বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী সিলেট বিভাগ একটি প্রাচীন ভূ-খন্ড। বিশ্বমানচিত্রে এর অবস্থান ২৩০৫৯’-২৫০১৩’ উত্তর অক্ষাংশ ও ৯০০৫৪’-৯২০২৯’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে। সমুদ্র থেকে এর উচ্চতা ৫৫ ফিট। এর আয়তন ১২৩৯৫ বর্গকিলোমিটার এবং লোক সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। এই অঞ্চলের উত্তরে মেঘালয়, দক্ষিণে ত্রিপুরা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পূর্বে আসাম ও ত্রিপুরা এবং পশ্চিমে নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সিলেট অঞ্চলের পরিচয় দিতে গিয়ে ডেভিড ও ন্যান্সি স্প্রাট (১৯৮৭:১) যথার্থই বলেন,
‘The district comprises in the main, the large eastern bulge of the northern part of the country, being surrounded to the north, east and south by mountainous areas of India, and opening out in the west to the vast low-lying-Brahmaputra-Ganga delta system.’
পাণিনির অষ্টধ্যায়ীতে সূরমস (৪-১-১৭০) নামে যে একটি জনপদের কথা বলা হয়েছে তা সুরমা উপত্যকা বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। সপ্তম শতাব্দীতে চৈনিক পরিব্রাজক ‘হিউ এন সাং এর ভ্রমণ বৃত্তান্ত সিযুকি (si-yu-ki) গ্রন্থে শি-লি-চ-ট-ল বলে একটি রাজ্যের উল্লেখ রয়েছে, সেটাই প্রাচীন শ্রীহট্ট এবং এখানে শ্রীহট্টকে একটি স্বতন্ত্র প্রাচীন রাজ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।’ এছাড়া আরব পর্যটক সোলায়মান ছয়রাফী বঙ্গোপসাগর অতিক্রমকালে বাংলার বিখ্যাত বন্দর সেলাহেটের কথা উল্লেখ করেছেন। নবম শতাব্দীতে, দশম শতাব্দীতে উৎকীর্ণ শ্রীচন্দ্রের তাম্রশাসনে ‘শ্রীহট্ট মন্ডল’ এবং একাদশ শতাব্দীতে উৎকীর্ণ গোবিন্দ কেশব দেবের তাম্রশাসনের উল্লেখ রয়েছে শ্রীহট্টরাজ্য বলে। আর প্রায় একই সময়ে মহাপন্ডিত আলরেবুনী তাঁর বিখ্যাত ‘কিতাবুল হিন্দ’ গ্রন্থে এ রাজ্যের নাম উল্লেখ করেছেন ‘লিলাহাত’ বলে।
সিলেট অঞ্চলের ইতিহাসের শুরু সপ্তম শতকের কাল থেকে। এই সময় এই অঞ্চল কামরুপের অধীন ছিল। তবে প্রাচীন গৌড় লাউড় ও জৈন্তা রাজ্যসহ ইটা, তরফ প্রভৃতি সামন্তরাজ্য সিলেটের অন্তর্ভূক্ত ছিল। হযরত শাহজালাল (র.) চতুর্দশ শতাব্দীতে সিলেট জয় করেন। এর পরবর্তী দু’শতকের ইতিহাসও অস্পষ্ট। ১৬১২ সালে বাংলার সুবাদার ইসলাম খাঁর সেনাবাহিনীর হাতে সিলেটের পাঠান শাসক খাজা ওসমানের পরাজয় হয়। মির্জা নাথনের ‘বাহার-ই-স্থান-ই গায়েবী’ গ্রন্থে এই যুদ্ধের বর্ণনা আছে। বাংলার নবাব মীর জাফরের আমলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ সালে সিলেটের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব গ্রহণ করে। সিলেটের প্রথম ইংরেজ কালেক্টর উইলিয়াম ম্যাকপীস থ্যাকারে ১৭৭২ সালে সিলেট আসেন। ১৮৭৪ সালে সিলেটকে নবগঠিত আসাম প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এতে সিলেটেবাসীরা আপত্তি জানিয়েছিলেন। প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ১৮৭৭ সালে সুনামগঞ্জ, ১৮৭৮ সালে হবিগঞ্জ ও করিমগঞ্জ এবং ১৮৮২ সালে সিলেট সদর মহকুমাকে বিভক্ত করে দক্ষিণ শ্রীহট্ট (মৌলভীবাজার) মহকুমা গঠন করা হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হলে সিলেট আবার আসামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।
বর্তমান সিলেট বিভাগ ইতিহাসের বহু ভাঙাগড়ার ফল। এই ভূখন্ডের আয়তন বারবার পরিবর্তিত-কখনও সংঙ্কুচিত, কখনও সম্প্রসারিত- হয়েছে। বর্তমানরূপ সংকোচনের ফল। সিলেটের কিছু অংশ কিশোরগঞ্জ এবং কিছু অংশ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভগের সময় সিলেট করিমগঞ্জ মহকুমার রাতাবাড়ি বদরপুর, পাথরকান্দি থানা ও করিমগঞ্জ থানার অংশবিশেষ সিলেট থেকে বিচ্যুত হয়ে আসামের কাছাড় জেলার অন্তর্ভূক্ত হয়। ১৯৮৪ সালে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার মহকুমা জেলায় উন্নীত হয়। ১৯৯৫ সালে সিলেট বিভাগ গঠিত হয়।
প্রসঙ্গ: সিলেটি নাগরী লিপি
সিলেটি নাগরী লিপি বাংলা ভাষার একমাত্র আঞ্চলিক লিপি। সিলেটি মুসলিম সমাজে প্রচলিত এ লিপির ব্যাপক পঠন পাঠন একসময় হতো। পুঁথিপত্র লেখা চলত, যার দরুণ এ লিপিকে সিলেটের এক ব্যতিক্রমি সম্পদ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী বঙ্গ বিজয় করেন। এর এক শতাব্দী পর ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি সরকার সৈয়দ নাসির উদ্দিন এর নেতৃত্বে সৈন্য বাহিনী সিলেট অভিযানে পাঠান। সিলেটে তখন হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের শাসন। যাত্রা পথে কাকতালীয় হযরত শাহজালাল (র.) এবং তাঁর সঙ্গী সাথী ৩৬০ আউলিয়ার সাথে দেখা হয়। দরবেশ সৈয়দ নাসির উদ্দিন আধ্যাত্ম-গুরু হিসেবে হযরত শাহজালাল (র.) এর নেতৃত্ব মেনে নেন এবং উভয় বাহিনী সম্মিলিতভাবে হিন্দুরাজা গৌড় গোবিন্দের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। পীর-আউলিয়াদের আধ্যাত্মিক প্রভাবে শেষ পর্যন্ত বিনা রক্তপাতে সিলেটে মুসলমানদের বিজয় হয়। এ বিজয় সারা বাংলার বুকে সুদুর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়। পীর আউলিয়াদের প্রায় সকলেই এদেশের অধিবাসী বনে যান। ফলে তাঁদের ফেলে আসা পরিবার পরিজনদের অনেকেও এসে যান এখানে। অপরদিকে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে ইসলাম গ্রহণের এক হিড়িক পড়ে যায়। আরব- পারস্যের প্রভাবে ধর্মের সাথে সাথে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চাটাও নতুন পথে যাত্রা করার অবকাশ পায়। দেব-দেরী নির্ভর কাহিনীর বদলে শুরু হয় সুফী ইজমের চর্চা এবং সুফী তত্ত্বমূলক মানবিক প্রণয় কাহিনী রচনার সূত্রপাত ঘটে। এতে বাহিরাগত মুসলমানগণ কঠিন-জটিল বাংলা লিপি নিয়ে একটা বিরাট ধাঁধাঁর সম্মুখীন হন। এ কারণে উত্তর ভারতের দেব নাগরী অধ্যুষিত এলাকা থেকে আগত ৩৬০ আউলিয়ার অন্তর্গত কতিপয় পীর আউলিয়ার প্রচেষ্টায় খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ শতকের প্রথমার্ধের ভেতরেই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ৩০ বর্ণে তৈরী আরবী বর্ণমালার সংখ্যার ভিত্তিতে সিলেটি নাগরী বর্ণ নামে বিকল্প লিপি তৈরী হয়ে যায়।
এ পর্যন্ত প্রাপ্ত নাগরী লিপিতে রচিত পুঁথির সংখ্যা প্রায় শ-খানেক। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ছাদেক আলীর হালতুন্নবী, মহব্বত নামা, হাসর মিছিল। মুন্সী ইরপান আলীর ছয়ফুল বেদাত, শাহজালালের তয়ারিখ, রাহাত নামা। মুন্সী মো. ছলিম (শীতালংশাহ) এর কিয়ামত নাম, হাসর তরান। সৈয়দ শাহনূর এর নূর নছিহত, রাগ নূর। আব্দুল হাকিম’র নছিত নামা ইত্যাদি উল্লেখ যোগ্য।
বর্তমানে নাগরী লিপিতে রচিত অনেক পুঁথি বাংলাসহ আদি নাগরী লিপিতে নতুন করে প্রকাশিত হয়েছে এবং পাঠকরাও অনেক আগ্রহ সহকারে গ্রহণ করেছেন। সিলেটি নাগরী নিয়ে অনেক গভেষণা, আলোচনা বিভিন্ন পর্যায়ের চালু আছে। ফলে আরো ব্যাপক তথ্য ও পাণ্ডুলিপি পাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
সিলেটের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের উদ্বোধয়। বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা বাংলা। বাঙালির বাইরে ৪টির বেশি নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে। তাদের সংখ্যা সাকল্যে ১৫ লাখ। এদেশে বসবাসরত নৃ-গোষ্ঠীগুলো পৃথিবীর অন্যতম চারটি ভাষা পরিবারের প্রায় ৩০টি ভাষা ব্যবহার করে। আমাদের সিলেট অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রচলিত ভাষার মধ্যে খাসিয়া, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ও মৈতৈ মণিপুরি অন্যতম। ২০১৩, ফেব্রুয়ারি মাসে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ‘বাংলাদেশের নানান ভাষা’ শিরোনামে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা সমূহের পরিচিতি ও অবস্থান তুলে ধরেন। ঐ অংশে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, মৈতৈ মণিপুরি ও খাসিয়া ভাষার বিবরণ উল্লেখ করা হলো।
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি
বাংলাদেশে মূলত সিলেট বিভাগে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার প্রচলন আছে। বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার দুটি উপভাষা। একটি রাজার গাঙ অর্থাৎ ‘রাজার গ্রাম’। আরেকটি ‘মাদাই গাঙ’, অর্থাৎ ‘রানির গ্রাম’। কে পি সিনহার মতে, নব্য ইন্দো-আর্য ভাষার উৎপত্তির কালে, কিংবা তার ঠিক পরেই-অর্থাৎ ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতকে-ইন্দো-আর্য-ভাষা থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার উদ্ভব। শুরুতে এই ভাষা ভারতের মণিপুর রাজ্যে প্রচলিত হয়। এই নতুন ভাষা মোটামুটি পূর্ণাঙ্গতা পায় ষোলো শতকে।
তেরো থেকে ষোলো শতক পর্যন্ত বিষ্ণুপ্রিয়া ও মেইতেই জনগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে বিষ্ণুপ্রিয়াতে মেইতেই শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে। উনিশ শতকের শুরুতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার ব্যাপকভাবে ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের শব্দাবলি প্রবেশ করে। অহমিয়া ও বাংলার সঙ্গে এই ভাষার সাদৃশ্য থাকায় একে বাংলা বা অহমিয়ার উপভাষাও বলা হয়ে থাকে। তবে পন্ডিতদের অনেকেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিকে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। জর্জ গ্রিয়ারসন তাঁর লিংগুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়াতে (১৯০৩) বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘[বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি] ভাষার মধ্যে দুই ভাষার (অহমিয়া ও বাংলা) বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেলেও উভয়ের সঙ্গেই এর বড় ধরনের পার্থক্য আছে।’ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায় এ-যাবৎ সংগৃহীত ৩০ হাজার শব্দসম্ভার রয়েছে। এর মধ্যে তৎসম শব্দ ১০ হাজার, অর্ধ তৎসম এক হাজার পাঁচ শ, তদ্ভব আট হাজার, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি শব্দসংখ্যা দুই হাজার।
ভারতের আসাম ও ত্রিপুরার পাশাপাশি মিয়ানমারেও এই ভাষাভাষী মানুষ আছে। ত্রিপুরা রাজ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার অবস্থান তৃতীয়। বাংলাদেশ বেতারের সিলেট কেন্দ্রে ‘মণিপুরি অনুষ্ঠান’ নামে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ও মেইতেই মণিপুরি ভাষায় গান, কথিকা ও নাটিকা প্রচারিত হয়।
বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার স্বীকৃতির জন্য এ ভাষাভাষী মানুষের সংগ্রাম করেছেন ভারতে। আন্দোলনের কর্মসূচী হিসেবে ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ রেল অবরোধ কর্মসূচী পালন করতে গেলে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। তাতে সুদেষ্ণা সিংহ প্রাণ দেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার সাহিত্যভান্ডার সমৃদ্ধ। এ ভাষার কবি রনজিত সিংহের ‘বলি ইয়া আছৎ, দাদা’ কবিতার কয়েকটি লাইন ‘হারৌহান বাহিছিলে মোরে পেয়া/ আকখলাগয় তর গরে-মাংকলে-কোঠাৎ বয়া/ কতিয়ৌ সহজ করে পানা;/ কিন্তু বিধির বিধানে লেখা/ বিদা লগ্নৎ নাহে ইল দেখা/ তেব অনন্তকাল সুপৌ দুকখ নাককো পানা।’
কবি নিজেই তাঁর কবিতার তর্জমা করেছে; ‘আনন্দে বিভোর ছিলে আমাকে পেয়ে/ একা, তোমার ঘরে-উঠোনে-সাজকক্ষে/ কতই না সহজ ছিলো এ পাওয়া!/ কিন্তু বিধির বিধানে লেখা/ বিদায় লগ্নে হলো না দেখা/ তবু অনন্তকাল যেন হয় না এ দুঃখ বাওয়া।’
মৈতৈ মণিপুরি
মৈতৈ মণিপুরি ভাষাভাষীদের বসবাস মূলত বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে। ভাষা পরিবারের দিক থেকে মৈতৈ মণিপুরি তিব্বতি-বর্মী ভাষা-পরিবারের কুকি-চীন গোত্রভুক্ত। জর্জ গ্রিয়ারসন মৈতৈ ভাষাকে ভোট-চীন পরিবাভূক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। টি সি হাডসন তাঁর দ্য মৈতৈস বইয়ে মৈতৈ ভাষাকে তিব্বতি-বর্মী ভাষা পরিবারের অন্তর্ভূক্ত করেছেন।
মৈতৈ অতি প্রাচীন ভাষা। এ ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা আছে। অধিকাংশ গবেষকের মতে, মৈতৈ লিপি ব্রাহ্মণী লিপি থেকে উদ্ভূত। ভারতের মণিপুর রাজ্যে মহারাজ পাংখংবার আমলে এ লিপির প্রথম প্রচলন হয়। তখন মৈতৈ ভাষার মোট হরফ ছিল ১৮ টি। পরে মহারাজ খাগেম্বার (১৫৯৬-১৬৫১) সময়ে আরও নয়টি হরফ যুক্ত হয়। সপ্তম শতকের একটি ব্রোঞ্জ মুদ্রার ওপর মৈতৈ লিপির প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। ফলে মৈতৈ লিপির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে এখন আর সন্দেহের অবকাশ নেই। মৈতৈ লিপি প্রাচীন হলেও এ পর্যন্ত এই লিপিতে রচিত কোনো প্রাচীন গন্থের সন্ধান মেলেনি। পরে বাংলা লিপিতে মৈতৈ ভাষা লেখার প্রচলন ঘটে। বাংলা হরফে মৈতৈ ভাষায় রচিত গোড়ার দিককার দুটি গ্রন্থ হচ্ছে পুইরেইতন খুনথক ও নুমিত কাপ্পা। ত্রিপুরা রাজ্যে অবশ্য বাংলা ও মৈতৈ দুই লিপিতেই মৈথে লেখার প্রচলন আছে। মণিপুরি লিপির একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এর প্রতিটি হরফের নাম রাখা হয়েছে মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের নাম অনুসারে। বাংলা ‘ক’ বর্ণের মণিপুর প্রতিবর্ণ ‘কোক’। ‘কোক’ মানে ‘মাথা’। ‘স’ এর প্রতিবর্ণ ‘সম’। এর অর্থ চুল।
১৯৯২ সালে মৈতৈ মণিপুরি ভাষাকে ভারতীয় সংবিধানে অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ভারতের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলাদেশে বাংলাদেশ বেতার ও সিলেট কেন্দ্র ‘মণিপুরী’ নামে একটি সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে মৈতৈ ভাষায় নানা অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা থেকে ‘ত্রিপুরা চে’ নামে মৈতৈ ভাষায় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হয়।
দীর্ঘদিন ধরেই মৈতৈ ভাষায় সাহিত্যচর্চা হচ্ছে। মৈতৈ ভাষার কবি খোইরোম কামিনী কুমারগী শৈরেং তার “লম্বন তোল্লবনি ঐদি বাঙলা ইমাগী মফমদা’ বা ‘ঋণী আমি বাংলা মায়ের কাছে’ কবিতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ ব্যক্ত করেছেণ। কবিতার কয়েকটি লাইন এ রকম: ‘রবীন্দ্রনাথ না ঐগী থাজবা থম্মোয়গী ঙমকৈনি/নজরুল ঐগী নুংশিবা-লালহৌনি/জীবনানন্দনা ঐগী লৈপাকনিঙবা/দ্বিজেন্দলাল, অতুলপ্রসাদনা ঐগী খোন্থোক্কী ঈশৈ;/লম্বন তোল্লবনি ঐদি/বাংলা অমসুং বাংলা ইমাগী মফমদা।’ কবির স্বকৃত অনুবাদে; ‘রবীন্দ্রনাথ আমার প্রত্যয়—হৃদয়ের সীমানা/নজরুল আমার প্রেম—বিদ্রোহ/জীবনানন্দ আমার দেশপ্রেম,/দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ আমার কন্ঠের গান। ঋণী আমি বাংলা ও বাংলা মায়ের কাছে’।
খাসি
বাংলাদেশের সিলেটের সীমান্তসংলগ্ন অঞ্চলে বসবাসরত মঙ্গেলয়েড খাসিয়া বা খাসি জাতির ভাষার নাম খাসি ভাষা। এই ভাষার স্থানীয় নাম খাসিয়া। খাসিয়া নৃগোষ্ঠী মঙ্গোলয়েড হলেও খাসি ভাষা অস্ট্রিক মোন-খমের গোত্রের অন্তর্গত। বাংলাদেশে বর্তমানে খাসিয়াদের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। ১৯৯১ সালের আদমশুমারিতে এ সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ২৮০। ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্য মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ লোক খাসি ভাষায় কথা বলে। বিভিন্ন ভাষাবিজ্ঞানী খাসি ভাষার সঙ্গে মিয়ানমারের মোঁয়ে, পলং এবং উপমাহাদেশের তালাং, খেড়, সুক, আনাম, খামেন, চোয়েম, ক্ষং, লেমেত, ওয়া প্রবৃতি নৃগোষ্ঠীর ভাষার মিল লক্ষ করেছেন। খাসি ভাষার নিজস্ব কোনো লিপি নেই। ১৮১২ সালে খ্রিস্টীয় ধর্মযাজক কৃষ্ণচন্দ্র পাল প্রথম বাংলা বর্ণমালায় খাসি ভাষায় নিউ টেস্টামেন্ট অনুবাদ করেন। ১৮৩৮ সালের পরে ওয়েলস মিশনারি দলের টমাস জোনস রোমান হরফে খাসি ভাষা লেখার প্রচলন করেন। বর্তমানে খাসি ভাষা রোমান হরফে লেখা হয়। বাংলাদেশের খাসিয়াদের মধ্যে অনেকে এখন বাংলা লিপিতেও খাসি ভাষা লিখছেন। খাসি ভাষার উপভাষা রয়েছে বেশ কয়েকটি। লিঙ্গামকে এই ভাষার ঔপভাষিক বৈচিত্র্য বলে মনে করা হয়।
খাসি ভাষায় খুব বেশি সাহিত্য রচিত হয়নি। চাকমা বা মণিপুরিদের সঙ্গে তুলনা করলে একে অপ্রতুল বলা চলে। খাসি ভাষার কবি রুশ পতামের একটি কবিতার নাম ‘জিং ইম হা লুম’ বা ‘অরণ্যে স্নিগ্ধ জীবন’। দীর্ঘ এই কবিতায় খাসিয়াদের রোজকার জীবনের একটি ছবি পাওয়া। একই সঙ্গে পাওয়া যায় গভীর দেশাত্মবোধ। কবিতাটির এক জায়গায় আছে, ‘ডাং স্টে ফেরঙাপ কি ফেট শা ব্রী/ কি সং উ কোয়াই কা ওয়াইট টারী/ উ ছট কি কিয়াং লেনটি বা জেঙাই/ কি স্টেট কি ইয়াইড বান ওয়ান ডিংশাই। হা ট্রেপ সংথাইট টেমপেউ তাহ শুন/ জ্বাপ জ্বাপ বাম কোয়াই কাম বা বুন। …/ কো রি বা ইজ খুবলেই ইয়াফা/ কুমনো ঙান ক্লেট জিংবাং জংফা/ রীথর রীলুম লং কিসিয়ার রুপা/ ডিংসীজ কেনবাট বাডাপ পুড়া।’ অর্থাৎ ‘ভোরে জেগে উঠে চলি পান ক্ষেতে/ পানসুপারি, দা-টারি সাথে/ কাঁধে ছট খাড়া অতি দ্রুত যেতে হবে দূরে/ ফিতে হবে আধার নামার আগে/ ক্ষেত আর কুঁড়েঘর আনন্দ-আয়েশ/ তাড়া করি কাজ পানসুপারি চিবিয়ে।…/ প্রিয় জন্মভূমি, তোমার আশীর্বাদ/ প্রতিদিন স্মরণে তোমার সুমিষ্ট দান/ সমভূমি পাহাড় অরণ্য সোনারূপার দেশ/ গাছ বাঁশ ঘাস লতাগুল্ম গুচ্ছ সমাহার।’
সিলেটিগণ তাদের নিজস্ব উপভাষা ও তার ঐতিহ্য সম্পর্কে গর্বিত এবং যেকোন পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের মধ্যে এই ভাষায় ভাব বিনিময় করতে ভালবাসেন। সিলেটিরা শিক্ষা দীক্ষায় সম্পদে এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানে উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন।
সহায়ক
* উপভাষা চর্চার ভূমিকা – মনিরুজ্জামান
* ফোকালোর চর্চায় সিলেট – নন্দলাল শর্মা
* সিলেটি নাগরী পরিক্রমা – চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্য ভূষণ
* ইউকোপিডিয়া
* ইন্টারনেট (গুগল)
* দৈনিক প্রথম আলো
* বিভিন্ন স্থানীয় স্মরণিকা

কবি, প্রাবন্ধি