কাকে বলব আফ্রিকার সাহিত্য

পৃথিবীর ১৯৫টি দেশের ৫৪টিই আফ্রিকার বিশাল মহাদেশের অন্তর্গত। আফ্রিকার রয়েছে হাজারেরও বেশি ভাষা ও উপভাষার অজস্র জাতি, উপজাতি। তাদের রয়েছে শত শত বছরের সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাস। ১৭ শতকের আগে থেকে আফ্রিকার লোকদের চুরি করে নিয়ে গিয়ে অন্য মহাদেশে বন্দি করে রাখা হয়েছে। সেখানে হয়েছে আরেক ধরনের আফ্রিকার ইতিহাস। ১৮ শতক থেকে আফ্রিকার মাটি কেড়ে নিয়ে ইউরোপের কয়েকটি দেশ বেঁধেছে তাদের কলোনি। সেখানে তারা সৃষ্টি করেছে আরেক ইতিহাস। আফ্রিকার বাইরেই আফ্রিকার সাহিত্য প্রকাশিত হয়েছে। আফ্রিকা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসেই আফ্রিকার অনেক অনেক কবি-সাহিত্যিক ভিন্ন ভাষায় তাদের মাতৃভূমির জনগণের কথা স্মরণ করে অজস্র সাহিত্য রচনা করেন। আফ্রিকার সাধারণ জনগণের অনেক অংশ হয়তো তা পড়তে ও বুঝতে পারেন না। তাহলে কাকে বলব আফ্রিকার সাহিত্য?

চিনুয়া আচেবে, ১৯৩০ সালে নাইজেরিয়ার এক বৃহৎ গোত্র ইগবো’র বংশের সন্তান, তৎকালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৯৫৪ সালে নাইজেরিয়ার বেতারে চাকরিসূত্রে লন্ডন বিবিসিতে প্রশিক্ষণে গিয়ে ঔপন্যাসিক গিলবার্ট ফেলপের সাথে তার পরিচয় হয়। তাঁর মাধ্যমে প্রকাশক হেইনিম্যানের সঙ্গে পরিচিত হয়ে চিনুয়া তার ‘থিংস ফল এপার্ট’ নামে ইংরেজি ভাষায় লেখা উপন্যাসটি ১৭ জুন ১৯৫৮ সালে প্রকাশ করেছিলেন। তারপর বইটি ব্রিটিশ মিডিয়ার নজরে এলো এবং এরপর যা হল তা তো এক ইতিহাস! এরপর শুরু হল ইংরেজী ভাষায় লেখা আফ্রিকান সাহিত্যিকদের শত শত বইয়ের প্রকাশনা উৎসব।

১৯৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতার দ্বিশতবার্ষিকী উদযাপনের সময় অ্যাফ্রো-আমেরিকান লেখক অ্যালেক্স হ্যালির যে বইটি প্রকাশিত হয়, তার নাম ‘রুটস : দ্য সাগা অব অ্যান আমেরিকান ফ্যামেলি’। হ্যালির পূর্বপুরুষকে আফ্রিকা থেকে অপহরণ করে দাসে পরিণত করা হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর কোনো এক সময় পশ্চিম আফ্রিকার গাম্বিয়া সাগর-উপকূল থেকে। বর্তমানে আমেরিকান নাগরিক হ্যালি তার পূর্বপুরুষের জীবনে ঘটে যাওয়া রক্তাক্ত-নিষ্ঠুর দাসজীবনের ইতিহাস নিয়ে লিখেছিলেন বইটি। এই বইকে কি আমরা আফ্রিকার সাহিত্য বলতে পারি না?

গুগি ওয়া থিওংও, কেনিয়ার প্রখ্যাত সাহিত্যিক ১৯৩৮ সালে গিকয়ু ভাষাভাষি এক কৃষক পরিবারে জন্ম নিয়ে কেনিয়ায় পড়াশোনা শেষ করে ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব লিডসে পড়তে গিয়েছিলেন। তিনি ১৯৬৪ সালে ইংরেজি ভাষায় ‘ডোন্ট ক্রাই, চাইল্ড’ (কেঁদো না, বাছা) নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। ইংরেজি ভাষায় এর পরেও অনেকগুলো উপন্যাস লিখে তিনি ১৯৭৭ সালে ইংরেজি ভাষাকে বিদায় জানালেন এবং সরাসরি তার মাতৃভাষায় গিকয়ুতে উপন্যাস লিখেছেন। তাকে বলব আফ্রিকার সাহিত্য?

নাকি মিশরের কায়রোতে জন্মগ্রহণকারি নাগিব মাহফুজ আরবি ভাষায় ১৯৫০-এর দশকে কয়েকটি উপন্যাস লিখেছিলেন, যার মধ্যে কায়রো ট্রিলজি রয়েছে, সেই আরবি বইগুলোকে আফ্রিকার সাহিত্য বলব?

লিথুয়ানিয়া থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় আগত এক ভদ্রলোকের সঙ্গে ব্রিটেন থেকে আগত আরেক নারীর বিবাহিত জীবনে ১৯২৩ সালে জন্ম নেয় এক কন্যাশিশু। যার নাম লডিন গার্ডিনার। এই শিশু বড় হয়ে ইংরেজি ভাষায় ১৯৭৪ সালে ‘দ্য কনজারভেশনিস্ট’ এবং এরকম আরো কয়েকটি রচনা লিখে নোবেল পুরস্কার পেলেন, তাকে বলব আফ্রিকার সাহিত্যিক?

লিওপোল্ড সেনঘর নামে একজন কবি, ১৯০৬ সালে সেনেগালের ডাকারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২৪ সালে ফ্রান্সে অভিবাসী হন, সোরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন- হিটলারের বাহিনীর হাতে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছেও বেঁচে গিয়েছিলেন। দেশে ফিরে এসে ১৯৬০ সালে সেনেগালের প্রেসিডেন্ট হন তিনি। ফ্রেঞ্চ ভাষায় লেখা কবিতার কয়েকটি বই তাকে বিশ্বসাহিত্যে সমাসীন করেছে! তাকেও আফ্রিকান কবি বলব!

ওল সোয়েঙ্কা, ১৯৩৪ সালে নাইজেরিয়ায় জন্ম নেওয়া একজন কবি, নাট্যকার ও লেখক ১৯৮৬ সালে নোবেল পুরস্কার পেলেন। আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া কালো মানুষদের মধ্যে তিনি প্রথম নোবেল পুরস্কার জয় করেছিলেন। ইংরেজি ভাষায় লেখা নাটক, কবিতা তাকে বিখ্যাত করেছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী হয়েছেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর কোনো এক সময় পশ্চিম আফ্রিকার গাম্বিয়া সাগর-উপকূলে কুনটা কিনটে নামে এক কিশোরকে আমেরিকার দাস ব্যবসায়ীরা চুরি করে নিয়ে বিক্রি করল সম্ভবত বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে। কুনটা কিনটের কয়েক প্রজন্ম পরের পৌত্রের নাম ছিল অ্যালেক্স হ্যালি। হ্যালির মা তার পুত্রকে কিছু আফ্রিকান শব্দ মনে রাখতে বলেছিলেন, তার মধ্যে একটা শব্দ ছিল কুনটা-কিনটে। হ্যালি এই শব্দগুলোর অর্থ খুঁজতে গিয়ে তার পূর্বপুরুষের মাতৃভূমি গম্বিয়ায় গিয়েছিলেন। সেখানে একজন প্রবীণ গোত্রপতির সাক্ষাৎকার নিতে যান তিনি। গোত্রপতির সঙ্গে হ্যালি সরাসরি কোনো কথা বলতে পারেননি, কারণ দুজনেই একে অন্যের ভাষা বুঝতে পারেননি। দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলতে গিয়ে গোত্রপতি তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, অ্যালেক্স হ্যালি কোন দেশ থেকে এসেছেন। উত্তর দিতে গিয়ে হ্যালি তার পূর্বপুরুষের দেশটিতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, আমি একজন আমেরিকান। যে ভূমি থেকে তার পূর্বপুরুষকে গুম করা হয়েছিল, সেই দেশটির নাম তিনি উচ্চারণ করতে পারেননি। আমেরিকান নাগরিক হ্যালি তার পূর্বপুরুষের জীবনে ঘটে যাওয়া রক্তাক্ত-নিষ্ঠুর দাসজীবনের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন ‘রুটস: দ্য সাগা অব এন আমেরিকান ফ্যামেলি’। এই বইকে কি আমরা আফ্রিকার সাহিত্য বলতে পারি না?

আবদুল রাজাক গুরনাহ ১৯৪৮ সালে সালতানাত অব জাঞ্জিবারে (আজকের তানজানিয়ায়) জন্ম নিয়েছিলেন। ষাটের দশকে মাতৃভূমির রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় তার পরিবারটি যুক্তরাজ্যে অভিবাসী হতে বাধ্য হয়। গুরনাহ পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করে ইংরেজি ভাষায় উপন্যাস লিখে আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী হন। মাতৃভাষা শোয়াহেলি হলেও ইংরেজি ভাষায় লেখা তাঁর উপন্যাসগুলোর জন্য ২০২১ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। চিনুয়া আচেবে যেমন ‘ডাব্লিউ বি ইয়েটস’-এর একটি কবিতা থেকে ‘থিংস ফল এপার্ট’ নামকরণ করেছিলেন, তেমনি আবদুল রাজাক গুরনাহ তাঁর গ্রেভ হার্ট বইটির নাম উইলিয়াম শেকসপিয়রের নাটক ‘মেজার ফর মেজার’ থেকে নিয়েছেন। ইংল্যান্ডবাসী গুরনাহর রচনাবলিকে কি আফ্রিকার সাহিত্য বলা যাবে?

আফ্রিকা মহাদেশের নিয়তিতেই যেন লেখা হয়েছে, তাদের এই মাতৃভূমি, মাতৃভাষা এবং লেখকদের অবস্থানে একটি স্ববিরোধ সব সময় দৃশ্যমান থাকবে। আমরা যদি ইতিহাসের আরো পেছনে খুঁজতে যাই, তাহলে আরো বিস্ময়কর চিত্র খুঁজে পাব।

১৭ শতকে আফ্রিকানরা ল্যাটিন ভাষায়ও কবিতা লিখেছেন- এরকম প্রমাণও আছে। ১৭০৩ সালে ঘানায় এক্সিমে জন্ম নিয়েছিলেন এনটন উইলহেম এমো, যিনি দাস হিসেবে বিক্রি হয়েছিলেন আমস্টার্ডামে। অথচ ভাগ্যচক্রে তিনি হল্যান্ডের হাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশাস্ত্রে উচ্চবিদ্যা লাভ করে অধ্যাপক হয়েছিলেন। দর্শন ও আইনের ওপর ল্যাটিন ভাষায় লেখা তার চারটি লেখা আর জার্মান ভাষায় লেখা একটি কবিতা কালের গর্ভে বেঁচে রয়েছে। জার্মান ভাষায় লেখা একটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ এরকম :

To the vivacious spirit in clever meditation
And unwearied in the matters of thorough studz
High noble person, you show that in the order of the scholars
You are accepted as a star, a brilliante star of the first dimension.

Which becomes brighter and brighter in the halo of new comers
Such a big reward Wisdom gives her sons
That’s enough! From Heaven, pleasure, which is enormous,
Must crown you and yours in the fullness of blessings.

ঘানার আরেকজন দাস জাকবাস এলিজা ক্যাপিটেইন (১৭১৭-১৭৪৭) [Jacobus Elisa Johannes Capitein] হল্যান্ডের জিল্যান্ডে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে ‘দাসপ্রথা ঈশ্বরের প্রবর্তিত আইনের বিরোধী নয়’ বলে প্রচার চালিয়েছেন এবং অনেকগুলো খ্রিষ্টীয় ধর্মসংগীত রচনা করেছেন।

১৫১৬ সালে জন্ম নেওয়া জুয়ান ল্যাটিনো নামে একজন আফ্রিকান পশ্চিম আফ্রিকার ইথিওপিয়া থেকে তার মাতাসহ অপহৃত হয়ে স্পেনে নীত হন। সেখানে একজন ডিউকের বাড়িতে ক্রীতদাস হিসেবে থাকতে গিয়ে তার উচ্চ শিক্ষার সুযোগ ঘটে। পরবর্তী জীবনে জুয়ানের লেখা চারটি সাহিত্যকর্ম বেঁচে আছে, যা এখনো ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।

২০০৭ সালে নোবেল পুরস্কারজয়ী ডরিস মে লেসিংয়ের জীবনটাই উপন্যাসের মতো। ইংল্যান্ডের ক্যাপ্টেন আলফ্রেড টেইলরের মেয়ে ডরিস ১৯১৯ সালে ইরানে জন্ম গ্রহণ করেন। কারণ, তার বাবা তখন ইরানে একটা ব্যাংকে চাকরি করতেন। সেখান থেকে তার বাবা ১৯২৫ সালে আফ্রিকায় ইংল্যান্ডের তৎকালীন উপনিবেশ রোডেশিয়ায় ১০০০ একর জমিতে ভুট্টার চাষ করার জন্য সপরিবারে উপস্থিত হন। ডরিস সেখানে কনভেন্ট স্কুলে পড়ালেখা করেন, এরপর ইংল্যান্ডে ফিরে তিনি গঁফ্রাইড লেসিংকে বিয়ে করেন। ডরিসের দেখা কৈশোরজীবনের এই রোডেশিয়াই পরবর্তীকালে জিম্বাবুয়ে হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করেন। রোডেশিয়ার স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা তার বই ‘গ্রাস ইজ সিংগিং’ ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। আফ্রিকাকে নিয়ে লেখা তার বই আফ্রিকান স্টোরিজ, গোল্ডেন নোটবুক ইত্যাদি বিশ্বখ্যাতি অর্জন করে। এভাবেই ডোরিস আফ্রিকার বর্ণবাদী সমাজের বিরুদ্ধে একজন যোদ্ধা হয়ে আফ্রিকার সাহিত্যে স্থান করে নেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার সাদা-শরীরের লেখক অ্যালান প্যাটন ১৯৪৮ সালে ‘ক্রাই, দ্য বিলাভেড কান্ট্রি’ বা ‘কাঁদো, হে আমার প্রিয় দেশ’ নামে একটা উপন্যাস লিখে বর্ণবৈষম্যবাদের প্রতি পৃথিবীর জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার জবরদখলকারীদেরই বংশধর অ্যালেন একসময় জোহানেসবার্গে দেশীয় কৃষ্ণবর্ণ তরুণদের সংশোধনাগারের অধ্যক্ষ ছিলেন- প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের গণহারে গ্রেপ্তার করে বন্দি করে রাখার আনুষ্ঠানিক কারাগার- তিনিই রচনা করেছেন বর্ণবাদবিরোধী এক মহান আলেখ্য- ‘কাঁদো, হে আমার প্রিয় দেশ’। তার পুর্বপুরুষেরা সৃষ্টি করেছেন বর্ণবৈষম্যবাদ, তারাই শোষণ করেছেন আফ্রিকার সম্পদ, হত্যা করেছেন লক্ষ লক্ষ আফ্রিকাবাসীকে। আবার তারাই বিশ্ববাসীকে উপন্যাস লিখে শোনাচ্ছেন দক্ষিণ আফ্রিকায় কী রকম নির্যাতন হচ্ছে কালো মানুষের প্রতি!

মরিশাসের ফ্রেঞ্চ ভাষার লেখিকা আনন্দ দেবী (১৯৫৭) [Ananda Devi (Ananda Devi Nirsimloo-Anenden]। বাবা ও মা ভারতের তেলেগু বংশের ইন্দো-মারিশিয়ান। লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়া এই লেখিকার বিখ্যাত উপন্যাস ‘রুয়ে লা পাউড্রিয়েবে’ (১৯৮৮) এবং ‘লে ভয়েল ডি দ্রৌপদী’ (১৯৯৩) এছাড়া ‘পাগলি’ নামে তার একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। এই ‘পাগলি’ শব্দের অর্থ বাংলায় মানসিক রোগী নারী। তাকেও আমরা আফ্রিকার সাহিত্য বলব?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *