ইশারা
তুমি তো আমারই রূপ—জলের ছায়ায়
স্ব প্রেমিক দোল খায়, নরম ঢেউয়ে—
তার হৃদয়ের কথা মাছের ডানায়
ছড়িয়ে গিয়েছে ঠিক নদী বেয়ে বেয়ে…
যে মাঝি করলো পার, তার’ই গোলুই
ভেঙে দিল কেন বলো—খোয়াজ খিজির!
প্রেমের দু-চোখে জাগে পূর্ণিমা শশী
রিপুর শাসক তিনি, এ মনের পীর।
কেন যে পাগল হয়ে খুঁজি সেই প্রভা
আমি কি আমাকে করি সহসা তালাশ?
নাকি চাই চুপিচুপি তোমার ইশারা
যে চোখ হৃদয় দ্বার, নূরের প্রকাশ—
মুসার মতন আজ অহং যে চাই
খিজিরের রূপে যদি তোমাকে গো পাই।
প্রথম চুম্বন
তোমার ডানায় রাখো লুকিয়ে আমায়
মেঘের আলোয় থাকে বিজলি যেমন;
শরতের দিনগুলো গোধূলি নামায়…
প্রতিমার নামে করি কায়া বিসর্জন!
যেই জলে ভেসে যায় গরিমা তোমার
তারই স্রোতধারা বয় কামনার দেহে,
জীবন যমুনা হয়ে হারিয়েছে তীর!
প্রেমের নিখোঁজ থাকা, শরীর সন্দেহে—
কোথা সে স্মৃতির দ্বার খুলে রাখা আছে?
আমি তো খুঁজেছি তার সদর কপাট—
হারানো এ মুখে কে যে মুকুর ধরেছে!
চোখের আগুনে ডুবে হারিয়েছি তট—
তোমারও কি মনে আছে প্রথম চুম্বন?
পূজোর প্রদীপ হয়ে জ্বলছে জীবন—
আত্মী
নিখুঁত ছায়ায় যদি ঢেকে যায় আলো
আলো কি আমার রুপ, নাকি তা করুণা?
পাতার গোপন থেকে তূর্ণ চমকালো—
দেহ কেনো ধরে রাখে জীবনের সীমা!
উদরে বইছি যাকে, ক্ষুধা নাকি কাম?
স্নায়ু থেকে ঝরে গেছে স্মৃতির বাদল
পাথর জেনেও যাকে করেছি প্রণাম
জানি না কোথায় ফোঁটে নিজের আদল!
বায়ু সেবনের মতো ঢুকে যাও দেহে
মুকুরের ছায়া ভেঙে মন প্রতিমায়
ক্ষুধার তাড়না পোষা শরীর প্রবাহে
যেভাবে ছড়িয়ে আছি, নিজও মাঝে নাই
ছুড়ে কেনো দিয়েছিলে— হৃদয় বাগ্বিধি?
যেন আমি আমাকেই তোমা হয়ে চিনি—
কুশ
নিধুবনে লঘু সুরে বেজে চলে বাঁশি
তার সরু ডাল ধরে গমনের পথ;
তোমার আগর ছায়া ধরে ধরে নাচি
যেভাবে কাঁপতো কামে বঁধুয়ার নথ।
সে সব কী গত হলো সময় বিপাকে—
আকাশের মন নিয়ে গুছিয়েছি মেঘ;
আড়ালে তো চাঁদ তবু আলো দিতে থাকে
ক্ষত কেনো থেকে যায় ওঠালে পেরেক।
কত মত কত পথ কাঁটাতারে আঁকা
স্মৃতির বিষের কাছে হতমুখ ফুল—
মাথার ভেতর ঘোরে সময়ের চাকা
করুণার ছল ক’রে বাঁচার আকুল।
অশেষ ধারণা ঘুরে ফিরবো কোথায়
ভাষাহীনতার মতো হয়েছি জবাই…
অভিলাষ
সন্ধ্যার ঘুমে যে বিষন্নতা ভর করে
তা কি আকাশফাঁটা গোধূলি থেকে আসে?
তুমি যাও, রীতিনীতির ছুরি-নদী পার হয়ে!
একা শূন্যতার ধোঁয়া-বন
নীল হয়ে আসা ঠোঁটে, তীক্ষ্ণ উরু চিরে
নিজেরই অসংখ্য ছায়া নিয়ে
আমি বাঁচি অপরিণত ঘুমে—
জুবুথুবু স্নায়ুর ইশারা থেকে
তোমার গরিমা ঝলকের মতো জাগে—
আর স্থির সরোবরে ছিন্ন পাতা পড়ে
নিমজ্জন পূর্ব, জল কাঁপে তানপুরা সুরে…
সরল তনয়া;
এবার তো বিম্বিত হও এ মন গহব্বর হতে—

শৈবাল নূর। বই: ‘যামিনী ও মরমী ধনুক’।