রাষ্ট্র বনাম মেমোরিয়াল ক্লাব

মজিদ মাহমুদ সর্বাধিক একজন কবি বা গবেষক হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি যে একজন উচুমানের কথাসাহিত্যিক একথা বলতে দ্বিধা নেই—কেননা সম্প্রতি পড়েছি লেখকের ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ নামের উপন্যাস। ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ উপন্যাসটি একটিমাত্র ঘটনাকে কেন্দ্র করে মনোবিশ্লেষণী পন্থায় রচিত হয়েছে। কিন্তু একে একটি ঘটনা বলতে পারি না। লেখক এখানে একের মধ্যে একাধিক ঘটনাকে অবতারণ করেছেন। যা আমাদের চৈতন্যগত। এই উপন্যাসের বর্ণিত চরিত্র—হাসান, মর্জিনা, আকলিমা, আব্দুল খালেক, মৌলবী আব্দুল কাদেরের হৃদয়বিদারক পরিণতি সত্যিই উপন্যাসকে অন্য এক মাত্রা দান করেছে। সেই সাথে লেখক আমাদের নগ্ন-সামাজিক বাস্তবতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে চিনিয়ে দেয়। হাসানের সাথে বিলকিসের প্রেমও আমাদের কম বিমোহিত করে না। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘চাঁদের অমাবশ্যা’ উপন্যাসটি বাংলাসাহিত্যের এক নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ উপন্যাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই-উপন্যাসে শিক্ষক আরেফ আলীর ঘটেছিল মানব চৈতন্যের উদ্বোধন। হৃদয়ের দাবিটিকে থাকার লড়াই, সেই টিকে থাকা আবার সামষ্টিক। বাঁচার চেষ্টা করলেও আমরা শেষ পর্যন্ত কি একা টিকে থাকতে পারি? কোনভাবেই একা টিকে থাকা সম্ভব? কিন্তু আজ আমরা ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবন-যাপনকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। যে কারণে আমরা বারবার আমাদের মূল জায়গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। ‘চাঁদের অমাবশ্যা’ গ্রন্থের  কেন্দ্রিয় চরিত্র শিক্ষক আরেফ আলীও এই পথই খুঁজেছিল সবসময়। কিন্তু তিনি জীবনের পথে বেশি দূরে যেতে পারেননি। শেষমেষ নতি স্বীকার করেছেন এই সামষ্টিকতার করতলে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এই পলায়নপরতা থেকে আরেফ আলীর লড়াইয়ে ফিরে আসা পর্যন্ত সময়ের মাঝে সমাজকে হাজির করেছেন নানা অনুষঙ্গে। মজিদ মাহমুদও তাঁর উপন্যাসে মূলত সময়কেই উপস্থাপন করতে চেয়েছেন নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে যা তার সামনে ঘটে যাওয়া স্বাধীনতা উত্তরকালীন বাংলাদেশের পটচিত্র। আমরা সমাজে বা রাষ্ট্রের নানা গ্যাড়াকলে আবদ্ধ ইচ্ছা করলেও এই গ্যাড়াকল থেকে নিজেদের রেহায় দিতে পারি না। তেমনি ’মেমোরিয়াল ক্লাব’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হাসান। সে সংবাদ অফিসে কাজ করে বাসায় ফেরার পথে পথবালিকাদের সাথে কথা হয় এবং এই কথাকে কেন্দ্র করে রাতের টহল পুলিশ তাকে আটক করে এবং ধরে নিয়ে যায় থানায়। এখান থেকেই মূলত উপন্যাস বিস্তার লাভ করে এবং সামাজিক নানা সমস্যা এসে তার সম্মুখে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে শুরু করে। এই সমস্যাগুলো হাসান নামের চরিত্রের মাধ্যমে লেখক আমাদের প্রত্যেক মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া বিষয়াদিকে নিখুঁত ভাবে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। এই দুর্বিষহ জীবন থেকে হাসান চেষ্টা করেও নিজেকে বের করতে পারছেন না। এই বর্তমান ঘটনার সাথে বিস্তৃতি লাভ করছে হাসানের অতীত-জীবনের অনুষঙ্গও। যা আমাদের জীবনের মর্মপীড়ার কারণ। এই যে মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া দুঃখ-কষ্ট-জরা যা অবহেলীত আর নিরীহ মানুষের জন্য সত্যিই এক বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দেয়। যে মানুষগুলো হতভাগ্য সেই মানুষ অন্যায় বা কোন পাপ না করেও সমাজ বা রাষ্ট্র যা কিছুই বলি না কেন এই যন্ত্রের কাছে বন্দী। হাসান অসহায়… চোখের সামনে একের পর এক উন্মোচিত হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের পেতে রাখা জালের গিঁট। উপন্যাসটি আমাদের সামাজিক, অথনৈতিক কি রাষ্ট্রীক জীবনের এক প্রামাণ্য দলিল। দার্শনিকতায় ঠাশা বাক্যবাণে আমাদের নিউরণে এক ধরনের অনুরণন ঘটায় এবং ভাবনায় বসিয়ে দেয়। একজন লেখকের সেটাই বুঝি স্বার্থকতা—যে লেখা পড়ে একজন পাঠকের চিন্তার উন্মেষ ঘটে। লেখক এক জায়গা বলছেন— ‘মেয়েটির টিকে থাকার ক্ষমতা দেখে সত্যিই অবাক হয়েছে হাসান। অবশ্য বিড়াল চক্ষু মেয়েদের দেখলে ঈশ্বরগুপ্তের কবিতা মনে পড়ে হাসানের—‘বিড়ালাক্ষ্মী বিধুমুখী…’ কিন্তু তারপরের বাক্যটি ভয়াবহ। যা বিলুর সঙ্গে আন্তরিকতা সৃষ্টিতে অনেকদিন বাঁধা হয়েছিল। অথচ চাকুরি জীবনে লোকে যাকে সাংবাদিকতা বলে, সেই সাংবাদিকতা বিলুর সঙ্গেই শুরু হয়েছে হাসানের। সাংবাদিক হলেও এ রহস্যের উদ্ঘাটন সে করতে পারেনি; অবশ্য এসব রহস্য উদ্ঘাটন শিশুদের কাজ। শিশুদের বাবারা রহস্য পাকিয়ে তুলতেই বেশি ভালোবাসে। এই রহস্যের নাম সংসার, নারী-পুরুষের সংসার। যে রহস্য খুলে গেলে স্বামী স্ত্রীর কাছে মা সন্তানের কাছে নতুন সম্পর্কে বাধ্য হতে পারে। তাই পাক কোরানে রহস্যের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর নিরানব্বই নামের এক নাম বাতেন। তিনি কী গোপন করেন! মানুষের দেহের মধ্যে রক্ত পঁচে পুঁজ। মানবীর দেহের মধ্যে আঁশটে গন্ধ হয়ে ওঠে লোহু। এই পঁচা রক্তের যন্ত্রণা। এই দুর্গন্ধ নিঃসরণ ছাড়া মানুষ আর কি রেখেছে বাকি! কায়রো সম্মেলনে নারীরা গর্ভপাতের অধিকার চেয়েছে। সে অধিকার কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে! নাকি সে অধিকার নারীদের ছিল কোনদিন। ভ্যাটিকানের সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। আরে বাবা অধিকার চাই দাও না। গর্ভপাত তো মৈথুন নয়। বাথরুমে বালিশে ওয়ারে… গর্ভপাত কি আমার নবীজীর আমলে ছিল না। হযরত শিষ নবী আলাইহের সাল্লাম, মা সীতা, জনকের লাঙলের সাথে উঠে এসেছিল তার সর্বংসহা দেহ। শুক্র হত্যা করে পুরুষ বেঁচে থাকার আনন্দ নেয়; আর ভ্রূণহত্যা করে’…নারীর অধিকারের প্রশ্নেও লেখক সোচ্চার। তিনি আমাদের বর্তমানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকেও তুলে ধরেছেন নানাভাবে। আজ আমাদের রাজনৈতিক দর্শন পরিবর্তিত হয়েছে। একদিন যে ছেলেটা দেশের জন্য লড়াই করেছে সে আজ সমাজে সবার কাছে লম্পট, দুশ্চরিত্রের মানুষ হিসেবে পরিচিত। যার নামে আজ কোন কিছুর নাম রাখাটাও পাপ। বরং মাদরাসা করলে অনেক ছোয়াব হবে আল্লাহ মুক্তি দেবেন।

এই উপন্যাসে অন্য চরিত্র বা খলচরিত্র হিসেবে এসেছে পুলিশের চরিত্র। যা আমাদের চারিপাশে ঘটে যাওয়া দৃশ্য। পত্রিকার পাতা ভরে আসে সন্ত্রাসীদের চেয়েও মারাত্মক মারাত্মক নিউজ। ‘কিছুদিন আগে পুলিশ জালাল নামে তাদের এক সোর্সকে মেরে ডিবি অফিসের ছাদে খাবার পানির ট্যাঙ্কির মধ্যে ফেলে রেখেছিল। লাশ পঁচে পানির সাথে দুর্গন্ধ ছড়ানোর পরে তা জানা গেল। বাড়ি থেকে পুলিশ তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করেছে বলে বলা হচ্ছে। তাদের কোনো অপকর্ম জালাল জেনে ফেলেছিল। অনেকে বলছে, টাকা পয়সা ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে তাদের মধ্যে কি যেন হয়েছিল। তারপর পত্র-পত্রিকায় দু’একদিন হৈচৈ। তারপর সব আগের মতো। রুবেল হত্যার কথা তো সবাই ভুলেই গেছে। এখন শুনছি উল্টো তার পরিবারের লোকজনকে পুলিশ নানাভাবে হয়রানি করছে। দুএকটি পত্রিকা অবশ্য পুলিশের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিল, তাতে পুলিশের কিচ্ছু যায় আসে না। পুলিশ সকল কিছুর ঊর্র্ধ্বে। যে কোন সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার উৎসের নাম পুলিশ। সুতরাং পুলিশকে বিগড়ানো চলবে না। পুলিশ যতই না বালিকাকে ধর্ষণ করুক, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে নগ্ন করে গোপনাঙ্গে মুখ লাগাতে বাধ্য করুক, পথচারীর টাকা ছিনতাই করুক, এরশাদ আর এরশাদ শিকদারকে হিরো বানাক তবু পুলিশই জিন্দাবাদ।’ ভদ্রলোকের মুখোশ ধরে সমাজে বাস করে মুখোশধারী মানুষেরা। যা দৈহিকগঠনে সুন্দর হলেও দ্বিবাচনিকতায় তাদের জুরি মেলা ভার। তাদের ভণ্ডামীর কোন কমতি নাই। এই উপন্যাসে মুক্তিযোদ্ধাদের কথাও উঠে এসেছে নানাভাবে। যা আমাদের চিনিয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সুবিধাবাদীদের আসল চেহারা কিংবা সমাজের মাতব্বরদের সালিশের নামে নানা তালবাহানা। প্রান্তিক নানা অসংগতি লেখক এই বিশাল ক্যানভাসে বলার চেষ্টা করেছেন। যা পড়া মাত্রই আমাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে—এসব আমাদের চারপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনা বলেই আমাদের তাড়িত করে, মোথিত করে। মিথ্যাকে অনেক সময় লেখক সত্যি বলেই চালিয়ে দিতে পারে কিন্তু সেটা সচেতন পাঠক মাত্রেই ধরতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু লেখক আমাদের সামনে যা হাজির করছেন তা আমাদের মিথ্যা, বানোয়াট বা কল্পনায় মোড়ানো মেকি সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের বিষয় বলে মনে হয় না। বরং মনে হয় আমাদের চোখের সামনেই ঘটে যাওয়া ঘটনা লেখক বর্ণনা করছেন। সব কিছুর মূলেই রাষ্ট্র। কেননা রাষ্ট্রের বানানো সিস্টেমে আজ আমাদের জীবন নাভীশ্বাস। যা কোনভাবেই এই সিস্টেম থেকে বের হওয়া সম্ভব না। যে কারণে হাসানদের শেষাব্ধি হতে হয় পাগল নতুবা রাষ্ট্রদ্রোহী।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *