একটা সাংস্কৃতিক ঝড় উঠুক

কত বীরত্বগাথা, সংস্কার আর অগ্রগতি- বলে শেষ করা যাবে না। আবার অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের ধসও নেমেছে। সবচে বেশি চোখে পড়ে সংস্কৃতির জমিনে। আমাদের লোকসংস্কৃতি আজ মুমূর্ষু। আমাদের নিজস্ব নাট্যরূপ যাত্রা আজ রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার অভাবে ভুগছে। হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালির নিজস্ব নাচ-গান। আমাদের চলচ্চিত্র রোগাক্রান্ত। সিনেমা হল ভেঙ্গে গড়ে উঠছে শপিং মল আর বইয়ের বাজার ভেঙে কাপড়ের দোকান। নাটক হয়ে পড়েছে প্রধানত শহুরে ব্যাপার এবং ক্রমান্বয়ে ঢাকাকেন্দ্রিক। গ্রামীণ অনুষ্ঠানে একসময় যেসব গান-বাজনা হত, এখন তা আর শোনা যায় না। এখন বিয়ে, মুসলমানি, পূজাপার্বণ প্রায় সব অনুষ্ঠানেই সিনেমার নাচ-গানের সমাহার, যা আবার দেশি-বিদেশি যেকোনো কিছু হতে পারে। দেশে বাড়ছে দালান-কোঠা। তাল মিলিয়ে বাড়ছে কংক্রিটের হৃদয়। তাই এখন ‘একতারা বাজাইয়ো না, দোতারা বাজাইয়ো না, … একতারা বাজাইলে মনে পড়ে যায়, মোরা একদিন বাঙালি ছিলাম রে।’

সংস্কৃতির প্রাণরস নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমাদের সমাজদেহে নানারকম বিকার দেখা দিচ্ছে। বছর বছর পাশের হার ও শিক্ষার হার বাড়ছে। সেইসাথে বেশি করে ঘটছে নকল ও প্রশ্নপত্র ফাঁস। বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জ্যাম ও সড়ক দুর্ঘটনা। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবার মধ্যে দুর্নীতিপরায়ণ লোকের জয়জয়কার। দুর্নীতির অট্টহাস্য আর সুনীতির কান্না দুইই সমান তালে বাড়ছে। চলছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ আর নীতিকথার যেমন-খুশি-তেমন-সাজো। দুর্নীতিবাজ ও নীতিবাজ দুপক্ষই কেউ বেশি কেউবা কম ফায়দা লুটে নেয়। আগে গল্প-সিনেমায় সৎ মা নায়ক-নায়িকার খাবারে বিষ মিশিয়ে তাকে মারার চেষ্টা করত। বাস্তবে সকল সৎমা খারাপ না, অনেকে মায়ের মতোই আপন। তবে এখন সৎ মা নয়, ব্যবসায়ীরা নায়ক-নায়িকা নয়, দেশের সকল মানুষের খাবারে বিষ মিশিয়ে মুনাফার পাহাড় গড়ছে। ডায়রিয়ায় এখন আগের মতো মানুষ মারা যায় না, বসন্ত নির্মূল প্রায়, যক্ষা হলে রক্ষা নাই মিথ্যা হয়ে গেছে। তাতে কি? ঘুষ, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, ইভটিজিং, খাদ্যে বিষ মেশানো এসব মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক ভালো কথার পুষ্পবৃষ্টি দিয়ে কি এ মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে?

