হুমায়ুন আজাদের কবিতা : বিষয় ও শিল্প প্রবণতা

ত্রিশের কাব্যের বিষয় বৈচিত্র ও আঙ্গিকের নতুনত্ব কবি হুমায়ুন আজাদকে স্পর্শ করেছিল কিন্তু প্রভাবিত করেনি। পঞ্চপাণ্ডবের বিদ্রোহ ও নতুনত্বকে তিনি অঙ্গীভূত করেছেন কিন্তু তাঁদের শিল্পের অমানবিকীকরণ, বহিরিস্থতা, হতাশা-বিষণ্নতা, বিচ্ছিন্নতা, অপ্রকৃতস্থতাকে গ্রহণ করেননি। ‘কল্লোল’ ছিল তাঁর পক্ষপাতের ক্ষেত্র, বুদ্ধদেব বসুর প্রভাবকে তিনি উপলব্ধি করেছেন আবার রবীন্দ্রনাথের জীবনদৃষ্টিকেও উপেক্ষা করেননি। বঙ্কিমচন্দ্র যেমন গ্রহণ করেছিলেন মিল, কোঁৎ, বেন্থামের চিন্তাকে মধুসূদন গ্রহণ করেছিলেন হোমার, মিল্টনকে। হুমায়ুন আজাদ গ্রহণ করেছিলেন সম্পূর্ণ ইউরোপকে। তিনি ফ্রয়েড, মার্কসীয় চিন্তার পাশাপাশি ইউরোপের নারীবাদি চিন্তা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। কবিতার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মালার্মে, হাইনে, এজরা পাউন্ড, ডিলান টমাস, ই ই কামিংস, ডব্লিই. বি. ইয়েটস, বোদলেয়ার আমেরিকার হুইটম্যান এবং ইউরোপের অন্যান্য রোমান্টিক কবিদের রচনাবলীও তিনি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন। অনুবাদ করেছেন জন কীট্স, ম্যাথিউ আরনল্ড, ডব্লিউ বি ইয়েট্স্, ই ই কামিংস, হাইনরিশ হাইনে প্রমুখের স্বল্প কিছু কবিতা।

হুমায়ুন আজাদ ছিলেন ‘খাপ না খাওয়া মানুষ’, সংঘ, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা গুরুবাদে ছিল তাঁর অতীব অনীহা। তাঁর মতে এসব নিম্ন মাঝারিদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া। প্রতিভাবানদের প্রয়োজন হয় না কোনো সংঘের তাই তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন দেবস্তুতি ও মহাপুরুষবন্দনা। তিনি মনে করেন দুরাচারীরাই আজ বেশি সংঘবদ্ধ। তিনি হয়ে উঠেছেন একাকী-নিঃসঙ্গ। ‘খাপ-না-খাওয়া মানুষ, ‘নিঃসঙ্গ ছিলাম’ প্রভৃতি কবিতায় তিনি নিজের নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্বের কথা বলেছেন, এটি কেবল তাঁর কাব্যিক ভাবাবেগ নয়, এটি তাঁর ব্যক্তিস্বভাব সম্পর্কে স্বীকারোক্তিও।

ভাব-ভাষায় তিনি ত্রিশের নিকটবর্তী হলেও চেতনা ও বিষয়বস্তুতে স্বতন্ত্র। ষাট ও সত্তরের দশকের বিনির্মাণের রক্তাত্ব সংগ্রাম ও আশির দশকের স্বপ্নভঙ্গের সময়ে হুমায়ুন আজাদ ব্যর্থতা ও বিষণ্নতার গান গাইতে বাধ্য হলেও তাঁর বিদ্রোহের রূপ অত্যন্ত তীক্ষ্ম; দুর্বৃত্তায়ন ও নির্বুদ্ধিতাকে তিনি অসঙ্কোচ চিত্তে ঘৃণা করেছেন। তাঁর কবিমানস সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও ভিন্ন ব্যক্তিত্বের স্বাক্ষরপরিবাহী; তাঁর নেই জীবনানন্দের আত্মনিমগ্নতা, রবীন্দ্রনাথের বহিরিস্থতা, কল্লোলের হতাশা, জীবন বিতৃষ্ণা, নেই বুদ্ধদেব বসুর-বোদলেয়ারের হতাশাক্লিষ্ট ক্লেদাক্ততায় নিমগ্নতার প্রয়াস। দেশ-কাল চেতনা, বস্তুবাদী দর্শন, প্রথা বিরোধিতা, প্রকৃতি, প্রেম নিভৃত চিন্তা সবই ‘হুমায়ুন আজাদী’ ব্যক্তি স্বাতন্ত্রে ভিন্নমাত্রা লাভ করেছে। দার্শনিকের নিমগ্নতা, জ্ঞানীর গাম্ভীর্যের সঙ্গে ব্যক্তিত্ব ও রসবোধে হুমায়ুন আজাদ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। হুমায়ুন আজাদ ‘প্রথা বিরোধী’ কবি, তাঁর প্রথা বিরোধীতা অকৃত্রিম, কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ত। ‘তিনি নানান প্রবচন ব্যবহারের মাধ্যমে কবিতায় বাণীস্বত্ব সংযোজনের প্রয়াস পেয়েছেন যে কারণে তাঁর কবিতা সমাজ ও জাতির সংকটকালে উচ্চারিত হয়েছে মানুষের মুখে মুখে।’১ তিনি ছিলেন প্রথা বিরোধী, তাঁর এই প্রথা বিরোধীতাকে অনেক সময় উন্নাসীকতা বলেই মনে হয় কিন্তু তিনি বিশ্বাসী ছিলেন গণতন্ত্রে, অপগণতন্ত্রে তাঁর বিশ্বাস ছিল না, আস্থা নেই এক দল বা স্বৈরতন্ত্রে। তাঁর আস্থা নেই পৌরাণিক স্বর্গে, মানুষকে পরিশ্রম করে আধুনিক চিন্তা দিয়ে ভবিষ্যত নির্মাণ করতে হবে, পশ্চাতে প্রত্যাবর্তনের প্রচেষ্ট সেটা প্রতিক্রিয়াশীলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘প্রাচ্যকে আমি হাজার হাজার বছর ধরে প্রথার পায়ে অবনমিত দেখেছি এবং অনেকাংশে প্রত্যাখান করেছি। আমি যদি উনিশ শতকে জন্ম নিতাম, তাহলে ওই প্রত্যাখান হতো অত্যন্ত স্পষ্ট।’২

‘মূল্যজ্ঞানের চেতনায় একটি আদর্শকে তিনি কবিতায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। সেখানে স্মৃতিজড়িত গ্রাম-নিসর্গই মূলধারা-বস্তুত সেখানেই তাঁর সর্বোত্তম প্রতিষ্ঠা। …চিত্ররূপময়তায় আবাহনে বাংলাদেশের ঋতু-রঙ নগর-গ্রাম নির্বিশেষে বর্ণিল। বাক্সময় স্বদেশ তবে বিপরীতপ্রান্তে আবার দুঃখদীর্ণ বিনষ্ট স্বদেশের প্রতিও ক্রুদ্ধতা বিরাজমান। হুমায়ুনের আবেগ শুধু রোমান্টিক শর্তে পরিস্রুত নয়, আনন্দ-আলিঙ্গনের ভেতর দিয়ে এক ধরণের যৌক্তিক শাসন পেয়েছে। কারুচেতনায় তা বিভাঋদ্ধ। জীবদ্দশায় হুমায়ুন আজাদ কবিমনে উন্নত অন্তর্লীন মুগ্ধতায় প্রকৃতিবিশ্বকে ধারণ করলেও বিভিন্ন কাব্যে কখনো অতিশয় অতীত মুগ্ধতার পুনরাবৃত্তি (রাঢ়িখাল বা বেড়ে ওঠা স্মৃতিময় গ্রাম), কখনোবা প্রথার-অর্গল ভাঙার বেপরোয়া তৎপরতায় কবিচিন্তন বৃত্তাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তবে বাকপ্রতিমা-নির্মাণ, শব্দের কাব্যময় কল্পনাবিন্যাস আমাদের কবিতায় নতুন ধর্ম অর্জন করেছে।’৩

হুমায়ুন আজাদের শিল্পী মানস পরিস্ফূট হয়েছে তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। বাংলার রূপে মুগ্ধ তিনিও, কিন্তু সময় তাঁকে সর্বদা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তিনি জন্মেছেন অন্যদের সময়ে, যে সময় কেড়ে নিয়েছে তাঁর সোনালি শৈশব, নষ্ট করেছে যৌবনের উচ্ছলতা, কলুষিত করেছে বার্ধ্যক্যের জ্ঞাননিবিষ্টতার সুখ। ফুল আর পাখিরা হত তাঁর কবিতার বিষয়, বেলা কাটত প্রকৃতির লীলা দর্শন করে বা সৃষ্টির মাঝে আত্মনিমগ্নতায় নিবিষ্ট থেকে; কিন্তু ‘বেহাত’ বিপ্লব তাঁকে করেছে প্রথাবিরোধী-বিদ্রোহী। তাঁর কাব্যের একটি বৃহদাংশে ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশের জন্যে উচ্চকিত শোক আর বিদ্রোহের বাণী শোনা যায়। অস্থির সময় তাঁকে জীবন ও প্রকৃতিতে নিমগ্ন হতে দেয়নি-ব্যর্থতার নিঃসঙ্গতাই তাঁর কাব্যগতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তথাপি তিনি প্রকৃতি ও জীবনকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি, কিন্তু প্রকৃতি-প্রেম-জীবনভাবনা ঘনীভূত হয়ে ওঠার অবকাশ পায়নি। ’৪৭ পরবর্তীতে বাঙালির পরিচয় রক্ষার দীর্ঘ সংগ্রাম এবং ’৭১ এর যুদ্ধোত্তর কালের গণতান্ত্রহীন শাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের অনির্ধারিত জনবিক্ষোভ কবিচিত্তকে অস্থির করেছে। তিনি বিরোধীতা করেছেন কিন্তু বিপ্লবের আহ্বান করেননি, কেননা তিনি আজীবন কেবল ভাঙতেই দেখেছেন, নিকটকালে তিনি বাঙালির সমাজ-মানসে কোনো পরিবর্তন দেখতে পাননি। তাই তাঁর কবিতা কোনো মতবাদের ভিত্তিতে স্থিত নয়, দুর্বৃত্ত ধনবাদীদের বিপরীতে বামেরা বিলুপ্ত ডায়নোসর।৪ একারণে তিনি নন সমাজতন্ত্রের কবি বা বিপ্লবের কবি। সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সমর সেনের থেকে এখানেই তিনি ব্যতিক্রম ও স্বতন্ত্র। তাঁরা নির্মাণের আহ্বান করেছেন হুমায়ুন আজাদ এর ভিত্তি গড়েছেন, মুক্তির পথ তাঁর অজানা কিন্তু তিনি জানেন কোন অন্ধকারই চিরজীবী নয়। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বারবার ব্যর্থতা ও ভারতীয় উপমহাদেশসহ বাংলাদেশে বাম রাজনীতির উপর্যুপরি ব্যর্থতা তাঁকে সন্দিহান করেছে তাই তিনি হয়ে ওঠেন নি কোনো মতবাদের কবি। তাঁর বিদ্রোহের স্বরূপকে অনেক তরুণ কবিই গ্রহণ করেছেন কিন্তু তার তীব্রতাকে কেউ গ্রহণ করতে পারে নি।

হুমায়ুন আজাদ ‘কাব্য সমগ্র’-এর ভূমিকাংশে লিখেছেন, ‘খ্যাতি, সমাজ বদল, এবং এমন আরো বহু মহৎ উদ্দেশ্যে কবিতা আমি লিখি নি ব’লেই মনে হয়; লিখেছি সৌন্দর্যসৃষ্টির জন্যে, আমার ভেতরের চোখ যে-শোভা দেখে, তা আঁকার জন্যে; আমার মন যেভাবে কেঁপে ওঠে, সে কম্পন ধ’রে রাখার জন্যে। মানুষের অনন্ত সৃষ্টিশীলতা আমার ভেতর দিয়েও প্রকাশ পাক কিছুটা, এমন একটা ব্যাপারও হয়তো আছে।’ জনপ্রিয়তার অভিলাষে তিনি লেখেননি কিন্তু সময় যেমন দুর্বৃত্তদের জন্ম দিয়েছে তেমনি নির্মাণ করেছে ‘হুমায়ুন আজাদ’।

তিনি বলেন, ‘কমিয়েছি উচ্ছ্বাস, অতিশয়োক্তি, ছেঁটে দিয়েছি নিরর্থ বিশ্লেষণ, শব্দ ও বাক্যাংশ, দমিয়েছি যতিচিহ্নের নির্বিচরিতা।’ এর সঙ্গে তিনি বর্জন করেছেন তথাকথিত বাঙালির আবেগ, ব্যর্থ প্রলাপ, ভাবোচ্ছ্বাস। কৃত্রিম আঙ্গিক বিনির্মাণের প্রচেষ্টাও হুমায়ুন আজাদে দৃষ্টিগোচর হয় না। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থে আঙ্গিক নির্মাণের প্রচেষ্টা দেখা গেলেও তিনি পরবর্তী কাব্যগ্রন্থসমূহে তাঁর সহজাত শিল্পোচেতনা দ্বারা নবসৃষ্টির প্রয়াসে নিবিষ্ট হয়েছেন। ষাট, সত্তরের দশকের পরাবাস্তবতা, পোস্টমডার্নিজম, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ, ত্রিশের আধুনিকতা, দুর্বোধ্যতা, অতিপরিমার্জন, প্রথাগত টাইপ কাব্যবিন্যাস এমনকি নারীবাদী চেতনাও তাঁর কাব্যক্ষেত্রে স্বীয় ব্যক্তিত্বকে অতিক্রম করেনি। তিনি সর্বাংশে আধুনিক, গ্রাম বা নগরের প্রতি তাঁর বিশেষ দুর্বলতা নেই। তাঁর সম্পূর্ণ দুর্বলতা জীবনকে ঘিরে, জীবনকেই তিনি এঁকেছেন কবিতার আকারে।

হুমায়ুন আজাদ যেমন ক্লিষ্ট হয়েছিলেন তাঁর সময়ের দ্বারা, তেমনি তাঁর কবিতা একাদিক্রমে পাঠ করে পাঠকও কোনো কোনো সময়ে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত-বিষণ্নতা বোধে আক্রান্ত হন। কেননা তাঁর কাব্য একটা অস্থির সময়েরই প্রতিচ্ছবি। রবীন্দ্রনাথ পাঠ করে পাঠক সুস্থির হন, জীবনানন্দ পাঠ করে আত্মচেতনায় নিমগ্ন হন, নজরুল-সুকান্ত করে বিদ্রোহ ও বিপ্লবে উজ্জীবিত, কিন্তু হুমায়ুন আজাদের কাব্য পাঠককে কোনো নির্ধারিত গন্তব্যে উপনীত করে না। কোনো নির্ধারিত তত্ত্ব, চিন্তা, জীবনবোধ বা দর্শনকে ঘিরে তাঁর কাব্য পরিমণ্ডল আবর্তিত হয় না; তাঁর অনেক ভাব ও ভাবনাই ক্ষণকালীন চেতনা ও স্বতঃস্ফূর্ত। প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থে তাঁর কবিসত্তাই প্রধান হয়ে উঠেছে, এখানে তাঁর বক্তব্য কবিভাষাকে অতিক্রম করতে পারেনি; এরই মধ্যে কোনো কোনো কাব্যে প্রধান হয়ে ওঠেছে কবির দার্শনিক সত্তা। ‘টি এস এলিয়ট এবং তাঁর অনুগামীরা ভাষা প্রয়োগের দিক দিয়ে চরমপন্থী বলে আখ্যায়িত হতে পারেন। তাঁদের বক্তব্য এই যে, কবিতার পুরো অর্থটা নাই-বা জাহির হলো, তাতে এসে যায় না কিছুই। কাব্যের আস্বাদ নিতে হবে শব্দ ও পঙ্ক্তিগুলোকে নিংড়ে। বারবার পড়ে যেতে হবে; ছন্দোবদ্ধ শব্দ আর পদ মনের মধ্যে কোমল কঠোরে বাজতে থাকবে, অনুরণিত প্রতিধ্বনি হতে থাকবে; কবির বক্তব্য যতটুকু ধরা দেয় তা-ই সই।’৫ প্রাচীন গ্রীক ঐতিহ্যপ্রিয় এলিয়ট বা আধুনিকতার কবি জীবনানন্দ দাশ শিল্প প্রেরণা হয়েছেন কোন কোন সময়। আবার অপরপক্ষে তাঁর কতিপয় কবিতা শব্দ আর বাক্যের কারুকাজের বদলে বক্তব্যের অনুশাসনই প্রধান হয়ে ওঠে এক্ষেত্রে আব্দুল গনি হাজারীর ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’ এবং শামসুর রাহমানের ‘যদি তুমি আসো’ প্রভৃতি কবিতাকে অনেকে প্রেক্ষিত রূপে চিহ্নিত করতে চান।

‘অলোকিক ইস্টিমার’ (১৯৭৩)-এ তিনি কবিভাবনা সুনির্দিষ্ট, সুচিন্তিত, বিষয় ও আঙ্গিক সচেতন। এখানে তাঁর স্বকীয়তা স্পষ্ট কিন্তু প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নন। ত্রিশের পঞ্চপাণ্ডবের বিদ্রোহ ও খ্যাতি তাঁর স্মৃতিকে উদ্দীপ্ত করে রেখেছে, ইউরোপীয় কবিদের আধুনিক আঙ্গিক ও নারীবাদী চেতনা এবং বাংলা কবিতাকে আর একটি ভিন্নমাত্রা প্রদানের প্রচেষ্টা তৎকালীন কবিদের ব্যতিব্যস্ত করেছিল, তিনিও এর থেকে মুক্ত নন। আঁটোসাটো গঠন, সুনিয়ন্ত্রিত ছন্দ, সংযত ও পরিমিত আবেগ, অর্থের অস্পষ্টতা ও দ্বৈধতা, শব্দের কারুকাজ, যতিচিহ্নের পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রভৃতিতে তিনি শ্রমনিবিষ্ট ও সতর্ক। প্রথমকাব্যে তাঁর বিদ্রোহের কণ্ঠ উচ্চকিত নয়, এখানে বিরোধীতা নয় বাস্তবতা বর্ণনায় কবিকে সচেষ্ট দেখা যায়, স্বপ্নভঙ্গ ও শাসকদের বিশ্বাসহন্তার রূপ তখনো স্পষ্ট নয় তাই এখানে প্রথাবিরোধী হুমায়ুন আজাদ স্বরূপে আবির্ভুত নন, তাঁর বিদ্রোহের রূপও এখনো স্পষ্ট নয়। দেশ স্বাধীন হবার অনতিকাল পরেই এই কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু এতে নেই স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস, মুক্তির আনন্দ বা জীবনকে বাংলার কোমল আলো-বাতাসে গড়ে তুলবার স্বপ্ন বরং প্রথম কাব্যগ্রন্থেই তিনি সংশয় প্রকাশ করেন,

আমার বাবার
স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়েছিল আমার জীবনে।
আমার স্বাধীনতা কী রকম হবে আমার সন্তানের জীবনে?
নাকি তাকেও বলতে হবে আমার মতোই কোনদিন,
‘এতো দিনে স্বাধীন হলাম।’
-হুমায়ুন আজাদ, অলৌকিক ইস্টিমার

পূর্ববর্তী সময়ের অনেক কবিতাই এখানে স্থান পেয়েছে, ষাট বা সত্তরের দশকের সমাজচিত্র অঙ্কন, আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বাস্তবতার বিমর্ষ বর্ণনাই এ কাব্যগ্রন্থের পরিচয় নির্ধারক বৈশিষ্ট্য। হুমায়ুন আজাদের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘জ্বলো চিতাবাঘ’ (১৯৮০)। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থেই কবি হুমায়ুন আজাদ স্বমূর্তিতে আবির্ভুত হয়েছেন, এটা ছিল তাঁর চেতনা ও স্বাতন্ত্রের একটি নির্ধারক উলম্ফন। তাঁর সুপ্ত ভিন্নমাত্রার ব্যক্তিত্ব এখানে বিষয় ও আঙ্গিকে প্রভাবক রূপে স্বাতন্ত্রের রূপকে উদ্ভাসিত করেছে। এই স্বাতন্ত্র ও স্বকীয়তা তাঁর পরবর্তী চারটি কাব্যগ্রন্থে অব্যাহত দেখা যায়। আড়ষ্টতা ও সংকোচকে অপসারণ করে পরবর্তী কাব্যগ্রন্থসমূহে তিনি আরও বেশি স্পষ্ট ও সুনিশ্চিত। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কবিরা সমস্বরে জনতার কাতারে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিয়েছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন, উজ্জীবিত করেছেন, প্রেরণা দিয়েছেন সৃষ্টির। সত্তরের দশকে ও যুদ্ধোত্তর পর্বে দেশীয় মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের বিশ্বাস ভঙ্গের দিনে কবিদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর চিৎকার ও কোলাহলে পরিণত হয়। কেউ কেউ চিন্তা ও রাজনৈতিক চেতনাকে অপসারিত করে শিল্পের কারুকার্যে আত্মনিমগ্ন হন। কবি হুমায়ুন আজাদ তাঁর প্রতিবাদের ভাষাকে কখনই কোমল করেননি বরং দিনে দিনে তা আরও শাণিত হয়েছেন। হুমায়ুন আজাদের অন্যান্য কাব্যগ্রন্থসমূহ হল: সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে (১৯৮৫), যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল (১৯৮৭), আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০), কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু (১৯৯৮), পেরোনোর কিছু নেই (২০০৪)।

‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’ হুমায়ুন আজাদের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা এবং এটাই হয়তো তাঁর শেষ বাণী, শেষ উক্তি বা কবি মানসের অন্তিম পরিণতি। জীবনানন্দকে যেমন পাওয়া যায় ‘বোধ’ কবিতায় তেমনি যুগযন্ত্রণা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, কবিস্বভাব, দেশপ্রেম প্রভৃতি কবিবৈশিষ্ট্যসহ হুমায়ুন আজাদ যেন এই কবিতায় প্রবিষ্ট হয়ে রয়েছেন। কাব্য পাঠে কবির প্রতি পাঠক যেমন একাত্ম হন তাঁর জীবন বোধের সঙ্গে তেমনি বেদনাও অনুভব করেন কবিজীবনের ব্যর্থতাবোধ থেকে উদ্ভূত চাঞ্চল্য দ্বারা। প্রিয় বাংলার রূপে তিনি মুগ্ধ, আলো-আঁধারের খেলা তাঁর হৃদয়কেও আবিষ্ট করে কিন্তু তিনি বিস্মৃত হতে পারেন না যে, বাংলার ফুল পাখিরাও দুর্বৃত্তায়নের কবল থেকে মুক্ত নয়।

আমি ভুল সময়ে জন্মেছিলাম। আমার সময় তখনো আসে নি।
আমি ভুল বৃক্ষে ফুটেছিলাম। আমার বৃক্ষ তখনো অঙ্কুরিত হয় নি।
আমি ভুল নদীতে স্রোত হয়ে বয়েছিলাম। আমার নদী তখনো উৎপন্ন হয়নি।

আমি ওদের সময়ে আমার মতো দিঘি খুঁড়েছিলাম ব’লে
আমার দিঘিতে পানি ওঠে নি।

আমার সব কিছু পর্যবসিত হয়েছে ভবিষ্যতের মতো ব্যর্থতায়,
ওরা ভ’রে উঠেছে বর্তমানের মতো সাফল্যে।

আমি যে-পৃথিবীকে চেয়েছিলাম, তাকে আমি পাই নি।
তখনো আমার সময় আসে নি। তখনো আমার সময় আসে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম
অন্যদের সময়ে।
-আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে

‘অলৌকিক ইস্টিমার’-এ কবি তখনো সন্দিহান, তিনি ভাবতে চান না বাঙালি আর একবার বিভ্রান্ত হবে। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিপর্যয় থেকে মুক্ত নয় দেশের একটি মানুষও। অতীতের বেদনাদায়ক স্মৃতি, অনিশ্চিত ভবিষ্যত, উপায়হীন, লক্ষ্যহীন জনজীবন—যেন এক অন্ধকার চক্রব্যুহ যেখান থেকে বেরুনোর কোনো পথ নেই, নেই আলোর সম্ভাবনা। পরাবাস্তব কাব্যের মতোই বাংলার জনজীবন দুর্বোধ্য আর অমীমাংসার বিবরে নিমজ্জিত। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে তাঁর গোধুলির স্বল্পআলো জমাট অন্ধকারে পরিণত হল।

হুমায়ুন আজাদ, হতাশ ব্যর্থ শ্রান্ত অন্ধকারমুখি;
উৎফুল্ল হয় না কিছুতে-প্রেমে, পুষ্পে, সঙ্গমেও সুখী
হয় না কখনো; আপন রক্তের গন্ধে অসুস্থ, তন্দ্রায়
ধ্বংসের চলচ্চিত্র দেখে, ঘ্রাণ শুঁকে সময় কাটায়;
ওকে বাদ দেয়া হোক, নষ্ট বদমাশ হতাশাসংবাদী।’
-এ-আঁধারে উন্মাদ ও অন্ধরাই শুধু আশাবাদী।
-উন্মাদ ও অন্ধরা, জ্বলো চিতাবাঘ

কবির এই ব্যর্থতাবোধ উত্তোরোত্তর কেবল বৃদ্ধিই পেয়েছে, তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘পেরোনোর কিছু নেই’। একের পর এক পাহাড় আর সমুদ্র অতিক্রম করে করে কবি ক্লান্ত, ক্লান্ত দরিদ্র বাঙালিরাও; সব পেরিয়ে এসে, জীবনের শেষ সীমায় কবি দেখছেন পেরিয়ে যাবার আর কিছুই নেই-সম্মুখে যে অন্ধকার এর পরেও নেই কোনো সৌরকিরণ। শিশিরের শব্দে এখানে সন্ধ্যা নামে না, এখানে যে সন্ধ্যা নামে তার রূপ ভৌতিক, গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী। বির্যস্ত, ক্লান্ত, বিগতযৌবন কবি বাংলাদেশের নামও আর উচ্চারণ করতে চান না, সে নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য স্বপ্ন-স্বপ্নেরা সেখানে দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়। সেখানে পাখা ঝাপেটে পঙ্কে ডুবে যায় স্বপ্নের রাজহাঁস।

যখন আমরা বসি মুখোমুখি,-
তখন ভুলেও কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা জিজ্ঞেস কোরো না;
আমি তা মুহূর্তও সহ্য করতে পারি না, -তার অনেক কারণ রয়েছে।

তার ধানখেত এখনো সবুজ, নারীরা এখনো রমণীয়, গাভীরা এখনো দুগ্ধবতী,
কিন্তু প্রিয়তমা, বাঙলাদেশের কথা তুমি কখনো আমার কাছে জানতে চেয়ো না;
আমি তা মুহূর্তও সহ্য করতে পারি না, -তার অনেক কারণ রয়েছে।’
বাঙলাদেশের কথা, পেরোনোর কিছু নেই

হুমায়ুন আজাদ মৃত্যু চেতনায় আচ্ছন্ন নন মৃত্যুভাবনা তাঁর কবিতায় দুর্লভ কিন্তু মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন অগণিত দেশপ্রেমিক যোদ্ধা, কবি, দার্শনিক, নারী-শিশু এবং জনতার মতো। হুমায়ুন আজাদ এমন একটি দেশ আকাঙ্ক্ষা করেছেন যেখানে ফুলেরা নির্ভয়ে প্রস্ফুটিত হবে, মাছেরা নিশঙ্কচিত্তে খেলা করবে, পানকৌড়িরা বিলে-ঝিলে আহরণ করবে জীবীকা আর বকেরা সরোবরে নিবিষ্ট হবে জীবন ভাবনায়। যেখানে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণিরা নিশ্চিত জীবনের স্বাদ পায় যে স্থান সর্বদা সোনালি আলোয় উদ্ভাসিত থাকে। এরূপ একটি পৃথিবীর জন্যেই হুমায়ুন আজাদ মৃত্যুবরণ করবেন বলে আশঙ্কা করেছিলেন। তাঁর আশঙ্কা সত্য হয়েছে, ‘ছোট্ট ঘাসফুল, একটি টলোমলো শিশিরবিন্দু, এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্যেই তিনি প্রাণ দিয়েছেন।

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
ছোট্ট ঘাসফুলের জন্যে
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে
উড়ে যাওয়া একটি পাপড়ির জন্যে
একটিফোঁটা বৃষ্টির জন্যে।
-আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে, কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু

বাংলাদেশে হুমায়ুন আজাদ প্রাবন্ধিক হিসেবেই বিখ্যাত, তাঁর প্রথা বিরোধিতার কথা সবাই জানেন। অনেকে বলতে চান কবিতার ক্ষেত্রে তিনি ততোটা উল্লেখযোগ্য নন কিন্তু এক্ষেত্রে আরও ভাবার অবকাশ আছে। কবিতা রচনায় তিনি অনুসরণ করেননি কোনো প্রচলিত ধারা বরং নিজেই একটি নতুন ধারা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁর নির্মিত পথ অনুসরণ করছেন অনেকে, তিনি শুধু কবিতার রূপই বদলে দেননি সুরও বদলে দিয়েছেন। তাঁর স্পষ্টতা ও তীব্রতা অনন্য। তাঁর সময়ে দেখেছি আন্দোলনে-সংগ্রামে দেশের ছাত্র-জনতা একই সাথে তাঁর কবিতার পঙ্ক্তিগুলোকে ব্যবহার করেছে বাণী ও শ্লোগান রূপে। তখন ছাত্রদের ও সংগ্রামী মানুষের মুখে মুখে ছিল-সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে, রাজনীতিবিদগণ প্রভৃতি কবিতা। তাঁর কবিতার অনেক পঙ্ক্তি প্রবাদে পরিণত হয়েছে। তাই মনে করার কারণ আছে, হুমায়ুন আজাদ বেঁচে থাকবেন আরও অনেকদিন। তিনি ছিলেন প্রথাবিরোধী। তাঁকে বুঝতে পঞ্চাশ বছর সময় লাগবে, এটি তিনিই বলেছেন। বাঙালিরা এখনো তাদের পরিচয়ের মূল সূত্রটি খুঁজে পায়নি তাই তারা ঘুরেফিরে মরছে মধ্যযুগীয় অন্ধকারে। বাংলাদেশে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ জন্মেছেন যারা বাঙালিদের নিয়ে যেতে চায় মধ্যযুগীয় অন্ধকারে। কোট-টাই-এর ভেতরে তারা ঢেকে রাখেন আদিম-অসংস্কৃত-অনাধুনিক এক মানুষকে। হুমায়ুন আজাদ আঘাত করেছেন এই দুর্বৃত্তদেরই, এদের কারণে বাঙালিরা হয়তো আরও অনেক বছর পরে আত্মসত্তাকে খুঁজে পাবে; তখন আবার হুমায়ুন আজাদ হয়ে উঠবেন প্রাসঙ্গিক। বাঙালি সমাজের জন্য এখন খুবই দরকার এনলাইটেনমেন্ট বা রেনেসাঁ-এই রেনেসাঁ বাঙালিকে সম্পূর্ণরূপে আধুনিক করে তুলবে। দূর হবে পুরনো অপসংস্কার-কুসংস্কার, সেই সময় হুমায়ুন আজাদ অবশ্যই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন।

তথ্যসূত্র:
১. মামুনুর রহমান, বাংলা কবিতা
২. আমার নতুন জন্ম, হুমায়ুন আজাদ, পৃ. ৬৪
৩. বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস, শহীদ ইকবাল, পৃ.২০২-২০৩
৪. নিজকথায় লোককথায় হুমায়ুন আজাদ, অনুপ সাদি, পৃ. ১০৬
৫. কবিতা ভাষা মাতৃভাষা, রণেশ দাশগুপ্ত

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *