সকালবেলায়
একাকীত্বই ভালো বলে
যেসব শব্দরা ছলকে উঠল
তাদের কোলাহল ও গুঞ্জন নিয়ে
একটা মৌমাছি কোথা থেকে এসে ঘুরে বেড়ায়!
ঘর হতে সে যায় না
মন হতে সে যায় না
ওদিকে দেখো, একটা মেঘ এসে বসে পড়ল
দূরের ঝাকড়া আমগাছের মগডালে
রোদটাকে ঠেকিয়ে রাখল
গরমে সূর্য সরে যায়, তখন রোদ আটকে না
সে আটকে যায় ঠিক শীতকালে
যখন তাকে দরকার হয় মানুষের!
তো, এই যে মেঘলা একাকীত্ব
ছড়িয়ে পড়ল মৌমাছির গুঞ্জনের মতো
বাতাসে চাপা আর্তনাদসহ
তার যথাবিহিত উৎপাদন ও বন্টন
পৃথিবীতে ঘটে না…
অসম বন্টনের শাসন চলে তার!
কেউ কেউ মেঘে চাপা পড়ে
তার আর রেহাই থাকে না
আবার কেউ কেউ রোদের সালোকসংশ্লেষণে
উদ্বৃত্তের মতো ভোগ করে মুনাফার পাহাড়!
শব্দরা ছলকে ওঠে নৈঃশব্দ্যের কোলাহলে
ছুড়ে ফেলে দিল শত শত বর্ণমালা
একটি বধির সকালবেলায়….
গল্প
গল্পের ছায়া দিয়ে নিজের গল্পটা ঢেকে রাখি
তারপর নিজেকে শুনাই মিথের গল্প
নিজেকে অস্ফুটস্বরে বলি, হে মিথ্যাবাদী রাখাল একদিন ঠিকঠাক বাঘ চলে আসবে!
সেদিন তোমার মিথ্যা তোমাকে খেয়ে ফেলবে
সত্যের মুখোমুখি হবে জগত!
জগতে কিছু মানুষ থাকে যারা নিজেকে নিজের গল্প বলে, সত্যি গল্প না, মিথ্যা গল্প
সত্যি গল্প দিয়ে প্রবোধ হয় না
প্রবোধ হতে হলে মিথ্যা গল্প হতে হয়!
মিথ্যাকে সত্য করে তুলতে না পারলে
পৃথিবীতে কোনো রূপকথার জন্ম হয় না!
রূপকথার পাখিরা বৃত্তাকার জীবনের উড়াল দিয়ে
রচনা করে অনন্ত রহস্যের গল্প।
নিজের জীবনের দিকে তাকাই
একটা বৃত্তাকার গল্প
বিন্দুগুলো ছুঁয়ে দেয়
শূন্য থেকে পুনরুৎপাদন করে শূন্য
যেখান থেকে শেষ করে
সেখানেই পুনরায় শুরু হয়….
এই সেই গল্পের আয়না
যে আয়নায় নিজের মুখ
গল্পের মধ্যে গলে পড়ে!
যে আয়নার পিছনের পারদ
মুছে গেছে প্রাগৈতিহাসিক কালে!
সহজ কবিতা
হে গন্তব্যের বিমূঢ়তা
হে প্রেমহীন শূন্যতা
তোমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি!
দাঁড়িয়ে আছি এখানে
নিজের মহাকর্ষ সূত্র অনুযায়ী
লুপ্ত হওয়া সকল পথের মাঝখানে
মহাস্রোতের টানে!
উষর হয়ে উঠে হৃদয়
বাক্য থেকে খসে পড়ে কোমলতা
শব্দের শরীর লু হাওয়ায় তপ্ত
গলে পড়ে অনর্থের কোলে!
নদীকে অর্থহীন করে
জলকে করে নিরালম্ব
সবুজ হয়ে পড়ে আড়ম্বরহীন
নিরানন্দ সময়ের আয়নায়
জীবন তার প্রলম্বিত প্রতিবিম্ব দেখে!
হে প্রেমহীন শূন্যতা, দৈর্ঘ্যে তুমি কতদূর?
কত বাড়বে তুমি প্রস্থে?
কত রচনা করবে চৌচিরতা?
দিগন্তপ্লাবী বর্ষণে, বৃষ্টিতে
টাপুরটুপুর মেঘভারে
নুয়ে পড়া অন্ধকারে
নবধারাজলে
তীব্র বন্যা ও বানে
ভেসেগিয়ে, ডুবে গিয়ে
নাকাল হওয়া হে প্রেম
হে অপাপবিদ্ধ পতন
তোমাকে খুব চাচ্ছি যে!!
সহজ কবিতা ২
তোমারে ফুল ভাবতাম আমি, নদী ভাবতাম, ভাবতাম সাঁতার কাটা মৎস্য
জলের গভীরতাকে খণ্ডন করে তুমি চলতা…
তোমারে আমি সীমাহীন ভাবতাম
তোমার কোনো দিগন্ত আছে আমি বিশ্বাস করতাম না
ভাবতাম অই যে দিগন্ত দেখা যায় তা মিছা
একটা মিছা দিগন্তের আড়াল তুইলা মজা পাও বইলা
যত কুয়ারা কর তুমি!
তোমারে আমি নিস্তব্ধতা ভাবতাম
শান্ত, স্থিতধী জলে মৃদু বাতাসে যে ঠান্ডা ঢেউ ওঠে
তার মতো মিহি
তার মতো নরোম
জলের পোকারা যেমন সেই জলের উপর দৌড়ে বেড়ায়
খেলা করে, তেমনি তুমি আমার মনে খেলা করতা
তোমারে আমি আমার উন্নয়ন সমিতির সভাপতি বানাইছিলাম
আমার সকল তহবিল, সকল সম্পদ তোমার একটা সইয়ের অধীনস্ত হইয়া থাকত
নির্ভার আমি ভাবতাম, ভবিষ্যৎ আমার নিরাপত্তার চাদরে এইবার ঢেকে গেল!
তোমারে আমি বৃষ্টি ভাবতাম, মেঘ ভাবতাম
মেঘের গর্জন ভাবতাম
রোদ, ছায়া, ফুল, লতাপাতা, ধুপধুনো দিয়ে পেঁচানো আমার ভাবনাসকল শুধু তোমারেই ভাবতে গিয়া
একদিন আমার ভাবনা থেকে আমি তিরোহিত হইয়া গেলাম
আর তোমার ভাবনায়ও আমি ছিলাম না কোনোদিন!
আমি পৃথিবীর ভাবনানিচয় থেকে মুছে গেলাম!!
কবিতা
আমি একটি কবিতা লিখতে চাইলাম
তুমি কবিতা হয়ে উঠতে চাইলে না!
তারপর দিন মাস বছর যুগ শতাব্দী কেটে গেল
শব্দ, বাক্য, ছন্দ নিয়ে অনেক কাটাকুটি করলাম
তবু সেই কবিতাটি কোনোদিন ঠিকঠাক লিখে উঠতে পারলাম না

ইকতিজা আহসান। জন্ম ১লা ডিসেম্বর ১৯৭৭। পৈত্রিক নিবাস বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। মাসিক ‘বিবিধ’ পত্রিকার সম্পাদক। ফ্রিল্যান্স গবেষক। অনিয়মিত লিটলম্যাগ ‘প্রান্তস্বর’ এর সম্পাদক। কাব্যগ্রন্থ : মাটিলগ্ন ঘুম (২০০৮), অনপেক্ষ রসুনের ঝাঁজ (২০১১), অনেক রেখার একটি পাতা (২০১৮) গল্পগ্রন্থ : দরগাতলার বটগাছ (২০১৪), নাচনমহল (২০২৩) অনুদিত প্রবন্ধ: ফ্রয়েড, আধুনিকতা, উত্তর-ঔপনিবেশিক সন্ত্রাস ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০১৬) সাক্ষাৎকার গ্রন্থ : ‘মানবতাবাদী’ সাহিত্যের বিপক্ষে : মাসরুর আরেফিন।। ইকতিজা আহসানের সঙ্গে আলাপ (২০২৩)।