আফ্রিকান সাহিত্য বলতে সেই কাজগুলোকেই বোঝানো উচিত, যা ৫৪টি স্বতন্ত্র জাতির সমন্বয়ে গঠিত একটি মহাদেশের বৈচিত্র্যকে ধারণ করে, প্রতিটির ইতিহাস, সংস্কৃতি, উপজাতি ও ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ আধার হয়ে ভবিষ্যতের নাগরিকদের জন্য অপেক্ষমাণ থাকে। এটা হওয়া উচিত মৌখিক এবং লিখিত আকারে বিস্তৃত বর্ণনাসহ একটি অমোঘ শিল্পসম্ভার।
আফ্রিকান সাহিত্যের আলোচনায় দীর্ঘকাল ধরে একটা পরস্পরবিরোধী চিন্তা-ভাবনা সক্রিয় থেকে লেখক-শিল্পী-পণ্ডিত, পাঠক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের একটি সর্বসম্মত চুক্তিতে পৌঁছাতে দেয়নি। আফ্রিকান সাহিত্য বলতে কি আফ্রিকানদের দ্বারা রচিত গল্পগুলোকে বোঝায়? পৃথিবীর সব উপমহাদেশের বা দেশের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকদের লেখাকেই তাদের দেশের সাহিত্যের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু আফ্রিকা এমন একটি মহাদেশ, যেখানে তার শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যিকদের প্রায় সবাই ইউরোপের বা আমেরিকার কোনো দেশের নাগরিক এবং তারা তাদের মাতৃভাষায় নয়, ইংরেজি বা ফ্রেঞ্চ ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করেন।
এই উপমহাদেশের ভাষার সমস্যার সাথে জড়িয়ে আছে এর মানবিক যোগাযোগের বহুবিধ মাধ্যমগুলির সাথে তাদের সাংস্কৃতিক সূত্রগুলোর বৈচিত্র্য।
নিচের ফ্লোচার্ট থেকে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে প্রচলিত বিদেশি ভাষার প্রসারের একটা চিত্র দেখা যায় :

নাইজেরিয়ান লেখক অ্যামোস টুটুলার লেখা ১৯৫২ সালে প্রকাশিত দ্য পাম-ওয়াইন ড্রিঙ্কার্ডকে বলা হয় আফ্রিকার বাইরে ইংরেজিতে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস। আমরা যে আধুনিক আফ্রিকার সাহিত্য পাঠ করে যে আফ্রিকাকে চিনি, তার প্রধান বাহন ইংরেজি ভাষা। আফ্রিকার সাহিত্যের সুপ্রাচীন ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও এর অনেকাংশ অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। আফ্রিকার জনগণের মাতৃভাষার সাহিত্য কোথায়? কার জন্য এই সাহিত্য?
দক্ষিণ আফ্রিকার সাহিত্যিক নদিন গর্ডিমার তার ‘আফ্রিকা ইমারজেন্ট’ (‘উদীয়মান আফ্রিকা’) গল্পের শুরুতে পাঠককে উদ্দেশ্য করে বলেছেন :
He is in prison now. So I am not going to mention his name. It might not be a good thing, you understand,—perhaps you think you understand too well; but don’t be quick to jump to conclusions from five of six thousand miles away….
অর্থাৎ তিনি ধরেই নিয়েছেন তার পাঠকগণ পাঁচ বা ছয় হাজার মাইল দূরে অবস্থান করছেন। গর্ডিমারের লেখার এই লাইন তার অবচেতন মনের ফসল, যেখানে তিনি জানেন এবং প্রবলভাবে বিশ্বাস করেন যে তার পাঠকেরা সবাই আফ্রিকার বাইরে অবস্থান করেন। তার পাঠক আফ্রিকান নন। অথচ ‘আফ্রিকা ইমারজেন্ট’— আফ্রিকার রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা। এখানে যে বর্ণবাদের অত্যাচারের কথা বলা হয়েছে, তা দক্ষিণ আফ্রিকা অতিক্রম করে ভিন্ন দেশেও আফ্রিকীয় দুর্ভাগ্যের বয়ানকে ধারণ করেছে।
আফ্রিকা মহাদেশের অনেক লেখক আন্তর্জাতিকভাবে প্রভূত পঠিত অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কারও নিয়মিত পেয়ে থাকেন। এ পর্যন্ত পাঁচজন নোবেল বিজয়ী লেখক এই মহাদেশের নামে সাহিত্যে করেন যেমন—ওল সোয়েঙ্কা (১৯৮৬), নাগিব মাহফুজ (১৯৮৮), নদিন গার্ডিমার (১৯৯১), জে এম কোয়েটর্জি (২০০৩) ও ডরিস লেসিং (২০০৭)। তাদের মধ্যে নাগিব মাহফুজ ছাড়া সবাই আফ্রিকার বাইরে ভিন্ন দেশের নাগরিক।
এরকম বিশাল ভুবনখ্যাত পুরস্কারের অধিকারী হয়েও আফ্রিকার সাহিত্যের দুর্ভাগ্য হলো—এই সাহিত্যিকেরা যে ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করেন, আফ্রিকার নাগরিক বাসিন্দা বা পাঠকেরা সেই ভাষায় কথা বলেন না বিধায় ওই সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতা তাদের নেই বললেই চলে। যেসব সাহিত্যকর্মকে আফ্রিকার বাইরে অবস্থানরত আন্তর্জাতিক পাঠক আমরা আফ্রিকান সাহিত্য বলে অভিহিত করছি, সেগুলো মূলত ইংলিশ ও ফ্রেঞ্চ—এ দুই ভাষাতেই লেখা। অধিকাংশ গ্রন্থই প্রকাশিত হয় আফ্রিকা মহাদেশের বাইরে। আর এই সাহিত্যের অধিকাংশ লেখকই থাকেন আফ্রিকা মহাদেশের বাইরে। স্বতঃসিদ্ধভাবে বলা যায়, এই বইগুলোর পাঠকও থাকেন বিদেশে।
নাইজেরিয়ার চিনুয়া আচেবে লিখেছেন ইংরেজিতে—তার দেশের ৫৩ শতাংশ জনগণ ইংরেজিতে শুধু কথা বলতে পারেন। কেনিয়ার সাহিত্যিক গুগি ওয়া থিয়ংও প্রথম জীবনে কয়েকটি উপন্যাস ইংরেজিতে লিখেছিলেন—তার দেশের ১৮ শতাংশ জনগণ ইংরেজি ভাষা বোঝেন। গুগি ওয়া থিয়ংও পরবর্তীকালে ইংরেজি ভাষা পরিত্যাগ করে তার নিজের ভাষা ‘গিকয়ু’তে সাহিত্য রচনা শুরু করেছেন। গুগি ওয়া থিয়ংওকে পরবর্তীকালে বিশ্ব বইবাজরের জন্য তার ‘গিকয়ু’তে রচিত সাহিত্য ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করতে হয়েছে। আর সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, তার পুত্র মুকোমা ওয়া গুগি ‘গিকয়ু’ ভাষার কোনো চর্চা করেননি। তিনি বর্তমানে আমেরিকায় একজন কবি ও ক্রাইম ফিকশনের লেখক। সেনেগালের লিওপোল্ড সেনঘর, ওসমান সেমবেন, বিরাগ ডিউপ প্রমুখ ফ্রেঞ্চ ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন অথচ সেনেগালে মাত্র ২৬ শতাংশ জনগণ ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলতে পারেন।
ওলে সোয়েঙ্কা আরেকজন নাইজেরিয়ান নাট্যকার, যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার নাটকগুলো ইংরেজি ভাষায় লেখা। লন্ডনে অবস্থানকালেই তিনি তার প্রথম নাটকটি সোয়াম্প ডোয়েলার লিখেছিলেন, যা ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয়।
মিশরের নাগিব মাহফুজ আরবি ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। মিশরের নৃতত্ত্ব সভ্যতা-সংস্কৃতি-ভাষা-রাজনীতি ও সমাজ—সবকিছুই আফ্রিকার অন্যান্য দেশ থেকে পৃথক। আরবি ভাষা ইসলামের আবির্ভাবের পরে আফ্রিকায় সাব-সাহারার কয়েকটি দেশেই বিস্তৃত হয়েছিল—মিশর, সুদান ইত্যাদি। কিছু এই অঞ্চলের অধিকাংশ দেশ মধ্যযুগের প্রহর শেষ না-হতেই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় কীর্তিমান প্রতিনিধি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ ও পর্তুগিজদের আক্রমণে তাদের স্বাধীন সত্তা হারিয়ে ফেলে। আফ্রিকায় আরবি সাহিত্য বিকাশের অপমৃত্যু সেই সময় রোধ করতে পারেনি সাব-সাহারার কয়েকটি দেশ।
আফ্রিকা মহাদেশকে এই তিন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী (ইংরেজ-ফ্রান্স-পর্তুগাল) লুণ্ঠনকারী দস্যুরা দৈত্য-দানবের মতো আক্রমণ করেছিল অষ্টাদশ শতকে। অথচ তার আগে হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার সংস্কৃতি নিয়ে বিকশিত হয়েছিল এই মহাদেশের মানুষগুলোর ইতিহাস। ইতিহাসবিদ জি এফ পোলোকের মতে, ইউরোপের আক্রমণকারী দেশগুলোর শতবর্ষ ধরে ক্রীতদাস বাণিজ্য আর রাজনৈতিক আগ্রাসন আফ্রিকার ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করে দিয়েছে :
The natural course of African history was savagely halted by European conquest and the centuries of the slave trade. (G F Pollock, Civilization of Africa: Historic Kingdoms, Empires, and Cultures, American Education Publication Unit, 1970, page 5)
আফ্রিকার ফ্রেঞ্চ দার্শনিক ফ্রানৎস ফানোঁ ইউরোপীয় শক্তির দ্বারা আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের শোষণের সমালোচনা করতে সব সময়ই উন্মুখ ছিলেন। তার বইটির নামই হলো ‘কালো চামড়া, সাদা মুখোশ’। এ বইয়ের শুরুতেই তিনি বলেছেন যে, যেকোনো একটি স্বাভাবিক নিগ্রো পরিবারে বেড়ে ওঠা স্বাভাবিক নিগ্রো শিশু সাদা পৃথিবীর কোনো স্পর্শ পেলেই অস্বাভাবিক হয়ে যাবে :
A normal Negro child, having grown up in a normal Negro family, will become abnormal on the slightest contract of the white world. (The Negro Psychology, Black Skin, White Mask, Franz Fanon, 1952)

আফ্রিকার ভাষা সমস্যা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছে। আচেবে থেকে সোয়েঙ্কা পর্যন্ত অনেকেই এই বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। ১৯৬২ সালের সেই বিখ্যাত উগান্ডার কাম্পালার বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সে অনেক প্রশ্ন উঠেছে :
কাকে আফ্রিকান সাহিত্য বলব?
এটা কি আফ্রিকানদের লেখা সাহিত্য? যা আফ্রিকান অভিজ্ঞতাকে চিত্রিত করে?
আফ্রিকান সাহিত্য কি আফ্রিকান ভাষায় লেখা উচিত?
৫৫ বছর পরে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার একই বিষয় নিয়ে কনফারেন্স হয়েছে। ওলে সোয়েঙ্কা সেখানে সভাপতিত্ব করেছেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি।
আফ্রিকার সাহিত্য অতীব প্রাচীন। কারণ, এখানে অনেক পুরানো প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন ইতিহাসের সন্ধানের সাথে সাথে বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত হচ্ছে। এই মহাদেশের দুটি ভাষা, আরবি ও হাউসা—উভয়ের কিছু লিখিত সাহিত্যের প্রমাণ রয়েছে—যা বর্তমান নাইজেরিয়া ও সোমালিয়ার ইতিহাসের অংশ। এছাড়া গ্রিজ (Geʽez) ও আমহারিক (Amharic) ভাষার কিছু লিখিত প্রমাণও পাওয়া যায় ইথিওপিয়ায়। ইথিওপিয়ার রয়েছে বিপুল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। প্রাক-ঔপনিবেশিক আফ্রিকান সাহিত্য বেশির ভাগ লোককাহিনি, ধাঁধা-প্রবাদ, গান—এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে এর লোকস্মৃতিতে প্রবাহিত হয়েছে। তাহলেও আমাদের মনে রাখা উচিত, মালি বা তৎসংলগ্ন পশ্চিমে আফ্রিকা প্রচলিত সুনডিয়াটা মহাকাব্যের কথা। এরা ছিল মধ্যযুগীয় সানি—পুরানো ঘানা সাম্রাজ্যের ডিঙ্গার মহাকাব্য। ধারণা করা হয়, মহাকাব্যটি ১৩ শতকে সৃষ্টি হয়েছিল—সাতশত বছর ধরে আফ্রিকার এই অংশের জনগণ একে স্মৃতি থেকে লুপ্ত হতে দেয়নি। যদিও কালের পরম্পরায় কাহিনি-শব্দ-ঘটনাপ্রবাহে নিঃসন্দেহে পরিবর্তন এসেছিল, যে কারণে এর অনেকগুলো ভার্সন পাওয়া যায়।
সুনডিয়াটা মহাকাব্য আমাদের কাশীরাম দাসী মহাকাব্যের মতো পঠিত ও গীত হতো। রামায়ণ ও মহাভারতের মতোই এখানে রাজা-রাজত্ব, রাজপরিবারের বিরোধ-জাদুবিদ্যা-ভবিষ্যদ্বাণীর ফলে সৃষ্ট দুর্বিপাক, রাজকীয় বন্ধুত্ব বিশ্বাসঘাতকতা—এগুলোর মধ্যে তৎকালীন সমাজ-সংস্কৃতি-রাষ্ট্রব্যবস্থা ইত্যাদিকে খুঁজে পাওয়া যায়। সুনডিয়াটা আমাদের রামের মতোই একজন রাজকুমার, যার দুর্ভাগ্য ঘিরে পল্লবিত হয়েছিল কাহিনি। কাহিনি শেষে গীতিকার সুনডিয়াটা ও মালি সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে তার শাসনের প্রশংসা করে মহাকাব্যের সমাপ্তি ঘটান। তিনি সবশেষে বলেন, মালি চিরন্তন এবং তার কৃতিত্ব ইতিহাসের অনুস্মারক হিসেবে সর্বত্রই রয়েছে। যারা এই গীতিকাহিনি পাঠ করে, তারাই কেবল তা জানতে পারে।

আহমদ বশীর বাংলাদেশের সাহিত্যের সত্তর দশকের অন্যতম প্রধান কথাশিল্পী। সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর কয়েকটি বই: উপন্যাস- ত্রিশঙ্কু (২০২৪), মুদ্রারাক্ষস (২০১৯), স্বাধীনতার পরের এক পরাধীনতা (২০১৭), তিথিডোর : মুক্তিযুদ্ধের একটা উপন্যাস হতে পারতো (২০১৬), অবাস্তব বাস্তব (২০১৫)। ছোটগল্প- আহমদ বশীরের গল্প (২০২২), অন্য পটভূমি (১৯৮১), নায়ক কাপুরুষ (১৯৮৩), নির্বাচিত গল্প (২০১৬), উনিশ শ’ তিয়াত্তরের একটি সকাল (২০১৯)। প্রবন্ধ- বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : দেশ কাল ও শিল্পরূপ (২০২০), ঠকচাচা, হাসিম শেখ, রামা কৈবর্ত্ত, কুবের মাঝি : বাংলা উপন্যাসে সমাজচিত্র ও অসাম্প্রদায়িকতা (২০২৫)।