক বিস্মৃত পীঠস্থান। এখানে রয়েছে পাল সেনযুগের লোকেশ্বর বিষ্ণু মূর্তি, ধর্মরাজের দেউল আর বর্তমান মহারাজা মণীন্দ্র নন্দীর জন্মভিটে। প্রচলিত আছে এখানকার কেতুগ্রামের রাজারা কবি চণ্ডীদাসকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আমার মতো একজন ক্ষুদে কবিকে কি এই গ্রাম আশ্রয় দিতে পারে না, আমারও মনে সুপ্ত বাসনা ছিল একদিন আমিও চণ্ডীদাসের মতো মস্ত কবি হয়ে উঠব; মানুষের জন্য গান গাইব—‘শুনহ মানুষ ভাই/ সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ কবি চণ্ডীদাসের স্মৃতিবিজড়িত রাজাদের বাড়ি দর্শনের মানস নিয়ে এক মনে পথ চলতে ছিলাম। একজন অপরিচত লোক আমার পথ রোধ করে দাঁড়াল। বলল, তুমিই কি কালকের কবিগানের ব্যাঙাচি। ব্যাঙাচি নও, তুমি তো দেখি রীতিমতো বিষধর স্বর্প। এই বয়সে এমন গানবাঁধা কোথায় শিখলে? এত কথা কোথায় শিখলে?
তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, তিনি নবীনচন্দ্র হাইস্কুলের শিক্ষক। তারও বাড়ি এই গ্রামে নয়। স্কুলের অফিস কক্ষের পাশে অতিরিক্ত একটি কামরায় বসবাস করে। সেও প্রতিদিন এত ভোরে হাঁটতে বের হয়।
তিনি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, আমি কোন স্কুলে কতদূর লেখাপড়া করেছি। জানালেন, এত অল্প বয়সে আমার মুখে মুখে কবিতা রচনা ও অভিনয়ের ক্ষমতা দেখে তিনি নাকি বিস্মিত হয়েছেন। বললেন, তোমার এসব গান-বাজনার দলে না থেকে ভালো করে লেখাপড়া করা দরকার। তাহলে অনেক ভালো করবে, অনেক বড় কবি হতে পারবে। তোমার বয়স এখনো অনেক কম। তুমি যখন ‘শকুনিবধ’ পালার শকুনির অভিনয় করছিলে, যখন অপূর্ব সুরে বলছিলেন—
‘কোথা গেলি প্রিয় উলুক পুত্র ধন কী দোষে অসময়ে আমায় করিলি বর্জন।.. চিরনিদ্রাতে নিদ্রিত কেন রে প্রাণাধিক সুত কে তোরে করিল এমন।’
আওরঙ্গজেবের মতো ধর্মান্ধ হিন্দু বিদ্বেষী ক্ষমতায় না বসলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এতটা বাধাবাধির কারণ ঘটত না।
তখন আমার মহাকবি মধুসূদনের কথা মনে হলো। তুমি নিশ্চয় মধুসূদনের নাম শুনেছ।কুয়াশার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, আমি অতি দরিদ্র বালক। বাবা নেই, মা বোন ও দুই ভাইয়ের সংসার। পিতার মৃত্যুর পরে বড় ভাইকেও স্কুল ছাড়তে হয়েছে। তার আয় দিয়ে আমাদের চলে না। এখান থেকে প্রায় সত্তর মাইল দূরে আমাদের বসবাস। স্কুলে লেখাপড়ার করার মতো সামর্থ্য আমার নেই। রাস্তার দুপাশের খেজুর গাছগুলোর কাটা চামড়া থেকে ফোঁটা ফোঁটা রস ঝরে পড়ছে। প্রবল শীতের একজন গাছি মালকোচা মেরে একটি দড়ির সমর্থনে খেজুর গাছের সরু শরীরে ঝুলে আছে। দুই হাতে ছ্যানের পোঁচে গাছের মাথার সূক্ষ্ন অংশের ছাল ছড়িয়ে নিচ্ছে। ভাবছিলাম কী অদ্ভূত আমাদের জীবন, সারারাত কর্তনের ব্যথা থেকে গাছের কান্না মানুষের কাছে সুমিষ্ট রস হিসাবে ধরা দেয়। এই উপমা মনে আসতেই আমার মন থেকে সকল কষ্ট তিরোহিত হয়ে গেল। ভাবলাম, মানুষের গান-কবিতা সুর ও সংগীতের প্রকাশ তার নিজস্ব ব্যথা ও বোধের উৎসরণ। জীবনের কোনো কিছুকেই উপেক্ষা করার নয়। একটু বড় হয়ে যখন জেনেছি, আমার প্রিয় কবি কীটসের সেই কবিতার লাইন—‘আওয়ার সুইটেস্ট সংস আর দোজ দ্যাট টেলস আস দ্য স্যাডেস্ট থটস’ তখন মনে হয়েছে—আমিও ঠিক সেদিন এ কথাই বলতে চেয়েছি।
সেই দয়াদ্র শিক্ষক বললেন, তুমি চাইলে আমাদের স্কুলেও ভর্তির চেষ্টা করতে পারো—তাতে যদি তোমার আপত্তি না থাকে। তিনি জানালেন—এই স্কুলের হেড মাস্টার মহাশয় একজন নামকরা কবি। আপনভোলা সাধক মানুষ, তোমার মতো ছাত্র পেলে তিনি হারাতে চাইবেন না। চাইলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে। এ অঞ্চলের অনেক ছাত্র সমর্থবান গৃহস্তের বাড়িতে লজিং থেকে তাদের ছেলে-মেয়ে পড়িয়ে গ্রাসাচ্ছাদন করে থাকে। আর মহারাজার ফান্ড থেকে বৃত্তি পেয়ে গেলে তো কথাই নেই।
কথায় কথায় তিনি বর্তমান রাজার অনেক গুণকীর্তন করলেন। বললেন পরাধীন ভারতবর্ষের কোথাও তখন নাটক নিয়ে কোনো স্কুল ছিল না, তখন মহারাজা নাট্যচর্চার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘দি কাশিমবাজার স্কুল অব ড্রামা’। সেই নাট্যবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষের বাগবাজারের নাট্যদলের বিশিষ্ট অভিনেতা গোবর্ধন বন্দ্যোপাধ্যায়। তার দলে অভিনয় করেছেন, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়িসহ অনেকে। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বহরমপুর সংগীত সমাজ বিদ্যালয়’। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে ১৯০৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে প্রথম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কাশিমবাজার রাজবাড়িতে। সাহিত্য সম্মেলনের সঙ্গে সংগীত সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মহারাজা নাকি বলতেন—‘আমার যা কিছু সম্পত্তি আছে, তার সব অন্যের হিতার্থে, আমি এই সব সম্পদের একজন পাহারাদার মাত্র ’।
তার কথা শুনে মন ভরে গেল। ভাবলাম তাই তো ফিরে গিয়ে কী লাভ! কে-ই বা আছে সংসারে, কি-ই বা আমার কাজ! যদি এখানে স্কুলে ভর্তি হওয়ার কোনো সুযোগ পাওয়া যায়, তাহলে কতই না ভালো হয়। আস্তানায় ফিরে গিয়ে চাচাকে আমার মনের ভাব জানালাম। তিনিও খুব খুশি হলেন, বললেন, তাহলে তো ভালোই হয়, এ পথ তোর জন্য নয়। তুই আরো অনেক বড় হবি। দেখ যদি কষ্টেসৃষ্টে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারিস। আমাদের গ্রামে স্কুল থাকলে আমিও তোকে এ পথে আনতাম না। সামনেই ভর্তির মৌসুম। নিম্ন মাধ্যমিক পাস তো তুই করেছিস। এখন এখানে ভর্তি হয়ে যা, যদিও এটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল, তোকে আটকাতে পারবে না, তোর বয়সী যে কোনো ছাত্রের চেয়ে তুই ঢের এগিয়ে। ইংরেজি না পড়লে এদেশের মুসলমানদের মুক্তি নেই। তুই ভালো করে পড়াশোনা শিখে কাজী বংশের গৌরব পুনরুদ্ধার কর। ফিরে গিয়ে আমি তোর মাকে সব বুঝিয়ে বলব।
চাচা চুরুলিয়া ফিরে যাওয়ার আগে লেটোদল থেকে পাওয়া কয়েকটি টাকা আমার হাতে তুলে দিয়ে গেল। স্কুলের শিক্ষকরা তাকে ভর্তির আশ্বাস দেয়ায় তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন।
এভাবেই মাথরুনের সঙ্গে আমার সম্পর্কের সূত্রপাত। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির মাইনর পাঠের দেড় দুই বছর এই স্বজনবর্জিত স্থানে আমার জীবনের ইতিহাস হয়ে রইল। এই স্কুলে যদিও আমি নিম্ন মাধ্যমিকের ছাত্র, তবু এখানে কবি হিসাবে আমার পরিচিতি আগেই প্রকটিত হয়ে উঠেছিল। কারণ মাথরুনে কবিগান পরিবেশনের সূত্র ধরেই আগমন, ফলে কবি হিসাবে আমি এখানে আলাদা একটি সম্মানও অর্জন করে নিয়েছিলাম। অন্যদের বিচারে আমার উপস্থিত বুদ্ধি, সদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, বক্তৃতা দেবার ক্ষমতা, সংগীতের দক্ষতা সহজেই বিদ্যালয়ে শিক্ষক ছাত্রদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠল। মক্তবে পড়ার সময় থেকেই বাংলার পাশাপাশি আরবি ফারসি এমনকি ইংরেজিতেও কিছুটা জ্ঞান অর্জিত হয়েছিল। নবীনচন্দ্র ইনস্টিউটে অধ্যায়নকালে আমি ইংরেজি ভাষার গঠন প্রণালি সম্বন্ধে জ্ঞান ও স্বাধীনভাবে লেখার ক্ষমতা অর্জন করেছিলাম। এই স্কুলের শিক্ষার মাধ্যম বাংলা ইংরেজি মিশ্রিত হলেও ইংরেজির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হতো। মহারাজার প্রতিষ্ঠিত সকল প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়া হতো এই জন্য যে অল্প-স্বল্প লেখাপড়া যা-ই হোক না কেন, তা দিয়েই যেন ইংরেজ বাহাদুরের ছোটখাটো চাকরিতে অংশ নেয়া যায়। ঔপনিবেশিক আমলে ভারতীয়দের জন্য বড় চাকরির সুযোগ না থাকলেও নিম্নশ্রেণির চাকরিগুলো নির্ধারিত ছিল—খানসামা-আয়া, আর্দালি-চৌকিদার—ভাগ্য ভালো থাকলে তোহশিলদার হওয়াও সম্ভব ছিল।
এই বিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষকই ছিলেন উজ্জ্বল চরিত্র ও উচ্চনৈতিকতার অধিকারী, শিক্ষকগণ বয়সে প্রায় সকলেই ছিলেন বয়সে তরুণ, কেবল সংস্কৃত শিক্ষক হেড পণ্ডিত মহাশয়ের বয়স কিছুটা প্রৌঢের দিকে। টিকা পৈতা ধূতি-তৈলযুক্ত চেহারায় আরো কিছুটা প্রবীণই দেখাত। পুরো বিদ্যালয়ে একজন মাত্র ফারসির শিক্ষক ছিলেন মুসলমান, তার বয়সও কিছুটা বেশি; মুখভর্তি লম্বাদাড়ি ও পান-তামাকের রঙিন ওষ্ঠের আড়ালে খুব একটা ঠাহর করা যেত না। পণ্ডিত ও মৌলবি সাহেবের মধ্যে ছোঁয়াছুঁয়ির আড়াল থাকলেও তারা আড়াল বাঁচিয়ে রেখে নিজেদের মধ্যে সর্বাধিক সদ্ভাব বজায় রাখতেন। তাদের মধ্যে ঝগড়া ও তুমুল বিতণ্ডার কারণও ঘটত। বিতণ্ডার বিষয় ছিল মুসলমান আমল আর ইংরেজ আমলের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে। পণ্ডিত মহাশয়ের বিচারে আকবরের পরে দারাশুকোই হতে পারতেন এদেশের যোগ্য শাসক, আওরঙ্গজেবের মতো ধর্মান্ধ হিন্দু বিদ্বেষী ক্ষমতায় না বসলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এতটা বাধাবাধির কারণ ঘটত না। আর মৌলবি সাহেব আওরঙ্গজেবকেই ভারতের শ্রেষ্ঠ শাসক বলে মনে করেন। তার মতে আকবর এবং দারাশুকো ছিলেন কপট, তারা হিন্দুদের বশে রাখার জন্য কপটতার আশ্রয় নিয়েছেন। নিজ নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণই ছিল তাদের বাহ্যিক বিরোধিতার কারণ। সব সময় তারা একে অন্যকে কথায় আক্রমণ করত, খোচা দিত। মৌলবি সাহেব বলতেন, মুসলমানরা ভারতে না এলে তোমরা গাছ থেকে নামতে পারতে না পণ্ডিত, শাখামৃগের মতো এ ডাল থেকে ও ডালে ঘুরে বেড়াতে। এখন তো একটা লেংটি পড়ে আছ, তখন শুধু এই পৈতি ছাড়া কিছুই ঊর্ধ্বাঙ্গে থাকত না।
এক আত্মীয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এই কিশোর বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাস। কিছুদিন পরে ব্রিটিশ আদালতের রায়ে তার ফাঁসি হয়ে যায়।
পণ্ডিত বলতেন, সেও ভালো, তোমাদের মতো আমরা তো ডাকাতি করে খাই নি, পরের ধন পরের মেয়ে মানুষ দখল করি নি। শ্রেফ ডকাতি ছাড়া একে কী বলবা। সুলতাম মুহম্মদের কথাই ধরো না, সৈন্য-সামন্ত নিয়ে সতের বার এদেশে ঢুকেছে শুধু মন্দিরের সোনা লুট করতে। তাকে তোমরা গাজী বলো। গাজী তো নয়, সব পাজির দল।
মৌলবি বলতেন, ওই সোনা তো তোমাদের কাজে আসত না পণ্ডিত। পূজারিকে প্রলোভন দিয়ে তার সর্বস্ব দেবতার দেউলে লুকিয়ে রাখলে কার লাভ। এও এক ধরনের ডাকাতি বই কি।
কিন্তু তারা একজন আরেকজন ছাড়া এক মুহুর্ত একা থাকতে পারতেন না। বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকগণ তাদের নাম দিয়েছিলেন পণ্ডিত-মৌলবি প্যাক্ট, যদিও তখনো বেঙ্গলপ্যাক্ট কিংবা গান্ধী-আরউইন প্যাক্টের সূচনা হয় নি। ছুটির দিনে তারা নিজেদের বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকতে না পারলেও বাইর বারান্দায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন—নামাজ আর সন্ধ্যা আহ্নিকের সময়টুকু বাদে।
বিদ্যালয়ে প্রবেশের আগেই এখানকার প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয় হলো, আমি তার কথা আগেই শুনেছিলাম। তার খ্যাতি কেবল এই স্কুলের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বলা চলে তার নামের মোহে আমি এই গ্রামে থেকে গিয়েছিলাম। প্রথম দিনে ভোরের অস্পষ্ট আলোয় পথ চলতে যে শিক্ষক আমায় এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন, তিনিই বলেছিলেন—এখানকার প্রধান শিক্ষক একজন কবি, লেখাপড়া শিখলে আমিও একদিন তার মতো কবি হতে পারব।
প্রথম দেখায় তিনি প্রসন্ন হয়েছিলেন। তবে তার চোখে মুখে কিছু বিস্ময় ছিল, চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি ইচ্ছুক ছাত্রদের চেয়ে গায়ে-গতরে আমি কিছুটা বেড়ে গিয়েছিলাম। তবে তার চেয়ে আমিই মনে হয় বেশি অবাক হয়েছিলাম, আমার ধারণা ছিল কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক বয়স্ক একজন মানুষ হবেন। মাত্র পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের এক তরুণ, মাথার মাঝখান দিয়ে সিঁথির দুধারে চুলগুলো কান পর্যন্ত নেমে এসেছে। একহারা গড়ন, গলায় বৈষ্ণবদের কণ্ঠি, নাকের ওপরে গোল চশমা, শাদা পাঞ্জাবি-ধূতি, শীতের দিন বলে ঘাড়ের উপর টানানো একটি পশমি শাল—সব মিলে তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানিয়ে গেছে।
প্রথম দিনের সাক্ষাতে আমাদের এতটুকুই পরিচয় হয়েছিল। তিনি হয়তো কিছু বলে থাকবেন—হুবহু তা আজ মনে নেই। তবে আমি সেদিন তার ছাত্র হতে পেরে বড় আনন্দিত হয়েছিলাম। ইতোমধ্যে তার কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এখানে শিক্ষকতার শুরুতে কাশিমবাজারের রাজার আহ্বানে সাহিত্যে সম্মেলেনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। কালিদাস রায় এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তার কবিতা পড়ে বলেছিলেন—‘কুমুদরঞ্জনের কবিতা পড়লে বাঙলার গ্রামের তুলসীমঞ্চ, সন্ধ্যাপ্রদীপ, মঙ্গলশঙ্খের কথা মনে পড়ে।’
ছাপানো অক্ষরে তার কবিতার বই দেখে আমার কৌতূহল আরো বেড়ে গিয়েছিল। বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে তার ‘শতদল’ ‘বন-তুলসী’ ও ‘উজানী’ নামের কাব্যগ্রন্থ তিনটি তখনই পাওয়া যেত। স্কুল লাইব্রেরিতে কোলকাতা থেকে যে-সব সাহিত্য মাসিক পাক্ষিক আসত সেখানেও তার কবিতা ছাপার অক্ষরে থাকত। কবিতা লেখার অভ্যাস ততদিনে আমি রপ্ত করে ফেললেও সেগুলো কোলকাতার কাগজে ছাপার মতো ছিল না। তার একটি কবিতার কথা আমার এখনো মনে আছে।
‘বাড়ি আমার ভাঙন ধরা অজয় নদীর তীরে জল সেখানে সোহাগ-ভরে স্থলকে ঘিরে রাখে।’
বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরেই জাতীয় জীবনের এক ভয়ংকর ঘটনার দোলা এই মাথরুন গ্রামকেও আন্দোলিত করে তুলল। মাত্র চার বছর আগে বড়লাটকে মারার ব্যর্থ প্রচেষ্টার জন্য কিশোর ক্ষুদিরামের ফাঁসিতে দেশ যেভাবে কেঁপে উঠেছিল—এটিও তারচেয়ে কম নয়। যদিও এটি ছিল জাতীয় জীবনের ঘটনা, তবু এই ঘটনার পরোক্ষ নায়ক লালবিহারী বসু মাথরুন গ্রামের সন্নিকটের সুবলদহ গ্রামের সন্তান। তাঁর প্রত্যক্ষ মদদে ও শিক্ষায় ষোল বছরের কিশোর বসন্ত বিশ্বাস বড়লাট হার্ডিঞ্জের ওপর বোমা নিক্ষেপ করেন। ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকির মতো এবারও এই বিপ্লবী বালকের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়। মেয়েদের পোশাকে এবং লীলাবতী নামে বসন্ত বিশ্বাস হার্ডিঞ্জের শোভাযাত্রার মধ্যে বোমা নিক্ষেপ করে দিল্লির রাজপথ রক্ষাক্ত করে তোলেন। তাকে ধরার জন্য ব্রিটিশ পুলিশ এক লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। এই কিশোর বিপ্লবী এতই দুর্ধর্ষ ছিলেন যে তাকে ধরা সম্ভব নয় বলে দিল্লি মসজিদ থেকে ব্রিটিশ পুলিশকে পরিহাস করে তিনি পত্র লেখেন। কারণ পুলিশ জানত হার্ডিঞ্জের শোভাযাত্রায় হামলাকারী একজন নারী। এখানেই বসন্তের বিপ্লবী কার্যক্রম শেষ হয় না। তিনি লাহোরে গিয়ে অন্যান্য বিপ্লবীর সঙ্গে লরেন্স গার্ডেনে পুলিশ অফিসার্স ক্লাবে বোমা বর্ষণে যুক্ত হন। ঘটনার দুই বছর পরে এক আত্মীয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এই কিশোর বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাস। কিছুদিন পরে ব্রিটিশ আদালতের রায়ে তার ফাঁসি হয়ে যায়। বসন্ত বিশ্বাসের বাড়ি নদিয়া জেলায় হলেও রাসবিহারী বসু ছিলেন পূর্ব বর্ধমানের। বহু বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকায় ব্রিটিশ সরকারের সন্দেহভাজন হয়ে ওঠেন তিনি। এবং শেষ পর্যন্ত দেশত্যাগে বাধ্য হন। আমি মাথরুন নবীনচন্দ্র স্কুলের ছাত্র থাকাকালে প্রবল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সুবলদহ গ্রামে ত্রাণকার্য বিতরণে তিনি এখানে এসেছিলেন। আমিও ধীরে ধীরে তার বিপ্লবী কাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি, সুভাষও তাক গুরু মানতে বাধ্য হয়। এটা বোঝার মতো আমাদের বয়স হচ্ছিল ব্রিটিশ খেদাতে হলে সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না।
মাথরুন গ্রামটি তখনকার তুলনায় বেশ বর্ধিষ্ণু ছিল। বর্তমান রাজার পিতা ও তার পূর্বপুরুষেরা গুড়ের ব্যবসা করে অনেক টাকা উপার্জন করেছিলেন। রাজার কৃপার ফলে এখানে এক ধরনের প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। বর্ধমানের এই পূর্বাঞ্চলে অনেক গুণী লোকের জন্ম। বাংলা মহাভারতের কবি কাশীরাম দাশ এখান থেকে অদূরে কাটোয়ার সিঙ্গি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা কমলাকান্তের তিন সন্তানই ছিলেন কবি। আমার গুরু কুমুদরঞ্জনের নামানুসারে আজ কোগ্রামটি কুমুদগ্রামে পরিণত হয়েছে, তেমনি সিঙ্গি গ্রামটিও কাশীরাম দাসের পরিচয়ে পরিচিত। আমি এখানে থাকা অবস্থায় সিঙ্গি গ্রামে ভারত পাঁচালীর এই কবির বসত ভিটা দেখার জন্য কয়েকবার গিয়েছি।
সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পাড়ের মানুষের অধীনস্ত থাকতে হয়, তাদের পড়াশোনা মানে তো পরিণামে তাদেরই দুষ্কর্মের সহযোগী হওয়া।
গ্রাম থেকে এতটা দূরে এসে এর আগে কখনো থাকি নি। সংসারের বন্ধনহীন ছিন্ন তরীর মতো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভেসে চলা এখন আমার অভ্যাসের অংশ হয়ে গেছে। তাই বলে সত্যি সত্যি এসব করতে আমার ভালো লাগত তা নয়। প্রায়ই মায়ের কথা মনে পড়ত, ছোট ভাই আলী হোসেনের কথাও, বড় ভাই সাহেবজান আর আমার মধ্যে বয়সের ব্যবধান থাকলেও আলী হোসেন ও আমি পিঠাপিঠি হওয়ার কারণে অনেকটা বন্ধুর মতো ছিলাম।
পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলেও মাথরুনে আমার আর থাকা সম্ভব হলো না। আগে থেকেই মনে হচ্ছিল, এসব পড়ালেখা আমাদের জন্য নয়, সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে আবার লেটোদলে যোগ দিই। যে আশায় এই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম সে-আশারও গুড়ে বালি হলো। খাওয়া থাকায় যদিও সমস্যা হচ্ছিল না, স্কুল কর্তৃপক্ষ আমার জন্য কোনো বৃত্তির ব্যবস্থা করতে পারলেন না। বৃত্তি ছাড়া আমার পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কোনো ভাবেই সম্ভব নয়।
মনে হলো এসব পড়াশোনা করে কী লাভ। কার জন্য এসব পড়াশোনা। তারচেয়ে ডাকাত হয়ে ধনীদের কাছে থেকে সম্পদ লুট করে এনে গরিবদের মধ্যে ভাগ করে দিলে কতই না ভালো হতো। যে দেশের মানুষ নিজের দেশ নিজে শাসন করতে পারে না, সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পাড়ের মানুষের অধীনস্ত থাকতে হয়, তাদের পড়াশোনা মানে তো পরিণামে তাদেরই দুষ্কর্মের সহযোগী হওয়া। ক্ষুদিরামের মতো বসন্ত বিশ্বাসের মতো বিপ্লবী হয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলে পড়াও এরচেয়ে ঢের ভালো।
তখন থেকেই বুঝেছিলাম, স্কুল কলেজে লেখাপড়ার সঙ্গে ভালো ফলাফলের সঙ্গে মেধার কোনো যুক্ততা নেই। ইচ্ছের কোনো মূল্য নেই। লেখাপড়ার সঙ্গে কেবল আর্থিক সামর্থ্যের যুক্ততাই প্রধান, এটা বিনিয়োগ ব্যবসা ছাড়া কিছুই নয়। লেখাপড়া না শিখলে রাষ্ট্রীয় শোষণ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এসব নিদারুণ চিন্তা আমায় অসুস্থ করে তুলছিল। একদিন লেটোদলে গান গাইতে এসে যেভাবে এই পাণ্ডব বর্জিত দেশে থেকে গিয়েছিলাম, ঠিক একদিন কাউকে কিছু না বলে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউটের মাঠ ছেড়ে, কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের ছায়া ছেড়ে, মঙ্গলকোট মাথরুনের রাজবাড়ি ছেড়ে নীরবে নিশ্চুপে পূর্বের মতো আরেক অজানার পথে পাড়ি দিয়েছিলাম।



