বাংলা সনের উৎস সন্ধান

বাংলা বর্ষবরণ বাংলাদেশের বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে। দিন দিন তার উজ্জ্বলতা বাড়ছে। বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এর পৃষ্ঠপোষকতাও শুরু করে দিয়েছে। বর্তমানে যে ধারায় বাংলা নববর্ষ পালিত হচ্ছে তার সূচনা খুব বেশি আগে হয়নি। ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট রমনার বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানটি করছে। আর চারুকলার শোভাযাত্রা শুরু হয়েছে ১৯৮৯ সাল থেকে। এই ক’বছরেই তা এভাবে বেড়ে উঠেছে। নববর্ষ উদযাপনের এই রীতিটি একেবারেই নাগরিক। পান্তা-ইলিশ খেয়ে একটা গ্রামীণভাব আনার চেষ্টা থাকলেও তার সঙ্গে গ্রামের কোনো সংযোগ নেই। গ্রামের লোকজন বরং নতুন বছরে ভালো ভালো খাবার খান। তারা মনে করেন, বছরের প্রথম দিনে ভালো খেলে সারা বছর ভালো ভালো খাবার খাওয়া যাবে। শহরের বর্ষবরণে পাশ্চাত্য ধারার নববর্ষ উদযাপনের অনুকরণই বেশি চোখে পড়ে, সঙ্গে অবশ্য আমাদের ঐতিহ্যের কিছু মিশেলও থাকে।

১৯৬৯-৭০ সালের দিকে দেখেছি গ্রামে চৈত্র-সংক্রান্তির মেলা হতো, আর হতো বৈশাখী মেলা। গ্রামের বাজারের দোকানগুলোতে হত হালখাতা উৎসব। বাবা-চাচার হাত ধরে দোকানে যেতাম। প্রথমেই মিষ্টিমুখ করানো হত। মিষ্টি খেয়ে বড়রা পান মুখে দিয়ে কিছু টাকা দিতেন। সেই টাকা নতুন খাতায় তুলে শুরু হত নতুন হিসাব-নিকাশ। চৈত্র-সংক্রান্তিতে হিন্দু পরিবারগুলোতে বিশেষ ধরনের খাবার তৈরি হত। কোনো কোনো মুসলমান বাড়িতেও তার কিছু ছাপ দেখতাম। বিশেষ করে তিতা আইটেম থাকত। গাছভরা ছোট ছোট আম থাকলেও চৈত্র-সংক্রান্তি পার না হলে আমরা সে পিচ্চি আম খাওয়া শুরু করতাম না।

মেলা বসত মাঠের মাঝে কোনো বড় গাছের নিচে। কোনোটা বাজারের অদূরে খোলা জায়গায়। বড়দের হাত ধরে অনেক মেলায় গেছি। মূলত উৎপাদিত ফসল আর ঘরে তৈরি নানা জিনিস মিলতো সেখানে। নানা ধরনের মিষ্টি. জিলাপি, বাতাসা, মুড়ি, মুড়কি, খই ইত্যাদি পাওয়া যেত। পাওয়া যেত অনেক রকমের খেলনা, বাঁশি, বেলুন, শাড়ি, চুড়ি, লেইস ফিতা, আলতা, সাবান ইত্যাদি। নানা রকমের খেলার আয়োজন হত। ছিল লোকগানের আয়োজন। দোলনা আর চরকী চড়ার প্রতি ছিল অনেক আকর্ষণ। সবার সঙ্গে ভাব বিনিময়ের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল মূল লক্ষ্য। কিছুটা বদলে গেলেও গ্রামীণ মেলাগুলোর বেশিরভাগ এখনো চালু আছে।

অবাক আঁধার!
বাংলা সনের ঠিকুজি খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম এর নির্ভরযোগ্য ইতিহাসের কোনো হদিস নেই। সেখানে রাজত্ব করছে অজানার এক অবাক আঁধার। মাত্র দুটি বইতে সন তারিখের বিষয়ে কিছু আলোচনা আছে। একটি আল বিরুনির ‘ভারততত্ত্ব’ আরেকটি আবুল ফজলের ‘আকবরনামা ও আইন-ই-আকবরী’। সেখানেও বাংলা সনের উল্লেখ নেই। আর সব ইতিহাস বইতে কোনো ঘটনার সন তারিখ নিয়ে বহু বাকবিতণ্ডার দেখা পেলেও সন তারিখের কোনো ইতিহাস নেই। সব ইতিহাস বইতে দেখি খ্রিষ্টাব্দের রাজত্ব। যদিও এই খ্রিষ্টাব্দপ্রবণ ইতিহাস চর্চা এমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে যে, মানুষ যেন যুগযুগ ধরে খ্রিষ্টাব্দ ব্যবহার করে আসছে। যদিও প্রকৃতপক্ষে বর্তমান খ্রিষ্টীয় তথা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ১৫৮২ সালে চালু করেন ভ্যাটিকানের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি; কিন্তু সেটা সবাই তখনই মেনে নেয়নি। খোদ ব্রিটিশরাই এই ক্যালেন্ডার গ্রহণ করতে প্রায় দুইশ বছর দেরি করেছে। ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজরাই এর চর্চা করেছে সীমিত পরিসরে। ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলায় আইন করার সময়, ব্রিটেনে যোগাযোগের জন্য লেখালেখিতে বা অফিসে এই ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হলেও খাজনা আদায় হয়েছে বাংলা সন ধরে। এখনো ভূমি-সংক্রান্ত সব কর আদায় বা একসনা সব বন্দোবস্ত বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারেই হয়। অথচ বাংলা সনেরই শুরুর কাহিনির কোনো হদিস নেই!

সন তারিখের খোঁজ-খবর
ক্যালেন্ডার ব্যবহারের ইতিহাস ৬ হাজার বছরের। প্রথম ক্যালেন্ডার ব্যবহারের গৌরব প্রাচীন মিশরীয়দের। প্রাচীন মিশরীয় ক্যালেন্ডারটি ছিল সৌর ক্যালেন্ডার। প্রাচীন ব্যাবিলনীয়, গ্রিক আর রোমান ক্যালেন্ডারও ছিল সৌর ক্যালেন্ডার। কারণ এই চার সভ্যতাই ছিল কৃষিনির্ভর তথা ঋতুনির্ভর। মিশরের কৃষিনির্ভর করতো নীল নদের বার্ষিক বন্যার ওপর। যা পুরোটাই ঋতুনির্ভর। মিশরীয় ক্যালেন্ডারে ছিল ১২ মাস। প্রতি মাসে ৩০ দিন। আরও ৫ দিন তারা ব্যয় করত দেবতার জন্মবার্ষিকীর উৎসবে। সে ৫ দিন কোনো মাসের সঙ্গে যোগ করা হত না। এভাবে বছরে মোট দিন দাঁড়াতো ৩৬৫। অধিবর্ষ গণনা করে ৪ বছরান্তে কোনো দিন যোগ করত না তারা।

ব্যাবিলনের ক্যালেন্ডার ২৭০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে তৈরি অর্থাৎ প্রায় ৪৭০০ বছরের পুরোনো। তারা বছর গুনতো ৩৬০ দিনে। ১২টি চান্দ্র মাসের প্রতিটিতে ছিল ৩০ দিন করে। ঋতুর সঙ্গে ফারাক মেটাবার জন্য তারা প্রতি ৬ বছর পর পর একমাস বাড়িয়ে নিত (১৩ মাসে বছর)। মায়া সভ্যতার চি‎‎হ্ন হিসাবে যে ক্যালেন্ডার পাওয়া গেছে তার বয়স প্রায় ৩ হাজার বছর। তারা ‘Venus year’ ব্যবহার করত। প্রতি মাসে ২০ দিন। ১৮ মাসে বছর। মোট ৩৬০ দিন। সঙ্গে জুড়ে নিত আরো ৫ দিন। এই ৫টি দিনকে তারা অশুভ বলে গণ্য করত।

রোমানরা প্রথম গ্রহণ করেন গ্রিক ক্যালেন্ডার। তখন ছিল বছরে ৩০৪ দিন, মাস ছিল ১০টি (মার্চ থেকে ডিসেম্বর)। শীতের বাকি দিনগুলোতে কাজ করতেন না বলে ক্যালেন্ডারেও রাখতেন না। এ সময়কে বলা হতো হাইবারনেশন। ধারণা করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে রোমান রাজা Numa Pompilus জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি মাস যুক্ত করে ১২ মাসের বছর প্রবর্তন করেন। শীতের বাদপড়া দিনগুলো পড়ে এই দুই মাসের ভাগে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে সম্রাট জুলিয়াস সিজার ক্যালেন্ডার সংস্কার করে জানুয়ারি থেকে বছর শুরু করেন এবং লিপ ইয়ার চালু করেন। এর নাম ছিল জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি জুলিয়ান ক্যালেন্ডারকে সংস্কার করে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু করেন। এটিই আমাদের কাছে এখন খ্রিষ্টীয় বা ইংরেজি ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত।

রোমান থেকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার
রোমানরা প্রথম গ্রহণ করে গ্রিক ক্যালেন্ডার। তখন বছর ছিল ৩০৪ দিনের। ১০টি মাস। মার্চে বছর শুরু হয়ে ডিসেম্বরে শেষ। শীতের বাকি দিনগুলোতে তারা কোনো কাজ করতো না বলে ক্যালেন্ডারেও রাখত না। এ সময়কে বলা হত হাইবারনেশন। অনুমান করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে রোমের রাজা Numa Pompilus জানুয়ারি আর ফ্রেব্রুয়ারি মাস যুক্ত করে ১২ মাসে বছর গণনা শুরু করেন। শীতের সময়ের না গোনা দিনগুলো পড়ে এই দুই মাসের ভাগে। জুলিয়াস সিজার রোমের সম্রাট হবার আগে পর্যন্ত এ বিষয়টি সুশৃঙ্খল ছিল না। ক্যালেন্ডারের হিসাবের গোলমালের জন্য ঋতুচক্রের সঙ্গে সংগতি বিধানের জন্য সম্রাট জুলিয়াস সিজার ৪৬ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে এক রাজকীয় ডিক্রি বলে সে বছরকে ৪৪৫ দিনের বছর হিসাবে ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে বছরের দৈর্ঘ্য স্থির করেন ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা। প্রতি মাসে দিন হবে ৩০-৩১। বাড়তি ৬ ঘণ্টা সমন্বয়ের জন্য প্রতি ৪ বছর পর পর ৩৬৬ দিনের লিপ ইয়ার চালু করেন। আগে বছর শুরু হত সূর্যের মহাবিষুবে (vernal equinox) প্রবেশের সময় মার্চে। তিনি তা রদ করে প্রতি বছর ১ জানুয়ারি বছর শুরুর আদেশ দেন। সে থেকে এ ক্যালেন্ডার জুলিয়ান ক্যালেন্ডার হিসেবে পরিচিত হয়। এ সংস্কারের পরও সৌর বছরের চেয়ে সাড়ে ১১ মিনিট দীর্ঘ হয় জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের বছর। শত শত বছরের এই গরমিলের ফলে আবার ঋতুর সঙ্গে ক্যালেন্ডারের গরমিল হয়ে যায়।

এই গরমিল দূর করার জন্য পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার সংশোধনের উদ্যোগ নেন। সে সংস্কারের প্রধান দিক ছিল ৩টি। প্রথমত, ২১ মার্চ সূর্যের মহাবিষুবে প্রবেশের সঙ্গে মিল রাখার জন্য ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাস থেকে ১০ দিন বাদ দেন। ফলে সে বছরের ক্যালেন্ডারে বৃহস্পতিবার ৪ অক্টোবর আর শুক্রবারকে ১৫ অক্টোবর লেখা হয়। দ্বিতীয়ত, সৌর বছরের দৈর্ঘ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রাখার জন্য প্রতি ৪০০ বছরের মধ্যে ৩টি লিপ ইয়ার বাদ দেবার ব্যবস্থা করেন। ফলে শতাব্দী পূর্ণকারী বছর (যথা ১৫০০, ১৬০০ সাল) হলে যেসব বছর ৪০০ দ্বারা বিভাজ্য হবে না সেগুলো লিপ ইয়ার হবে না। ফলে ১৯০০ সাল লিপ ইয়ার ছিল না ২০০০ সাল লিপ ইয়ার ছিল। তৃতীয়ত, এই হিসাবে চান্দ্র তিথির সঙ্গে কোনো মিল না রাখায় চান্দ্র তিথি নির্ভর ধর্মীয় পর্ব যথা ইস্টার সানডে, গুড ফ্রাইডে ইত্যাদি যথাসময়ে না আসায় তার একটা হিল্লে করার দরকার হয়। এ জন্য সৌর বছর আর চান্দ্র মাসের অনুপাতের মধ্যে সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন আনা হয়। ফলে নতুন নিয়মে ইস্টার সানডের তিথিটি ৫৭ লাখ বছরে একবার আবর্তিত হবে।

এই ক্যালেন্ডারে মাসের নামগুলোর তাৎপর্য হলো- জানুয়ারি (৩১ দিন)- (ল্যাটিন জানুয়ারিয়াস) দেবতা জানুসের নাম হতে এসেছে। ফেব্রুয়ারি (২৮/২৯)- (ল্যাটিন ফেব্রুয়ারিয়াস) পিউরিফিকেশন উৎসব ফেব্রুয়া হতে এসেছে। মার্চ (৩১ দিন)- (ল্যাটিন মার্টিয়াস) দেবতা মার্সের নাম হতে এসেছে। এপ্রিল (৩০ দিন)- (ল্যাটিন এপ্রিলিস) গ্রিক দেবী আফ্রোদিতি মতান্তরে ল্যাটিন শব্দ aperire হতে এসেছে। মে (৩১ দিন)- (ল্যাটিন মাইয়াস) দেবী মায়ার নাম হতে এসেছে বলে অনুমান করা হয়। জুন (৩০ দিন)- (ল্যাটিন জুনিয়াস) দেবী জুনোর নাম হতে এসেছে বলে অনুমান করা হয়। জুলাই (৩১ দিন)- (ল্যাটিন জুলিয়াস) সম্রাট জুলিয়াস সিজারের নাম হতে এসেছে। আগস্ট (৩১ দিন)-(ল্যাটিন অগাস্টাস) রোমান সম্রাট অগাস্টাসের নাম হতে এসেছে। সেপ্টেম্বর (৩০ দিন)- (ল্যাটিন সেপ্টেম্বর)- সেপ্টেম অর্থাৎ সাত হতে এসেছে। এটা প্রাচীন রোমান ক্যালেন্ডারের সপ্তম মাস ছিল। অক্টোবর (৩১ দিন)- (ল্যাটিন অক্টোবর) অক্টো অর্থাৎ আট হতে এসেছে। এটা রোমান ক্যালেন্ডারের অষ্টম মাস ছিল। নভেম্বর (৩০ দিন)-(ল্যাটিন নভেম্বর) নভেম অর্থাৎ ৯ থেকে এসেছে। রোমান ক্যালেন্ডারের নবম মাস ছিল। ডিসেম্বর (৩১ দিন)- (ল্যাটিন ডিসেম্বর) ডিসেম অর্থাৎ দশ থেকে এসেছে। রোমান ক্যালেন্ডারের দশম মাস ছিল। সিজারের সংস্কারের ফলে শেষ চারটি মাসের নাম সংখ্যার বিচারে ভুল হিসাবে চালু আছে অর্থাৎ বছরের ৭, ৮, ৯ ও ১০নং মাসের বদলে এখন ৯, ১০, ১১ ও ১২নং মাস হিসাবে আছে।

পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরির এ সংস্কার ক্যাথলিক খ্রিষ্টানরা মেনে নিলেও প্রোটেস্টান্টসহ অন্য অনেকেই মেনে নিতে অনেক বিলম্ব করেছে। ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দেই নতুন ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে ইতালি, পর্তুগাল, স্পেন, বেলজিয়াম, হল্যান্ড এবং পোল্যান্ডের ক্যাথলিক রাষ্ট্রগুলো। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে গ্রহণ করে জার্মানি ও সুইজারল্যান্ড-এর ক্যাথলিক রাষ্ট্রগুলো। ১৫৮৭ খ্রিষ্টাব্দে হাঙ্গেরি। ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানি, সুইজারল্যান্ড ও হল্যান্ডের প্রোটেস্টান্ট রাষ্ট্রগুলো, ডেনমার্ক ও নরওয়ে তা গ্রহণ করে। ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে তা গ্রহণ করে ব্রিটেন (আমেরিকান কলোনিসহ), ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে জাপান, ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে মিশর, ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়া, ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে গ্রিস, ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে তুরস্ক ও ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে চীন তা গ্রহণ করে। ব্রিটেন ও রাশিয়ায় এটা গ্রহণের সময় আবার অক্টোবর মাসে ১১ দিন বাদ দিতে হয়েছে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে তৈরি হওয়া ব্যবধান ঘুচানোর জন্য। সেটা নিয়ে ব্রিটেনে শ্রমিক আন্দোলন হয়েছে। অক্টোবর বিপ্লবের বার্ষিকী পালিত হয় নভেম্বরে। ব্রিটিশ উত্তরাধিকার থেকেই আমরা ব্যবহার করছি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার।

হিজরি সনের কথকতা
হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের (৬২২ খ্রিষ্টাব্দে) স্মরণে প্রবর্তিত হয় হিজরি সন। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) ৬৩৮-৩৯ খ্রিষ্টাব্দে এ ক্যালেন্ডার চালু করেন। সূর্যাস্ত থেকে দিন গণনা শুরু করা হয়। ১২টি চান্দ্র মাস ( মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জামাদিউল আউয়াল, জামাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ) নিয়ে হিজরি সন গঠিত। অমাবশ্যা শেষে চন্দ্রোদয় থেকে আরেক অমাবশ্যা পর্যন্ত ২৯-৩০ দিনে হয় মাস। সাধারণত একটি মাস ৩০ দিনে হলে পরের মাসটি ২৯ দিনে হবে, তার পরেরটি আবার ৩০, তার পরেরটি ২৯ এভাবে আবর্তিত হয়। হিজরি বছরে ৩৫৪ দিন। গড় চান্দ্রযুতিকাল ২৯.৫৩০৫৮৮১ দিন হিসাবে ১২ চন্দ্রযুতিতে হয় ৩৫৪.৩৬৭১ দিন। অর্থাৎ হিজরি বছর চান্দ্র বছর থেকে ০.৩৬৭১ দিন কম। এই ঘাটতি সমন্বয় করার জন্য ৩০ বছরের একটা পুনরাবৃত্তি চক্র স্থির করা হয়। ওই ৩০ বছরে মোট ১১ বার পূর্বনির্ধারিত চান্দ্র বছরের শেষ মাস জিলহজ মাসে ১ দিন যোগ করে ২৯ দিনের স্থলে ৩০ দিন করা হতো। ৩০ বছরে ৩৫৪ দ্ধ ৩০ = ১০৬২০ দিনের সঙ্গে ১১ দিন যোগ করে ১০৬৩১ দিন হিসাব করা হয়। এর ফলে গড় চন্দ্রযুতি বা চান্দ্র মাসের স্থায়িত্ব দাঁড়ায় ২৯.৬৩০৫৬৬ দিন, যা বর্তমান চান্দ্র মাস থেকে মাত্র ০.০০০০৩২ দিন কম। এ ৩০ বছরের চক্রে কোনো ১১টি বছর অধিবর্ষ হবে তা নির্ধারণ করা হয় এভাবে- হিজরি সনটিকে ৩০ দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল ২, ৫, ৭, ১০, ১৩, ১৬, ১৮, ২১, ২৪, ২৬ বা ২৯ হলে বছরের শেষে ১দিন যুক্ত হবে।

এই হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মুসলমানদের যাবতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালিত হয় পৃথিবীব্যাপী। এ ছাড়া মুসলিম শাসনামলে তাদের সব রাজ্যে সরকারি কাজে হিজরি ব্যবহার করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনামলেও হিজরি ছিল সরকারি ক্যালেন্ডার। এখনো সৌদি আরবে তা সরকারি ক্যালেন্ডার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকও হিজরি ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে।

বাংলা সনের কথা
বাংলা সনের প্রচলন নিয়ে সরাসরি কোনো ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ নেই। আমাদের ইতিহাসচর্চার ভিত্তি হচ্ছে রাজা বা রাজবংশের ঠিকুজি, আধিপত্যবাদী ধনিক শ্রেণির জীবন ইতিহাস, প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার আর শিলালিপি পাঠ। আমাদের সনাতন ইতিহাসচর্চায় এ দেশের মূল জনগোষ্ঠী তথা কৃষকের জীবনাচরণ সরাসরি উপেক্ষিত। এটাই বাংলা সনের কোনো খোঁজ না থাকার কারণ। কৃষক জীবনের সঙ্গেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা সনের প্রকৃত যোগাযোগ। তাই ভায়া পথে অন্যান্য ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বাংলা সন প্রচলন নিয়ে চারটি মত চালু আছে। সম্প্রতি জয়নুল আবেদীন খান ‘বঙ্গাব্দ’ নামে একটি বইতে পঞ্চম মত প্রকাশ করেছেন।

সব চেয়ে প্রচলিত মতটি হলো মুঘল সম্রাট মহামতি আকবর এই সনের প্রবর্তন করেছেন। মূলত অক্সফোর্ড থেকে ইতিহাসে এমএ, পাস করা প্রখ্যাত ঐতিহাসিক কাশীপ্রসাদ জয়সোয়ালই (১৮৮১-১৯৩৭) প্রথম নানা যুক্তি প্রদর্শন করে বলেন আকবর এর প্রবর্তক। পরে বিশ্বখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিদ ও ভারতের ক্যালেন্ডার সংস্কার কমিটির প্রধান ড. মেঘনাদ সাহা, নোবেল পুরস্কার জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য কুমার সেন, প্রত্নতত্ত্ববিদ অমিতাভ ভট্টাচার্য (দ্য বেঙ্গলি এরা ইন দ্য ইন্সক্রিপশনস অব লেটার মেডিয়েভাল বেঙ্গল), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ভূতপূর্ব কারমাইকেল অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বাংলা সন গবেষক মোবারক আলী খান প্রমুখ এই মত সমর্থন করেন। তাদের যুক্তি হল আকবর যখন সিংহাসনে আরোহন করেন, তখন ছিল ৯৬৩ হিজরি। বর্তমান বাংলা সনের হিসাব অনুযায়ীও তখন ছিল ৯৬৩ সাল। আইন-ই-আকবরীতে বলা হয়েছে আকবর নতুন সন ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ চালু করেন তাঁর সিংহাসন আরোহনের বছর তথা ১৫৫৬ সাল থেকে কার্যকারিতা দিয়ে। তখন ৯৬৩ হিজরি। এখন চলছে ২০২৫ সাল। ড. মেঘনাদ সাহার অনুসরণে যদি হিসাব করি, তাহলে দেখা যায় ৯৬৩+২০২৫-১৫৫৬=১৪৩২। এ বছর ১৪ এপ্রিল থেকে বাংলা ১৪৩২ সাল শুরু হতে চলেছে। ড. সাহা লিখেছেন, হিজরি সন চালু করার একটা কারণ ছিল ধর্মীয় উৎসব পালনের ক্ষণ বের করার জন্য সাধারণ মানুষকে যেন আলেমদের ওপর নির্ভরশীল না থাকতে হয়। এই ক্যালেন্ডার সৌর বছরের যে কোনো সময়ে শুরু হতে পারে। ফলে ঋতুনির্ভর সরকারি কার্যক্রমে এর প্রয়োগে অসুবিধা দেখা দেয়। ১০৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান জালাল উদ্দীন মালিক শাহ ইরানে সৌর ক্যালেন্ডার চালু করেন। আকবর সেটার অনুসরণেই তারিখ-ই-ইলাহী চালু করেন। ড. সাহার নেতৃত্বে গঠিত ভারতীয় ক্যালেন্ডার সংস্কার কমিটির প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বস্তুত পক্ষে জালালী ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত এই ইরানী সৌর ক্যালেন্ডারটি সুলতানের অনুরোধে সংস্কার করেন সে কালের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও কবি ওমর খৈয়ামের নেতৃত্বে গঠিত এক কমিটি। হিসাবের গরমিলের জন্য নওরোজ বসন্তের সূচনায় আসছিল না বলেই এ সংস্কারের দরকার পড়ে। এ কাজটিই পোপ গ্রেগরি ওমরের ৫০০ বছর পরে করে বর্তমান গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু করেন। বর্তমানে যে বাজেট প্রণয়নের প্রথা চালু আছে সে আদলে আকবর রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংস্কার সাধন করেন। সারা বছরের সম্ভাব্য আয় ঠিক করে তার ভিত্তিতে ব্যয়ের প্রথা চালু করেন। ফসল তোলার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা চালু করা হয়। ফসল ওঠার সঙ্গে ঋতুচক্রের সম্পর্ক আছে বলেই চান্দ্র ক্যালেন্ডার হিজরির স্থলে সৌর ক্যালেন্ডার চালুর প্রয়োজন পড়ে। ড. মেঘনাদ সাহার মতে তারিখ-ই-ইলাহীর আদলেই বাংলা সন চালু হয়েছে। ১৯৫২ সালে এক বক্তৃতায় ড. সাহা এ কথা বলেন। তাঁর ভাষায়, ‘In 1079 A.D. Sultan Jelaluddin Melik Shah of Iran introduces solar calendar of Iran, and this was introduced by Emperor Akber in India in 1584 A. D. Under the name of tarik-ilahi, Akber’s calendar was used to date all events from his accession (1556A.D.) and was official calendar during the reign of Jehangir and early part of Sahjahan’s reign when it fell into disuse. But it gave rise to a number of hybrid Eras like the ‘Bangla San’ and of ‘Fasli’ Era which are still in use.‘

আকবরের সভাপণ্ডিত আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী সংস্কার কাজটি করেন। হিজরি থেকে সন (৯৬৩) নিয়ে জালালী ক্যালেন্ডারের গণনা পদ্ধতিকে মিলিয়ে দেন। মাসের নামগুলো ছিল ফারসি। আকবরের সমন্বয়বাদী নীতির প্রতিফলন আছে এই সন গণনাতেও। এসবের বিস্তারিত বিবরণ ও সম্রাটের ডিক্রির তথ্যাদি লিখা আছে আবুল ফজল আল্লামীর লেখা আকবরনামা ও আইন-ই-আকবরীতে।

এখানে যে দুটি প্রশ্নের কোনো তথ্যভিত্তিক জবাব নেই, তা হল তারিখ-ই-ইলাহী শুরু হয় সূর্যের মহাবিষুবে প্রবেশের সময় অর্থাৎ মার্চ মাসে, আর বাংলা সন শুরু হয় এপ্রিলে এবং আকবরের ক্যালেন্ডারের মাসের নাম ফারসি আর বাংলা সনের মাসের মাসের নাম কার্যত বাংলায়, যা নেয়া হয়েছে শকাব্দ থেকে। শকাব্দ সে নাম গ্রহণ করেছে জ্যোতিষশাস্ত্র থেকে। এ বিষয়ে অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে সম্ভাব্য কারণ হল, বাংলায় সৌর বঙ্গাব্দ প্রচলনের সময় ওই অঞ্চলে সমধিক জনপ্রিয় অব্দ সৌর শকাব্দের উপস্থিতি। শকাব্দের আরম্ভ বৈশাখ মাসে। যে অভ্যাসের বশে সৌর এলাহী অব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে জনগণ পরিচিত মাসক্রম ব্যবহার করতেন সে অভ্যাসেরই পুনরাবৃত্তি বঙ্গাব্দের মাসক্রমে দেখা যেতে পারে।

বঙ্গাব্দ প্রচলনের বিষয়ে আরেকটি প্রধান মত হল গৌড়ের সম্রাট শশাঙ্ক এর প্রচলন করেছেন। শ্রী সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় একটি বই লিখে এই মত প্রকাশ করেছেন। (এর আগে ১৯৫০-এর দশকে টাকী গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক শ্রীযুক্ত সমরজিৎ দত্ত স্কুল ম্যাগাজিনসহ কিছু পত্রিকায় শশাঙ্ক কর্তৃক বাংলা সন প্রচলনের কথা লিখেছিলেন। তখন তাঁর সহকর্মী মোবারক আলী খান তাঁর সে যুক্তি খণ্ডন করে প্রবন্ধ লিখেছিলেন।) সুনীল বাবুর মতে, ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল বঙ্গাব্দের গণনা শুরু হয়েছে এবং ওই দিনই শশাঙ্ক গৌড় বঙ্গে স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করেন। ড. অতুল সুরসহ কেউ কেউ এ মত সমর্থন করেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এই মতের সপক্ষে কিছু বলতে হলে প্রথমেই প্রমাণ করতে হবে শশাঙ্ক ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বা তখন তিনি রাজত্ব করতেন; কিন্তু এখন পর্যন্ত এর কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই। বেশিরভাগ ঐতিহাসিকের মতে শশাঙ্ক সপ্তম শতকের প্রথমভাগে রাজত্ব করতেন। তাছাড়া ৫৯৩-৯৪ সাল থেকে পরবর্তী ১ হাজার বছরে এমন কোনো নথিবদ্ধ তারিখ পাওয়া যায়নি যাকে নিশ্চিতভাবে বঙ্গাব্দের সঙ্গে যুক্ত করা যায়। শশাঙ্কের রাজ্যের সবচেয়ে বিস্তৃত সীমানার মধ্যে পরবর্তী হাজার বছরে যে বিরাটসংখ্যক লেখা আবিষ্কৃত হয়েছে, তাতে বঙ্গাব্দ ব্যবহারের চিহ্ন নেই। বঙ্কিমচন্দ্র যদিও ১৮৬৫ সালে (১২৭২ বাংলা সাল?) দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে বঙ্গাব্দের কথা উল্লেখ করেছেন তা ইতিহাসসিদ্ধ বাংলা সন নয়। বঙ্গাব্দ কিছুটা আধুনিককালের শব্দ। এখনো গ্রাম বাংলায় লোকজন বলে বাংলা সন বা বাংলা সাল। সন আরবি শব্দ, আর সাল ফারসি শব্দ। ব্রতীন বাবুর মতে এটাও বাংলা সন চালুর সঙ্গে কোনো মুসলিম শাসকের যুক্ত থাকার প্রমাণ দেয়। ১২০৮ শকাব্দে নারদীয় পুরাণের উত্তরভাগের এক পুঁথিতে বাংলা সনকে জ(য)বনে নৃপতে শকাব্দ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকেও বাংলা সন চালুতে মুসলিম শাসকের যুক্ত থাকার অনুমান করা যায়। আমার বিবেচনায় এখানে আরেকটি তথ্য প্রাসঙ্গিক। ড. নীহাররঞ্জন রায় জানাচ্ছেন, ‘শশাঙ্ক এবং পাল রাজারা সমগ্র পশ্চিম-বঙ্গের অধিকারী হইয়াও নিজেদের রাঢ়াধিপতি বা রাঢ়েশ্বর না বলিয়া নিজেদের পরিচয় দিলেন গৌড়াধিপ এবং গৌড়েশ্বর বলিয়া, …পাল এবং সেন রাজাদের লক্ষ্য ও আদর্শ ছিল গৌড়েশ্বর বলিয়া পরিচিত হওয়া। বঙ্গপতি যে মুহূর্তে গৌড়ের অধিপতি সেই মুহূর্তেই তিনি গৌড়েশ্বর। লক্ষ্মণসেন যে মুহূর্তে গৌড় অধিকার করিলেন সেই মুহূর্তে তিনিও হইলেন গৌড়েশ্বর।’ এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, তখন গৌড়ই ছিল স্বপ্ন ও প্রতাপের কেন্দ্র। বাংলার সে প্রতাপ বা আকর্ষণ তখন ছিল না। তাই তখন যদি কোনো ক্যালেন্ডার চালুও হত তার নাম বঙ্গাব্দ হবার সম্ভাবনা ছিল না। বরং তার নাম গৌড়াব্দ হবার সম্ভাবনাই বেশি ছিল।

ড. নীহাররঞ্জন রায়ের আরেকটি মতও বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। তাঁর ভাষায়, ‘কিন্তু গৌড় নাম লইয়া বাংলার সমস্ত জনপদগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করিবার যে চেষ্টা শশাঙ্ক, পাল ও সেন-রাজারা করিয়াছিলেন, সে চেষ্টা সার্থক হয় নাই; গৌড় নামের ললাটের সেই সৌভাগ্য লাভ ঘটিল বঙ্গ নামের, যে বঙ্গ ছিল আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক হইতে ঘৃণিত ও অবজ্ঞাত এবং যে বঙ্গ নাম ছিল পাল ও সেন রাজাদের কাছে কম গৌরব ও আদরের; কিন্তু সমগ্র বাংলাদেশের বঙ্গ নাম লইয়া ঐক্যবদ্ধ হওয়া হিন্দু আমলে ঘটে নাই; তাহা ঘটিল তথাকথিত পাঠান আমলে এবং পূর্ণ পরিণতি পাইল আকবরের আমলে, যখন সমস্ত বাংলাদেশ সুবা বাংলা নামে পরিচিত হইল।’ আকবরের আমলের আগে বাংলা নামে প্রশাসনিকভাবে বিস্তৃত জনপদই ছিল না, তার আগে বাংলা সন চালুর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এ তথ্য আকবরের পক্ষে পরোক্ষভাবে হলেও সাক্ষ্য দিচ্ছে।

পুঁথি গবেষক যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের মতে বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বাংলা সন চালু করেছেন। বাংলা ভাষা সাহিত্যের বিকাশে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের অবদান সর্বজন স্বীকৃত। তবে সুলতানী আমলের বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিক সুখময় মুখোপাধ্যায় হোসেন শাহ কর্তক বাংলা সন চালুর কোনো তথ্যপ্রমাণ পাননি। সুলতানী আমল সম্পর্কে আরেক বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল করীমও এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেননি। যতীন বাবুও তেমন কোনো শক্ত তথ্যপ্রমাণ হাজির করতে পারেননি। আরেকটি বিষয়ও আমি বিবেচনাযোগ্য বলে মনে করি। যে কবিগণ হোসেন শাহের বা তার কোনো সভাসদের আনুকূল্য পেয়েছেন তারা প্রায় সবাই কৃতজ্ঞতাবশত তাঁদের রচনার নানা জায়গায় তার উল্লেখ করেছেন। মনসামঙ্গলের কবি বিজয়গুপ্ত লিখেছেন-

ঋতু শশী বেদ শাশী পরিমিত শক।
সুলতান হোসেন সাহা নৃপতি-তিলক
সংগ্রামে অর্জুন রাজা প্রতাপেতে রবি।
নিজ বাহুবলে রাজা শাসিল পৃথিবী।

মনসামঙ্গলের আরেক কবি বিপ্রদাস লিখেছেন-

সিন্ধু ইন্দু বেদ শশী শক পরিমাণ।
নৃপতি হুসেন শা গৌড়ের সুলতান।।

মহাভারতের অনুবাদক কবীন্দ্র পরমেশ্বর শ্রীকর নন্দী লিখেছেন-

নৃপতি হুসেন সাহ হএ মহামতি।
পঞ্চম গৌড়েতে যার পরম সুখ্যাতি।।
অস্ত্রে-শস্ত্রে সুপণ্ডিত মহিমা অপার।
কলিকালে হৈল যেন কৃষ্ণ অবতার।।

বিজয়গুপ্ত এবং বিপ্রদাস উভয়েই রচনাকাল হিসাবে শকাব্দ ব্যবহার করেছেন। ৬ ঋতু (৬), ১টি শশী বা চাঁদ (১), ৪টি বেদ (৪), শশী (১)। এখানে উল্টো করে দেয়া হয়েছে বছরটি ৬১৪১। এটা মধ্যযুগে প্রচলিত ছিল। একে বলা হতো অঙ্কস্য বামা গতি। প্রকৃতপক্ষে বছরটি ১৪১৬ শকাব্দ (১৪৯৪ খ্রিষ্টাব্দ)। বিপ্রদাস লিখেছেন ১৪১৭ শকাব্দ বা ১৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দে। সিন্ধু বা সাগর ৭টি (৭), ইন্দু বা চাঁদ (১), বেদ (৪), শশী (১)। বাংলা সন চালু থাকলে তাঁরা বাংলা সন ব্যবহার করতেন বলেই ধরে নেয়া যায়। হোসেন শাহ বাংলা সন চালু করলে এই কবিগণ যে সাড়ম্বরে সেটা লিখে যেতেন সেটাও নিশ্চিত করে বলা চলে।

খ্যাত নামা প্রাচ্যবিদ সিলভাঁ লেভি তাঁর লেখা ‘লে নেপাল’ বইতে বলেছেন ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের কিছু আগে সংস্রন নামে এক তিব্বতী রাজা মধ্য ও পূর্বভারত জয় করেন। তিনিই তার নামের শেষের ‘সন’ যুক্ত করে বাংলা সন চালু করেন। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতে এই সম্ভাবনা নেই। কারণ সংস্রন কর্তৃক বাংলা আক্রমণের কোনো তথ্য বা কোনো সন তারিখ চালু করার বিষয়ে কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই।

জয়নুল আবেদীন খান ‘বঙ্গাব্দ’ নামক বইতে বিক্রমপুরের রাজা বল্লাল সেন কর্তৃক বঙ্গাব্দ চালু হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন; কিন্তু এর সমর্থনে যেসব যুক্তি প্রমাণ দাখিল করেছেন তা যথেষ্ট নয়। এর সমর্থনে কোনো সরাসরি দলিলও তিনি হাজির করতে পারেননি। ৫টি কারণে তিনি আকবরকে বাংলা সনের প্রবর্তক মনে করেন না। তাঁর মতগুলো হচ্ছে- ১. আকবরের রাজ্যের ১২টি প্রদেশের মধ্যে সুবে বাংলায় তিনি সন চালু করেছেন, অন্য কোনো প্রদেশে করেননি। তাই এ দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। ২. আকবরের সন চালুর সময় বারো ভূঁইয়ার কারণে বাংলা অশান্ত ছিল। তাই সন চালু হতে পারে না। ৩. বাঙালির জীবন জীবিকার প্রতি আকবরের আগ্রহ ছিল না। আগ্রহ ছিল খাজনা প্রতি। তাই বাংলা সন আকবর চালু করেছেন বলে তিনি মনে করেন না। ৪. কোনো মুসলমানের চালু করা সন হিন্দুরা ধর্মীয় কারণে (কারণ এতে ধর্মীয় আচারদির সংশ্লেষ আছে) তা মেনে নেবার কথা নয়। ৫. আকবরনামা বা আইন-ই-আকবরীতে বাংলা সনের উল্লেখ নেই তাই বাংলা সন আকবর চালু করেননি। এরপর তিনি বলেন, এ দেশেরই কোনো প্রজাহিতৈষী ও কীর্তিলিপ্সু হিন্দু বা হিন্দু ভাবাপন্ন কোনো রাজা বা রাজপুরুষ একটি সমন্বয়বাদী সন হিসাবে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি বল্লাল সেনকে বাংলা সনের প্রবর্তক মনে করেন। কেন মনে করেন তার কোনো যথাযথ প্রমাণ দাখিল করতে পারেননি। বরং তার মতের মধ্যেই স্ববিরোধিতা আছে।

আকবর তার পুরো সাম্রাজ্যের জন্যই তারিখ-ই-ইলাহী চালু করেছেন। কোনো প্রদেশের জন্যই আলাদা করে সন চালু করেননি। যাঁরা আকবর কর্তৃক বাংলা সন চালুর কথা বলেন তাঁরা বলেছেন সেই সনের ভিত্তিতে বাংলা সন চালু হয়েছে। বাংলার জন্য পৃথক সন চালুর কথা বলেননি। অন্যদিকে বারো ভূঁইয়ারা কিছু অঞ্চলে স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখলেও প্রাদেশিক সরকার ছিল আকবর কর্তৃক নিযুক্ত। বাঙালির জীবিকার প্রতি আকবরের আগ্রহ ছিল না এ তথ্য তিনি কোথায় পেলেন? আকবরের রাজস্ব মন্ত্রী রাজা টোডরমলের নেতৃত্বে ভূমি ও রাজস্ব সংস্কার সম্রাট হিসেবে আকবরের শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক হয়ে আছে। তর্কের খাতিরে যদি তাঁর এ মত মেনেও নিই তাহলে সন চালুর কৃতিত্ব আকবরের দিকেই ইঙ্গিত করে। কারণ আকবর সন সংস্কার করেছেন খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্যই। তাঁর কথা অনুযায়ী মুসলমানের চালু করা সন যদি হিন্দুরা না মানেন তাহলে হিন্দু রাজার চালু করা সন মুসলমানরা কেন মানবেন? তিনি বৌদ্ধ ও মগদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বল্লাল সেনকে বাংলা সন চালুর কৃতিত্ব দিয়েছেন; কিন্তু কোনো যৌক্তিক সমীকরণ টানার যে পদ্ধতি ঐতিহাসিকরা ব্যবহার করেন তেমন কিছু তাঁর লেখায় চোখে পড়েনি। কি প্রক্রিয়ায়, কি কারণে বল্লাল সেন বাংলা সন চালু করেছেন তার কোনো বিবরণ দেননি, বা দালিলিক প্রমাণ দেননি। বরং সমাপনী বক্তব্যে নিজেই নিজের মতের বিরোধী মত প্রকাশ করেছেন। তাঁর ভাষায়- ‘বাংলা সনে চান্দ্র হিজরি সনের ইসলামী ঐতিহ্যের সঙ্গে ভারতীয় সৌর সনের বৈজ্ঞানিকতা যুক্ত হয়েছে। এই সনের মধ্যে হিন্দু ও বৌদ্ধদের দিন ও মাসগুলো আছে। আছে বর্ষ শুরুর মাস হিসেবে ভগবান বুদ্ধের ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র বৈশাখ মাস। আছে সূর্য পূজার অনুষঙ্গ চৈত্র-সংক্রান্তির চড়ক উৎসব। আছে মগ রাজাদের নববর্ষের খাতা উৎসব। আর আছে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর মদিনা গমন, হিজরি সন ও মোগল সম্রাট মহামতি আকবরের সিংহাসন আরোহন।’ এ বক্তব্য দিয়ে তিনি পুরো ব্যাপারটি আকবরের দিকেই নিয়ে গেলেন। কারণ আকবরের তারিখ-ই-ইলাহীর মূল বক্তব্য তো এগুলোই। যার বিস্তারিত বিবরণ আকবরনামা আর আইন-ই-আকবরীতে দেয়া আছে। সেখানে বাংলা সন চালুর কথা বলা থাকলে তো এতো মতভেদের সুযোগই থাকতো না। আর বল্লাল সেন কোনো দুঃখে আকবরের সিংহাসনে আরোহনের বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন তার কোনো ব্যাখ্যাও নেই।

বাংলা মাসের নাম বৃত্তান্ত
বাংলায় আমরা যে মাসগুলো ব্যবহার করি তা এসেছে মূলত জ্যোতিষশ্রাস্ত্র ও শকাব্দ থেকে। প্রতিটি নাম রাখা হয়েছে নক্ষত্রের নাম থেকে। চাঁদ সূর্যকে বছরে ১২ বার প্রদক্ষিণ করে। প্রতিবারে গড়ে সময় লাগে ৩০ দিন। চাঁদের এই আবর্তন থেকেই মানুষ মাসের ধারণা গ্রহণ করেছে। month শব্দের অর্থ হিসাবে Oxford Dictionary-তে বলা হয়েছে period of moons revolution অর্থাৎ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চন্দ্রের আবর্তনকাল। এই ১২ বার প্রদক্ষিণের পথে ২৭টি নক্ষত্রের সঙ্গে চাঁদের মোলাকাত হয়। এর সঙ্গে মিশে আছে একটি পৌরাণিক কাহিনি। পুরাণ অনুসারে দক্ষ প্রজাপতির ছিল ২৭টি সুন্দরী কন্যা। তাঁদের নাম-অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা, আদ্রা, পুনর্বসু, পুষ্যা, অশ্লেষা, মঘা, পূর্ব-ফাল্গুনী, উত্তর-ফাল্গুনী, হস্তা, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা, জ্যেষ্ঠা, মূল্য, পূর্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া, শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, শতভিষা, পূর্ব ভাদ্রপদা, উত্তর ভাদ্রপদা ও রেবতী। এই সাতাশ কন্যার বিয়ে হয় একমাত্র উপযুক্ত পাত্র চন্দ্রদেবের সঙ্গে। চন্দ্রদেবকে প্রতি মাসে স্ত্রীদের দর্শন দিতে হবে। এতে সময় লাগবে ২৭ দিন, বাকি ৩ দিন বিশ্রাম। আর্যভট্ট রচিত ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃত। মাসের নামকরণের বিষয়ে সূর্যসিদ্ধান্তে বলা হয়েছে,‘নক্ষত্রনামা মাসান্তুজ্ঞেরাঃ পর্বান্তযোগতঃ’ অর্থাৎ পূর্ণিমান্তে সাধারণতঃ যে নক্ষত্রের সঙ্গে সংযোগ দৃষ্ট হয় সেই নক্ষত্রের নামানুসারে চান্দ্রমাসের নামকরণ হয়েছে। প্রাচীন কালে সব জাতির ন্যায় ভারতীয়রাও চান্দ্র মাস ব্যবহার করত। পরে চান্দ্র-সৌর কালেন্ডার চালু হয় ভারতে। সে হিসাবে বিশাখা নক্ষত্রের সঙ্গে সংযোগকালে যে মাসে চাঁদ পূর্ণিমা দেখায় সে মাসের নাম বৈশাখ। সে ধারাবাহিকতায় জ্যেষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, পূর্বাষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, পূর্বভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, অশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, মৃগশিরা বা অগ্রহায়ণী থেকে অগ্রহায়ণ, পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, পূর্বফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র।

বাংলা বছরের সূচনা-বিরোধ
বাংলা বছরের সূচনা নিয়েও আছে নানা মত। ইতিহাসে সুনির্দিষ্ট কোনো সূচনা চিহ্ন মেলে না। চর্যগীতিকায় বাঙ্গালির কথা থাকলেও বাংলা সনের কোনো কথা নেই। মধ্যযুগের কিছু কিছু সাহিত্য পাঠে অস্পষ্ট একটা ধারণা করা যায় অগ্রহায়ণ মাসে বছর আরম্ভ হত। অগ্রহায়ণ শব্দের মধ্যেই বছর শুরুর একটা আভাস আছে। অগ্র মানে প্রথম আর হায়ন মানে বছর। মধ্যযুগের বারোমাসীতে এর সমর্থন মেলে। সিলেট থেকে সংগৃহীত আবিরার বারোমাসীতে বলা হয়েছে, “পরথমে আগন মাস ঘরে ঘরে ধান/তুমি নি আইছরে বন্ধু এমন পাষাণ/কার্তিক মাসের দিনে বছরের শেষ।/না আইলা আবিরার সাধু ছাড়িয়া বৈদেশ।’ প্রাক-আধুনিক যুগের কবি ভারত চন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদা মঙ্গল’ কাব্যে লেখা হয়েছে, ‘হায়নের অগ্রহায়ণ জানিয়া/শুভ দিনে পুণ্যাহ করিলা বিচারিয়া।” ভারত চন্দ্রের এ বই লেখার আগেই মুর্শিদাবাদে বৈশাখ মাসে পুণ্যাহ চালু হয়ে গেছে। অন্যদিকে এর আগের কবির রচনায় বৈশাখে বারোমাসীর কথা আছে। বিজয়গুপ্তের ‘পদ্মপুরাণ’-এ বেহুলার বারোমাসী বৈশাখে আরম্ভ হয়ে চৈত্রে শেষ হয়েছে। ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে ফুল্লরার বারোমাসীও বৈশাখে আরম্ভ হয়ে চৈত্রে শেষ হয়েছে। রংপুরের অজ্ঞাতনামা কবির রচিত কমলার বারোমাসীও বৈশাখে শুরু; কিন্তু শাহ মোহাম্মদ সগীরের ইউসুফ-জুলেখা কাব্যে জুলেখার বারোমাসী মাঘ মাসে শুরু হয়ে পৌষে শেষ। অন্য দিকে দৌলত কাজীর সতী ময়না ও লোরচন্দ্রানী কাব্যে এবং মহাকবি আলাওলের পদ্মবতী মহাকাব্যে ময়নামতি ও নাগমতির বারোমাসী আষাঢ় মাসে শুরু হয়ে জ্যৈষ্ঠে শেষ হয়েছে। পুরো বিষয়টিই গোলকধাঁধায় ভরা। কবে থেকে বাংলা সন চালু হয়েছে তার যেমন কূলকিনারা মেলে না তেমনি কবে থেকে বৈশাখে বাংলা নববর্ষ শুরু তারও হদিস মেলে না। কোনো কোনো বইতে পাই চৈত্র মাসে বছরের শুরু। ১৮১৩ সালে চার্লস স্টুয়ার্ট রচিত ‘বাংলার ইতিহাস’ বইতে বছরের প্রথম মাস হিসাবে চৈত্র মাসের কথা বলা আছে। ফলে কবে থেকে বাংলা সন বৈশাখে শুরু হলো তার প্রমাণ নেই। অর্থাৎ বাংলা সনের ইতিহাসের পুরো বিষয়টি এখনো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ায়নি।

কবে থেকে ব্যবহার করছি বাংলা সন
কোন ইতিহাসের বই বা অন্য কোনো লেখায় বাংলা সন চালুর কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাই নানা তাম্রলেখ, দলিল বা কবিতায় বাংলা সনের ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলা সন চালু হবার তত্ত্ব তালাশ করা যেতে পারে। পুঁথি গবেষক যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য পাণ্ডুলিপিতে রচনাকাল নির্দেশক ২৪ রকমের অব্দ বা সনের ব্যবহার চিহ্নিত করেছেন। তবে হিজরি, শকাব্দ আর বাংলা সনই বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো কবিরা রচনাকাল সরাসরি বলেছেন, কখনো সংখ্যাবাচক হেঁয়ালীতে রচনাকাল নির্দেশ করেছেন। একে বলা হয় ‘কবি শকাঙ্ক’। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সংখ্যা বলেছেন উল্টো করে। যাকে বলা হয়েছে ‘অঙ্কস্য বামা গতি’। রামজীবন বিদ্যাভূষণ রচিত মনসা-মঙ্গলের রচনাকাল নির্দেশক পদটি এরূপ-‘শর কর ঋতু বিধু শক নিয়োজিত।/মনসা-মঙ্গল রামজীবন রচিত।’ এখানে শর মানে ৫ (পঞ্চ শর), কর মানে ২ (দুই হাত), ঋতু মানে ৬ (ছয় ঋতু), বিধু মানে ১ (চাঁদ)। উল্টো করে লিখলে হয় ১৬২৫ শকাব্দ (১৭০৩ খ্রিষ্টাব্দ)। কবি শক শব্দটি ব্যবহার করেছেন। মুক্তারাম সেন রচিত সারদা-মঙ্গল কাব্যের রচনা কাল- ‘গ্রহ ঋতু কাল শশী শক শুভ জানি।/মুক্তারাম সেন ভণে ভাবিয়া ভবানী।’ এখানে গ্রহ=৯, ঋতু=৬, কাল=৩ (ত্রিকাল), শশী=১। অঙ্কস্য বামা গতি হিসাবে ১৩৬৯ শকাব্দ। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন ১৫টি হাতে লেখা পুঁথির রচনা কাল ১০৯৫ সন থেকে ১০১৭ বাংলা সনের মধ্যে বলে নির্দেশ করেছেন। এর মধ্যে প্রাচীনতম তারিখ ফকিররাম দাস রচিত ‘সত্যনারায়ণ’ পুঁথি। রচনাকাল-ইতি সন হাজার সতেরো ১০১৭ জ্যৈষ্ঠ মাসে। এখন পর্যন্ত বাংলা সনের সবচেয়ে প্রাচীন ব্যবহার দেখা গেছে বিশ্বভারতীর একটি পুঁথিতে (কাশীরাম দাসের মহাভারত নং ৩৫০৬)। লিপিকাল পাওয়া যায় সং ১০০২ সাল। একই তারিখ পাওয়া গেছে বারো ভূঁইয়ার অন্যতম ঈসা খাঁর কামানে। তাতে লেখা রয়েছে, ‘সরকার শ্রীযুত ইছা খাঁনে মসনদ্দালি সন হাজার ১০০২। যাঁরা বাংলা সন প্রবর্তক হিসাবে আকবরের কথা বলেছেন তাঁদের হিসাবে বাংলা সনের প্রাচীনতম ব্যবহার হবার কথা ৯৬৩ সন। এটি তার সব চেয়ে নিকটবর্তী।

যে বাংলা সন আমরা ব্যবহার করছি
আমরা যে বাংলা সনটি ব্যবহার করছি তা নানা সংস্কারের মাধ্যমে এখানে এসেছে। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ড. মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে গঠিত ক্যালেন্ডার সংস্কার কমিটির সুপারিশ ভারত সরকার গ্রহণ করে। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ভাষাবিদ পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে বাংলা একাডেমি বাংলা সন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। সে কমিটি ড. মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশ বিবেচনায় রেখে কাজ করেছে। শহীদুল্লাহ কমিটির রিপোর্টে লিপ ইয়ারসহ কিছু জটিলতা থাকায় তা নিরসনের জন্য বাংলা একাডেমি ‘বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কার কমিটি’ গঠন করে। সে কমিটি শহীদুল্লাহ কমিটির রিপোর্ট পর্যালোচনা করে কিছু সুপারিশ করে। পরে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২৬ জুলাই ১৯৯৫ তারিখে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালককে আহ্বায়ক করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। শহীদুল্লাহ কমিটিসহ পরের কমিটির রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দাখিলকৃত টাস্কফোর্সের প্রধান সুপারিশগুলো ছিল-

(ক) সাধারণভাবে বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস (৫ মাস) পর্যন্ত প্রতি মাসে ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র (৭ মাস) পর্যন্ত প্রতি মাসে ৩০ দিন গণনা করা হবে। (এটি শহীদুল্লাহ কমিটির সুপারিশের অনুরূপ)

(খ) গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির অধিবর্ষে যে বাংলা বছরের ফাল্গুন মাস পড়বে, সেই বাংলা বছরকে অধিবর্ষ রূপে গণনা করা হবে।

(গ) ১৪০২ সালের ১লা বৈশাখ থেকে এটি কার্যকর হবে এবং তারিখ পরিবর্তনের সময় হবে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী মধ্যরাত (১২টায়)

এখন বাংলাদেশে এ ক্যালেন্ডার চালু আছে; কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এখনো আদি পঞ্জিকা অনুসারে আচারাদি পালন করেন। তাই দুটি ক্যালেন্ডারে প্রায়ই গরমিল দেখা দেয়। ফলে চৈত্র-সংক্রান্তি বা ১লা বৈশাখ ভিন্ন দিনে পালিত হয়। বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নববর্ষের উৎসব আমাদের সঙ্গে পালন করলেও ধর্মীয় আচারাদি সনাতন পঞ্জিকা অনুসারেই পালন করেন। এটি এখনো একটা অমীমাংসিত এক সমস্যা।

সমাপনী
দীর্ঘ দিন থেকে বাংলা সন তারিখ নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত শামসুজ্জামান খান মুনসী সলিমুল্লাহর ‘‘তারিখ-ই-বাঙ্গালা’’ (বাংলার ইতিহাস) বইয়ের কিছু তথ্যের আলোকে অনুমান করেন কেন্দ্রীয়ভাবে আকবর প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহীকে ভিত্তি ধরে আঞ্চলিক ফসলি সন হিসাবে বঙ্গাব্দের সূচনা করেন নবাব মুর্শিদকুলি খান। মুর্শিদাবাদের নবাবরা অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে পুণ্যাহ প্রবর্তনের মাধ্যমে বাংলা সন ও নববর্ষ পালনের সূচনা করেন। ব্যবসায়ীরা চালু করেন হাল খাতা। জনাব খানের এই মতটি বেশ যুক্তিপূর্ণ মনে হয়।

মুর্শিদকুলি খান কর্তৃক বৈশাখ মাসে পুণ্যাহ চালু করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ‘A NARRATIVE OF THE Transactions in Bengal, DURING THE SOOBAHDARIES OF AZEEM US SHAN, JAFFER KHAN, SHUJA KHAN, SIRAFRAZ KHAN, AND ALYVIRDY KHAN.’ নামক ফারসি বইতে।

১৭৮৮ সালে প্রকাশিত বইটির ফারসি ভাষী লেখকের নাম অনুবাদক খুব সম্ভব উদ্ধার করতে পারেননি। সম্ভবত পাণ্ডুলিপিতে লেখকের নাম ছিল না। এতে বলা হয়েছে- The collections of the year were always completed by the end of Cheyte, and Moorshed Kuly Khan held the Bengal pooneah in the beginning of the month of Bysack. চৈত্র মাসের মধ্যে খাজনা আদায় শেষ করতে হত। মুঘল আমলে শুরু হওয়া এ রীতি ইংরেজ আমল পার হয়ে এখনো বহাল আছে এ দেশে। খাজনা আদায় শেষে বৈশাখে হত রাজপুণ্যাহ; কিন্তু দীনেশচন্দ্র সেন উল্লিখিত ১০১৭ সন এবং ঈসা খানের কামানে লেখা ১০০২ সন এর চেয়ে শতাধিক বছরের বেশি প্রাচীন। এটা সঠিক হলে জনাব খানের এবং উক্ত বইয়ের দাবি সঠিক বিবেচনা করা যায় না।

যে দুটি ঐতিহাসিক আকরগ্রন্থে সন আরিখের কথা বলা আছে সেখানে বঙ্গাব্দের উল্লেখ নেই। ১০৩১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত আল বেরুনীর ‘ভারততত্ত্ব’-এ শ্রীহর্ষাব্দ, বিক্রমাব্দ, শকাব্দ, বল্লভাব্দ ও গুপ্তাব্দের উল্লেখ আছে। বঙ্গাব্দের কথা নেই। আবুল ফজল আল্লামীর ‘আকবরনামা ও আইন-ই-আকবরী’ বইতে সে সময় সারা বিশ্বে প্রচলিত প্রায় সব ক্যালেন্ডারের উল্লেখ আছে কিন্তু বঙ্গাব্দের কথা নেই। আবুল ফজল যে বাংলা সম্পর্কে জানতেন তার প্রমাণ তাঁর বইতে আছে। এ দুটি আকরগ্রন্থে বঙ্গাব্দের উল্লেখ না থাকা প্রমাণ করে আল বেরুনীর বই লেখার সময় (১০৩১ খ্রিষ্টাব্দ) বা তার আগে অথবা আকবরের রাজত্বের আগে বঙ্গাব্দের প্রচলন থাকার কোনো দলিল নেই। এটা আকবর কর্তৃক বাংলা সন প্রবর্তিত বলে প্রমাণ না দিলেও তার আগে যে প্রবর্তিত হয়নি সেটার প্রমাণ দেয়।

আমাদের ঘরে ঘরে যে ক্যালেন্ডার শোভা পায় তা গত ৪০-৫০ বছরের ঘটনা। তার আগে স্বচ্ছল ঘরে কিছু ক্যালেন্ডার চোখে পড়ত। প্রকৃত পক্ষে সন তারিখ দরকার হত ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানে। তার মূল অবলম্বন ছিল পঞ্জিকা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা লোকনাথ ডাইরেক্টরি বা গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকা বা বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা দেখতেন বা এখনো দেখেন। আর মুসলমানরা মোহাম্মদী পঞ্জিকা দেখেন। আমার অনুমান ছিল আকবর প্রচলিত ফসলি সন আর বিদ্যমান পঞ্জিকাকে মিলিয়ে বাংলা সনের প্রচলন পঞ্জিকাকারগণও করে থাকতে পারেন; কিন্তু মুদ্রিত পঞ্জিকার প্রথম প্রকাশকালের চেয়ে প্রাচীনতর বাংলা সনের উল্লেখ পাওয়া গেছে। হাতে লেখা পঞ্জিকার যুগে এটা ঘটেছে কি-না, তার এখনো কোনো প্রমাণ মেলেনি। যত দিন এর কোনো বিহিত না হচ্ছে ততদিন সর্বাপেক্ষা যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাবটির পক্ষেই আমার অবস্থান। অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলি-

‘…আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে আকবরের রাজত্বের পূর্বে বাংলা সন বঙ্গাব্দ ব্যবহারের কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ও আলোচিত তথ্যাদি আকবরের আমলে চান্দ্র হিজরি অব্দের সংস্কারের মধ্যেই বঙ্গাব্দের সূচনার ইঙ্গিত করে। এর বিপরীতে কোনো ঘটনা নির্দেশক বিশ্বাসযোগ্য তথ্যসূত্র আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত এই মতই গ্রহণযোগ্য।’

কৃতজ্ঞতা স্বীকার
1. অজয় রায়-প্রাচীন ভারতীয় বর্ষপঞ্জি: একটি সমীক্ষা
2. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়-বাঙ্গালা সন
3. মোবারক আলী খান-বাংলা সনের জন্মকথা
4. শামসুজ্জামান খান-বাংলা সনের ইতিহাস অনুসন্ধান ও নববর্ষ উদযাপনের রূপান্তর কথা
5. শামসুজ্জামান খান-বাংলা সন ও পঞ্জিকার বৈশিষ্ট্য
6. সত্যেন সেন-বিশ্ব পটভূমিতে বাংলা মাস তালিকা
7. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম-বাঙালির একান্ত অব্দ বঙ্গাব্দ
8. ড. আশরাফ সিদ্দিকী-নববর্ষের উৎসব ও অনুষ্ঠান
9. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-বাংলা সাহিত্যের কথা (দ্বিতীয় খণ্ড-মধ্যযুগ)
10. নীহাররঞ্জন রায়-বাঙালির ইতিহাস আদি পর্ব
11. দীনেশচন্দ্র সেন-বঙ্গভাষা ও সাহিত্য

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *