আলবেয়ার কাম্যু (Albert Camus, ৭ই নভেম্বর ১৯১৩–৪ঠা জানুয়ারি ১৯৬০) উত্তরাধুনিক সাহিত্যের একজন বলিষ্ঠ লেখক, ঔপন্যাসিক। সাহিত্যে যারা নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন তাদের মধ্যে আলবেয়ার কাম্যু অন্যতম এবং তিনি মাত্র ৪৩ বছর বয়সে নোবেল প্রাইজ লাভ করেন। তার প্রধান সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- The Outsider (১৯৪২), The Plague (১৯৪৭), The Myth of Sisyphus ( ১৯৪২), The Fall (১৯৫৬), The Rebel ( ১৯৫১)।
আলবেয়ার কাম্যুর দর্শন মূলত “অ্যাবসার্ডিজম” (Absurdism) বা “অর্থহীনতার দর্শন”-এর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তিনি অস্তিত্ববাদী (Existentialist) লেখক হিসেবে পরিচিত হলেও নিজেকে কখনোই অস্তিত্ববাদী বলে দাবি করেননি। কাম্যুর চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে—জীবনের অর্থহীনতা, মানব অস্তিত্বের বৈপরীত্য (binary opposition) এবং নৈতিক বিদ্রোহ (moral rebellion)। আলবেয়ার কাম্যুর মতে, “অ্যাবসার্ড” বলতে বোঝায় মানুষের অর্থ অনুসন্ধানের আকাঙ্ক্ষা এবং এই মহাবিশ্বের নীরবতা (human exploration for the meaning of life and the unreasonable cosmic silence)—এই দুইয়ের সংঘাত। মানুষ চায় তার অস্তিত্বের অর্থ খুঁজে পেতে, কিন্তু মহাবিশ্ব কোনো উত্তর দেয় না। এই বিরোধ বা বৈপরীত্যই (confrontation) হলো অ্যাবসার্ড।
“The absurd is born of this confrontation between the human need and the unreasonable silence of the world.”—The Myth of Sisyphus, Albert Camus
The Myth of Sisyphus (1942) প্রবন্ধে কাম্যু প্রশ্ন করেন: “Should I kill myself?”—যদি জীবন অর্থহীন হয়, তবে আত্মহত্যাই কি উত্তম উপায়? কিন্তু তিনি বলেন—না, “অ্যাবসার্ডিটির” সাথে মানিয়ে নেওয়া কিংবা বিদ্রোহ করে বেঁচে থাকাই মানুষের কর্তব্য। পৌরাণিক চরিত্র সিসিফাসের কাহিনিতে দেখা যায়, সে প্রতিদিন একটি পাথর ঠেলে পাহাড়ের ওপরে নিয়ে যায়, কিন্তু ওপরে যেতে না যেতেই পাথরটি আবার গড়িয়ে পড়ে। তবুও সে হাল ছাড়ে না।
“One must imagine Sisyphus happy.”—কাম্যু দেখাতে চেয়েছেন, অর্থহীনতা স্বীকার করেও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে মর্যাদার সঙ্গে।
The Rebel (1951) গ্রন্থে কাম্যু বলেন, যখন মানুষ অর্থহীনতার মুখোমুখি হয়, তখন সে বিদ্রোহ (Revolt) করে। এই বিদ্রোহ হলো নৈতিকতা, মানবতাবোধ ও মানবিক প্রতিরোধের প্রকাশ। কিন্তু এই বিদ্রোহ কখনোই সহিংসতা বা স্বৈরাচারের পথে যেতে পারে না। তিনি বিপ্লবী মতবাদ (যেমন মার্কসবাদ বা বলশেভিজম)-এর একনায়কতান্ত্রিক রূপের তীব্র সমালোচনা করেন।
কাম্যু ও অস্তিত্ববাদ ( Camus and Existentialism)
কাম্যুকে অনেক সময় জ্যঁ-পল সার্ত্রের সঙ্গে এক কাতারে ফেলা হয়, কিন্তু কাম্যু আত্মহত্যা ও অর্থহীনতা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন, সার্ত্রের মতন স্বতন্ত্র স্বাধীনতা ও দায়িত্ব নিয়ে নয়। কাম্যুর দর্শনে ঈশ্বর নেই—কিন্তু সেই নাস্তিকতা তার কাছে নৈতিক বিপ্লবের পথ, সহিংস বিপ্লব নয়। কাম্যুর দর্শনের মূল উপাদান হচ্ছে জীবনের অর্থহীনতা বা Absurdity।
কাম্যুর দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা (Relevance of Camus’ philosophy)
আজকের পৃথিবীর যন্ত্রণা, যুদ্ধ, মহামারী, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা—এই সবই কাম্যুর অ্যাবসার্ড জগতকে মনে করিয়ে দেয়। তাঁর দর্শন আমাদের শেখায়, অর্থহীনতার মাঝেও মানবিকতা, প্রতিবাদ এবং জীবনকে ভালোবাসা সম্ভব। আলবেয়ার কাম্যুর দর্শন এক ধরনের নৈতিক অস্তিত্ববাদ, যেখানে ঈশ্বর নেই, তবুও মানুষ বিনাশ ও নৈরাজ্যের মুখেও প্রত্যাশা ও মর্যাদা বজায় রাখতে শেখে। তার দার্শনিক অবস্থান প্রশ্ন করে—জীবন অর্থহীন হলেও কি তা ত্যাগ করার কিছু? না কি আমরা সেই অর্থহীনতাকেই অর্থে রূপ দিতে পারি?
এখানে তাঁর নিজের বক্তব্যই প্রনিধানযোগ্য— “In the depth of winter, I finally learned that within me there lay an invincible summer.”—Albert Camus
বিশ্বসাহিত্যের এক অন্যতম দৃষ্টান্ত আলবেয়ার কাম্যুর The Outsider (1942), যেটি আধুনিক অস্তিত্ববাদী ও নিরর্থকতাবাদী (Absurdism) দর্শনের এক বর্ণনামূলক বিশ্লেষণরূপে বিবেচিত। উপন্যাসের মূল চরিত্র মার্সো (Meursault) সমাজ ও প্রচলিত মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত এক অস্তিত্বের প্রতিনিধি। উপন্যাসের প্রেক্ষিত বিবেচনা করলে দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়কাল মানব অস্তিত্ব সম্পর্কে চরম প্রশ্নবোধের জন্ম দেয়। মানুষের ওপর ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র ও নৈতিকতার নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ে। কাম্যু বলেন—
“In a universe that is suddenly deprived of illusions and of light, man feels a stranger.”—The Myth of Sisyphus
এই “stranger” বা “outsider”-এর ধারণাই কাম্যুর উপন্যাসে রূপ পায় মার্সোর মাধ্যমে। আধুনিক মানুষ যেমন নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ অনুভব করে, তেমনি মার্সোও “আত্মিক সংযোগহীন” (emotionaly detached) এক চরিত্র। উপন্যাসের শুরুতেই মার্সোর মায়ের মৃত্যুসংবাদ আসে—
“Today, mother died. Or maybe yesterday, I don’t know.”
এই বাক্যেই প্রকাশ পায় এক শীতল, নিরাসক্ত সত্তা—যে সমাজের রীতি অনুসারে শোক প্রকাশ করে না। মার্সোর এই অনীহা আধুনিক মানুষের বোধবর্জিত অস্তিত্বের দিকটি তুলে ধরে। মার্সো তার প্রেমিকাকে ভালোবাসে না, হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় উদ্দেশ্যহীনভাবে, রৌদ্রের উত্তাপে বিরক্ত হয়ে একজন আরবকে হত্যা করে। এগুলো দেখে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগে—কেন? কাম্যু কোনো উদ্দেশ্য দেখান না। কারণ, জীবনের কোনো ‘অন্তর্নিহিত অর্থ’ নেই বলেই তিনি বিশ্বাস করেন।
“There is but one truly serious philosophical problem, and that is suicide.”—The Myth of Sisyphus
কাম্যুর দৃষ্টিতে, মানুষ যখন অনর্থকতার মুখোমুখি হয়, তখন তার সামনে দুই পথ খোলা থাকে—আত্মহত্যা অথবা বিদ্রোহ (revolt)। মার্সো আত্মহত্যা করে না, বরং নিরর্থকতাকে মেনে নিয়ে জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে একরকম মুক্তির স্বাদ অনুভব করে।
মার্সোকে একজন আরব হত্যার জন্য নয়, বরং মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অশ্রুবিহীন থাকার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এই পর্বটি কাম্যুর একটি মৌলিক প্রশ্ন তুলে ধরে—সমাজ কি ব্যক্তির অনুভূতির ওপর দখলদারি করতে পারে?
“I had only a little time left and I didn’t want to waste it on God.”—The Outsider
এই উক্তিতে ধর্মীয় অনীহা ও ঈশ্বরহীন এক অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটে, যা আধুনিক নাস্তিকতার ও আধ্যাত্মিক শূন্যতার প্রতীক।
অস্তিত্বের নিরর্থকতা ও বেঁচে থাকার অনিবার্যতা
শেষ অধ্যায়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মার্সো বলেন—“I laid my heart open to the benign indifference of the universe.”
এই বাক্যে ফুটে ওঠে কাম্যুর নিরর্থকতাবাদের চূড়ান্ত রূপ। জগত নির্লিপ্ত, জীবন অর্থহীন—তবুও মানুষ বাঁচে। এই স্বীকারোক্তিই কাম্যুর “absurd hero”-এর আত্মপোলব্ধি। The Outsider আধুনিক মানুষের অস্তিত্বের সংকট, বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং অন্তঃসারশূন্য বেঁচে থাকার এক সাহসী প্রতিচ্ছবি। কাম্যু কোনো সমাধান দেন না, বরং প্রশ্নের গুরুত্ব তুলে ধরেন। মার্সো আমাদেরকে দেখায় কিভাবে ব্যক্তি সমাজের ‘অভ্যস্ত আবেগময়তার’ বাইরে গিয়ে এক ধরণের অস্তিত্ববোধের সন্ধান করে, যা হয়তো শূন্য—তবুও মৃত।
আলবেয়ার কাম্যু-র The Myth of Sisyphus (1942) কেবল একটি দার্শনিক প্রবন্ধ নয়; এটি মানুষের অস্তিত্বের গভীর সংকট, জীবনের অর্থহীনতা এবং সেই অর্থহীনতার মুখোমুখি এক সাহসী বিদ্রোহের আখ্যান। কাম্যুর মূল প্রতিপাদ্য হলো— “মানুষ একটি নির্বাক, অর্থহীন জগতে বেঁচে থাকলেও, সেই বেঁচে থাকাকে সে নিজেই অর্থময় করে তুলতে পারে। কাম্যুর দার্শনিক চিন্তার কেন্দ্রে রয়েছে নিরর্থকতা (Absurdity) নামক একটি ধারণা। এটি সৃষ্টি হয় যখন মানুষের ভিতরে অর্থের অনুসন্ধান এবং বহির্বিশ্বের নির্বিকার, নৈঃশব্দ্যপূর্ণ বাস্তবতার মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। মানুষ চায় জীবন, মৃত্যু, সুখ, দুঃখের কোনও চূড়ান্ত ব্যাখ্যা। অথচ পৃথিবী এ বিষয়ে নির্বাক। এই দ্বৈততার থেকেই জন্ম নেয় নিরর্থকতা ( Absurdism)।
পৌরাণিক উপাখ্যানে সিসিফাস ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি দেবতাদের রোষে পড়ে একটি পাথর অনন্তকাল পাহাড়ে ঠেলে নিয়ে যেতে বাধ্য হন—যা বারবার নিচে গড়িয়ে পড়ে। এটাই তাঁর শাস্তি। এই অর্থহীন শ্রমকে কাম্যু ব্যাখ্যা করেন এইভাবে—
“The struggle itself toward the heights is enough to fill a man’s heart. One must imagine Sisyphus happy.”
সিসিফাস যেন প্রতিটি মানুষের প্রতিচ্ছবি, যে প্রতিদিন একঘেয়ে জীবনযাপন করেও নিজের কর্মে মর্যাদা খোঁজে। কাম্যুর মতে, আবসার্ড জীবন মানে হাল ছেড়ে দেয়া নয়, বরং তা হলো একটি সজাগ ও সাহসী বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ আত্মহত্যার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে। মানুষ যখন জেনে ফেলে যে তার কাজ অর্থহীন, তারপরও সে কাজটি করে—সেই সচেতনতাই তাকে মহান করে তোলে। এটাই “Absurd Hero”-র বৈশিষ্ট্য।
নিরর্থকতা মানুষকে এক ধরণের অস্তিত্ববাদী স্বাধীনতা দেয়। সে কোনও নির্ধারিত ধর্মীয়, নৈতিক কাঠামো দ্বারা বাঁধা থাকে না। কাম্যুর মতে, এই স্বাধীনতা ভয়ংকর, আবার আনন্দময়—
“The absurd man is he who is aware of the absurd and yet continues to live.”
কাম্যু বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বরের ধারণা মানুষকে বাস্তব জীবনের কঠিন প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে সাহায্য করে। তাই তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রত্যাখ্যান করেন। তার দৃষ্টিতে, ঈশ্বরে বিশ্বাস করা এক ধরণের ‘আত্মিক আত্মহত্যা’।
The Outsider ও The Myth of Sisyphus কেবল একটি দার্শনিক পাঠ নয়, বরং এটি এক অস্তিত্ববাদী সাহসিকতার ঘোষণা। কাম্যুর ভাষায়, “জীবন অর্থহীন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তা বেঁচে থাকার যোগ্য।” এই অনন্ত পাথর ঠেলার মাঝেও যে মানুষ হাসতে পারে, তার মধ্যেই নিহিত আছে মানবিক মুক্তির প্রকৃত সৌন্দর্য। কাম্যু আমাদের শেখান, “One must imagine Sisyphus happy”—কারণ সে জানে, সে বেঁচে আছে। সিসিফাস এর মতো মার্সোও জীবনের অর্থহীনতা মেনে নিয়ে আত্মতৃপ্তি অনুভব করে।

রিজভী জামান, প্রাবন্ধিক।