একটা জ্বলন্ত মোমবাতি দিয়ে তো কত কিছুই করা যায়!
চারপাশে ছড়ানো নানারকম আঁধার কুড়িয়ে-বাড়িয়ে সংগ্রহ করার জন্য একশো ঊনত্রিশটা ঝাড়বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া যায়।
অতিকায় একটা রাসায়নিক কারখানা জ্বালিয়ে ফাটিয়ে দেওয়া যায়।
আমাদের জন্মদিন ঘিরে কেকের গোধূলিহাহাকার ঘিরে মানবজনমের অর্থহীনতা ঘিরে কিংবা আমাদের ফালতু রাষ্ট্রীয় ভালোবাসাবাসির সাক্ষ্য দেওয়া অতি ক্ষণচারী আরেকটা বাটারফ্লাই ইফেক্ট জ্বালিয়ে দেয় কেউ বা।
আনাল হককে ক্রসিফিকেশনের আগে চারপাশের গারদে তথা নবীর মাভূমে দাউদাউ পাবক ধরিয়ে দিয়ে ‘আমি আমার সত্য’কে বাঁচানো যায়।
কুপির তেল ফুরিয়ে যাওয়ায় চিমনির ভিতর আধপোড়া মোমবাতিটা বসিয়ে নদীতে চোরাইভাবে জাটকা ধরার কালে কিংবা মাঝ দরিয়ায় পরমাণু বোমাবাবাজির অসফল পরীক্ষার কিছু পড়ে…
ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
তো সিদ্ধান্ত নিলাম—একের পর এক ব্যবসায় লস এবং তদুপরি সি সি লোনের দায় মিটাতে না পেরে সদ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া মাস্টার বিড়ির মালিকের পুরনো চালগুদামে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেব, মালিকের ছোট ছেলেবউয়ের গোপন নির্দেশমতো সারতে হবে এ নাশকতা। তাতে এই ব্যবসার জন্য নেওয়া ব্যাংক লোনের বোঝাটাও কমবে আর গুদামঘরটির এগেইনস্টে যে ইনসুরেন্স ছিল, তারও মোটা ক্ষতিপূরণ পেতে অসুবিধে হবে না। বীমা কর্মকর্তাকে একটু টাকাপয়সা খাওয়াতে পারলেই হিসাবপত্র সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে, হরহামেশা তো এসব ভোজবাজি চলছেই সব সেক্টরে। দয়াল ইবলিশের কী মহিমা, ওস্তাদ!
ঠিক হল, অগ্রহায়ণের অল্প শীতের রাতে ঈষৎ বৃষ্টির মধ্যে মেইন গেটের তালা শাবলের চাড়া দিয়ে ভেঙে ভিতরে ঢুকে পোকায় খাওয়া প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া চালের বস্তায়, ভেঙে নেমে আসা টিনের চালে, কড়িকাঠে, ভবিষ্যৎ-থমকে-যাওয়া-কাঠের জানালায় আগে কিছু কেরোসিন ছিটিয়ে নেব, যাতে জ্বলানো আগুন পরে নিভে না যায়। এরপর দেশলাইয়ে মোমবাতি ধরিয়ে চারদিকে আগুন লাগিয়ে দেব। তাহলেই কীর্তিনাশা, ফর্দাফাই ৫ই আগস্ট।
চৌদ্দিকে দস্তুরমত কেরোসিন ছিটিয়ে মোমবাতিতে যেই আগুন ধরাতে যাব, এমন সময় পাশ থেকে ফিসফিস করে কে জানি বলল, “আরে বাঞ্চোত, গুদামঘরের কড়িকাঠে, ঘুলঘুলিতে যে বেশুমার কবুতর বাসা বান্ধিছে এই ক’বছরে, এ রাতের অন্ধকারে, বৃষ্টির মধ্যে আগুন লাগলি পরে তারা যাবে কোথায় রে হারামজাদা?”
ঘটনা হল, চালের গুদামে এই রাতবিরেতে এ কুকীর্তি তো আমি একাই সাধন করতে এয়েচি, তা খামোখা নিরুদ্দেশ থেকে কতা কইচ কে গা? পাশের শ্মশানের প্রেতযোনি নয় তো? যা শ্লা, এ কেমনতর ডাইনী গো তুমি যে, আগুন অব্দি ভয় পাওনি কো! সমানে আয়তুল কুরসি জপতেছি, তাও সাইড হতিছ নাকো ক্যানে?
এমনতর ভাবতি ভাবতি আবারও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, “এই মাদারি, পাখিগুলা তোর কী ক্ষেতি করেচে, ক তো! গুষ্টিশুদ্ধো ওদের মারতে চাইছিস ক্যানে?”
বুঝলাম, এ আমার মনগুরু বাকবাকুম পারতেছে, এসবে এত গুরুত্ব দিলে নতুন মহাভারত লিখা যাবে নাকো। সো, রেডি সেট এন্ড গো… আগুন জ্বালাও, আক্রমণ কর।
সবে মোমবাতিতে আগুন ধরিয়ে কাছের একটা ভাঙা টুলের উপর রেখে ঘরের চারদিক ভালো করে দেখে নিচ্ছি বেবন্দেজ দহন লাগাব বলে, ওমনি কোন্ অন্ধকারশাবক যেন ঘাড় মটকাবার মর্তবায় আমার সাধের টুঁটিখানি প্রাণনাশক চেপে ধরেছে! আশেপাশের বসতবাড়িতে জানাজানি হবার তরাশে আমি চিৎকার ভি দিতে পারতেছি না, আবার ঢোকও গিলতে পারতেছি না, পাস-আনফাস আটকে যায় যায় অবস্থা, এই ঠাণ্ডার মধ্যেও মম মরণঘাম ছুটে গেছে…
রাখ্ তোর দাবানলের ইমেজে নতুন ম্যাটান্যারেটিভ আরোপ, বীমা আদায়ের মাধ্যমে ঋণমুক্তি এবং নতুন ঋণ নিয়া নতুন ব্যবসা ফাঁদার পাঁয়তারা, আগে জান বাঁচা সোনা…
টুলে রাখা ঐ প্রজ্জ্বলিত মোমশলাকা হাতে নিয়া বাইরে লাগা দৌড় হালার পো, পরনের লুঙ্গির বাঁধন টুটে যায় যাক, আগে নিজে বেঁচে বংশের বাতি রক্ষে কর ক্ষণিকের ছেলে! ভূতের গায়েবি চিপায় নধর জানখানি পুটকি দিয়া বাইর হইব। ভাগ মিলখা ভাগ…
বাইরে সুনসান রাত, কপিশ আন্ধার, হাওয়া বৃষ্টি-অবসন্ন ভূতেধরা—এরই মধ্যে দৌড়াচ্ছি প্রায় অলৌকিক অবনির লাহান আমি দৌড়াইতেছি, বাউরি!
সামনের মোড়ে পরান কাহার বাড়ি, মানে কুঁড়েঘর, শুকনা তালপাতা দিয়ে বাড়ির চাদ্দিকে বেড়া বানাইছে কাহা। পাশ কেটে যেতে যেতে শুনতি পালাম, ভিতর থাকি কে জানি কানতিছে। ঠিক কানতিছে না, গোঙাইতেছে। ঘটনা কী? গোডাউনের শাঁকচুন্নি তো আর এখানে এসে কাচামিঠা আমগাছে বইসা কান্দন জুড়ে দেয় নাই আমারে তরাশ দেখানোর লাইগা। তাইলে?
আমতা আমতা করে জিগাই, “কাহা ও কাহা, কী হইছে? কানতেছে কে ডা গো?”
দেহি কিছুক্ষণ পর ভিতরথন পরান কাহা ধুতি পইরা হাড্ডিসার খালি গায়ে বাইর হয়া আহে, উদ্ভ্রান্ত তার চাহনি, হাঁপাইতে হাঁপাইতে কয় “তোর কাকীর গর্ভের ব্যাথা উঠছে, ছাওয়াল হইব রে গ্যাঁদা।”
“কও কী কাহা, এই বয়েসে আবারও?”
“হ রে ব্যাটা, চমকাস ক্যান? গাছ থাকলি পর ফল ধরতিই পারে। শোন, কান্দনির মায়েরে বইলে রাখছিলাম আইতে, তর কাকিরে খালাস করাইতে। কাল বৈকালে সাপের কামড়ে নাকি অর ছোট ভাইটা মরছে তালাতগাড়ি, তারে তো এখন আর পাব না। এদিকে বাড়িত তেল-পত্তরও নাই, বাত্তি জ্বালাইতে পারতেছি না, তর কাকীরে দফা করব কেমনে? ক তো, এত রাইতে কনে কেরোসিন পাই? একে তো তোর কাকীর বুইড়া বয়স, ওদিকে সাঁঝের বাওয়ে জল ভাঙছে, ছাওয়ালও বাইর হয় হয় অবস্থা, এহন বাতি ছাড়া কেমনে কী করব, দিশা পাইতেছি না রে বাপ!”
মনে মনে ভাবলাম, হাতে মোমবাতি থাকলি কী হবে, দেশলাই তো ভয়ে গোডাউনেই ফালায়ে আসছি…
“বাড়িতে আগুন আছে কাহা, তাইলে মোম দিতে পারতাম একখান।”
“মোম? এত রাইতে মোম নিয়া তুই কই যাইতেছিলি?”
আমি নিজের লগে নিজে গুজরানি দেই, কাহার ব্যাটা কাহা, তর বেটির লগে তো আমার বিয়া দিছিলি না! দিছিলি তিন যৌবন গিয়া চার যৌবনে পড়া মকরধ্বজ পানের ব্যাপারি কেশবচন্দ্রের লগে! ক্যান আমার লগে দিলা না, স্বজাতি নই বইলা, কামাই কম বইলা? সুলেখার ভরণপোষণ দিতি পারতাম না? ওরে আমি জীবন দিয়া আগলায়া রাখতে পারতাম না? ভালোবাসায় কোন ছ্যাঁচড়ামি ছিল আমার? তাইলে বিয়া দিলা না ক্যান, ব্যাটা? ও, ছোটবেলায় তুমি যহন নৌকাভর্তি পাট নিয়া মোকামে মোকামে যাইতা বাণিজ্য করতি, ফাঁক বুইঝা জহির কাহার চিঠি আমি হ্যাফপ্যান্টের পকেটে লুকায়া আইনা তোমার বউরে মাঝেমধ্যি দিতাম বলে? জহির কাহা খাসির মাংস দিয়া কবুতরের মাংস দিয়া গঞ্জের হোটেলে নিয়া গিয়া ভাত খাওয়াইতো আমারে আর ঘুড্ডি-মার্বেল কিইন্না দিত, আমি কত ছোট ছিলাম তখন, বলো? এসবের কী বুঝতাম? আর তুমি কী করলা? তোমাদের তেরছা পিরিতের গল্পে বাঁকি দুইজনরে ফাল দিতি না পাইরা আমারে শহীদ বানায়ে দিলা? জহির কাহার চিঠি নিয়া একদিন হাতেনাতে ধরা পইড়া কী মাইরডাই না খাইছিলাম তোমার হাতে! আরে বাল, চিডি কী আমি লিখছিলাম? জহির কাহারে কিছু কইতে পারছিলা না? ও, হেয় তোমার বন্ধু দেইখা, ব্যবসার পার্টনার দেইখা? হের পর পাটের আবাদ এ অঞ্চলে আস্তে আস্তে একেবারে কইম্যা গেল, আগের মতন ব্যবসাও আর নাই, প্রায় সবাই পাটের ব্যবসা বদলায়া অন্য রাস্তা ধরছে। কাহা প্রথম প্রথম চটের বস্তা আর সুতলির ব্যবসা করল, চালগুদামেও সাপ্লাই দিতেছিল, পরে গুদামও বন্ধ হয়ে যায়, অন্য পাবলিকেরাও পেলাস্টিকের বস্তা পেলাস্টিকের সুতার দিকে ঝুঁইকা পড়ে, দামও কম টেকসইও বেশি। কাহা আর নিজেরে বদলাইতে পারল না, বয়সও বাড়ছে, ফলে এহেন দুর্দশাবাস।
“বাত্তি নিয়া কই যাই, হেইডা তোমার এ্যাহন না জানলিও চলবে, আগে আগুন দাও, মোম জ্বালাই। ভিতরে নিয়া গিয়া কাকীরে খালাস কর দেহি!”
বিড়ির আগুনে কোনরকমে মোম জ্বালায়া দিগ্বিদিক কাহা ভিতরে যায়, ফজর অক্তর আগে আগে কাকী চিক্কুর দিয়া গর্ভ প্রসব করলি পর ছলছল নয়নে কাহা বাইরে আইসা বলে, “পোলা হইছেরে গ্যাঁদা, তিন মাইয়ার পর পোলা হইছে। এই বুইড়া বয়সে যে পোলার মুখ দেখতি পারব, ভাবি নাই!”
“শোন্, আমি ঠিক করছি, ওর নাম তর নামের সাথে মিলাইয়া ‘লালন’ রাখব গ্যাঁদা।”
হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলতে থাকে “ক, তুই না আসলি পর আজ তর কাকীর আর তর এই ভাইডার তো দফারফা হইয়া যাইত, ব্যাটা। তুই জান দিছস ওদের, বুঝলি?”
অজান্তে আমারও চোক্ষে পানি চইলা আসল টপাটপ। কাহার হাত দুখান জড়ায়ে ধইরা বলি, “আগে ভিতরে যাও তো, দ্যাহো, কাকীর কী অবস্থা, কিছু দরকার হয় নাকি।” এই মামলায় প্রসব দুনিয়া থাকি কিয়ৎ অক্ত পর বিদায় নিয়া নদীর ধার দিয়া বাড়িত ফিরতে ফিরতে ভাবতেছি, এ জীবনে না হল কাহার মাইয়ারে বিয়া করা, না পারলাম উজানী গাঙের পাশে বেহুলার স্নানের জায়গা থেকে কষ্টিপাথরের চাঁই ভাইঙ্গা তুইলা ঢাকার ফরেন পার্টির কাছে রাহুল তেল মিল দেবার লাহান দামে বেচবার, ঐহানে যে সত্যি সত্যি এহনো আজদাহা সাপে দাবড়ায়, এদিকে না পারলাম চালের বন্ধ গুদামটাও পোড়াতি, মধ্যি থাকি ছাওয়ালের নাম নাকি রাইখব আমার নামে! কও দেহি, মাইনষে শুনলি পরে কী কবে? সুলেখার হাবড়া সোয়ামি কী ভাববে?
শালার কেন্ যে আগাম টাকা নিতে গেছিলাম গুদাম পোড়ানোর জন্য? সে টাকাও তো তিন তাসের জুয়ায় ফতুর করছি দুইদিনে। অহন টাকা ফেরত দিবাম কই থিকা?
শালার আগুন তো লাগাতি পারলামই না, মধ্যি থিকা কাহার মাইয়া সুলেখার কথা এদ্দিন বাদে মনে পইড়া কইলজার মধ্যে নতুন সিলসিলায় তুফান ধইরা গেল গো! আহা রে গাঙের পানি, গুদামে আগুন লাগলি দেখলি পরে ঠিকই কেউ না কেউ দৌড়ায়া নিভাইতে আইত, কিন্তু এই সক্কাল সক্কাল তোর জোয়ারে গোসল দিলেও আমার কইলজার শ্মশান যে নিভবো না রে ব্যাটা! আমি কই ডুইবা মরি অহন, কও সুলেখা?

অমিত রেজা চৌধুরী কবি ও গদ্যকার। জন্ম সত্তরের দশকে, বসবাস বগুড়ায়। লেখালেখির শুরু নব্বইয়ে। অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ক’বছর চাকরি করেছেন। মূলত লিটল ম্যাগাজিনের মানুষ। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও সমালোচনা লেখেন। সংগীত, ভ্রমণ, পুরনো বইপত্র, ফিল্ম ও নিঃসঙ্গতা তার প্যাশন।