আমাদের নৈতিক শক্তির জাগরণ প্রয়োজন। কিন্তু নৈতিকতা শুধু বই-পুস্তকের বিষয় না। এটি একটি চর্চার বিষয়। আর সে চর্চা শুধু ব্যক্তিক নয়, দলীয়, সামাজিক। খেলাধুলা, বইপড়া, সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে আবৃত্তি-নাচ-গানের মতো সাংস্কৃতিক উৎসবের মধ্য দিয়েই প্রকৃত নৈতিকতার শিক্ষা হয়। নৈতিকতা ক্যাপসুল বা সিরাপ আকারে দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না। এটি বোতলজাত বিশুদ্ধ পানির চেয়েও বেশি কিছু। এটি মানুষের আক্সিজেন যা কেবল সংস্কৃতিচর্চার হাওয়া থেকেই পাওয়া যায়। আজকাল দেশে সেই হাওয়ারই বড় অভাব। যেটুকু হাওয়া এখনও মানুষের হৃদয়কে বাঁচিয়ে রেখেছে, তা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত চেষ্টার ফল। আর কিছু চর্চা হয় চারকোণা বাক্সে, হঠাৎ কিছু ভালো হলেও প্রধানত ব্যবসায়িক স্বার্থে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা সামান্যই।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষার বাহন হিসেবে আমাদের লোক-সংস্কৃতি, যাত্রা প্রভৃতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছিলেন। ‘ছাত্রদের নীতিশিক্ষা’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমরা যেমন ছেলেদের কাদায় লুটাইবার সুখ পরিহার করিয়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকিবার সুখ ভোগ করিতে শিক্ষা দিই, সেই প্রকারে তাহাদিগকে অপবিত্র ও অন্যায় কার্য পরিহার করিতে শিক্ষা দেওয়া উচিত। কিন্তু এ প্রকারে শিক্ষা দু-চারিটি শুষ্ক নীরস নীতিবচনের কর্ম নহে; ইহা ঘরে ঘরে পদে পদে সহস্র ছোটোখাটো খুঁটিনাটির উপর দৃষ্টি রাখার কর্ম, ইহা বাল-হৃদয়ে প্রবেশ করিয়া তাহাদের সুখদুঃখ, কষ্ট আহ্লাদ সহানুভূতির সহিত বুঝিয়া চলার কর্ম। নীতিবচনের বাঁধি বোলের মধ্যে পবিত্রতা ও ন্যায়ের সৌন্দর্য দেখিতে পাওয়া যায় না, যদি পবিত্রতা কতদূর সুন্দর ও অপবিত্রতা কতদূর কুৎসিত ইহা হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করাইতে চাহ তো বরং ভালো নভেল ও কবিতা পড়িতে দাও। মরাল টেক্সটবুক-এর সহিত হৃদয়ের কোনোই সংস্রব নাই।

‘আমাদের নীতিজ্ঞরা আমোদ-আহ্লাদের উপর বড়োই নারাজ। কিন্তু আমি বলি যে, যদি অবৈধ অপবিত্র আমোদ হইতে মনকে নিবৃত্ত করিতে চাও তো তাহার পরিবর্তে বৈধ আমোদ-আহ্লাদটা নিতান্ত প্রয়োজনীয়, সমাজ যদি বৈধ আমোদ-আহ্লাদের স্থান না রাখে তো লোকে স্বভাবত সমাজের বাহিরে অবৈধ আমোদ-আহ্লাদ অন্বেষণ করিবে, সহস্র নীতিজ্ঞানে আমোদ-আহ্লাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হইবে না।’

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সম্পদ সংরক্ষণে অবহেলার ক্ষেত্রে বাঙালির আকাশচুম্বী খ্যাতি রয়েছে। সেইসঙ্গে এখন যোগ হয়েছে দলবল নিয়ে ভেঙে ফেলার খ্যাতি! সেখানে বিভিন্ন রকম সাংস্কৃতিক চর্চাকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে ও জোরদার করতে যে ভূমিকা রাখা দরকার সেদিকে রাষ্ট্রের হর্তাকর্তাদের লক্ষ্য নেই। কর্তাগিরি ফলাতে ফলাতে আর সময়ইবা থাকে কই? রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, ঢাকাকেন্দ্রিক, কখনো কখনো জেলাভিত্তিক যেসব অনুষ্ঠান করা হত ও এখনও কিছু হচ্ছে, তাতে ব্যাপক সাধারণ মানুষকে সাংস্কৃতিক চর্চার উৎসবে টেনে আনার উদ্যোগ কম। শিক্ষাক্ষেত্রে সত্যিকার অগ্রগতি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাবলম্বী ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আত্মমর্যাদায় বলিষ্ঠ জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য আমাদের প্রয়োজন দেশেব্যাপী একটি সাংস্কৃতিক জোয়ার সৃষ্টি।

একটি সংস্কৃতিবান জাতি ও নাগরিকগোষ্ঠী সৃষ্টির জন্য কারুকলা ও সুকুমারবৃত্তি শিক্ষাদান জরুরি। সংগীত, চিত্রকলা, আবৃত্তি, অভিনয়, নৃত্য ইত্যাদি বিষয় মন ও মননকে বিকশিত করে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক-সেবনসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক বিকৃতিতে আজ আমাদের যুবসমাজের একাংশ গুরুতরভাবে আক্রান্ত। নানারকমের অসুস্থ চর্চা আজ তরুণ ও কিশোর থেকে শিশুদেরকে পর্যন্ত গ্রাস করছে। এ থেকে রক্ষা পেতে হলে সাংস্কৃতিক চর্চা শিক্ষার একটি অনিবার্য অংশ হওয়া প্রয়োজন। সাংস্কৃতিক বিকাশের মাধ্যমে আমরা এমন সব সামাজিক সমস্যার সমাধ্যান করতে পারি যা প্রথাগত টেক্সট বই মুখস্থ করিয়ে কোনদিনই সম্ভব নয়। শিশুর ওপর বইয়ের বড় বড় বোঝা চাপিয়ে দিয়ে পণ্ডিত বানানোর অশুভ চেষ্টার মধ্য দিয়ে মানসিক বিকৃতিকে কেবল প্রশস্তই করা সম্ভব। যা দরকার তা হল শিশুর সুকুমারবৃত্তিসমূহের বিকাশ- তাকে মিথ্যুক, অন্যায় প্রতিদ্বন্দ্বী, স্বার্থপর ও চতুর বানানো নয়, দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে যা করে আসছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং শহর ও গ্রাম পর্যায়ে চিত্রকলা ও কারুশিল্পের প্রদর্শনী, সংগীত, নাটক ও সাংস্কৃতিক চর্চা ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশে কাজটি মোটেও কঠিন নয়। কারণ বাঙালি ও এ দেশের পাহাড় ও সমতলের অবাঙালি সবাই সংস্কৃতিবান জাতি। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই দুয়েকটা গান, নাটক, যাত্রা বা সার্কাসের দল রয়েছে। তাদেরকে সামান্য পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সরকার কাজটি অতি সহজেই করতে পারে। এর ফলে প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে উঠবে এলাকার নিজস্ব, মানুষের প্রাণের অনুষ্ঠান। তাতে মানুষের অংশগ্রহণ হবে স্বতঃস্ফূর্ত। এর ফলে বিভিন্ন এলাকার যে বিশেষ সাংস্কৃতিক দক্ষতা ও বিশেষত্ব তারও স্ফূরণ ও বিকাশ ঘটবে। সাধারণ মানুষও এসব অনুষ্ঠান সফল করতে আর্থিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও কায়িক সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসবে।

জাতীয় জীবনে সংস্কৃতিচর্চার নদনদীকে শুকিয়ে ফেলে ও দূষিত করে দিয়ে শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার খাল কেটে শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ নিলে তা আত্মঘাতী হয়। পদ্মা-যমুনা-মেঘনা-তিতাস-সুরমা-বুড়িগঙ্গার আজ করুণ দশা। আমাদের ভূগর্ভস্থ পানিও নানা ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যে আক্রান্ত। এখন আধালিটার খাওয়ার পানি বাজারে কুড়ি টাকায় বিক্রি হয়। পদ্মার ইলিশ তো আকাশের চাঁদ হওয়ার পথে। এখনই একতারা শুনলে আমাদের মনে পড়ে যে, কোন একদিন আমরা বাঙালি ছিলাম। আমাদের সাংস্কৃতিক শুষ্কায়ন যদি চলমান থাকে, তবে একদিন একতারা শুনেও তা মনে পড়বে কিনা বলা যায় না। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ই শুধু নয়, এক বিরাট জীবন-প্রবাহ। নদীতে মাছ থাকে। মানুষ ডাঙায় থাকে। তবে নদীর কোলেই মানুষের সভ্যতা গড়ে ওঠে। আর মানুষ বাস করে সংস্কৃতির নদীতে।

সংস্কৃতির জলেই মানুষের জন্ম, মৃত্যু ও বেড়ে ওঠা। সেই সংস্কৃতির নদনদীতে চর পড়লে বা তার জল দূষিত হয়ে পড়লে জলের মাছ ডাঙায় তুললে যা হয়, তাই হয় জাতির জীবনে। আমাদের সংস্কৃতির নদনদীকে গভীর, প্রশস্ত ও বেগবান করে তোলা আজ তাই অতি জরুরি। সাংস্কৃতিক চর্চাবিহীন শিক্ষা জাতীয় জীবনে রবীন্দ্রনাথের গল্পের তোতাপাখির মর্মান্তিক পরিহাস মাত্র। সাংস্কৃতিক চর্চাবিহীন জীবনযাপন মৃততুল্য। দেশের আনাচেকানাচে আমাদের একটি সাংস্কৃতিক ঝড় প্রয়োজন, এখনই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *