ইলিশ মাছে ত্রিশ কাটা

তখন দুপুর। লাঞ্চ টাইম। রাজধানীর হাতিরপুলের তিতুমির হোটেলের সব টেবিল খদ্দেরে পূর্ণ। টেবিলে টেবিলে খাবার যোগান দিতে ৩ জন মেসিয়ার গলদঘর্ম। ৭ নম্বর টেবিলে খদ্দেররা ভাতের খালি প্লেট নিয়া বসে আছে; ৩ নম্বর টেবিলে টেবিলে ভাত দেয়া হলেও তরকারী দেয়া হয়নি; ৯ নম্বর টেবিলে কাচ্চি দেয়া হয়েছে তো সালাদ দেয়া হয়নি; ১৪+১৩ নম্বর টেবিল এক করে বসেছে ছ’সাত জন। তারা প্লেটও পায়নি। ১৬ নম্বর টেবিলে জনপ্রতি একটা করে দেয়া তুনদুল রুটি খেয়ে বসে আছে, তারা আরও রুটি পেতে হা করে বসে আছে— বাঙালির সব সয় তো খেতে বসে মুখ কামাই যাওয়া সয় না। ২১ নম্বর টেবিলে নানরুটি দেয়া হয়েছে তো মাটন কাবাব দেয়া হয়নি। খুদা পেটে আধেক শুকনো রুটি তৃপ্তিসহকারে খেয়ে সাবার। থোরা তরকারীর ফরমায়েস যেন শুনেও শুনছে না মেসিয়াররা। খদ্দেরদের গাল-গল্প হাক-ডাক, মেসিয়ারদের হৈ হুল্লোড আর থালাবাটির টুং টাং শব্দে সারা হোটেলময় একটা জবরজং অবস্থা। তার উপর এপ্রিলের দুপুর। ক’দিন ধরেই বেশ টানা গরম পড়ছে। ছাদ থেকে খাবার টেবিলগুলির উপরে নামানো বৈদ্যুতিক পাখা যান্ত্রিক আওয়াজে ভন ভন করে ঘুরছে। পাখাগুলি থেকে শুধুই আগুন বাতাস বের হয়ে আসছে যেন। অজান্তর হাতের কাজটা সেরে আসতে আজ একটু দেরি হয়েছে। তাতেই এই দশা। পই পই করে বসার জায়গা খুঁজতে হচ্ছে। ঘর ভর্তি লোক হলেও হোটেলের পেছনের দিকে হাত ধোয়ার এবং খাবার সরবরাহের যায়গা সংলগ্ন নম্বরবিহীন যে দুটো টেবিল রয়েছে তাতে তেমন কোনো লোক নেই। ওখানে লোক না বসার কারণ অজান্তর জানা। রান্না ঘর থেকে আগুনের হল্কা ধেয়ে ধেয়ে আসে। এছাড়া আছে ওয়েটারদের ঘন ঘন আশা যাওয়া, চিৎকার করে খাবারের ফরমায়েস দেওয়া—এই তিন কাচ্চি এক বোরহানি, ২ প্লেন রাইচ, আইড় মাছ, প্লেন রাইচ বাচা মাছ। এসব কারণে পেছনের এই দুটো টেবিলে কেউ বসতে চায় না। অগত্যা অজান্ত তার একটিতে বসে পড়ে এবং খাবার অর্ডার দিতে একজন মেসিয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। মেসিয়াররা তার আশ-পাশ দিয়ে দ্রুত চলে যায়, তাকে দেখেও দেখে না। হাত ইশারায় ডাকে, মেসিয়ার চোখ দিয়ে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে, সে একা। এখানে এনজিও, সরকারী-বেসরকারী অফিস ও এলিফেন্ট রোডের বড় বড় শো’রুমের লোকজন দল বেধে খেতে আসে। তারা আসে চাক বেধে দলে দলে; কখনও  দুই তিন টেবিল একসঙ্গে মিশিয়ে দল বেধে খায়। তাদের বিলের অংক বেশ বড় হয়, সেই সঙ্গে সেই পরিমানে বকশিষ। সরকারী অফিসে যারা তদবিরে আসে তারা লাঞ্চের সময় ধরে আসে। সুযোগ বুঝে বলে ফেলে, ‘বস, চলেন তো লাঞ্চটা সেরে আসি’। বসরাও যে আশায় থাকেন না—এমন নয়। তবে এরা শাখা পর্যায়ের ছোট বস। বড় বসদের জন্য পার্শেল। সরকারী অফিসের লোকজন, তদবীরকারক, পার্শেল সব সময়ই অগ্রাধিকার পায়। এসব হিসেব মিলিয়ে অজান্ত চুনোপুটির চুনোপুটি। সে নিজেকে ভাবে চুনোপুটিদুর্বল। তাই, অফিসের খুব কাছে হলেও সে খুব একটা এ হোটেলে আসে না। বিপাকে পড়ে কখনও এসে পড়লেও মেসিয়ারদেরকে খুব জোর দিয়ে ডাকতে সাহস করে না। আজও তাই। এই ফাকে অজান্ত হাত ধোয়ার জন্য উঠে যায়। হাত ধুয়ে ফিরে এসে দেখে ৩ জন লোক তার টেবিলটাতে বসে পড়েছে। এ জন্যই সে চেয়েছিল খাবারের প্লেটটা টেবিলে দেয়ার পর সে হাত ধুতে যাবে। এখন? তার খুব অপমান বোধ হল। কিন্তু কি করা, তারা সংখ্যা গরিষ্ঠ। এছাড়া, সে যে টেবিলে বসেছিল তার তো কোনো প্রমাণও নেই। এই দুটি খালি টেবিলে চেয়ারও তিনখান করে। অগত্যা সে দেয়াল ঘেসা খালি টেবিলটাতে বসার মনস্থ করে এবং সেখান থেকে সরে আসে। সেটি আবার তুনদুল রুটি সেকার চুলার খুব কাছে এবং আগে থেকেই সেখানে একজন মহিলা বসে আছে। এবং একজন তখনও একজন মেসিয়ার মহিলার পিঠের খুব কাছে দাঁড়ানো। চেয়ারে বসতে বসতে অজান্ত লক্ষ্য করে, মেসিয়ারের হাত দুটো বুকের কাছে তোলা, এক হাতে ভাতের ট্রে অন্য হাতে কি একটা মাছের সালুনের পেয়ালা হবে। মেসিয়ার ছেলেটি বলল, ‘‘কি ভাবী বললেন না তো কি খাবেন।’’ তখন মহিলা বলে, ‘‘আচ্ছা ইলিশ মাছ কত করে?’’ ‘‘সাড়ে চারশ। আপনে খান আমি ধইররা দিমানে। ইলিশ মাছই খান, ভাবী। ভাল অইব। এক সাইয়া কাটা— কোল আর গাদা এক সাথে। শরিষা ইলিশ’’ বলেই মেসিয়ার অন্যদিকে চলে গেল। এ কি ব্যবহার! অজান্তকে সে আমলেই নিল না। এক নিমিষের জন্যও অজান্তর দিকে ভ্রক্ষেপ করল না। এবং এই মহিলা যে এই হোটেলে প্রায়ই আসে বা ছেলেটির পরিচিত, মহিলার আচরণে তা মনে হল না অজান্তর। অজান্ত মহিলার বিপরিত দিকের চেয়ারে বসা। ছেলেটি চলে যেতেই সে অজান্তর দিকে তাকায় এবং তার বুকের যথাস্থানে যথাযথভাবে স্থির থাকা ওড়না খামখাই টানা-টানি করে ঠিক-বেটিক করে। তারপর সে মেসিয়ারের মত অজান্তর দিকে ঘুর্ণাক্ষরেও ভ্রুক্ষেপ করে না। সে পাশের টেবিলে হায়দারাবাদী বিরিয়ানি খেতে থাকা লোকদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিল। তার চোখে অজান্ত ক্ষুধাতুর বেদনার আভাস দেখে থাকবে। অবশ্য সে পুরুষ হলে তার গলার কণ্ঠার ওঠা নামায় তার ঢোক গেলা বোঝা যেত। যা থেকে বোঝা যেত, তার উদর বিবিয়ানি খাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করছে। কি আর করা গন্ধম খেতে গিয়ে সে তো কণ্ঠাটি খুইয়ে এসছে সেই সৃষ্টির প্রথম প্রহরে। আবার তা নাও হতে পারে। বিরিয়ানি খেতে খেতে লোকগুলো পদ্মা ব্রিজের ফরেন লোন বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে তুমুল আলোচনা করছে। কেন ওয়াল্ড ব্যাংক এই লোন বন্ধ করল, নিশ্চয়ই এর পেছনে কারও হাত আছে, নিশ্চয়ই দুর্নিতী হয়েছে ইত্যাদি। মহিলা মনোযোগ দিয়ে তাই শুনছিল। এরপর কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে মহিলা। তার দিশাহীন দৃষ্টি এখন টেবিলের রাখা পানি ভরা গ্লাসে নিবদ্ধ আর তার হাত দুটো লবনের ছোট খোলা কৌটা থেকে চিমটি চিমটি লবন নিয়ে দু আঙুলে খুটা-খুটি করে, নাড়া-চাড়া করে। অসাবধানতায় কিছুটা লবন ছিটকে পড়লে সে চকিত চোখে অজান্তর দিকে তাকায়। অজান্ত না দেখার ভান করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকাতে সে স্বস্থি পায়। এরপর সে কপালে ডান হাত রাখে এবং তাতে ভর দিয়ে কিছুটা ঝুকে পড়ে, মাথা নিচু করে থাকে। এবং ঠোটে মৃদু এমন দু’একটি শব্দ করল যাতে অনেক আক্ষেপ ঝড়ে পড়ল বলে মনে হল অজান্তর। এর কিছুক্ষণ পর সে কপাল থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে বসে এবং টেবিলে রাখা তিনটি পানির গ্লাসের একটি হাতে তুলে নেয়। এবং পুরো পানিটা একটানে খেয়ে নেয়। পানি খাবার সময় কিছু পানি তার চিবুক গলিয়ে বুকের ওড়নার ওপর পড়ে। সে ওড়নার খুট দিয়ে মুখ মোছে। সে এত শক্তি দিয়ে মুখ মুছল যে, অজান্তর ভয় করছিল, তার ঠোট চিরে এখনি বুঝি বা রক্ত বের হবে।  এবং অজান্ত তখন খেয়াল করে যে, মহিলা ঠোটে লিপস্টিক দেয়নি। তাহলে সে কোনো প্রাইভেট অফিসে চাকরি করে না। ঠোটে লিপিস্টক ছাড়া দেখতে বিধবার মত মহিলাকে কেউ কর্পোারেট অফিসে এলাউ করবে না। যাহোক, মহিলা এই এলাকারই কোনো সরকারী অফিসের ছোট-খাট চাকুরে হবে বলে অজান্তর ধারনা হয়। এরপর টেবিলে রাখা টিসু বক্স থেকে একটি টিসু পেপার বের করে নিয়ে সে বুকের ওড়নার পানি শুষে নেবার জন্য বার বার বুকে চাপ দেয়। তখন অজান্তর চোখ খুব সাবধানে মহিলার বুকে নিবদ্ধ হয়। সে দেখে, মহিলার বুক খুব উন্নত নয়। আকর্ষণীয়ও নয়। অজান্তর মনে পড়ে, লিপিকার বুক ছিল এই রকমের। লিপিকার স্তন অনুন্নত ছিল এবং স্তনে বোটা ছিল না। বোটার জায়গাটা সামান্য উচু ছিল। অজান্ত খুব চিন্তিত হত, বিয়ের পর ছেলে পুলে হলে লিপিকা তাদের বুকের দুধ খাওয়াবে কিভাবে! অজান্ত এখন বোঝে, সেসব তার যত আজিরা চিন্তা ছিল। লিপিকার বিয়ে হয়েছে। লিপিকার আড়াই বছরের একটি ছেলে আছে বলে শুনেছে সে। অনেক দিন পর কি কারণে অজান্তর বুকের ভেতর থেকে একটা গাঢ় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে হোটেলের গরম বাতাসের সঙ্গে মিশে গেল। মহিলা আবার অযথাই টেনে-টুনে তার বুকের ওড়না ঠিক-ঠাক করল। তখন সেই মেসিয়ার খাবার হাতে পাশ দিয়ে যাবার সময় বলে, কি ভাবী বললেন নাতো কি খাবেন? তাতে মহিলার মুখে চোখে কোনো ভাবান্তর হল না। মেসিয়ার একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে যেতেই সে হুট করে উঠে দাড়িয়ে কোনো দিক না তাকিয়ে, একে ওকে প্রায় ধাক্কা মেরে, হোটেলের মাঝখানটি অতিক্রম করে দ্রুত হোটেলের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

মহিলা গেল তো গেল, অজান্তর রাতের ঘুম হারাম করে দিয়ে গেল। সেই যে দুপুরে মাথার মগজে মহিলা ঢুকল আর পোকা হয়ে মাথার ঘিলু কামড়াতে শুরু করল। অফিসে বসে মহিলার আদি-অন্ত ভাবতে চেয়েও কাজের চাপে তা পেরে ওঠেনি সে। পরনে ছিল ইন্ডিয়ান ত্রি-পিচ। কম দামী হলেও মার্জিত। এখন মেয়েরা সাধারনত এসব পরে না। এখন পরে বুটিক। হাতায় হাতের কাজ, বুকে কম্পিউটার কাজ, বডিতে এমব্রডারির কাজ—ইত্যাদি। বয়স কত হবে, চব্বিশ কি ছাব্বিশ। তার বেশি কমও হতে পারে। মহিলাদের বয়স আন্দাজ করা অত সহজ না। দেখতে খারাপ না। ফর্সা। এখনও এ সমাজের ১০০% মানুষের মধ্যে ফর্সা মেয়েদের জন্য একটা বাড়তি কদর আছে। গোলমত মুখখানির মধ্যে একটা মায়ার ছায়াও আছে। একটু মুটিয়েছে। খাটও না, আবার লম্বাও না, তবে খাটমত দেখতে—একটু মুটিয়ে যাবার জন্য হয়তো। বিবাহিত না-কি অবিবাহিত। নাহ! এটি ধারনা করার কোনো উপায় নাই। তবে কি কারণে সে ইলিশ মাছের দাম জিজ্ঞেস করে কিছু না খেয়ে উঠে চলে গেল এই চিন্তা অজান্তকে যার-পর-নাই-ভাবে চিন্তায় ফেলে দিল। কি জানি হয়ত ইলিশ মাছ খাবার বাসনা পোষণ করতে গিয়ে তার সন্তানের মুখ মনে পড়েছে। হতেই পারে সংসারে ইলিশ মাছ কেনার খুব সংগতি তাদের নেই। ফলে, ছেলে-মেয়েকে রেখে সে কি করে এখানে একা বসে ইলিশ মাছ খায়। সে হতে পারে না। বাজারে ইলিশ মাছের যে পরিমান দাম, ও চোখ দিয়ে একবার তাকালে, কিছু টাকা নজরানা দিয়ে আসা উচিৎ। আবার হতে পারে টানাটানির সংসার। তাকে এখানে বসে এমন সব হিসেব মেলাতে হয়েছে, ছেলের এ মাসের স্কুলের বেতন, ৫০০ টাকা দেয়া হয়নি। অথবা মেয়েটির স্কুলের জুতো নাই, বাটা থেকে কিনলে ৫০০ কি ৬০০। আর ইলিশের দাম ৪৫০ টাকা। কি ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিল সে। হতে পারে কলিগদের গল্পের খপ্পরে পড়ে সে এখানে ইলিশ খেতে এসেছিল। হয়তো কলিগরা এক সঙ্গে বসে গল্প করে থাকবে যে, তিতুমির হোটেলের ইলিশ মাছ খেতে খাসা। যারা খেয়েছে তাদের মুখরোচক গল্প সভাতে সে শ্রোতা ছিল মাত্র। হয়ত মহিলা ধরে নিয়েছিল এক-দেড়শ টাকা হবে। দাঁতে কামড় দিয়ে না হয় খেয়েই দেখবে একটুকরো মাছ। আবার এমনও হতে পারে তার ছেলে-পুলে নেই। এখনও হয়নি। তো কি হয়েছে, ঘরে স্বামী রয়েছে। স্বামীকে রেখেই বা একা একা সে কি করে হোটেলে বসে ইলিশ মাছ খাবে! বাঙালি মেয়ে যে। আবার ধরে নেয়া যাক তার বিয়ে এখনও হয়নি। সংসারে বাবা নেই, বা বাবা থাকলেও ঘরে পড়া, অসুস্থ; কামাই রোজগার করতে পারে না। তার কাঁধে সংসারের পুরো দায়িত্ব। তার উপর ছোট ভাইবোনদের লেখা-পড়া, নানা আবদার, নানা প্রয়োজন। দিন আন্তে পান্তা ফুরোয়। চাকরির পরও পাড়াতে কমপক্ষে প্লে-গ্রুপের দুটি টিউশানি চালাতে হয়। ফলে, বাসার জন্য সে কোনো দিনই একটা ইলিশ কিনতে পারেনি। এমন উদাহরণ তো আমাদের ধারে কাছে রয়েছে। ছোট ভাই-বোনদের মানুষ করতে গিয়ে বড় বোন কোনো দিন নিজের কথা ভাবেনি। বিয়ে পর্যন্ত করেনি। এক সময়, ভাইবোন সব বড় হয়ে যে যার মত করে নিজ নিজ সংসারে থিতু হয়ে যায়, আরামে অয়েশে দিন কাটায়। ততদিনে মা-বাবাও কবরে। দিন শেষে— সে একা। এই মানুষটির পরিনতি কি শেষ পর্যন্ত তেমন কোনো উদাহরণ হবে। যদিও আরেকটি বিষয় ভাবতে অজান্তর বুক কেপে ওঠে—এমনও তো হতে পারে, দুপুরে অফিসে যখন সবাই এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতে বসে, তখন সে খাবার নাম করে বাইরে বের হয়, এদিক ওদিক ঘুরে, হাটাহাটি করে। সময়টা পার হলে অফিসে ফেরৎ যায়। হতে পারে, সাহস করে কোনো কোনো দিন কোনো হোটেলে ঢুকে খাবারের ঘ্রাণ নেয়। তারপর এক গ্লাস পানি খেয়ে দুপুরের খাবারের সমাপ্তি টানে। নানা এমনটি ভাবা ঠিক নয়। খুব নিষ্ঠুরতা হয়। ভাবে অজান্ত। কিন্তু ভাবনা তাকে ছাড়ে না। আবার সে নিজেকে বলে, এসবের একটিও না হতে পারে। কারণ সে কিছুই না খেয়ে উঠে গেছে। হয়ত তার পার্স হারানো গেছে। না না এমনটি ভাবা যৌক্তি না, মহিলার তেমন কোনো অস্বাভাবিক হঠাৎ আচরণ অজান্তর চোখে পড়েনি। এবং তার বা হাতে একটি সস্তা দামের ছোট লাল পার্স ছিল। হয়ত তার কাছে টাকা নেই। টাকা না থাকলে সে তো খাবার হোটেলে ঢোকার কথা না। হতে পারে ইলিশ মাছ খাবার অত টাকা তার কাছে নেই। হতেই পরে। সেক্ষেত্রে সে শবজি আর ডাল দিয়ে দিব্বি এক প্লেট ভাত বা শুধু শবজি দিয়ে দুটি তুনদুল রুটি চালিয়ে দিতে পারত। অজান্ত তো প্রায়ই তা করে। 

শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে অজান্ত।

আঃ রহমানের অফিসের সভাকক্ষে দুপুরে খেতে বসেছে ছ-সাত জন। অজান্তও। তাদের মধ্যে দু’জন মহিলা। মহিলারা রয়েছে বলে অজান্ত একটু বাড়তি ভাললাগা অনুভব করে। তবে একজন মহিলা কালো বোরকায় আবৃত। এই গরমের মধ্যে বোরকায় আবৃত দেখে সে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে। আবার আশান্বিত হয় এই ভেবে যে জিনস ও হাফ-হাতা ফতুয়া পরা ওড়না ছাড়া মেয়েটির চেয়ে বোরকা পরা মহিলা বেশী সুন্দরী হবে। অজান্ত অপেক্ষা করে কখন সে বোরকার ছাদনি (নেকাব) খুলবে। কারণ খেতে হলে তাকে ছাদনি সরিয়ে উল্টিয়ে মাথার উপর রাখতেই হবে। অবশ্যই বোরকা পরা মহিলা বেশী সুন্দরী হবে—অজান্তর এই অনুমানের কারণ হল, সে শুনেছে এখন বেশীরভাগ সুন্দরী মহিলা বোরকা পরে চলাফেরা করে। তাতে তাদের সৌন্দর্য ঢাকা থাকে। আর কোনো জিনিস ঢাকা থাকলে তার ঔজ্জলতা বাড়ে। টেবিলে সবাই আগড়ুম বাগড়ুম গল্প করতে থাকলেও অজান্তর মন ও দৃষ্টি বোরকা পরা মহিলার দিকে। এরই মধ্যে খাবার এসে যায়। এবার অজান্তর আগ্রহ চমক দিয়ে ওঠে। তার ধারনার সত্যতার পরীক্ষা এক্ষুনি হয়ে যাবে। কারণ বোরকার ছাদনি সরিয়ে এখন মহিলা খেতে শুরু করবে। কিন্তু অজান্তর সে আশায় গুড়েবালি। মহিলা বোরকার ছাদনি ঢাকা অবস্থাতেই খাবার খেতে শুরু করে। সে বাম হাতে বোরকার ছাদনি সামান্য উপরে তুলে ডান হাতে মুখে খাবার পুড়ে দেয়। খাবার মুখে পোড়া শেষ হলে সে ছাদনি ফেলে পূর্বসৃষ্ট ফাঁকটুকু বন্ধ করে মুখ ঢেকে দেয়। ছাদনির নিচে তার খাওয়ার চলমান দৃশ্যের ছায়ার নড়া-চড়া দেখা যায়। সে এক অদ্ভুদ দৃশ্য। দেখার মত বটে। তবে, মুখের নড়াচড়ার অংশটি দৃষ্টিকটু। তারপরও দৃষ্টি সরায় না অজান্ত। এমন সময় গরুর মাংসের বড় টুকরোয় কামড় দিতে গিয়ে বোরকার ছাদনিটা অনেক খানি উপরে তুলতে হয় মহিলাকে। অজান্ত তো চোখ নিবদ্ধ করেই রেখেছে। সে চমকে ওঠে। এ তো সেই তিতুমির হোটেলের মহিলার মত দেখতে— যে তার সঙ্গে এক টেবিলে বসে ইলিশ মাছের দাম করে, না খেয়ে উঠে গিয়েছিল। সে নিশ্চিত হতে আরেকবার ছাদনিটি আগের মত উপরে ওঠার অপেক্ষা করে। কিন্তু মহিলা তখন গরুর মাংশ রেখে ইলিশ মাছ খেতে শুরু করেছে। আর সে ছাদনিটি উপরে না তুলে কোনো রকম একটু সরিয়ে দু’অঙুলের মাথায় আটকে দেয়া ইলিশ মাছ সহজে মুখে পৌঁছে দিচ্ছে। তাতে অজান্তর মহিলাকে চেনার বিষয়টি নিশ্চিত হতে রীতিমত গলধঘর্ম হতে হচ্ছে। অন্যরা সবাই গো-গ্রাসে খাবার গিলছে আর রান্নার প্রশংসা করছে। আঃ রহমানকে প্রসংসা করছে। দোস্ত প্রতি মাসে মাসে তোমার পদোন্নতি হোক। আর এমন ট্রিট আমাদের দাও। অন্যদিকে কিসের খাওয়া কিসের নওয়া। অজান্ত তাকিয়ে আছে মহিলার মুখের দিকে। কিছুতেই সে নিশ্চিত হতে পারছে না যে, এই মহিলাই তার দেখা তিতুমির হোটেলের মহিলা। সে যতবার নিশ্চিত হতে চেষ্টা করে ততবার গুলিয়ে ফেলে। তখন সে এই মহিলাকে গতকালের সেই মহিলা বলে নিশ্চিতকরণের প্রাণপণ চেষ্টা ক্রমাগতভাবে চালিয়ে যাওয়া একমাত্র কর্তব্য বলে জ্ঞান করে। রহমান আর অজান্ত ভুতের গলির একই মেসের বাসিন্দা। দু’জন বন্ধুও বটে। রহমান পদোন্নতি পেয়েছে। সেই আনন্দে সে তার অফিস কলিগদের খাওয়াচ্ছে। অজান্তাকেও খেতে আসতে বলেছে রহমান। সবার খাওয়া শেষ হয়ে যায়, অজান্তর খাওয়া হয় না। অজান্তর পাতে ইলিশ মাছ আস্ত পড়ে রয়। এখন কি সে আস্ত মাছটা পাতে রেখেই উঠে যাবে? সে ভাত নেয়নি যে। মহিলা তার বোরকার নিচ থেকে বা হাত বের করে অজান্তর দিকে পলিথিনের একটা পুটুলি এগিয়ে দেয়। তাতে কিছু মুড়ি বাঁধা। সে বলে, ‘তরকারি মজা হওয়াতে সবাই ভাত বেশি খেয়েছে, তাতে ভাতে টান পড়েছে। যেটুক ভাত আছে মুড়ি দিয়ে মিশিয়ে খান, তাতে আপনার পেট ভরবে।’ মুড়ি নিতে ইতস্তত করে অজান্ত। এক সময় মহিলা বলে, ‘রহমান স্যার, রহমান স্যার ইলিশ মাছের পিচ কত টাকা নিয়েছে।’ তাজ্জব বনে যায় অজান্ত। মহিলা বলে কি! তার কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই, খেতে বসে এভাবে কেউ পাতের মাছের দাম জিজ্ঞেস করে? কিন্তু অন্যান্যদের মুখে কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করে না অজান্ত। তারা দিব্বি প্লেটের কিনারে চুমুক দিয়ে পাতলা ডালের পিয়া খাচ্ছে। একি এদেরও কি কোনো ভদ্রতার বালাই নেই; পাঁচজনের সামনে খেতে বসে কেউ এভাবে প্লেটের কান্দায় চুমুক দিয়ে পিয়া খায়! অজান্তর আক্কেল গুড়ুম দশা। রহমানও নির্ধিধায় মহিলার কথার জবাব দেয়। বলে, ‘প্রতি পিচ ইলিশ মাছের দাম নিয়েছে সাড়ে পাঁচশ টাকা।’ তখন মহিলা বলে, ‘বলেন কি স্যার, আপনাকে তো ঠকিয়েছে। গতকাল তিতুমির হোটেলে আমি তো খেলাম, এত্ত বড় একখান ইলিশ মাছ নিল মাত্র চারশ টাকা।’ মহিলার কথা শুনে প্রথমে হেচকি এবং অতপর কাশি উঠে গেল অজান্তর। সে উঠে বেসিনে যাবার উদ্যেগ করতেই কাশির গমকে বাম হাতে লেগে তার খাবারের থালাটি ইলিশ মাছসহ উল্টে উৎকট শব্দে টেবিলের নিচে মেঝেয় পড়ে গেল। অমনি অজান্তর ঘুম ভেঙ্গে গেল। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *