জাদুবাস্তববাদের উৎস

এই অনুবাদটি Maggie Ann Bowers- ‘MAGIC(AL) REALISM’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়

জাদুবাস্তববাদকে ইংরেজিতে তিনটি নামে ডাকা হয়— magic realism, magical realism ও mavellous realism। এর ইতিহাস বেশ জটিলই বলতে হবে। আট যুগেরও অধিক ইতিহাস এবং তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। প্রতিটিরই রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। প্রথম পর্যায়ের সূচনা ১৯২০-এর দশকে জার্মানিতে। দ্বিতীয় পর্যায়ে মধ্য আফ্রিকায় ১৯৪০-এর দশকে। এবং তৃতীয় পর্যায়ে ১৯৫৫ সালের দিকে লাতিন আমেরিকায় শুরু হয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী এর ব্যাপ্তি। প্রতিটি পর্যায়ের বা ধাপের সূতিকাগার আসলে ওই সময়ের শিল্পী ও সাহিত্যিক, যাঁদের সাহিত্যকর্মই আসলে জাদুবাস্তববাদকে ছড়িয়েছে ইউরোপ ও তার আশপাশে, ইউরোপ থেকে লাতিন আমেরিকায় এবং লাতিন আমেরিকা থেকে সারা বিশ্বে। ‘জাদুবাস্তববাদকে দাঁড় করানোর পেছনে যাঁরা হর্তাকর্তা আছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথমেই আসে জার্মানির ফ্রাঞ্জ রুহর (Franz Roh) কথা, যিনি ১৯২০-এর দশকে তাঁর বিভিন্ন কাজের জন্য বিশেষ পরিচিত, ১৯২০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের কিউবান লেখক আলেজো কার্পেন্তিয়ার (Alejo Carpentier), ১৯২০-১৯৩০-এর মাঝামাঝি সময়কার ইতালীয় লেখক মাছিমো বন্টেমপেল্লি, বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের লাতিন আমেরিকান সাহিত্য সমালোচক এনজেল ফ্লোরেস এবং ওই সময়ের শেষের দিকের লাতিন আমেরিকান ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস।

উত্তর-অভিব্যক্তিবাদকে জাদুবাস্তববাদের অন্যতম শাখা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ ধারার অনেকেই জাদুবাস্তববাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাঁরা ছিলেন মূলত ১৯২০-এর দশকের জার্মান পেইন্টার। আরও আছেন বিশ শতকের প্রথম দিকের আধুনিকতাবাদী ও উত্তর-আধুনিকতাবাদী ইউরোপীয় এবং বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের লাতিন আমেরিকান ও ইংরেজি বলা বিশ্বের লেখকেরা। যদিও এটি এখন লাতিন আমেরিকার বলেই বেশি পরিচিত, তার অনেক প্রভাবই ইউরোপীয় সাহিত্যে দৃশ্যমান, বিশেষ করে বিশ শতকের শুরুর দিকের আধুনিকতাবাদী ধারায়। জাদুবাস্তববাদী পেইন্টিং ও আধুনিকতাবাদ—দুটি বাদই আসলে বাস্তবকে আরও গভীরভাবে তুলে আনার জন্য একটি নতুন পদ্ধতির অনুসন্ধান করে। চিত্রশিল্পীরা নিরীক্ষা করেন পেইন্টিংয়ে এবং লেখকেরা করেন রচনাশৈলীতে। এটি আগের ধারাগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে যেমন ধরুন, আগের স্টাইলে ফটোগ্রাফি ও রেনেসাঁ-শিল্পের একটা মিশেল প্রভাব ছিল। এটা করা হতো মূলত ছবির স্পষ্টতা ও মসৃণতার জন্য। জাদুবাস্তববাদী লেখা, বিশেষভাবে জড়িয়ে গেছে আধুনিকতাবাদী কৌশল ক্রমানুগ সময়ের ভাঙন ও ইতিহাসের ভাবনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

জাদুবাস্তববাদ একটি ‘বিবদমান’ টার্ম, কারণ বেশির ভাগ সমালোচকই যা করেন, তা হচ্ছে জাদুবাস্তববাদের ইতিহাসের যেকোনো একটি ব্যাখ্যার ওপর দাঁড়িয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। সামগ্রিক বিষয়টি বিবেচনায় আনেন না। এ কারণেই সমালোচক রবার্তো গঞ্জালেজ ইসেভারিয়া মনে করেন, এর ‘প্রকৃত ইতিহাস’ উদ্ঘাটন করা খুব কঠিন (১৯৭৭ : ১১২)। আমেরিকান সমালোচক সেমার মেনটন, গুটি কয়েক সমালোচকের মধ্যে অন্যতম, যিনি এই তত্ত্বের ইতিহাস উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন। ‘জাদুবাস্তববাদের আসল ইতিহাস’ বইয়ের নির্ঘণ্টের সময়ানুক্রমিক ইতিহাস দেওয়া আছে। এই বইয়ের উপশিরোনামটি শিরোনামের জন্য একটি আইরনী বটে। মেনটন তাঁর নির্ঘণ্ট সাজিয়েছেন সেসব সাল দিয়ে, যে সালগুলোকে জাদুবাস্তববাদের প্রকৃত উৎস সাল হিসেবে তিনি দাবি করেন। সালগুলো হচ্ছে ১৯২৫, ১৯২৪, ২৯২৩, ১৯২২? (১৯৯৮-২০০৯)।

অধিকাংশ সমসাময়িক সমালোচক, যেমন আমারিল চ্যানেভি, সেমার মেনটন, লুই পারকিনসন জালোরা এবং ওয়েল্ডি ফরিস একমত যে জার্মান চিত্রসমালোচক ফ্রাঞ্জ রুহই (১৮৯০-১৯৬৫) ওয়েমার বিপারলিকের সময়কালীন উত্তর অভিব্যক্তিবাদী পেইন্টিংয়ের নতুন একটি ফর্মকে নামকরণ করতেই প্রথম জাদুবাস্তববাদ টার্মটি ব্যবহার করেন। ১৯২৫ সালে লেখা তাঁর বই Nach-Expressionismus, Magisher Realismus : Probleme der neusten europaischen Malerei (Post- expressionism, Magic Realism: Problems of the Most Recent European Painting) -এ এই টার্মটি আত্তীকরণ করেন এবং সেই টার্মটি ইংরেজিতে অনূদিত হয় ‘Magic Realism’ বা জাদুবাস্তববাদ নামে। টার্মটি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে এক নতুন ধরনের পেইন্টিংয়ের নামকরণে, যা অভিব্যক্তিবাদী আর্ট থেকে বৈশিষ্ট্যের দিকে থেকে অনেক আলাদা। নতুন এই ধরনের শিল্পকর্মের বৈশিষ্ট্য ছিল নিখুঁত বর্ণনার, গভীর মনোযোগ, ছবিতে ফটোগ্রাফির মতো মসৃণ স্বচ্ছতা এবং বাস্তবের মরমি দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থাপনা। রুহ এই ধারার প্রায় ১৫ জনের নাম উল্লেখ করেছেন, যাঁরা একসময় জার্মানিতে খুব সক্রিয় ছিলেন। তাঁদের মধ্যে আছেন আট্টো ডিক্স, ম্যাক্স আর্নেস্ট, আলেকজান্ডার কানল্ডট, জর্জ গ্রসজ ও জর্জ শ্রিম্প। তাঁদের প্রত্যেকের পেইন্টিংই একে অন্যের থেকে অনেক আলাদা। কিছু জাদুবাস্তববাদী পেইন্টিং যেমন ধরুন অট্টো ডিক্স এবং জর্জ গ্রসজের পেইন্টিংগুলো একেবারেই অদ্ভুত রকমের অতিরঞ্জিত। মনে হয় তাঁদের পেইন্টিং ও বিষয়বস্তুগুলো বাহ্যিক গঠনের সঙ্গে আসামঞ্জস্যপূর্ণ। জর্জ গ্রসজের পেইন্টিং ‘গ্রে ডে’ (১৯২১)-তে দেখা যায়, অসম্ভব রকমের গোলাকার মাথাবিশিষ্ট ল্যান্ডসকেপ, যে পাশে একজন কুজো সৈন্য, যার রয়েছে দীর্ঘ মাথা ও হাত, তার বিপরীতে একটি সুন্দর ল্যান্ডসকেপ। দুজন পেইন্টারই গতানুগতিক এবং বাস্তবিক ধারার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেছেন। The Match Seller 1-এ পথিকদের দেখে মনে হচ্ছে তারা বুঝি পড়ে যাচ্ছে। এমন দেখাচ্ছে পা-এর অ্যাঙ্গেলের কারণে। অন্যদিকে, ‘গ্রে ডে’-তে সে সৈনিককে মনে হচ্ছে যেন বাতাসের মধ্যে হাঁটছে। এমন দেখাচ্ছে শুধু পেছনের দেয়াল এবং দালানের কনটেক্সট বা পরিপ্রেক্ষিতের ঘাটতির জন্য। অন্যান্য জাদুবাস্তববাদী পেইন্টিংস যেমন আলেকজান্ডার কানল্ডটের শান্ত ও স্থির জীবন চিত্রগুলো খুব অল্পই জাদুকরি। তারা গতানুগতিক স্থির জীবনচিত্রকে বিষয় হিসেবে তুলে আনেন। যেমন : Still Life II (1926)  স্থির চিত্র ২ (১৯২৬)-তে দেখা যাচ্ছে, টেবিলের কোণে একটি বোতলের পাশে একটি ছোট পাত্রে পামগাছ রাখা আছে। ছবিতে প্রতিটি কনটেন্ট বা উপাদানকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ছবির পেছনের কালো কাপড়ের ওপর পর্দা দেওয়া হয়েছে। তাতে যেমন দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে, ঠিক ততটুকু গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে পামগাছটার দিকেও। প্রতিটি উপাদানকে সমান শেড দিয়ে আঁকা হয়েছে। বিষয়বস্তুর স্পষ্টতা এবং বিশেষ কোনো একটি দিকের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব না দেওয়া এই ছবিটি ‘জাদুকরি’ হিসেবে আখ্যা দেয়। তার পরও রুহর কাছে এই ‘জাদুকরি’ বিষয়টি কোনো ধর্মীয় বা ডাইনিদের জাদুবিদ্যারও কোনো বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এটি তার কাছে Magic of being, যা আসলে বিশ্বের যৌক্তিক গঠনকেই প্রথিত করে (গোয়েন্থার ১৯৯৫ : ৩৫)। শিল্প ঐতিহাসিক আইরিন গুয়েন্থার সংক্ষেপে বিবরণ দেন, পাশাপাশি দুটো বিপরীতধর্মী জিনিস ‘জাদু’ ও ‘বাস্তববাদ’ আসলে মানুষের ভেতরের বিকট ও বিশ্বয়কর রহস্যক্ষমতাকে তুলে ধরে। এবং এ বিষয়টি চারপাশের আধুনিক প্রযুক্তির বিষয়াদি থেকে উৎসারিত (১৯৯৫ : ৩৬)। এই ধরনের জাদুকরি বিষয় অনেকাংশেই সিগমান্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণবিদ্যার দ্বারা প্রভাবিত। আরও প্রভাব আছে ইতালিয়ান ‘arte merafisica’ আন্দোলনের জিওরজিও ডি শিরিকোর পেইন্টিং। তিনি ছবিতে ‘বস্তুকে’ বিভিন্ন অচেনা দিক (angle) থেকে দেখার বিষয়টি অনেক জার্মান জাদুবাস্তববাদীদের সঙ্গে শেয়ার করেছিলেন (ibid : ৩৮)। আরও অনেক সমালোচকের অনেক দাবি আছে যেমন জ্যাঁ পিঁয়েরে ডিওরিক্স দাবি করেন যে জি এফ হার্টলব ১৯২৩ সালে ম্যাক্স বেকম্যানের পেইন্টিংয়ের একটি প্রদর্শনী আয়োজন করেন এবং তিনি জাদুবাস্তববাদ শব্দটি ব্যবহার করেন (১৯৯৮ : ১০৩)। যা-ই হোক, যেহেতু পরবর্তী সময়ে তিনি আর এই একই শিল্পীর ক্ষেত্রে আর এই টার্মটি ব্যবহার করেননি এবং ব্যবহার করেন নতুন টার্ম ‘নিউ অবজেকটিভিটি’। রুহ এই টার্মটির সবচেয়ে বেশি প্রচলন করেন, তাই জাদুবাস্তববাদ টার্মটি রুহর নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে। রুহ পরবর্তী সময়ে এই টার্মটি পরিত্যাগ করলে হার্টলবের ‘নিউ অবজেকটিভিটি’ টার্মটিই বাজারে বেশি প্রচলিত হয়ে যায় (ক্রকেট ১৯৯৯ : ৩)। সবদিক বিবেচনায় এনে, এই টার্মটির আসল উৎসের কথা পাশে রেখে বলা যায় যে এর উদ্ভব ১৯২০-এর দশকে জার্মানিতে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল একদল জার্মান পেইন্টার। তাদের ছিল একই রকম উদ্দেশ্য, যেখান থেকে একই ধরনের চিন্তার বিকাশ ঘটে।

যে ঐতিহাসিক পটভূমিতে জাদুবাস্তববাদী পেইন্টিংয়ের উদ্ভব ঘটে, সেই সময় ছিল খুবই উত্তাল, ওইমার রিপাবলিকের ১৯২৯-২৩ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের পরাজয়ের পরবর্তী সময় এবং ১৯১৮ সালে কায়জারের নির্বাসন। কায়জারের অপসারণের ফলে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়, রাজনৈতিক অস্থিরতারও সৃষ্টি হয়। বামপন্থী ও ডানপন্থীদের মধ্যে শুরু হয় যুদ্ধ, এমনকি ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত অ্যাডলফ হিটলারের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক পার্টিও বিদ্বেষে জড়ায়। চারদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা (পুনর্গঠনবিষয়ক মন্ত্রীকে হত্যা করা হয় ১৯২০ সালে)। তখন যুদ্ধের কারণে জার্মানির অর্থনৈতিক অবস্থাও ভেঙে পড়ে। যুদ্ধে জয়ীদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণেরও চাপ বাড়াতে থাকে (ডেভিস ১৯৯৬ : ৯৪১-২)। খুব দুর্বল জোট রাজনীতির কারণে উচ্চমাত্রার মূল্যস্ফীতি, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও বৈপ্লবিক কার্যক্রমের ফলে একধরনের জাতীয় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার তৈরি হয় (মিখালস্কি ১৯৯৪ : ৭)। গণতান্ত্রিকভাবে ইউরোপ থেকে সরে যাওয়া, পুরোনো সাম্রাজ্যের পতন ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে আটকা পড়া, বাস্তববাদী হওয়ার বাসনা—এসব কিছু তখন জাতীয় ভাবনার কেন্দ্রে চলে আসে (ibid : ১৩)। শিল্প ঐতিহাসিক মিখালস্কি তার নিবিড় পাঠের মাধ্যমে ‘ওইমার রিপাবলিক’-এর সময়কার শিল্পের সংক্ষেপসারে ওই সময়ের ‘ভাব’ এবং জাদুবাস্তববাদী পেইন্টিংয়ের প্রভাব দেখান। তিনি বলেন, ‘প্রকৃত অর্থে এটা ছিল জার্মান সমাজের পূর্ণ প্রতিফলন, নিঃশর্ত আধুনিকতার প্রতি আকাঙ্ক্ষা ও যুগগত ভীতি—এই দুইয়ের মধ্যে টানাপোড়েন। সংযত ও নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতার এবং বাকি অভিব্যক্তিবাদী ও যৌক্তিক অযৌক্তিকতাবাদী এর মধ্যকার দ্বন্দ্ব উঠে আসে (ibid : ১৩)। রুহর জাদুবাস্তববাদের বিশ্লেষণধর্মী ও তত্ত্বীয় কাজের যে প্রতিজ্ঞা বা সূচনা, যার ওপর ভর করে ওইমার রিপাবলিকের সময়কার আলোচিত শিল্প আন্দোলনকে তিনি সংজ্ঞায়িত করতে চেয়েছিলেন। তা ছিল নিছকই অভিব্যক্তিবাদ থেকে ভিন্ন একটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করার প্রয়োজনীয়তা উদ্ভূত আন্দোলন। যেমন ভ্যান গঘের ও পরাবাস্তববাদী সলভাদর ঢালীর পেইন্টিং। বাস্তবিকই ১৯২৫ সালে তাঁর লেখা বইয়ে বাইশটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেন, যা অভিব্যক্তিবাদ থেকে জাদুবাস্তববাদকে আলাদ করে। এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আছে রঙের ক্ষেত্রে অভিব্যক্তিবাদের একটু উত্তাপ। জাদুবাস্তববাদী পেইন্টিং হচ্ছে খুবই মসৃণ, সযত্নে তৈরি ও চমৎকার ফটোগ্রাফিক গুণাগুণসমৃদ্ধ। রুহ মনে করেছিলেন যে জাদুবাস্তববাদ, উপাদানগত জিনিস এবং যেসব জিনিসের পৃথিবীতে অস্তিত্ব আছে তার ওপর ফোকাস করে থাকে, যেখানে জাদুবাস্তববাদীরা মস্তিষ্কজাত এবং মানসিক বাস্তবতাকেই খুঁজে ফেরে।

রুহর কাছে জাদুবাস্তববাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল বাস্তবিকভাবে পেইন্টিংয়ে দৃশ্যমান বস্তুর রহস্যময়তাকে ধরা : ‘বস্তু ও বিষয়কে অবশ্যই নতুন করে তৈরি করা (১৯৯৫ : ১১৩)। এতে রুহ চেয়েছিলেন যে শিল্পীরা সিগমান্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণবিদ্যা ও কাল জাংয়ের পরাবাস্তববাদের দ্বারা প্রভাবিত হোক এবং এ দুটোর সংমিশ্রণে এমন পদক্ষেপ নিক যে বিষয়বস্তু স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। শিল্পীরা জাংয়ের দ্বারা খুব প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাদের ‘সাবকনশাস’ ও আনকনশাসের ব্যাখ্যা চিন্তায় ও কাজে বিশেষ করে ‘মানুষের’ স্বপ্নে ব্যাপক প্রভাব ফেলে, যা পরাবাস্তববাদী শিল্পীদের শিল্পের অপ্রাচুর্য বুঝতে সাহায্য করে। এবং এই বোধ তাদের লুকায়িত জীবনকে না ধরে বাহ্যিক ও বস্তুগত বিশ্বকে তুলে ধরতে উদ্বুদ্ধ করে। ফ্রয়েডের স্বপ্নের ব্যাখ্যা এমন সময় আসে, যখন ওই শতাব্দী একটি নতুন মোড় নিচ্ছে। এর প্রভাব পড়ে পরাবাস্তববাদীদের ওপর। ওয়ালেস ফাইল তাঁর পাঠ থেকে ব্যাখ্যা করেন যে ফ্রয়েড ও জাংয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পরাবাস্তববাদীরা মনে করবেন যে ‘মানুষের চেতন অবস্থা’ তাকে, ‘সে নিজেকে’ (myself) এবং অন্যদের ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট নয় (১৯৬০ : ১৬)। রুহর কাছে ব্যাপারটা এমন যে জাদুবাস্তববাদীদের, মানুষের ভেতরের জীবনকে বস্তুগত জীবনের মাধ্যমেই শিল্পে তুলে ধরার বিষয়টি প্রয়োজন হয়ে পড়ে। রুহ মনে করতেন, মানুষের জীবনের রহস্য, অন্তর্গত জীবনের জটিলতা অবজেক্টের গভীর পর্যবেক্ষণ দ্বারাই উপলব্ধি করা যায়। তিনি শিল্পীদের আহ্বান জানান তাঁর এই নতুন আবিষ্কারের ওপর কাজ করার জন্য। নতুন শিল্পীরা সত্য ও বাহ্যিক দুনিয়ার অন্তর্গত চরিত্রকে, আমাদের চোখের সামনে অভিনব কৌশলে দেখানোর জন্যও তিনি আহ্বান জানিয়েছেন (রুহ ১৯৯৫ : ২৪)।

জাদুবাস্তববাদ পরাবাস্তববাদের সমসাময়িক হওয়ার কারণেই যত জটিলতার সৃষ্টি। পরাবাস্তববাদের ইশতেহার লেখা হয় ১৯২৫ ও ১৯৩০ সালে এবং কেউ কেউ মনে করেন পরাবাস্তববাদ জাদুবাস্তববাদেরই একটি শাখা। এই দুটি শিল্প আন্দোলনেরই অনেক মিল রয়েছে এবং জেনে রাখা ভালো, পরবর্তী সময়ে অনেক জাদুবাস্তববাদী লেখক, বিশেষ করে আলেজো কার্পেন্তিয়ার রুহর লেখনী এবং পরাবাস্তববাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরাবাস্তববাদীদের কথা না বললেই নয় যে তারা মানুষের মনের অন্তর্গত বিষয়কে শিল্পে আনতে চেয়েছিল। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে নতুন ধরনের শিল্পের প্রতি তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল এবং তারা স্ববিরোধ (contradiction) এবং আপাতবৈপরীত্য (Paradox)-এর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করার চেষ্টা করেছিলেন। যা-ই হোক, পরাবাস্তববাদের তাত্ত্বিকেরা এবং রুহর জাদুবাস্তববাদ—এই দুটি শিল্পান্দোলনই শৈল্পিক পার্থক্যের ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং তাদের আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেন।

প্রাথমিক পর্যায়ের এই জাদুবাস্তববাদী পেইন্টিং শুধু জার্মানিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল অন্যত্রও। একই রকম অনেক পেইন্টিং দেখা যায় ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও ইতালিতে। ১৯৩১ সালে নিউইয়র্কে জার্মান জাদুবাস্তববাদী শিল্পীদের একটি প্রদর্শনী হয়। এর প্রভাবে আমেরিকান বাস্তববাদী ও জাদুবাস্তববাদী (১৯৪৩) নামে আরেকটি প্রদর্শনী হয় এডওয়ার্ড হপার (১৮৮২-১৯৬৭)-এর সম্মানে। তিনি মূলত বিখ্যাত তাঁর মসৃণ, ফটোগ্রাফিক আঙ্গিক এবং শান্তস্নিগ্ধ, নগরদৃশ্যসমৃদ্ধ ছবি আঁকার জন্য। এসব বৈশিষ্ট্যও জাদুবাস্তববাদের বৈশিষ্ট্য (মেনটন ১৯৯৮ : ২১৯-২২০)।

রুহর দেওয়া টার্ম ‘জাদুবাস্তববাদ’-এর তত্ত্বীয় প্রয়োগের প্রভাব জাদুবাস্তববাদী পেইন্টিংয়ের চেয়েও বেশি ছিল। দুটো নতুন পরিণতিরও সূচনা হয়। প্রথমত, ইতালীয় লেখক ন্যাছিমো বন্টেমপেল্লি, যিনি প্রথমে পরাবাস্তববাদ দ্বারা এবং পরে জার্মান জাদুবাস্তববাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একটি দ্বিভাষিক ম্যাগাজিন ‘৭০০’ প্রতিষ্ঠা করেন। সময়টা ছিল মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট শাসনের সময়, ১৯২৬ সালে। আরেকটি জার্নাল প্রতিষ্ঠা করেন ১৯২৬ সালে ‘নাভয়েনতো’ (Noveunto) নামে। এটি ফরাসি ও ইতালীয়—এই দুই ভাষাতেই সমালোচনা প্রকাশ করত (মনটন ১৯৯৮ : ২১২)। জাদুবাস্তববাদ সম্পর্কে তাঁর বেশির ভাগ ধারণাই কাকতালীয়ভাবে রুহর সঙ্গে মিলে যায়। রবার্ট ড্রম্বস্কি ‘দ্য কেমব্রিজ হিস্ট্রি অব ইটালিয়ান লিটারেচার’ বইয়ে লেখেন যে বন্টেমপেল্লি চেয়েছিলেন বাস্তবের রহস্যময় ও চমৎকার দিকগুলো শিল্পে তুলে ধরতে (১৯৯৬ : ৫২২)। রুহ থেকে তাঁর পার্থক্য এই ছিল যে তিনি তাঁর ভাবনার প্রতিফলন শুধু লেখালেখিতেই দেখান, শিল্পে নয়। বন্টেমপেল্লি ইতালীয় ফ্যাসিবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। চেয়েছিলেন জাদুবাস্তববাদী লেখা ইতালির জাতিকে উৎসাহিত করুক ও ইতালীয় সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক প্রসার হোক। রবার্ট ড্রম্বস্কি মনে করতেন যে সাহিত্য হচ্ছে ‘বাস্তবের ওপর নতুন মিথিক্যাল এবং জাদুময় বিষয় আনয়নের দ্বারা’ একটি সামগ্রিক চেতনার সৃষ্টি করা। তাঁর লেখনী বেশির ভাগই ছিল কল্পনাপ্রসূত, জাদুবাস্তববাদী, পরাবাস্তবের খুব কাছাকাছি। কিন্তু অনেক সময়ই তাকে জাদুবাস্তববাদী লেখক হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়েছে। যেহেতু তাঁর ম্যাগাজিন দুই ভাষায় প্রচারিত হতো, তাই তাঁর প্রচারণা ছিল ইউরোপজুড়েই। উদাহরণস্বরূপ, তারা ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে ফ্লেমিশ লেখক জোহান ডাইসন ও রবার্ট ল্যাম্মু (ল্যাম্পু ১৯৯৩ : ৩৩) প্রভাবিত হয়েছিলেন।

জাদুবাস্তববাদের দ্বিতীয় প্রভাবটাই আসলে সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ এবং সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত। আর সেটি লাতিন আমেরিকায় রুহর কাজের প্রভাব। ১৯২৮ সালে ফ্রান্সে রুহর বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ যে অধ্যায়গুলো রয়েছে, যেগুলো জাদুবাস্তববাদ-সংশ্লিষ্ট যেমন Nach Expreasionismus, Magischer Realismus স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করেন ফার্নান্দো ভেলে এবং মাদ্রিদে Revista de Occidente প্রকাশ করে Realismo magico. Post expreassionisomo: Problemus de la pintura europea mas reciente নামে। Revista de Occidente-এর প্রকাশনের অনেক লাতিন আমেরিকান লেখকের মাঝে ছড়িয়ে যায়। তাঁদের মধ্যে আছেন মিগোয়েল অ্যাঞ্জেল এস্টোরিয়াস এবং হোসে লুই বোর্হেস। আর এটাও মনে করা হয় যে এই দুজন এই প্রকাশনা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং প্রভাবিত করেছিলেনও। যেহেতু তাঁরাই মোটামুটি ইউরোপীয় বই অনুবাদ করে লাতিন আমেরিকান পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতেন। (মেনটন ১৯৯৮ : ২১৪)।

রুহর প্রভাবের পাশাপাশি, উত্তর অভিব্যক্তিবাদ ও পরাবাস্তববাদ, ইউরোপ থেকে লাতিন আমেরিকার মধ্য থেকে জাদুবাস্তববাদের ওপর আরেকটি রেখা অঙ্কন করা যেতে পারে। দুজন লেখক-কূটনীতিক এবং একজন ফরাসি-রাশিয়ান-কিউথান আলেজও কার্পেন্টিয়ার (১৯০৪-৪০), অন্যজন ভেনিজুয়েলিয়ান আর্তোওর উমলার পিয়েট্রি (১৯০৬-২০০১)। তাঁরা দুজনই ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে প্যারিসে থাকার সময় ইউরোপীয় শিল্পকলার বিভিন্ন আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কার্পেন্টিয়ার ইউরোপীয় শিল্পকলা ও সাহিত্যে মগ্ন হন ১৯২০-এর দশকে এবং পরবর্তী সময়ে লাতিন আমেরিকান জাদুবাস্তববাদের একজন পুরোধা বলে গণ্য হন। ইউরোপ থেকে হাইতি হয়ে কিউবা দিয়ে এক নতুন ধরনের লতিন আমেরিকান জাদুবাস্তববাদের কথা নিয়ে প্ররোচিত হন তিনি। ইউরোপীয় পরাবাস্তববাদের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে তিনি অবস্তুগত জীবনের বিভিন্ন দিক প্রকাশের প্রয়োজনীতা অনুভব করেছিলেন। তিনি ইউরোপীয় ও লাতিন আমেরিকার পটভূমির পার্থক্য অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তিনি মারভেলাস রিয়ালিজম টার্মটি ব্যবহার করেছিলেন একটি ধারণাকে বর্ণনা করতে, যা লাতিন আমেরিকার সাংস্কৃতিক পদ্ধতির ভিন্ন আরেক মিশ্রণ এবং বিচিত্র ধরনের অভিজ্ঞতা, যা সৃষ্টি করে অসাধারণ পরিবেশ, বিকল্প আচরণ এবং বাস্তবের ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধি।

লাতিন আমেরিকায় অনন্য ও ‘অস্বাভাবিক বাস্তবতার’ ধারণা কোনো নতুন বিষয় ছিল না। ষষ্ঠদশ শতকে স্পেনীয় শাসক হার্নান্দো কর্তেস মেক্সিকো দখল করেন, আমেরিকাকে ইউরোপীয় কোনো ভাষায় সঠিকভাবে বর্ণনা করতে ব্যর্থ বলে জানিয়েছিলেন। যা-ই হোক, কার্পেন্তিয়ার লাতিন আমেরিকায় জাতভেদে, সংস্কৃতিতে ও জীবনযাপনে অনন্য বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পেয়েছিলেন। ভেনিজুয়েলিয়ান পত্রিকা ‘EL Nacional’-এর জন্য এক লেখায় তিনি এসব ধারণার কথা বলেছিলেন। এবং আরও প্রচারিত হয় ১৯৪৯ সালে লেখা উপন্যাস ‘ÔEl reino de este mundo’ (The Kingdom of This World)-এর প্রস্তাবনায়। দুটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে অতিকৃত্রিম এবং বিরক্তিকর কম ভান বলে নিজেকে এবং নিজের লেখাকে তিনি রুহর জাদুবাস্তববাদ থেকে আলাদা করেন (কার্পেন্তিয়ার ১৯৯৫ : ৮৪)। তিনি প্রস্তাব করেন Marvelous Realism বা ‘আশ্চর্য বাস্তবতাই’ হচ্ছে আমেরিকার প্রকৃত ঐতিহ্য (ibid : ৮৭)। তাঁর প্রস্তাবনায় ইংরেজিতে অনূদিত Magical Realisms : Theory, History, comminity (১৯৯৫)-এর নামে পুনরায় লেখা বইয়ে; লুই পারকিনসন জামোরা এবং ওয়েন্ডি দারিস ব্যাখা করেন যে কার্পেন্তিয়ারের টার্মটিতে, পরাবাস্তববাদের বিপরীতে ‘অসম্ভাব্য জিনিসের পাশাপাশি বিপরীতধর্মী বিষয়ের অবস্থান এবং আশ্চর্য সংমিশ্রণ, লাতিন আমেরিকার ইতিহাস, ভূগোল, জনসংখ্যা এবং রাজনীতির গুণগত কারণেই অবস্থান করে, ইশতেহারের কারণে নয় (৭৫)।

১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে আর্তারো উসলার পিয়োট্রর ছোট গল্পের দ্বারা অনেক ভেনেজুয়েলান লেখক উদ্বুদ্ধ হন। তিনি রুহর উত্তর-অভিব্যক্তিবাদী জাদুবাস্তববাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিলেন এভং বন্টেমপেল্লির সঙ্গে প্যারিসে পরিচিত হয়েছিলেন (গোয়েন্তার ১৯৯৫ : ৬১)। তাঁর লেখালেখি কার্পেন্তিয়ারের নতুন উদ্ভাবন ‘আশ্চর্য আমেরিকান বাস্তবতা’র অনুসরণ না করেও, জীবন-বাস্তবতার মাঝে মানুষের রহস্যময় বেঁচে থাকার দিকে গুরুত্বারোপ করে। তিনি জাদুবাস্তববাদকে আধুনিক লাতিন আমেরিকান পরীক্ষামূলক নতুন লেখালেখি ‘Varguardia’-এর ধারাবাহিকতা বলেই মনে করেন। অনেক সমালোচকই যেমন মারিয়া এলেনা মনে করেন, উসলার পিয়েটিই জাদুবাস্তববাদকে লাতিন আমেরিকায় নিয়ে আসেন। এমনটা ভাবার কারণ হচ্ছে তিনি আধুনিকতাবাদ ও রুহর আসল ধারণার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। শেষ বিচারে, উসলার পিয়েট্রিকে নয় বরং কার্পেন্তিয়ারকে স্বীকৃতিটা দেওয়া হয়, যিনি আমেরিকায় প্রথম জাদুবাস্তববাদ নিয়ে এসেছিলেন। পিয়েট্রির কাজগুলো স্প্যানিশ কথা বলা লাতিন আমেরিকার বাইরে খুব কমই পরিচিত। এটা মনে করা হয় যে পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত লাতিন আমেরিকান জাদুবাস্তববাদী লেখক গার্সিয়া মার্কেস জাদুবাস্তববাদ বিষয়ে পিয়েট্রির কাজকেই অনুসরণ করেছিলেন।

কাকতালীয়ভাবে কার্পেন্তিয়ার ও উসলার, পিয়েট্রির লাতিন আমেরিকায় প্রত্যাবর্তনের পরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষান্তে প্রচুর ইউরোপীয় বিশেষ করে স্পেনীয়রা, স্পেনীয় রিপাবলিকের পতনের ফলে লাতিন আমেরিকায় পাড়ি জমায়। ১৯৪০-এর দশকে অনেক লাতিন আমেরিকান দেশ সব দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে থাকে। ফলে তারাও ইউরোপীয়দের থেকে ভিন্ন এক নিজস্ব চেতনার দিকে ধাবিত হতে থাকে (ইশেভারিয়া ১৯৭৭ : ৯৯)। কিউবায় কার্পেন্তিয়ার এমনই সব আন্দোলনের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তাঁকে কিউবান সংগীতের ইতিহাস রচনা করার জন্য সরকারিভাবে নিয়োগ দেওয়া হয় (ibid : ১০১১)। যেমনটা ইশেভারিয়া লিখছেন, ‘চল্লিশের দশকে কার্পেন্তিয়ারের শৈল্পিক উদ্যোগ আসলে ছিল মূলের খোঁজ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার, সাধারণ আমেরিকান চেতনার ভিত তৈরি, যা আসলে নতুন পৃথিবীর সাহিত্যের ভিত হিসেবে কাজ করবে (ibid : ১০৭১)। যেখানে ‘ম্যাজিক রিয়্যালিজম’ ও ‘মার্ভেলাস রিয়্যালিজম’—দুটোই ম্যাজিক(ক্যাল) রিয়্যালিজমের দুটি স্বতন্ত্র ধারা, সেখানে ১৯৯৫ সালে অ্যাঞ্জেল ফ্লোরেসের নিবন্ধ ‘স্প্যানিশ আমেরিকান উপন্যাস জাদুবাস্তববাদ’-এ নতুন টার্ম ‘ম্যাজিক্যাল রিয়্যালিজম’-এর আবির্ভাব। এই টার্মটি ম্যাজিক(ক্যাল) রিয়্যালিজমের দুটো ধারা ম্যাজিক রিয়্যালিজম ও মার্ভেলাস রিয়্যালিজমকে ধারণ করে। হুসে লুই বোর্হেসর কথা বলতে গিয়ে ফ্লোরেস বলছেন যে বোর্হেসের জাদুবাস্তববাদে ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদ বিশেষ করে স্পেনীয় প্রভাব লক্ষণীয়। যদিও বিতর্কিত তবু বলি, তিনি মনে করেন না যে উসলার পিয়েট্রি বা কার্পেন্তিয়ার এদের কেউই রুহর জাদুবাস্তববাদকে আমেরিকায় নিয়ে আসেন। বরং তিনি আরও যুক্তি দেখিয়েছেন যে জাদুবাস্তববাদ স্পেনীয় ভাষায় সাহিত্য এবং তার বিপরীতে ইউরোপীয় সাহিত্যের রোমান্টিক রিয়্যালিস্ট ধায়ারই ধারাবাহিকতা। এ জন্য ফ্লোরেস লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের ওপর বিভিন্ন প্রভাব নিয়ে একটি নতুন ইতিহাসের জন্ম দেন। সে জন্য তিনি ষষ্ঠদশ শতকের স্পেনীয় লেখক মিগুয়েল ডি সাভেন্দ্রা সারভেনতেস, চেক-অস্ট্রিয়ান লেখক ফ্রাঞ্জ কাফকা ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদী পেইন্টার জিওর্জিওর প্রসঙ্গ টেনেছেন। সার্বেন্তেসের উপন্যাস ডন কুইকজটকে শিরিকোর অগ্রদূত ভাবা হয় (১৯৯৫ : ১১২)। যদিও জাদুবাস্তববাদেরও তিন শ বছর আগে এই উপন্যাসটি লেখা, The Dictionary of the Literature of the Iberian Peninsula অনুসারে এই উপন্যাস পরাবাস্তববাদের অনেক বৈশিষ্ট্য আছে : পাগলামি দ্বন্দ্ব, বই-পাগল দ্বারা অনুপ্রাণিত, আদর্শবাদী নাইট এবং তার বিবেক, বাস্তববাদিতা এবং বস্তুবাদিতা—এসবই তাদের সম্পর্কের প্রারম্ভিক বিচেনায় আসে। (ব্লেইবার্গ et al. ১৯৯৩ : ৩৮৩)। আরও বলতে গেলে ডন কুইকজট উন্ডমিলকে নাইট মনে করে তার সঙ্গে মারামারি করতে যায়। ফ্লোরেস তাঁর বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বলছেন যে ডন কুইকজট তাঁর নিজের বিশ্বাসে অটল, সেটা তাঁর সহযোগীরা দেখতে পায়, দেখতে পায় ভূমিপতি সানকো পাঞ্জা এবং পাঠকেরা একটু অন্যভাবে। ফ্লোরেস কাফকার মেটামরফোসিস-এ তুলে এনেছেন একজন মানুষের একটি বাস্তববাদী গল্প, যেখানে সে সকালে উঠে দেখে সে একটা পোকা হয়ে গেছে এবং তাকে এ বাস্তবতার মধ্যেইে তার পরিবারের সঙ্গে থাকতে হবে। ফ্লোরেসের বিবেচনায় জিওর্জিও ডি শিরিকোই হচ্ছে জার্মানিতে জাদুবাস্তববাদী পেইন্টিংয়ের অগ্রদূত, যিনি শীতল ও কোমল স্টাইলে শিল্পকারখানা ও শূন্যতার ছবি তুলে ধরতেন।

হোসে লুই বোর্হেসকে ধরা হয় আধুনিক লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের জনক এবং জাদুবাস্তববাদের অন্যতম অগ্রদূত। অ্যাঞ্জেল ফ্লোরেসের মতে বোর্হেসই প্রকৃতভাবে জাদুবাস্তববাদী লেখক। তিনি বলেন যে বোর্হেসের ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ছোট গল্পের সংগ্রহ A Universenl History of Infamy ছিল লাতিন আমেরিকান পরাবাস্তববাদী লেখনীর প্রথম উদাহরণ (ফ্লোরেস ১৯৯৫ : ১১৩)। ফ্লোরেস বলেন যে জাদুবাস্তববাদ, ইউরোপীয় সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, তার প্রকৃত উদাহরণ হচ্ছেন বোর্হেস। বোর্হেস ১৯২১ সালে আর্জেন্টিনার আধুনিকতাবাদী সাহিত্যতত্ত্বের কৌশলগুলোকে পরিচয় করিয়ে দেন। স্পেনে থাকাকালে তিনি ‘Ultraismo’ আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। স্পেনে এই আন্দোলন ছিল আধুনিকতাবাদী নিরীক্ষার একটি অন্যতম ফর্ম। এই আন্দোলন কৌশলকে অবলম্বন করে কবিতা লেখার জন্য। এ ধরনের কবিতায় প্রায় অসম্পর্কযুক্ত উপমাকে যুক্ত করার চেষ্টা থাকে, অলংকার থাকে না বললেই চলে। বোর্হেস এই কৌশলটি লাতিন আমেরিকায় প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন (লিন্ডস্ট্রস ১৯৯৪ : ৬৫)। তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন যাঁর দ্বারা, তিনি কাফকা, যাঁর বাস্তববাদী লেখনী আসলে পরাবাস্তববাদের দিকেই যায়। বোর্হেস বাস্তববাদী লেখনী সংকলিত করেছিলেন এবং অনুবাদ করেছিলেন (ফ্লোরেস ১৯৯৫ : ১১৩)। যদিও বোর্হেস তাঁর লেখনীতে রুহর প্রভাব সরাসরি স্বীকার করেননি, তবু মনে করা হয় যে বোর্হেস যখন ১৯৩২ সালে তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘আখ্যান শিল্প এবং জাদু’ লেখেন, তখন তাঁর মাথায় রুহর জাদুবাস্তববাদী ধারণার প্রতিফলন ছিল। এসব কারণেই তাঁকে বর্তমানে জাদুবাস্তববাদের পূর্বসূরি হিসেবে ধরা হয়, কারণ তিনি ইউরোপীয় ও লাতিন আমেরিকান এই দুই সাংস্কৃতিক ধারা দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সাংস্কৃতিক প্রভাবের মিশ্রণের একটা প্রভাব জাদুবাস্তববাদী লেখায় রয়েই গেছে।

ফ্লোরেসের প্রবন্ধ প্রকাশের ফলে লাতিন আমেরিকা, কার্পেন্তিয়ার ও তাঁর ‘আশ্চর্য বাস্তবতা’র দিকে নতুন করে সবার নজর পড়ে। এসব প্রভাবের সমন্বয় জাদুবাস্তববাদের দ্বিতীয় ঢেউয়ের দিকে যায়, যেটি আসল ‘জাদুবাস্তববাদ’ বা Magical Realism নামে পরিচিত। কিছু তা আসলে ফ্লোরেসের দেওয়া সংজ্ঞার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়, শুধু এটি ছাড়া যে তা শুধু ‘আশ্চর্য বাস্তবতা’ এবং জাদুবাস্তবতা, এ দুটি টার্মেরই অনেক বৈশিষ্ট্যকে সমন্বয় করে। খুবই লক্ষণীয় যে তা শুধু জাদুর মতো ঘটে যাওয়া বিষয়কে বর্ণনা করে। ১৯৫৯ সালে কিউবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারা ধরে এটি আজ লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য আন্দোলনের ধারা। একটু রমরমা কাটতি হবে ভেবে লাতিন আমেরিকায় এক নতুন সাংস্কৃতিক ঢেউ লাগে, যার প্রভাবে পরবর্তী সময়ে উপন্যাস লেখার হিড়িক পড়ে যায় (পোপ ১৯৯৬ : ২২৬)। ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদী সাহিত্যতত্ত্ব আমদানি করে অনেক লাতিন আমেরিকান লেখকই লিখেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মার্কেস, কাফকা ও জেমস জয়স দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত (কন্মেল ১৯৯৮ : ৯৮)।

কার্পেন্তিয়া ও গার্সিয়া মার্কেসের আন্তর্জাতিক খ্যাতির কারণে মানুষের একটি ভুল ধারণা হয় যে জাদুবাস্তববাদ একান্তই লাতিন আমেরিকান। এখানে বিশ শতকের ইউরোপীয় শিল্প-সাহিত্য, বিশেষ করে জার্মান শিল্প আন্দোলনের বিষয়টি নাকচ করা হয়। তথাপি, জাদুবাস্তববাদের লাতিন আমেরিকান দর্শনটিই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং গৃহীত হয়। জাদুবাস্তববাদী লেখকেরা আজ ভারত, কানাডা, আফ্রিকা, আমেরিকা ও সারা বিশ্বে স্বীকৃত। সালমান রুশদী, গার্সিয়া মার্কেস ও গুন্টার গ্রাসের জাদুবাস্তববাদ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। প্রভাবিত হওয়ার এসব দৃশ্যমান লক্ষণ জাদুবাস্তববাদের বিভিন্ন দৃষ্টান্তের মধ্যকার জটিলতা এবং তাদের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ককেই ইঙ্গিত করে। প্রত্যেক জাদুবাস্তববাদী লেখকেরই প্রভাবিত হওয়ার নিজস্ব ইতিহাস আছে। কেউ একেবারে সেই উৎসমূলের দ্বারা, আবার কেউ যখন এই টার্মটির আত্তীকরণ হয়নি, তখন থেকে। যে যেভাবেই প্রভাবিত হোক, কেউ এই টার্মটির উৎস অনুসন্ধান নিয়ে এত আগ্রহী নয়। যাহোক, সমালোচনামূলক বিষয় হিসেবে তাকে আলোচনায় আনলে তার বিকাশের ক্ষেত্রটি এবং বিষয়ের বিভিন্নতা সম্পর্কে জানাটা জরুরি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *